“নাফ” ছোট একটা উলংগ ‘টং দোকানে এক পা আরেক পায়ের উপর রেখে বাংলা হাঁটু ভাংগা “দ” এর মত করে তিন পায়া একটি বেঞ্চে বসে উদাসী মনে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দূরে মিলিয়ে যাওয়া পথের পাণে ! হাতে ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুকের ভংগিমায় ঠোঁট দুটি ঈষৎ ফাঁক করে চায়ের কাপের দিকে একটু ঝুঁকে স্থীর হয়ে বসে তার তৃষিত নয়ন দুইটি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে কাউকে ! ইদানিং তার বুকের বাঁ পাশ টা কেমন যেন একটু ব্যাথা করছে কোন আরাধ্যলব্ধ এক উর্বশীকে হারানোর আশংকায় ! হঠাৎ দোকানীর ‘মামা’ ডাকে ‘নাফ’ সম্বিৎ ফিরে দুই চুমুকেই চা শেষ করে ! খালি কাপ টি দোকানী কে ফেরত দিয়ে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে সে ! পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে চায়ের বিল পরিশোধ করে উঠতেই দোকানী বলে উঠলো কি ‘মামা’ আজো কি দেখা পাও নাই ! দোকানীর কথায় ‘নাফের’ হ্রদয় উথাল পাথাল করে উঠলো !
কাউকে চিরতরে হারানোর বেদনাবিধুর মায়াবী চোখে দোকানী কে ছোট্ট উত্তর “না” বলে মাথানিচু করে ধীরে পায়ে চলে গেলো ! দোকানীর অস্পষ্ট স্বরে ‘আহা বেচারা” শব্দটা তীরের মত গিয়ে বিঁধল নাফের হৃদয় মাঝে ! ছল ছল করে চোখে জলের ঢেউ বয়ে গেলো ! কি যেন হারিয়ে গেল চিরতরে ! ধীরে হেঁটে হোটেলে তার রুমে ঢুকে দরজা টা ভিজিয়ে দিলো ! হাল্কা ঘুমে আচ্ছন্ন বেদনাহত ‘নাফ’ রঙিন স্বপ্নের জগতে কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে গেল ! আর মাত্র দুইদিন সে এই এলাকায় থাকবে সদ্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করা তরুন ‘নাফ’, বাবা মায়ের আদরের ভালোবাসার একমাত্র ধন ! ভোরের ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুকে হারিয়ে যাওয়া সেই বহু আরাধনার ভিনদেশী অপ্সরীর খোঁজে প্রায়ই এই এলাকায় আসে ‘নাফ’ !
বছর দুয়েক আগের কথা । মিয়ানমার সরকার কর্তৃক নির্মম অত্যাচারে বাস্তুভিটা হারা রাখাইন মুসলিম জনগোষ্ঠী লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা নারী পুরুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বন বাদাড়ে কোনরকমে আশ্রয় নেয় ! বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, শত শত সাহায্য সংস্থা,এন জি ও, দয়ালু হৃদয় ব্যাক্তি, সরকার এবং অনেক সংগঠন রোহিংগাদের বাসস্থান, খাদ্যদ্রব্য, বস্র, চিকিৎসা সেবা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো।
এমনি একটি দলের সাথে ঢাকা থেকে ‘নাফ’ রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য নিয়ে এসেছিলো ! কিছু লোকজনের সহাতায় তারা রোহিঙ্গাদের একটি ক্যাম্পে গেলো মানবিক সাহায্য নিয়ে ! এক এক করে অনেক নারী পুরুষ লাইন ধরে এগিয়ে আসছে আর ‘নাফ’ তাদের ব্যাগে বা পাত্রে খাদ্যদ্রব্য ঢেলে দিচ্ছে ! হঠাত একটি পাত্রে খাদ্য দিতে গিয়ে তার চোখ স্থীর হয়ে যায় পাত্রধারী অধঃবদনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে ! পলক যেন আর পড়ছে না ! মেয়েটিও পাত্রে খাদ্য না পড়াতে চোখ তুলে ‘নাফের’ দিকে তাকালো !
মেয়েটির দৃষ্টি মুহূর্তেই আচ্ছন্ন করে ফেললো ‘নাফ’ কে ! মেয়েটি এমন সুন্দরী যেন এক অপ্সরী তার সামনে আকাশ থেকে মাত্রই পড়লো ! নাফ ভুলেই গেলো মেয়েটিকে খাদ্য দিতে ! ‘নাফের’ ভালোবাসার সাগরে প্রেম বৈশাখীর ঝড় তুললো ! হৃদয় খান খান করা চাহনি দিয়ে মেয়েটিও অব্যক্ত এক বেদনায় এবং লজ্জায় লাল হয়ে অস্ফুট শব্দে বললো আমি ‘নদী’ ! দলপতির ডাকে সম্বিৎ ফিরে ‘নাফ’ মেয়েটির পাত্রে খাদ্য ঢেলে দিয়ে স্থান ত্যাগ করে মেয়েটির চলে যাওয়ার পথে দিকে তাকিয়েই থাকলো !
ভালো সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে ‘নদী’ ভাগ্য বিড়ম্বনায় উদ্বাস্তু হয়ে এ পাড়ে এসেছে ! অজানা অচেনা ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তার সন্মুখে ! ‘নাফ’ আরো দুইদিন অপেক্ষা করে এই হৃদয় হরণকারী অসহায় মেয়েটির সাথে কথা বলে সব শুনে তাকে চির জীবন সঙ্গিনী করার বাসনা করলো! কিন্তু দেশের আইনের বাঁধা ও বাবা মা এর নারাজী ‘নাফ’ এর হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দিলো ! কথাটি মেয়েটিকে বলতে পারেনি ‘নাফ’ ! দীর্ঘ সময় মেয়েটি ‘নাফের’ আর দেখা না পেয়ে স্থান ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে যায় ! দুই ভিন দেশী ‘নাফ ও নদী’ র অকৃত্রিম ও অভিন্ন ভালোবাসা দুটি দেশের সীমান্ত কে পৃথক করে “নাফনদী” কোন এক মোহনায় মিলিয়ে গিয়ে আজো বয়ে চলছে ! নাফ – নদীর ভালোবাসা !