মায়ার মাহমুদ

মায়ার মাহমুদ

আজ আমার আর মায়ার ৩য় বিবাহবার্ষিকী। বিবাহ বার্ষিকীর গিফট হিসেবে আমার সাইন কৃত ডিভোর্স পেপার মুড়িয়ে ওর হাতে দিলাম। খুলে দেখতেই হতভম্ব হয়ে ওখানেই বসে পড়ল মায়া। কোন কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না, মনে হচ্ছে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।

আগের থেকে চেনাপরিচয় থাকলেও আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়। ওর পুরো নাম জান্নাতুল ফেরদৌস মায়া। নামের মত চেহারায়ও অস্বাভাবিক মায়া। ঢাকা টু চট্টগ্রাম বাস স্টোপেজে প্রথমবার বোরখায় আবৃত ওকে দেখে অসম্ভব ভালো লেগেছিল, কিন্তু সচারাচর ভেবে এড়িয়ে গেছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয়বার ফুফাতো ভাইয়ের বিয়ের ইভেন্টে দেখে আর এড়াতে পারলাম না।

বোরখায় আবৃত থাকায় এবারো মুখ দেখার সুযোগ হল না তবে না দেখেই ওর প্রেমে পড়ে গেছিলাম। অনেকবার কথা বলার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হলাম, কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, হাল ছাড়লাম না। বিদায়বেলা আমাকে দেখিয়ে টেবিলে একটা কার্ড রেখে গেল। কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখি কোন একটা বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভিজিটিং কার্ড, বুঝলাম না কেন দিলো…?? ছয় পাচ না ভেবে মানিব্যাগে রেখে দিলাম। রিকশার ভাড়া মিটাতে টাকা বের করতে গিয়ে দেখি কার্ডের অপর পাশে কিছু একটা লেখা আর সাথে একটা নাম্বার। ফোন দিলাম। রিং হচ্ছে….

— আসসালামু আলাইকুম…
— ওওওয়ালাইকুম আআসসালাম (আজব তো, আমি তুতলাচ্ছি কেন?? মনে মনে ভাবলাম।)
— এই যে মিস্টার! আপনি আমাকে পছন্দ করেন তাই না??
— আপনি আমাকে চিনেন?? জানেন আমি কে..??
— হুম চিনি, আপনি আমকে বাস স্টোপেজে দেখে বলদের মত আমার দিকে তাকায় ছিলেন, আর বিয়ের ইভেন্টে গাধার মত কথা বলার জন্য চেষ্টা চালিয়েছিলেন।

— কি ডেঞ্জারাস মেয়ে রে বাবা!!(নিম্ন স্বরে বললাম)
— এই কি, কি বললেন আপনি??
— কই কিছু না তো!
— একদম পাকনামো করবেন না বলে দিলাম, না হয় উদম কেলাবো।
— এত দেখছি আস্ত গুন্ডীর পাল্লায় পড়ছি আমি, তাড়াতাড়ি কেটে পড় মাহমুদ নাইলে তোর কপালে শনি আছে।
— ওই একদম ধরে পিটাবো, যদি কখনো ভাগার চিন্তাও মাথায় আনেন। আর হুম আপনার নামটা কিন্তু অনেক সুইট। আরেকটা কথা এই যে শনি টনি এসব বলবেন না এটা বলা ঠিক না।।

— জ্বী মহারানী।
— আল্লাহ কত গুলো কথা বলে ফেলছি আমি, ছিঃছিঃ মায়া তুই এত খারাপ কবে হলি…???(নিজেকে নিজে তিরস্কার করত বলল মায়া)

— এহহ এতে খারাপের কি আছে…?? আমি তো আপনার হবু স্বামী সো নো প্রব্লেম।
— হুহ, হইছে…!! আগে আপনি আপনার পরিবার নিয়ে আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন তারপর হবেন হবু,তার আগে নাহ। ইসলাম এটাকে বৈধতা দেয় না সো আজকেই প্রথম কথা বলা আজকেই শেষ।

— হ্যা ঠিক বলছেন, তাহলে এড্রেস দিন বাসার।
— সেদিন যে ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলাম সেটা আমার আব্বুর আর অপর পাশে যে এড্রেসটা দিয়েছি সেটা আমাদের বাসার।
— ওকে….

সালাম দিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। গ্রাজুয়েট শেষ করে সবেমাত্র নতুন একটা জবে জয়েন করেছি। বাবা মারা যাওয়ার পর মা আমি আর ছোট ভাই মিলেই আমাদের পরিবার। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বোন জামাই বাহিরে থাকে বিধায় মা বেশিরভাগ সময় সেখানেই থাকেন। তাই তো আমার জন্য মিষ্টি একটা বউ খুজছেন মা। মাকে বিকালে ফোন ফিয়ে বললাম মায়ার কথা, ওমা দেখি রাতেই বাসায় হাজির। জিজ্ঞেস করলাম রাত করে আসলে যে…??

