বিষন্ন বিকেল

বিষন্ন বিকেল

রাত কয়টা বাজে এখন?
“কুটুর মুটুর” শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার!
বিছানা হাতড়ে মোবাইলটা হাতে নিলাম।
তিনটা বত্রিশ মিনিট;
উঠে বসলাম।
“কুটুরমুটুর” শব্দটা আমার রুম হতেই আসছে। কিন্ত শব্দটা কিসের তা বুঝে উঠার আগেই কেউ একজন কথা বলে উঠলো-
.
—- ভাইজান,কাল থেইকা চিনি ছাড়া তক্তা বিস্কুট কিনবেন। (লোকটা)
—- শামীম সাহেব নাকি? (আমি)
—- জ্বী ভাইজান,
খিদা পাইছিলো বেবাক,আমার রুম খালি।
কিচ্ছু নাই!
—- তোষক আর কোলবালিশও কি খেয়ে ফেলেছেন?
—- হে হে হে,এঞ্জিনিয়ার সাব যে কি বলেন!
—- যাই হোক,কয়টা খেলেন টোস্ট?
—- সাড়ে সাতটা!
—- ওহ্,কেমন লাগলো?
—- খিদা পেটে তো কচুরিপানাও টেস্টি লাগে ভাইজান, তয় কাল থেইকা চিনি ছাড়া তক্তা বিস্কুট কিনবেন।
—- শামীম সাহেব,
—- জ্বী ভাইজান।
—- ওটা তক্তা বিস্কুট না,টোস্ট বিস্কুট।
—- ওই একই কথা ভাইজান।
—- তাই নাকি?
—- জ্বী ভাইজান,তয় আইজকা গেলাম; ঘুমাইয়া পড়েন।
—- বিস্কুটের বক্সটা নিয়ে যান।
—- সত্যি কইতাছেন ভাইজান?
—- জ্বী
—- আইচ্ছা ভাইজান।
.
শামীম সাহেব বিস্কুটের বক্সটা বগলদাবা করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চলে গেলেন।
একটা থ্যাংকস্ ও দিলেন না।
ক্ষুধার্তদের হয়তো কৃতজ্ঞতাবোধ থাকতে নেই,
কেননা পূর্ণতা ছাড়া কৃতজ্ঞতা আসে নাহ্।
যেদিন তারা পূর্ণতা পাবে,
সেদিন হয়তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।
শামীম সাহেবও হয়তো করবে।
কিন্ত প্রকৃতি পূর্ণতা পছন্দ করে না।
শূণ্যতাই প্রকৃতির ভালো লাগে।
শূণ্যের কোঠার মানুষ পূর্ণতা কি করে পাবে?
তবে চেষ্টা করতেই বা দোষ কি?
দেখি,এ মাসের বেতনটা পেয়ে নেই।
পেট ভরে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবো
শামীম সাহেবকে একদিন।
.
বিছানা ছেড়ে নিচে নামলাম।
গোল্ডলিফের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ছাদে চলে
এলাম।
বেশ মায়াময় রাত;
নেশা লাগানোর মতো!
আকাশে জমাট বাঁধা কালো মেঘ,
যেনো খই ছিটিয়ে আছে আকাশ জুড়ে।
চাঁদটাও বড্ড দুষ্টু হয়ে গেছে আজকাল।
লুকোচুরি খেলতে শিখে গেছে মেঘের
ভেতর।
একদম তাসফিয়ার মতো!
তবে দেখতে একেবারেই খারাপ লাগছে না।
ভালো,লুকোচুরি খেলা ভালো।
.
সিগারেট ধরানো দরকার।
একি!
লাইটার তো আনিনি,আবার রুমে গেলাম।কোথাও লাইটারটা খুঁজে পেলাম না।
শামীম সাহেবেরও সিগারেট খাবার বাতিক আছে,
দেখি,তিনি নিয়েছেন কিনা?
শামীম সাহেবের রুমে ঢুকলাম।
একটা চাপা গোঙানির শব্দ শুনছি!
কাছে গেলাম,
গোঙানি চাপা হলেও তার আড়ালের কথাটা বেশ
স্পষ্ট!
ঘুমের ঘোরেই শামীম সাহেব বলতেছেন,
“বড় খিদা লাগছে রে মা,
চাইড্ডা ভাত দে না মা…..!”
.
আমি দাড়াতে পারিনি আর এক মুহূর্তের জন্যেও।অনেকটা দৌড়েই রুম হতে বেরিয়ে এলাম।
প্রকৃতি এমন কিছু দৃশ্য দেখার অথবা এমন কোনোকথা শোনার ক্ষমতা আমাকে দেয়নি,
যা বুকের ভেতরকার পুরনো আগুনকে আবারউসকে দেয়!
বিশেষ করে ক্ষুধার্তের আঁকুতি আর অসুস্থের
আর্তনাদ!
কখনো সহ্য হয়নি,
হবেও না কখনো।
তার’চে ভালো,
সেসব না শোনা।
তবুও কানের ভেতর শামীম সাহেবের কথাটা
বাজতেছে,
“বড় খিদা লাগছে রে মা,
চাইড্ডা ভাত দে না রে…..!”
শামীম সাহেবের মতো আমিও ক্ষুধার্ত।
আমারও মন বলছে,
“বড় বেশী প্রেম তৃষ্ণা রে তাসফিয়া,
একটু ভালোবাসা দে না রে…..!”
.
চারটা বাজে,
রুমে এসে বসে আছি।
বড় বেশী মনে পড়তেছে তাসফিয়ার কথা!
পাঁচ বৎসর হয়ে গেলো,
কোনো যোগাযোগ নেই।
সে তো ভুলেই আছে আমাকে,
আমি তো পারিনি।
পারবোও না কখনো।
মোবাইলটা হাতে নিলাম,
অডিও প্লেয়ারে ঢুকলাম।
একটা গান প্লে করলাম,
“ভালোবাসার মতো ভালোবাসলে…..
তারে কি গো ভোলা যায়?….. ”
গানটা বাজতেছে,
মন আকাশের দিগন্তে মেঘ জমতে শুরু
করেছে।
চোখটা আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে এলো।
ফিরে যেতে মন চাচ্ছে পাঁচ বৎসর আগেকার
অতীতে।
সেই অতীত আমার,
যা এখন শুধুই বর্তমান আর ভবিষ্যতের জলসিক্ত স্মৃতি!
.
পাচ বৎসর আগে-
.
কোনো এক বিকেলে কথা হয়েছিলো আমার
আর তাসফিয়ার।
.
—- আচ্ছা,তুমি এমন কেনো? (তাসফিয়া)
—- কেমন?
—- নির্লিপ্ত।
—- এ আর নতুন কি?
—- বদলানো যায় না?
—- আমি তো পঞ্জিকা না রে!
—- একটু সিরিয়াস হও।
—- হুম!
—- কি হুম?
—- কিছুনা।
—- কাকে বুঝাই আমি?
—- সেমিস্টার ফাইনাল কবে?
—- কথা ঘুরাচ্ছো কেনো?
—- বলছি সেমিস্টার ফাইনাল কবে?
—- সামনেই।
—- প্রিপারেশন কেমন?
—- ভালোই!
—- ফাইনাল শেষেই তো বিয়ে করে নেবে!
—- থামবে তুমি?
—- চলো,ফুচকা খাই।
—- না,বাসায় যাবো।
—- এগিয়ে দেবো?
—- না থাক,আমি রিক্সা নিয়ে নেবো।
—- ওকে,যাও।
—- বেশীক্ষন বসে থেকো না,
চলে যেও বাসায়।
—- আচ্ছা,বাই।
—- বাই।
.
আমার আর তাসফিয়ার সম্পর্ক প্রায় দেড় বৎসর।
এই দেড় বৎসর সে শুধু একটা কথাই বারবার বলে
গেছে,
সিরিয়াস হও!
কিন্ত আমি জানিনা,
কি করলে সিরিয়াস হবো?
এই তো বেশ আছি!
দিব্যি খাচ্ছি,ঘুমাচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি,মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে
উঁকিঝুঁকি মারছি।
অবশ্য ক্যাম্পাসে আমার এলার্জী।
ঘোরতোর শত্রুতা ক্যাম্পাসের সাথে আমার।
মাঝে মাঝে ক্লাসরুমে নিজেকে মনে হয়
ডাইনোসারের চাচাতো ভাই।
কেননা,প্রতিটা টিচার এমন ভাবে তাকায় আমার দিকে,
যেনো মিলিয়ন বৎসর আগের হারানো ডাইনোসার
ক্লাসে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
তবে তাদের তাকানোর যথেষ্ট কারন আছে।
আমি তো নিয়মিত ক্লাস করিনা,
তবে প্রতিটা সেমিস্টারেই ঠিকঠাক উতরে যাই।
যা আমার সহপাঠী হতে টিচারদের কাছেও রহস্য!
অবশ্য সবার কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দু হতে আমার
বেশ ভালোই লাগে।
নিজেকে মনে হয় কোনো এক সাধু!
আর সবার দৃষ্টি আমার দিকে।
বড়বড় চোখে আমাকে যেনো পরখ করছে
তারা।
আমি চোখ বন্ধ করে আছি,
যেনো মনে হয় হয়তো কিছুক্ষন পর কোনো
দৈববাণী বলে দেবো তাদের কাছে!
বেশ চলছে আমার লাইফ।
তাছাড়া তাসফিয়ার সাথে পরিচয়েরও কোনো আহামরি
ব্যাপার নেই।
ফেসবুক রিলেশন, তারপর দেখা সাক্ষাত।
এই তো!
চলছে সবকিছু।
মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে কল্পনায় ডুব দিতে খুব
ভালো লাগে।
সে রাজ্যে শুধুই আমি আর সে।
লুকোচুরি স্বপ্ন আর অধরা বাস্তবতার এক মিশ্র
সংমিশ্রন আমি।
ঠিক পুরোনো দিনের বাত ব্যাথার “মিক্সার”
মেডিসিনের মতো!
.
ভাঙ্গা জানালা গলা, রোদ্দুরে স্বপ্ন ভাঙ্গার খেলা-
এবেলা ওবেলা।
দক্ষিনা বায়ুর তপ্তশাসে সারাদিন, সাত রঙ করে খেলা।
প্রতিটি নিদ্রা ভাঙ্গে
কঠিন চৈত্রের মতো, অতর্কিতে ছাওয়া।
চোখে আমার শিশির ভেজা- ভোরের অপূর্ণ
শীতল চাওয়া।
এখনো কি কোনো খোলা জানালায়- ব্যাকুল
চাহুনিতে,
অস্থির তাসফিয়ার ঠোট কাঁপে আমার অভিমানে?
দুপুর গেলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হলো
বলে,
বিভোর নিংসঙ্গতা তারে আরো একটু কাছে টানে?
.
রাতে মেসের বারান্দায় বসে বসে ডার্বি সিগারেট
টানছি।
কৃষ্ণপক্ষের রাত!
বেশ পছন্দ আমার।
সবাইকে পূর্ণিমারাত নেশা ধরায়,
আর আমাকে নেশার বনে আকুল নৈশজীবে
রূপান্তরিত করতে একটা কৃষ্ণপক্ষ রাতই যথেষ্ট!
আমি সিগারেটের ধূয়ার রিং ছাড়ছি বাতাসে,
দূর আকাশের তারারা সে রিং এর সাক্ষী বনে
গেছে।
হঠাৎ করেই বুকের বামপাশটা কেঁপে উঠলো,
নাহ্,ভয়ের কারন নেই।
আমার ভাঙ্গা টাচ্ ফোনটাতে কল এসেছে।
স্পীকার নষ্ট,তাই ভাইব্রেট করে রেখেছি।
যা ভাবলাম তাই,
তাসফিয়া ফোন করেছে।
অবশ্য সে আর মা ছাড়া আমাকে কেউই ফোন
করে না।
মাঝে মাঝে দু একটা ফোন আসে ভার্সিটি থেকে,
তাও আবার বিল বকেয়া পরিশোধের তাগিদ দেয়
সে কলে ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ।
তাসফিয়ার ফোনটা রিসিভ করলাম।
.
—- হ্যাঁ,বলো।(আমি)
—- কি করো? (তাসফিয়া)
—- বারান্দায়,কৃষ্ণপক্ষ রাত উপভোগ করি।
—- তা করো,তবে সিগারেট সাথে কেনো?
—- কই? না তো!
—- মিথ্যা আমার পছন্দ নাহ্!
—- ছিলো,ফেলে দিয়েছি।
—- গুড,ডিনার?
—- হুম।
—- শোনো,বাবার সাথে কাল মিট করবে?
—- কেনো?
—- বাবা মিট করতে বলেছে।
—- লা ইলাহা ইল্লা আঁনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ
জোয়ালিমীন।
—- দুআ পরে পড়ো,
কাল মিট করো।
—- পারবো না।
—- কেনো?
—- ডর লাগে!
—- চুপ নোয়াখাইল্লা!
—- আমি নোয়াখালীর না।
—- নোয়াখালি বা মহাখালী যাই হও,কাল মিট করবে
বাবার সাথে।
—- দেখি।
—- দেখি না,আর যদি তা না করো,
তবে লা ইলাহা ইল্লা আঁনতা বলার সুযোগ তোমার
হবে না।
লোকে তোমার জন্য ইন্নালিল্লাহ্ পড়বে।
—- আরে মিট করবো,ডর লাগাও ক্যারে?
—- এসব কি ভাষা?
—- হে হে হে,,,,,,
—- হাসতেও পারে না,
উজবুক।
—- হুম।
—- এখন রাখছি,পড়বো।
বাই…….
—- গুড বাই।
.
তাসফিয়াদের বাসায় ঢুকার আগে বুকে কয়েকটা ফুঁ
দিলাম।
কিন্ত সাহস পাচ্ছিনা।
পাবো কি করে?
বাসা থেকে বের হবার সময় তো সবকিছু হাতড়ে
আটাশ টাকা পেয়েছি।
বাবা বলতো,
“বড়লোকের সামনে দাড়াতে হয় বড় নোট
(৫০০/১০০০ টাকা) নিয়ে।
এতে সাহস বাড়ে,
টাকার পাওয়ার এর কাছে সবকিছু তুচ্ছ।”
কিন্ত আমার পকেটে এখন ষোলো টাকা আছে।
বারো টাকা ভাড়া চলে গেছে।
কি করবো বুঝতে পারছিনা,
দারোয়ান আমাকে অনেক্ষন ধরে ফলো
করছে।
দারোয়ান এগিয়ে এলো,
“কি চাই?” বলেই দারোয়ান এমন ভাব দেখালো,
মনে হচ্ছে পুরো ধানমন্ডি এলাকাটাই তার বাবার
নিজস্ব সম্পত্তি!
আমি বললাম, ভেতরে যাবো।
দারোয়ান বললো,
“কার কাছে যাইবেন?”
প্রশ্নটা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম।
তাসফিয়ার বাবার নাম তো জানি না আমি!
কি বলবো?
“ওই মিয়া? মশকরা পাইছেন? সামনে থেইকা যাইবেন
নাকি কুত্তা লাগামু?”
কুকুরের কথা শুনেই ভয়ে আমার আত্মারাম কাঁপাকাঁপি
শুরু করেছে,
দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমি তাসফিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছি”
দারোয়ান বললো,
“খাড়ান,বাসার ভিতরে কল দিয়া নেই,আপনের নাম কি?”
আমি নাম বললাম,
দারোয়ান গেটের কাছ থেকে ফোন করলো।
সে সুযোগে আমি বাড়িটার বাইরের কাঠামো
দেখতে লাগলাম।
আটতলা বিশিষ্ট বাড়ি!
বেশ সুন্দর লাগছে বাড়ির রংটা।
দ্বিতীয় তলার বারান্দার গ্রীলে পুঁই লতা পেঁচিয়ে
আছে।
আরেকপাশে একটা অপরাজিতা গাছ লতিয়ে আছে,
কয়েকটা ফুলও দেখা যাচ্ছে।
বেশ পরিপাটি একটা বাড়ি,
মুখ ফসকে বেরিয়েই গেলো,
“বাহ্,ওরা তো বেশ বড়লোক!”
“ভাইজান,ভেতরে যান।
আপামনি আপনেরে যাইতে কইছে।
এক্কেরে সোজা দোতালায় চলি যাবেন।”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ভেতরে ঢুকে
গেলাম।
.
আমার সামনে যিনি বসে আছেন,
তাকে দেখে মনে হয়না তিনি কথা বলতে পারেন!
ভারী চশমার ফাঁক দিয়ে উনার তীক্ষ্ণ চোখ দেখা
যাচ্ছে।
ও চোখে তাকানোর ক্ষমতা সবার নেই।
চেহারার গাম্ভীর্যতা স্পষ্ট,
দেখেই বোঝা যায় যে,
তিনি তার চেহারায় কথা বলেন।
আমি কল্পনায় দেখতে লাগলাম,
সবুর নামক একজন উনার সামনে দাড়ানো।
সবুর মিয়া খুব করে বকে যাচ্ছেন,
আর উনি শুধু মাথা দোলাচ্ছেন।
কোনো কথা নেই।
একসময় সবুর মিয়ার দিকে তাকিয়ে তিনি একটা কাঁশি
দিলেন,
সবুর মিয়া তেলতেলে টাইপ হাসি দিতে দিতে চলে
গেলেন।
কাঁশি যে মনের ভাব প্রকাশ করে,
তা তো জানতাম নাহ্!
আজিব!
বড়ই আজিব দুনিয়া!
তার ভেতর আমি আরেক আজিব চিড়িয়া!
“তো তুমিই তাহলে সে?”কথাটা বলেই তাসফিয়ার বাবা
আমার দিকে তাকালেন।
.
—- জ্বী স্যার (আমি)
—- স্যার কেনো বলছো? (তাসফিয়ার বাবা)
—- সরি আংকেল,আসলে আপনাকে দেখতে
অনেকটা আমার কলেজে পড়াকালীন সময়কার ম্যাথ
টিচারের মতো লাগছিলো তো,তাই।
—- বাহ্,বেশ সাজানো মিথ্যে।
—- এহেম এহেম….
—- পানি খাবে?
—- না আংকেল,আ’ম ওকে।
—- তো কি করা হয়?
—- এই তো,স্টাডি।
—- কিসে?
—- বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং,
লাস্ট সেমিস্টার।
—- গুড
—- জ্বী
—- বাসায় কে আছে?
—- আমি, মা,আর আমার তিন বোন।
সুফিয়া,মারিয়া…..
—- ওকে,আর বলতে হবে না।
বাবা কি করেন তোমার?
—- বাবা তো নেই।
—- সো স্যাড।
—- নো স্যাড আংকেল।
—- কেনো?
—- কেননা বাবা তো বেঁচে নেই,সব দুঃখ কষ্ট
জীবিতদের।
তাই উনার নামের পর দুঃখিত বলার চেয়ে নামের
আগে মরহুম শব্দটাই মানানসই।
—- যুক্তির কথা!
—- জ্বী
—- সংসার কি করে চলে?
—- চলছে আরকি আংকেল।
—- বলো,কি করে চলছে?
—- শুনবেন?
—- অফকোর্স!
—- ওকে,বলছি তাহলে।
(আমি চোখটা বন্ধ করে ফেললাম,অতীত
অতীত অতীত….
ভাসছে আমার সামনে।
আমি বলা শুরু করলাম।)
.
আমাদের বাড়ি অঁজপাড়াতে,
আমরা নিম্ন মধ্যবিত্তের আওতাভুক্ত।
দিন এনে দিনে খাই টাইপ।
বাবার সামান্য কিছু জমিজমা ছিলো।
চাষাবাদ করেই বেশ ভালোই চলতো।
আমি যখন ক্লাস টেনে উঠি,
তখন বাবা মারা যান।
অনেকটা হুট করেই চলে গেলেন।
জ্বর নিয়ে মাঠে গেছেন,
মাঠেই বাবা বুকের ব্যাথা উঠে মারা যান।
আমরা ভেবেছিলাম এ্যাসিডিটি,
পরে বড় হবার পর বুঝলাম ওটা হার্ট এ্যাটাক ছিলো।
বাবার স্বপ্ন ছিলো,
আমাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন।
সে কারনে লোকের কথা ঠেলেও বাবা আমাকে
সায়েন্সে ভর্তি করিয়েছিলেন।
আমি যে স্কুলে অষ্টম পর্যন্ত পড়েছি,
সে স্কুলে সায়েন্স ছিলো না।
আমার বাড়ি থে সায়েন্স স্কুল ছয় কিলোমিটার দূরে
ছিলো।
আমার বাবা আমাকে প্রতিদিন কাঁধে করে স্কুলে
নিতেন,
কাঁধে করে স্কুল থেকে আনতেন।
জানেন আংকেল?
নবমে আমি ভালো পাশ করে দশম শ্রেনীতে
উঠেছি,
সেদিনআবার বাবার আনন্দে প্রকৃতিও
হেসেছিলো।
আমার মা পিঠা আর শিরনী বিলিয়েছিলো।
কিন্ত আমার বাবার সে আনন্দ স্থায়ী হয় নি।
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাবা মানুষের বাসায় বাসায় পিঠা
আর শিরনী বিলিয়েছে,
তারপর প্রচন্ড জ্বর হলো।
বাকীটা তো বললামই।
.
যাই হোক,বাবার মৃত্যুর পর আমরা চার ভাইবোন পাথর
হয়ে গিয়েছিলাম।
সুফিয়া আর মারিয়া তখন অনেকটা বুঝতো সবকিছু।
আলেয়া কিছুই বুঝতো না,
সে তখন স্কুলেও ভর্তি হয় নি!
সে আমাকে মাঝে মাঝে বললো,
“ভাই গো…….
বা’জান কুনে গো ভাই?
আমার লাল জামা আনছেনি বা’জানে?”
জানেন আংকেল?
আমি তখন আমার বোনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম,
কেননা আমার চোখে তখন জীবন সংগ্রামের
দৃশ্য ভাসতো,
বাবার স্মৃতি সেসবের ভীড়ে ঠাঁই পেতো না।
আমার ছোটো বোনের চোখের দিকে
তাকালে আমি বাবাকে দেখতে পেতাম।
এমনই করে দিন কাটছিলো,
আমি একদিন স্কুলে গেলে দুদিন যেতাম না।
মাঠের কাজ কে করবে?
রাতে মা আর বোনেরা মিলে ধানের চারা রোপন
করতাম,
সেসবের যত্ন নিতাম।
একসময় ধান পাকতো,
আমরা রাতে ধান কেটে বাড়ি আনতাম।
যাতে লোকে আমার মা বোনকে না দেখে।
একদিন রাতে ধান কাটার সময় আমার বোনকে সাপে
কামড় দিয়েছিলো,
আমার বোন প্রলাপ বকতে লাগলো।
“ভাই গো…..
ওই দেহো বা’জানে খাড়ায়া রইছে।
ভাই,ও ভাই…..
দেহো না,বা’জানের হাত খালি।
আমার লাল জামা কুনে বা’জান?
দিবানা? কিন্না দিবানি কও না বা’জান?”
ওঝা ডেকে বোনের শরীর থেকে বিষ
নামালাম।
এভাবেই চলছিলো জীবন।
একসময় কলেজে উঠলাম,
বাড়ি থেকে চলে এলাম।
একটা বাড়িতে জায়গীর রইলাম।
পেটে ভাতে থাকবো।
কিন্ত তারা আমাকে দিয়ে ঘরের কাজও করাতো।
তার ফাঁকে আমি দুটো টিউশন নিলাম।
আমার বোনেরা তখন বড় ক্লাসে উঠতে
থাকলো,
খরচের পাল্লাও বাড়তে থাকলো।
দিন যত যায়,
জীবন ততই কষ্টসাধ্য!
কিন্ত কিছু করার নেই,
বাবা সবসময় বলতো,
“আমার বাচ্চাগোরে আমি বড় শিক্ষিত বানামু”
বাবার সে স্বপ্নের পূর্ণতায় আমি অঙ্গীকারবদ্ধ
ছিলাম।
কলেজ লাইফ শেষ,
ঢাকায় এলাম।
তখন একটা বোন এইচএসি আরেকটা এসএসসি
দেবে।
ঢাকা এসে আর ভর্তি হইনি।
একটা প্লাস্টিক কারখানায় কাজ নিলাম,
আড়াই হাজার টাকা বেতনে।
সে টাকার ভেতর আবার থাকা খাওয়া সামলানো।
বাধ্য হয়ে রাতে রিকশা চালাতে থাকলাম।
সে টাকা বোনদের পড়াশোনা,সংসারের খরচ
জোগান এর মুল উৎস ছিলো।
একসময় দুটো বোনই পরীক্ষায় পাশ করলো।
তারপর আমি একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম।
বড় বোনটাকে ঢাকা ভার্সিটিতে কেমেস্ট্রি তে
পড়াচ্ছি,
মেঝো বোনটাও কুয়েটে পড়ে আর্কিটেকচার
নিয়ে।
আর ছোটো বোন এবার এসএসসি দেবে।
আর আমি নিজে এখন তেমন ক্লাস করিনা,
একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করি।
সপ্তাহে একদিন যাই,
কোনো সপ্তাহে যাই না।
একটা মেসে থাকি ফার্মগেট এ।
এভাবেই চলছে আমার জীবন আর আমাদের সংসার।
বলার মতো এতটুকু ছিলো,বলেছি।
.
কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে গেছি,
পানি খেলাম।
আমি তাকিয়ে আছি তাসফিয়ার বাবার দিকে,
তিনি মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছেন।
আমার উপর দিয়ে কি ঝড় যাবে নাকি?
শুনেছি ঝড়ের আগে নাকি প্রকৃতি শান্ত রূপ ধারন
করে।
আল্লাহ্ জানে, কপালে আজ কি দূর্গতি আছে আমার।
তাসফিয়ার বাবা হঠাৎ করেই আমার দিকে তাকালেন,
তাকিয়েই বলতে লাগলেন-
.
—- বাস্তবতা অনেক কঠিন,
তাই না? (তাসফিয়ার বাবা)
—- জ্বী আংকেল।
—- তবুও তো সব মেনে নিতে হয়,নাকি?
—- জ্বী।
—- তুমি জানো?
আমার তাসফিয়া কখনো জগ থেকে পানি ঢেলেও
খায়নি?
—- এই জানলাম আংকেল।
—- গাড়ি ছাড়া চলেনি কখনো।
—- হতে পারে।
—- অভাব দেখেনি,উপোস করেনি,এসি ছাড়া
থাকেনি।
—- তারপর কি আংকেল?
—- তুমি বুদ্ধিমান ছেলে,বাকীটাও নিশ্চয়ই বলতে
হবে না আর।
—- হুম
—- কি হুম?
—- বুঝেছি আংকেল,
বাট আমি কি তাসফিয়ার সাথে একটু কথা বলতে পারি?
—- অফকোর্স!
—- থ্যাংকস্ আংকেল।
—- ইট’স ওকে।
. আমি তাসফিয়ার রুমে এলাম।
তাসফিয়া জানালার পাশে মাথা রেখে দাড়িয়ে আছে।
আমি তার কাছে গেলাম,
তাসফিয়া একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখলো।
তারপর আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো।
আমি বলতে লাগলাম-
.
—- তুমি কি আংকেলের আর আমার কথাবার্তা
শুনেছো? (আমি)
—- হুম
—- এক গ্লাস পানি হবে?
—- হুম
—- দাও
—- ওয়েট
(তাসফিয়া পানি আনতে গেলো,আনলো,আমি
খেলাম)
—- তাহলে কি আজকের পর আর যোগাযোগ
হবে না আমাদের?
—- কি বলবো বলো?
—- তুমি তো সবই জানতে,
৯৫% এর মতো,আজ বাকী ৫% আমি জানিয়ে দিয়ে
গেলাম।
—- আমার কিছু বলার নেই।
—- সিমটা কি অন থাকবে তোমার?
—- হয়তো থাকবে।
—- আচ্ছা,তাহলে গেলাম।
—- হুম
—- ভালো থেকো
—- তুমিও
—- ট্রাই করবো।
—- হুম
—- তাসফিয়া….
—- গেলাম
—- ওকে
—- বাই
—- বাই
.
বর্তমান
.
সেদিন তাদের বাসা হতে চলে আসার পর আর যাইনি
কখনো।
কষ্টে বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যেতো,
কত রাত কত রাত কেঁদেছিলাম।
যে কারনে আজ চশমা ব্যাবহার করতে হয়।
কত রাত কত রাত সিগারেটের ধুয়ায়
নিজেকে বিষাক্ত করেছিলাম।
হয়তো সে কারনেই আজ হার্টে পেইন হাতে
গোল্ডলিফের প্যাকেট।
আসলে রাতের গল্পগুলো অন্যরকম,
গল্পগুলোর কোনো শব্দ থাকে না!
শুধু কিছু অনুভূতি থাকে।
হয়তো স্মার্ট ফোনের পর্দায় চেয়ে থাকি,
পুরোনো পরিচিত সে নাম্বার বের করে।
কন্ঠ শোনার ইচ্ছে থাকলেও অধিকারটা যে আজ
নেই!
সময়ের মতো করে অধিকারটাও চলে গেছে।
তবুও মাঝে মাঝে ফোন দিতাম,
সে ইচ্ছে হলে পিক করতো।
আমি কোনো কথা বলতাম না,
যদিবা সে আমার কান্না টের পায়?!
আর আমি কাঁদলে তার কষ্ট হবে।
খুব কষ্ট,খু-উ-ব….!
কেননা এটা আমার সেই তাসফিয়া,
একদিন হাত কেটেছিলো আমার আর তাতে সে
ব্লেড দিয়ে নিজের হাতটাই কেটে ফেলেছে।
আমাকে জাগিয়ে রেখেছে সিজোফ্রেনিয়ার
মতো অদ্ভুত ঘোর!
ইঞ্জিনিয়ার হবার পরেও আজও মেসে থাকি আমি।
কেননা,এই গরীবত্ব আমার অহংকার!
আমার গৌরব!!
অফিস হতে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসি,
বিছানায় এলিয়ে দেই নিজেকে।
কিন্ত বেশীর ভাগ রাতই কাটে আমার নির্ঘুম!
যে চোখে ভাসে তাসফিয়া,
যে বুকে থাকে তাসফিয়া,
সে চোখ আর বুকের মালিক আমি।
অথচ তাসফিয়া নেই!
অবাক সেলফিস আমি।
আক্ষেপ নেই,
তোমাকে পাইনি তো কি হয়েছে?
হয়তো আবেগ গুলো চলে গেছে!
কিন্ত এখনো তো সেই চেয়ে থাকার অভ্যাস
রয়ে গেছে।
স্বপ্ন দেখার অভ্যাস রয়ে গেছে!
আর দূর থেকেও তো ভালোবাসা যায়,
তোমাকে তো ভুলেই যাবো হয়তো
কোনো একদিন,
খালি সময়টা হচ্ছে না তোমাকে ভোলার।
সব সময়গুলো আজ তোমার অনিকূলে আমার
প্রতিকূলে!
বড্ড বেশী অসময় রে তাসফিয়া,
বড্ড বেশী অসময়!
.
অফিসে বসে আছি,
হাতে কাজ নেই।
ফ্লিওরা কন্সট্রাকশন এর কাজটা শেষ হয়ে গেলে
জব ছেড়ে দেবো।
নিজেই একটা বিল্ডার্স কন্সট্রাকশন এর ফার্ম
খুলবো।
নাম দেবো, “তাসফিয়া বিল্ডার্স এন্ড কন্সট্রাকশন
গ্রুপ”
কেমন হবে নামটা?
ভালোই হবে হয়তো,
বেশ ভালো।
কয়টা বাজে এখন?
ঘড়ির কাটা চারটা ছুঁই ছুঁই করছে,
মানিব্যাগটা বের করলাম।
হাজার দশেক টাকা পড়ে আছে,
কদিন পরেই বেতন পাবো।
এতো টাকা লাগবে না আমার।
শামীম সাহেবকে একটা কল করি।
শামীম সাহেব কে কল করে রেস্টুরেন্টে
আসতে বললাম।
আজ পেট ভরে খাওয়াবো উনাকে,
তারপর এত্তগুলো টোস্ট বিস্কুট কিনে দেবো।
এক কার্টন বেনসন এন্ড হেজেজ সিগারেটও
কিনে দেয়া যেতে পারে।
নাহ্,গোল্ডলিফ কিনে দেবো।
আমার কাছে না থাকলে উনার ওখান থেকে নিতে
পারবে তখন।
আচ্ছা,গিফট করা জিনিস থেকে কি ভাগ চাওয়া যায়?
জানি না তোহ্!
হুর,সিগারেটই তো।
দু একটা নিলে প্রবলেম হবে না।
.
আমি শামীম সাহেবের খাওয়া দেখছি
রেস্টুরেন্টে বসে বসে।
পৃথিবীতে তিন প্রকৃতির মানুষের চেহারায় পূর্ণ
আনন্দ প্রকাশ পায়।
প্রথমত, তৃপ্তি সহকারে যে ঘুমাতে পারে।
দ্বিতীয়ত,তৃপ্তি সহকারে যে খেতে পারে।
তৃতীয়ত,সংসার জীবনে যে সুখী।
আমি এখন শামীম সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে
আছি।
বেশ গোগ্রাসে খাবার গিলছেন তিনি।
আমি সেদিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
ডান পাশের তিন নম্বর টেবিলটা তে চোখ আটকে
গেলো,
কে গো তুমি?
তাসফিয়া নও তো?
এ যে তাসফিয়া!
সে তাসফিয়া।
পাশে একজন ভদ্রলোক,
বেশ স্মার্ট!
ব্যাংকে জব করে হয়তো,
ভাবসাব তো তেমনই!
কতদিন কতদিন পর তাসফিয়া তুমি,
আমার চোখেরও আঙ্গিনায়!
এতোদিন পর তুমি এলে আজ,
যখন অন্য কেউ তোমার মোহনায়!
বুকের বামপাশটা আবার চিনচিন করে উঠলো।
ও কিছু নাহ্,
এ্যাসিডিটির প্রব।
খাবার কন্ট্রোলে নিয়ে যেতে হবে আমার,
তৈলাক্ত খাবার খাওয়া যাবে না।
পিচ্চিটা কি কিউট,
নিশ্চয়ই ওদের বেবী।
আমি মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম তাদের দিক হতে।
ওদিকে তাকানো অধিকারও আমার নেই।
বাইরে তাকালাম,
মেঘের পর মেঘ জমে আকাশটা গুমোট হয়ে
গেলো।
বিকেল বেলা এরকম আকাশ ভালো লাগে না,
শামীম সাহেবের খাওয়া শেষ।
দুজনেই উঠলাম,বিল দিয়ে একটা সিগারেট নিলাম
পাশের দোকান হতে।
শামীম সাহেব কিছু বলছে না,
পূর্ণতা পায়নি হয়তো।
রাতের খাবার খেয়ে হয়তো পূর্ণতা পাবে।
আকাশটা আরো বেশী ভারি হয়ে গেলো,
আজকের বিকেলটা একটু সুন্দর হলে কি হতো?
আজকের বিকেলের আকাশে শঙ্খচিল উড়লে কি
পাপ হতো?
কিংবা রংধনু উঠলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো?
বুঝিনা প্রকৃতির এ কোন খেল,
সঙ্গী আজ আমার বিষন্ন বিকেল!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত