সেইদিন প্রথম রাতের শেষাংশে মুখে গরম ভাব উপলব্ধি করতে খানিকটা ভয় পেয়ে চোখ মেলে দেখি সে আমার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে। খুবই কাছে, এতোটাই কাছে যে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ গুলো ও আমার গুনা সম্ভব ছিল। সেইদিন মনেমনে বলেছিলাম, পালিয়ে বিয়ে করলেও আমার ভালোবাসা স্বার্থক। তার নাম মায়া। এই মেয়েটার ভালোবাসা প্রতিটা মুহূর্তে আমি উপলব্ধি করতে পারতাম। পালিয়ে আসার সময় দুজনের কাছে যা টাকাপয়সা ছিল সেগুলো শেষ হবার আগেই আমি আমার কাজে ব্যবস্থা করে নেই। ইটের ভাটার কাজ। কাজটা কষ্টের হলেও দুজন কোনোরকমে সংসার চালাতে পারবো ভেবে মনে শান্তি আসে।
” মধ্যদিনে কাজের বিরতিতে ঘরে এসে ভাত খেতে বসলে সে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করবে আর আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। সে তাকিয়ে আছে চোখে পড়লে তাকেও নিজ হাতে খাইয়ে দিব। সারাদিন পরিশ্রম করে ঘরে ফিরলে সে তার আঁচল দিয়ে আমার মুখের ঘাম মুছে দিবে। ” -কঠিন কাজ মিললেও এরকম কিছু কল্পনায় এনে প্রথম থেকেই নিজেকে রোমান্টিকতায় ডুবিয়ে রাখতাম। সে আমাকে আমার কল্পনার মত ভালোবাসতো। দুপুরে খাওয়ার সময় হাতপাখা দিয়ে বাতাস করত, দিনশেষে ঘরে ফিরলে মুখের ঘাম মুছে দিত। কিন্তু সব সুখ তো আর কপালে জুটে না। বিয়ের প্রথম রাতেই আমরা ইচ্ছা করেছিলাম, দুজনের পরিবার আমাদের মেনে নিলে তবেই বাচ্চা নিব।
ছয়মাস গেল। কারোর পরিবার’ই মেনে নিল না আমাদের। তবে আমাদের মাঝে পরিবর্তন হলো। ভাটায় কাজের চাপ প্রচুর। দুপুরে বাসায় গিয়ে খেতে পারিনা। আমার ঘরের পাশ দিয়েই মটরসাইকেলে চড়ে প্রতি দুপুরে কাজের নমুনা দেখতে আসে কন্ট্রাক্টর রহিম ভাই। বয়সে আমার সমান হলেও উনার ওখানে কাজ করি বিধায় ভাই বলে সম্বোধন করি। সকালে টিফিন এনে ঠাণ্ডা খাবার খেতে হয় বিধায় বউ বলেছিল, “প্রতি দুপুরে রহিম ভাই যাওয়ার পথে আমার খাবার উনার কাছে দিয়ে দিবে। ”
আমি না করিনি। রহিম ভাই খুব মিশুক, ভালো ব্যবহার করেন সবসময়। এভাবে কেটে যায় আরো কয়েকমাস। পরিবার আমাদের মেনে নিল না, কারণ আছে অবশ্য। পারিবারিক দ্বন্দ্ব। এটাই মেনে না নেয়ার অন্যতম কারণ। অতিবাহিত হয় আট কিংবা নয় মাস। আমাদের দুজনের মধ্যেই পরিবর্তন লক্ষ্য করি আমি। সারাদিন কাজে থেকে অনকটা কালোছাপ পড়েছে আমার চেহারায়। মায়া ও আর আমার জন্য সাজে না এখন। আগে প্রতিটা সময় ভালো ভালো সাঁজে আমার সামনে থাকার চেষ্টা করত, এখন আর তেমনটা হয়না। আমিও তেমন কিছু ভাবিনা আর। বয়স বাড়ছে পরিবর্তন হবে অবশ্যই।
একদিন সকালে কাজে বের হবার পূর্বে আয়নার সামনে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলাম। আমি তো কাজে চলে যাই, তা সে এখন কার জন্য সাজছে! কাজের পথে এগুচ্ছি আর নিজেকে বুঝাচ্ছি, প্রথম থেকেই মায়া আমাকে আমার থেকে বেশী ভালোবেসে আসছে। কোনো ক্ষেত্রেই তার ভালোবাসার কমতি আমার চোখে পড়েনি। ভালোবাসার বিষ ঢুকাবে না অবশ্য। সারাদিন কাজে থাকলেও মন সবসময় বউটার মাঝেই পড়ে থাকে আমার। দুপুরে রহিম ভাই অন্য ব্যস্ততার কারণে কর্ম পর্যবেক্ষণে আসেনি। উনি আসেনি আমার খাবার ও আসেনি। তাই পাশবর্তী দোকান থেকে কলা আর বিস্কিট’সহ দুই গ্লাস পানি দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম।