— হুম কালকে সকালেই মায়াদের বাসায় যেতে হবে তাই।

এত দেখছি আমার চেয়ে মায়েরই বেশি তড়া, ভাবলাম আমি। উভয় পরিবার সম্মতি জানালো, বিয়েটাও ভালো ভালাই হয়ে গেল। বাসর রাতে দুজন গল্প করে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। মায়ার স্বযত্ন ও ভালোবাসায় আমাদের সংসারটা সুখে ভরপুর হয়ে যায়। কখনো দুজন দুজনকে ছাড়া একা কোথাও কেউ থাকি নি।যখন ও বাবার বাসায় যেত তখন সকালে গেলে বিকেলেই ফোন দিত যেতে, না যেতে চাইলে জিদ ধরে বসে থাকতো। কি আর করা?? বাধ্য ছেলের মত গিয়ে রাগ ভাঙ্গাতে হত। আমাদের দুজনের মাঝে কখনো কথা কাটাকাটি বা ঝগড়াঝাটি হইছে এমন কথা মনে পড়ে না। যখন ও কোন ব্যাপারে রাগ বা অভিমান করে কথা বলত তখন আমি চুপ থাকতাম এবং পরে রাগ-অভিমান ভাঙ্গাতাম, সেম কাজ মায়াও আমার বেলায় করত।

হটাৎ আমার একটা অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে যেতে হয় ২ দিনের জন্য। আমি বাসা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ও অনেক কান্না করে, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। ঐ ২টা দিন আমার কাছে সবচেয়ে বিশের মত লেগেছিল মায়াকে ছাড়া। ওকে বলেছিলাম আমি সব সময় তো কথা বলতে পারবো না তাই যখন তখন ফোন দিও না আমি ফ্রী হলেই কল দিব। কিন্তু ও থাকতে পারত না, মূহুর্তে মূহুর্তে কল, মেসেজ দিত। বাসায় ফিরে অনেক্ষণ ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিলাম, সেদিন আমার থেকে ও প্রমিস করিয়েছিল যেন আমি কখনো ওকে রেখে কোথাও না যাই। যদি যেতে হয় তাহলে যেন ওকেও নিয়ে যাই।

এই তিনটা বছর আমার জীবনের সবচেয়ে সুখময় বছর বলা যেতে পারে, কারণ আমাদের সংসারে কখনো অশান্তি ছিল না। তবে আমরা এখনো কোন সন্তানের মুখ দেখতে পারি নি। প্রথম ২ বছর কোন গুরুত্ব দেই নি কিন্তু এক বছর ধরে দুজনই খুব চিন্তিত, অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে। আমাদের দুজকেই চেকাপ করে বলত কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে কোন সমস্যা নেই। শেষমেশ আমার বন্ধুর বাবা একজন নামকরা ডাক্তার, তার কাছে গেলে দুজনকে চেকাপ করে এবং পরে রিপোর্ট দিবে বলে।

আজই আমাদের বিবাহবার্ষিকী।অফিস থেকে ফেরার পথে এক তোড়া গোলাপ আর ওর পছন্দের অনেক গুলো কাচের চুরি নিলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই বন্ধুর কল আসলো, এক্ষনি যেতে বলল। দ্রুত বাইকে চেপে বসলাম। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌছে গেলাম ওর বাবার চেম্বারে। আমি ঢুকতেই বন্ধুকে বাহিরে যেতে ইশারা করলেন তিনি। আমাকে অনেক কিছু বুঝালেন আর ২ টা রিপোর্ট সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, যে মায়া কোনদিন মা হতে পারবে না। তখন কি বলব বা কি করবো কিছুই মাথায় ঢুকছিল না, চেম্বার থেকে বের হয়ে সোজা উকিলের কাছে চলে গেলাম। ডিভোর্স পেপার নিয়ে সরাসরি বাসায় অনেক কান্না করছে মেয়েটা। চোখ লাল হয়ে গেছে কান্না জড়িত করুন কণ্ঠে জানতে চাইল….

— হটাৎ ডিভোর্স কেন জানতে পারি…?? ওর সামনে ওর রিপোর্টটা এগিয়ে দিয়ে বললাম…
— নিজের চোখেই দেখো। রিপোর্ট দেখতে দেখতে বলল…

— আমি কখনো মা হতে পারবো না বলে আমাকে ডিভোর্স দিচ্ছেন…?? এই আপনার ভালোবাসা…?? আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলুন। প্লিজ আমাকে ছেড়ে…..