রাতে বাসায় ফিরে দেখলাম মায়া আজ শাড়ি পড়েছে। খুব সুন্দর লাগছে আজ। তাহলে অনেকদিন পর আমার জন্য সাজলো! পরক্ষণেই শাড়ী লক্ষ্য করে দেখলাম, অত দামী শাড়ী আমি কখনো কিনে দেইনি আমি। তাহলে এই শাড়ী মায়া কোথায় পেল! তাহলে কি অন্য কেউ দিয়েছে? একপ্রকার রাগ চড়ে বসে আমার মাথায়। মায়ার দুইগালে হাতচেপে কাছে টেনে বললাম, ” এই শাড়ী তোমায় কে দিয়েছে? ” শাড়ী নিয়ে প্রশ্ন করতেই সে রাগী স্বরে বলে উঠে, ” নিজে তো কখনো এতো দামী শাড়ী কিনে দাওনি, আর কেউ দামী শাড়ী উপহার দিলে তোমার এতো জ্বলে কেন?” কিছু না বলে রাগে গজগজ করতে করতে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম।
” আজ সজীব ভাইয়ের বউকে বাইকে করে রহিম ভাই কোথায় যেন গেল। আল্লায় জানে, কি করে বেড়াচ্ছে এরা দু’জন। ” অন্ধকারে হাটছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম পাশের বাড়ির দুজন কি নিয়ে যেন কথা বলছে। কথার মধ্যে “সজীব” নামটা শুনতে পেয়ে অবাক হলাম। কথাগুলোর মধ্যে উপরের কথাটা শুনতে পেয়ে থমকে গেল আমার পৃথিবী। মায়াকে এতো ভালোবাসার ফল আমি এই পেলাম! কিছু না ভেবে আমি হেটে চলে আসছি তখনই ওদের একজন আমাকে দেখে বলে উঠলো, ” আরে সজীব ভাই! কোথা থেকে আসলেন? ” লক্ষ্য করলাম দুজনের মুখেই হাসি, তাই আমিও একটা মিথ্যে হাসি দিয়ে চলে আসলাম ওখান থেকে। গল্প থেকে বাস্তবে ফিরলাম। সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, হয়তো বাকি গল্পটা শোনার অপেক্ষায়। ” আচ্ছা তোমরা কিভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে এটা বলো তো। ” পাশে বসা তার দিকে তাকিয়ে মনে হলো সে এমনটা প্রশ্ন করছে। “আচ্ছা শোনো তাহলে।” বলে শুরু করলাম অতীতের রোমান্টিক সময়ের বার্তা প্রকাশ।
তুমি আর এই রাস্তায় এসো না, আঁড়চোখে আমার দিকে তাকিও না। তোমার দিকে তাকিয়ে আমাতে আমার নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া’টা খুব কষ্টকর মনে হয়। ” কথাগুলো বলার সময় বুকের ধপধপানি যেন সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার বেগে বেড়ে যাচ্ছিল, তবুও একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ফেললাম। অনেকদিন ধরে কিছু বলবো বলবো করে বলা হয়নি কিছুই, তাই অন্যরকম কথাই বললাম। লক্ষ্য করলাম মায়া তার অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বুকের কাঁপুনি’টা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, ভয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম আমি।
– আপনি এত ভীতু কেন? মায়ার এমন প্রশ্নে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালাম আমি। ” ভীতু হওয়ার করেছি আমি। ” কথাটি বাদে মুখ থেকে আর কিছুই বের হল না।
– কি করেন নি আপনি বলুন তো!
মায়ার প্রশ্নের উপর আরেক প্রশ্ন শুনে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হতে লাগলো। বোকার মত বলে ফেললাম, ” কি করিনি আমি? ” আমার থেকে এরকম উত্তর উত্তরে হেসে দেয় মায়া। মায়ার এই মুচকি হাসিতে বাকা দাঁতটা আমার চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি কোনোমতেই।
– আচ্ছা, কাল থেকে আর এই রাস্তায় আসবো না কেমন?
মায়ার এমন কথায় নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, “না।” এবার মায়া তার চোখ দুটোকে তুলনামূলক বড় করে রেগে যাওয়া ভঙ্গিতে বলল, ” এবার আবার না কেন হুম? ” উত্তরে আমি বললাম, ” বারবার তোমার প্রেমে পড়ে যাই। ”
– এইজন্য এইপথে আসতে বারণ করাটা কারণ?
– না। আসলে তোমার প্রেমে পড়ে যাই, কিন্তু আমাকে না উঠিয়েই তুমি চলে যাও তাই।
– ওহ আচ্ছা! তা এখন কি করতে হবে আমাকে?
– পিছু ফিরে তাকানোর পাশাপাশি কাছে এসে বসতে হবে।
– পিছু ফিরে তাকালে আমাতে কি দেখতে পান?
– মুখের হাসি আর টানা দুটো চোখ।
– আপনি চোখের ভাষা পড়তে জানেন?
– কখনো পড়িনি তো। তাই অক্ষরগুলো ঝাপসা লাগে।
– পড়বেন?
– তুমি আমার চশমা হবে? আমার এমন প্রশ্নে মায়া অবাক হয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আমার দিকে, ” চশমা হব কেন? ”
– তোমার মাধ্যমে চোখের ভাষার ঝাপসা অক্ষর গুলোকে স্পষ্ট দেখতে চাই।
মায়া আর কিছু না বলে “বুদ্ধু” শব্দটা উচ্চারণ করে সেখান থেকে চলে গেল। প্রথমবার ভালোলাগার মানুষটার সাথে কথা বলতে পেরে নিজেকে খুব হাল্কা লাগছে এখন। এরপর থেকে দিনদিন আমাদের কথার পরিমাণ বাড়তে থাকে। আমি নানানভাবে বুঝাতে চেষ্টা করি তাকে খুব ভালোবাসি। বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে হয়তো।
একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় হঠাৎ। মাথায় ভূত চড়ে বসে আজ মায়াকে “ভালোবাসি” কথাটি বলতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। মাঝরাতে তার টিনের চালে ঢিল ছুড়ি। মায়ার বাবা জেগে উঠে। কিছুক্ষণ “কে? কে?” বলে ডাকাডাকি করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ার রুমের পাশে গিয়ে “মায়া” বলে ডাক দেই। মায়াকে জানালা খুলতে দেখে হেসে দেই আমি। ” তাহলে তুমি সেই শয়তান! যে ঢিল ছুড়ে আমার ঘুম ভাঙ্গালো?” এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম, “বেরিয়ে আসো। কথা আছে একটু।” মায়া কিছু না বলে জানালা আটকে বাহিরে আসে। কেন জানি প্রথমদিনের ন্যায় বুকের ধপধপানি’টা ক্রমশ বেড়েই চলছে। রীতিমত ঘাম ঝড়ছে পড়ছে কপাল বেয়ে। মায়া আমার এমনাবস্থা হেসে-হেসে দেখে বললো, ” কিছু বলবে তুমি?”
আমি আর কিছু না ভেবে আসার পথে গাছ থেকে নেয়া রক্তজবা ফুলটা সামনে বাড়িয়ে হাটুগেড়ে বসে বললাম, ” বাড়িয়ে দিলাম রক্তজবা, তুমি কি আমার বউ হবা? তোমায় ভেবে অজান্তে হাসি, সত্যি তোমায় খুব ভালোবাসি। ” এবার মায়ার দিকে তাকালাম। সে মিটিমিটি হাসছে। সে রক্তজবা আমার হাত থেকে নিয়ে বললো, “বুদ্ধু একটা! কবিতাও ঠিকমতো বলতে পারেনা। তবে হ্যাঁ, আমিও তোমায় সেই কবে থেকে ভালোবাসি। ” আমি আর কিছু না ভেবে তার হাতদুটো ধরে বললাম, “পাশে থেকো সারাজীবন, দেখো আমার থেকে ভালো কেউ বাসবে না তোমায়। ” অন্ধকারে অশ্লীলতা আনতে চাইনা, তাই আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসলাম সেখান থেকে। পিছুফিরে লক্ষ্য করলাম, আমার মতো মায়া ও তার ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছে আমার দিকে।
সেদিন থেকে শুরু হয় আরেক ধাপ। খুব ভালোবাসি দুজন দুজনকে। কেটে যায় দুটো বছর। কথায় আছে, “বেশী সুখ কপালে সহে না। ” তেমনটা আমাদের ও হলো। মায়ার বিয়ে ঠিক করেছে তার পরিবার। আমার পরিবারে মায়ার কথা বলতেই বাবার সেকি রাগ! কারণ, মায়ার বাবার সাথে আমার বাবার সাথে অনেক আগে থেকেই শত্রুতা। তাই আমাদের সম্পর্ক মেনে নেয়া উনাদের পক্ষে সহজলভ্য নয়। উপায়ান্তর না পেয়ে পালিয়ে যাই দুজন। বিয়ে করে ফেলি। দূরে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করি। কর্মের ব্যবস্থা করি, সংসার করি অনেকদিন। তবুও কথায় আছে যে! “বেশী সুখ কপালে সহে না।” জীবনে তৃতীয় ব্যক্তির আগমণ। পাশ ফিরে বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম, সে আমার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে। তার প্রশ্ন হয়তো, “পরে কি হয়েছিল মায়ার?”
আমিও বলতে লাগলাম পরদিন সকালে আমি কাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম ঠিকি কিন্তু কাজে আর যাইনি। ঠিক দুপুরে বাসায় ফিরে দেখি রহিম ভাইয়ের সাথে মায়ার রোমান্টিকতা। এসব দেখে চলে আসছিলাম তখন মায়ার ডাক, “সজীব শোনো!” আমি পিঁছুফিরে তাকালাম। মায়া বলতে লাগলো, ” এভাবে একটা সংসার যায়না। তোমার সাথে আর আমি চলতে পারছি না। রহিম আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। আমি তাকে নিয়ে নতুন করে সংসার করতে চাই। ” আমি সোজা রহিম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, “রহিম ভাই! আপনি কি মায়াকে বিয়ে করবেন? ” রহিম ভাই মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” সম্মতি জানায়। আমি আর কিছু না বলে চলে আসতে লাগলাম সেখন থেকে। মায়ার দিকে তাকিয়ে আর মায়া বাড়াতে চাইনা।
পাশে থাকা বিড়ালটার দিকে আবারো লক্ষ্য করলাম। এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই বললাম, “আরে! আমার গল্প শেষ তো। এবার আসতে পারো।” তখনো বিড়ালটা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। পাশ দিয়ে দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা হেটে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে মেয়েটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “দেখো আসিফ, পাগলটা নিজেনিজে কথা বলছে।” আমি ওদের উদ্দেশ্য করে বললাম, “সাবধান! আগে সফল জীবন গড়ে নাও। নয়তো অভাব যখন দরজায় করাঘাত করবে, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালাবে। সফল জীবন গড়ো, দরজা আটকানো থাকলে দরজা ভেঙ্গে হলেও ভালবাসা আসবে।