ওর কথা শেষ হবার আগেই আমি সেখান থেকে উঠে চলে গেলাম, আমি জানতাম যদি ওখানে কিছুক্ষণ থাকতাম তাহলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারতাম না। অবশেষে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেল, কোন পরিবারই কোন আপত্তি করলো না। ডিভোর্সের তিন মাস পর কল দিলাম, সাথে সাথে রিসিভ হল। মনে হল যেন আমার কলেরই অপেক্ষায় ছিল মায়া। রিসিভ করে বলল….

— কেমন আছো তুমি…?? তোমার শরীর ঠিক আছে তো..?? ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করো তো…??
— আমি সালাম দিলাম এবং ওর সব প্রশ্নের উত্তরে আলহামদুলিল্লাহ বললাম। (এই মেয়েটার কখনো একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করার অভ্যাসটা পরিবর্তন হবে না, ভাবলাম আমি)
—(ফুফিয়ে ফুফিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসল)
— এই একটা বার আমাকে দেখতে আসবে…?? অনেকদিন তোমায় দেখি না, খুব দেখতে ইচ্ছা করছে..!!(বললাম আমি)
— অনশ্যই, কোথায়..?? কখন বলো…??
— কাল দুপুরে নীল শাড়ি আর নীল চুরি পড়বে আর বোরখায় আবৃত হয়ে রেডি থাকবে। আমি তোমাকে নিতে আসবো।
— ওকে…
— আচ্ছা এখন রাখি বলে সালাম দিয়ে ও কিছু বলার আগেই রেখে দিলাম।

পরেরদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে শেষ প্রহর গুনছি। আমার পাশে আমার মা আর ছোট ভাই। অক্সিজেন মাস্ক খুলে ছোট ভাইকে আমার কাছে আসতে ইশারা করলাম, এরপর বললাম আমার যখন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে তখন তোর ভাবিকে ফোন দিস আর একটা চিটি আমার বালিশের নিচে আছে ওটা ওর হাতে দিস। ছোট ভাইয়ের কান্নার আওয়াজ বেড়ে গেল, প্লিজ ভাইয়া এসব রাখো বলে মাস্কটা আবার লাগিয়ে দিল। মা কাঁদতে কাঁদতে ঢেকসি উঠিয়ে ফেলছে। মায়ের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। কোন কথা বলতে পারছে না মা। যোহরের আজান কানে ভেসে আসলো। নামাজ পড়ার তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্যেও পড়তে পারলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার হাত পা সহ সকল কিছু ঠান্ডা হয়ে আসছে, খুব পানির পিপাসা লাগছে কিন্তু কাউকে বলতে পারছি না। হটাৎ আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। মায়াকে জানানো হল। কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে আমার পাশে এসে বসলো, আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ছোট ভাই চিঠিটা মায়ার হাতে দিল।

খুলে পড়তে লাগল প্রিয় আমার মায়া তুমি যখন আসছো তখন হয়তো আনার নিথর দেহটা হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে। জানো প্রিয়তমা…!! যে দুদিন অফিসের কাজের কথা বলে বাহিরে গেছিলাম সেই দুদিন আমার চেকাপ চলছিল, চেকাপ শেষে জানতে পারি আমার ব্লাড ক্যান্সার। তখন তোমাকে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু যখন রিপোর্ট আসলো তখন ডাক্তার বলেছিল আমার সমস্যার কারণে আমরা নিঃসন্তান। তোমার রিপোর্টটা আমার রিপোর্টের সাথে পরিবর্তন করে দিলাম যাতে তোমাকে ডিভোর্স দেওয়ায় কোন বাধা না থাকে। তুমি হয়তো ভাবছো আমি এগুলো কেন করলাম তাই না…??

আমি বুঝতে পেরেছিলাম হটাৎ করে তোমার আমার বাবা না হওয়া ও আমার ক্যন্সারের দুঃসংবাদের কষ্ট সহ্য হবে না, আর তাছাড়া আমি বিহীন তুমি থাকতে পারবে না তাই তোমাকে দূরে রেখে একা থাকতে শিখালাম। ডিভোর্সের পর আমার শূন্যতা অনুভব করবে কিন্তু আমার আশায় তুমি একা থাকতে শিখে যাবে। নাহ….. আর কিছু লিখতে পারছি না…. খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো কিন্তু তোমার কষ্ট দেখলে আমার সহ্য হত না, যে কটা দিন বেঁচে থাকতাম নিজেকে অপরাধী মনে হত তাই এত কিছু করেছি….! ক্ষমা করে দিও আমায় প্রিয়তমা।

ইতি
মায়ার মাহমুদ
চিঠিটা শেষ করে আর ঠিক থাকতে পারল না, কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে মাহমুদের পাশে বেহুশ হয়ে গেল।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত