এক টুকরো কষ্ট

এক টুকরো কষ্ট

আমি যাকে ভালোবাসি সে প্রতিদিন একবার হলেও আমার কাছে আসে। আমার সাথে কথা না বললে নাকি তার পুরোটা দিন মাটি হয়ে যায়। ঊর্মি আজও এসেছিল সকালে। টিপটিপ বৃষ্টিতে কচুপাতা মাথায় দিয়ে আমার ঘরের দরজায় হাজির। দরজা ফাঁক করে রেখেছিলাম আমিই। ফোটা ফোটা বৃষ্টি যখন টিনের চালে পড়ে তখন মনে হয় কোন কিশোরী পায়ে নুপুর পরে নৃত্য করছে।

হঠাৎ ঊর্মিকে দরজায় দাঁড়ানো দেখে আমি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। ভেজা চুল থেকে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে। কপাল বেঁয়ে নামা পানি মুখের উপর যেভাবে আছে মনে হচ্ছে গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে কোন ক্লান্ত পথিকের মুখে ঘাম, একটু জিরোতে এসেছে আমার ঘরের দরজায়। একটা তালপাতার পাখা থাকলে আমি ঊর্মিকে বাতাস দিতাম।

ঊর্মি আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, “এখন বৃষ্টিটা একটু কম। বৃষ্টি বাড়লে যদি না আসতে পারি, তাই তোমাকে একটু দেখে গেলাম। তুমি ভালো আছো উজ্জ্বল?” আমি ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা টেনে বললাম, “তুমি আসলে ভালো না থাকার উপায় আছে?” ঊর্মি টিনের চাল থেকে গড়িয়ে পড়া পানি হাতে নিয়ে আমার গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে বলল, “বৃষ্টি দেখো। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। মা দেখলে ভীষন বকবে।” আমি ঊর্মির চলে যাওয়া দেখছিলাম। একটু আগে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে মনে হচ্ছিল কোনো কিশোরী নৃত্য করছিল। এখন মনে হচ্ছে সেই কিশোরী নেমে এসেছে নিচে। নৃত্য করতে করতে বাড়ি ফিরছে আর আমি তাকিয়ে আছি।

ঊর্মি এবার দ্বাদশ শ্রেণীতে। এত বড় মেয়ে অথচ তার চঞ্চলতা দেখলে মনে হবে প্রাইমারী স্কুলে পড়ুয়া সদ্য কিশোরী। তাকে কবে, কখন, কিভাবে ভালোবেসেছি আমার মনে পড়ে না। তবে আমি জানি, ঊর্মিকে আমি অনেক ভালোবাসি। এই ভালোবাসা ক্ষনিকের না। সারাজীবন এমনি করেই ভালোবাসব তাকে। ভালোবাসার সৃষ্টিও হয়েছে একটু একটু করে। আমি তাকে হঠাৎ ভালোবাসিনি। যখন সেই ছোট্টবেলায় কেউ আমাকে খেলায় না নিত। উর্মি এসে আমার সাথে চার কটি, পাঁচ কটি, লুডু আর বাঘবন্দীর মত কত খেলাই না খেলত। আমার এখন মনে হয় সেই পিচ্ছি কালে আমি যদি প্রেম ভালোবাসা বুঝতাম তখনো একবার আমি ঊর্মির প্রেমে পড়তাম।

ঊর্মি আমাকে ভালোবাসে না আমি জানি। তবে আমাকে তার খুব ভালো লাগে। আমি জানি ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক নয়। আমাকে ভালোলাগে বলেই সেই ছোটবেলা থেকে আমার সাথে মিশত। এখন তো বড় হয়ে গেছে। এখন আর ছোটবেলার মত করে দীর্ঘ সময় কাটাতে পারে না আমার সাথে। লোকে মন্দ বলতে পারে। তবে একবার দুইবার ঠিকই আমার সাথে দেখা করে যায়। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে যায়। আমন ধানের চাউল দিয়ে যখন মুড়ি ভাজা হয় তখন সাদা মুড়িগুলোকে একপ্রকার হাসতে দেখা যায়। ঊর্মি ঠিক তেমন করে হাসে। তাকিয়ে থাকলেও পলক ফেলতে মনে থাকে না।

আমি প্রায়ই ডায়রীর বুকে ঊর্মিকে নিয়ে কবিতা লিখি। ঊর্মি মাঝে মধ্যেই আমার কবিতা পড়ে। কবিতা লেখার পর অনেকবার আমি গুনগুন করে ঊর্মি নামের কবিতা পড়ি। তারপর পুরো কবিতা থেকে ঊর্মি নামগুলো কলমের কালি দিয়ে মোটা করে কেটে দেই। ঊর্মি যদি জিজ্ঞেস করে এত সুন্দর কবিতায় কয়েক জায়গায় কাটাকুটি কেন? তখন মিথ্যে করে বলি, “ভুল ছিল তাই কেটে দিয়েছি। এস. এস.সি ফেল করা ছেলে আমি, ভুল তো হতেই পারে।”

নিজ হাতে সূতো দিয়ে চুড়িতে ঊর্মির নাম লিখে দিয়েছিলাম। আমার সামনে কয়েকদিন হাতে পরেছে। আমি খেয়াল করে দেখতাম বাড়ি ফিরবার পথে ঊর্মি চুড়ি দুটো হাত থেকে টেনে বের করে কাপড়ে লুকিয়ে বাড়ি ফিরত। আমি জানি চুড়ি পেয়ে ঊর্মি অনেক খুশি। আর আমাকে খুশি করতেই আমার সামনে সে হাতে পরত। আবার খুলে ফেলত, কারণ কেউ দেখলে অন্যরকম কথা বলবে। এই এলাকায় আমি ছাড়া আর কেউ তো চুড়িতে সূতো দিয়ে লিখতে পারে না। খুলে রাখলেও চুড়ি দুটো যে ঊর্মি সযতনে রেখেছে সে বিশ্বাস আমার আছে।

আমার খুব ইচ্ছে ছিল একদিন পড়ন্ত বিকেলে ঊর্মির হাত ধরে আমি হাঁটব। তার চুলের খোঁপায় গুজে দেব রক্ত জবা ফুল। দুর্বা ঘাসে, তার পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বসে মৃদু স্বরে বলব, “ঊর্মি, তুমি আমার ভালোবাসার আকাশ হবে? আমি সেই আকাশের নীল হতে চাই। তোমার আকাশের বুকে নীল হয়ে লেপ্টে থাকতে চাই।” বলা হয়নি কোনোদিন, আর কখনো বলা হবে না। আমি যে ঊর্মির যোগ্য কেউ নই।

দু’দিন ঊর্মির দেখা নেই। সে কখনো আমার সাথে দেখা না করে থাকেনি। আজ দুটা দিন আমাকে না দেখে থেকেছে। তাকে অভ্যেস করতে হবে বলেই দু’দিন না এসে থাকতে পেরেছে? সামনের সপ্তাহে ঊর্মির বিয়ে। কারো বিয়ে ঠিক হলে সে জানুক আর না জানুক, পুরো এলাকা রটে যায়। আমিও খবর পেয়েছি। আমি যাকে ভালোবাসি তার বিয়ে। তাই বলে কিন্তু আমি কান্না করে বুক ভাসাইনি। বাস্তবতাকে আমি খুব সহজেই মেনে নিতে পারি। একটু কষ্ট হচ্ছে কারণ ঊর্মিকে আজও বলা হয়নি তাকে কতটা ভালোবাসি আমি। নাকি অপ্রকাশিত ভালোবাসা বলে আমার ভালোবাসা কম হয়ে যাবে? হলে হোক, তাতে কী? কম হলেও কেউ জানে না বেশি হলেও না। আমার কাছে ঊর্মি বিয়ের আগে একবার হলেও আসবে সেটা আমি ভালো করেই জানি।

যার বিয়েতে বৃষ্টি হয় সে নাকি ভাগ্যবতী। মুরব্বীরা বলাবলি করে। শ্রাবণ মাসের এই হঠাৎ বৃষ্টির দিনে ঊর্মির বিয়েতেও বৃষ্টি হবে সেটা আমি হলপ করে বলতে পারি। এখনো বৃষ্টি হচ্ছে, আর ঊর্মি বৃষ্টিতে ভিজে আমার ঘরের দুয়ারে। মেয়েটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? দু’দিন পর যার বিয়ে আর সে বৃষ্টিতে ভিজে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। কেউ দেখলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। টিনের চালের গড়িয়ে পড়া পানিতে ঊর্মি ভিজছে। হঠাৎ হেসে হেসে বলছে, “এখন আর দৈনিক তিনবার আসতে পারব না। তিনমাসে একবার যখন শ্বশুর বাড়ি থেকে বেড়াতে আসব তখন তোমাকেও দেখে যাব। জানো? আমার হবু স্বামী অনেক লম্বা, অনেক বড় চাকরি করে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। ”

কথাটা বলেই ঊর্মি দৌড়ে চলে গেল। আমি জানি ঊর্মি বিয়ের আগে আর আসবে না। এখন দৌড়ে চলে যাবার কারণটাও আমি জানি। কিন্তু তার গলার স্বরটা কেমন ধরা ধরা মনে হচ্ছিল। আচ্ছা ঊর্মি কি কেঁদেছিল আমার জন্য? হয়তো বৃষ্টির জন্য তার চোখের পানিকে পৃথক করতে পারিনি। আরে না, কী যে ভাবছি আমি। দু’দিন পর যার বিয়ে, সে আমার জন্য কাঁদবে কেন?

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। আমি বুকে হাত দিলাম। বুকের ভিতর কি কষ্টের বৃষ্টি নামে? না, চোখের জলকে আজ বৃষ্টি বলব না। এত কেবলই ঝরে পড়ে। বৃষ্টির মত ফোটা ফোটা ঘাম হয় না শরীরে। ঊর্মির শেষের কথাটা মনে পড়ছে, “আমার হবু স্বামী নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে ” আমি জানি কথাটা বলে ঊর্মি যখন দৌড়ে চলে যাচ্ছিল, ঊর্মি ঠিক কেঁদেছিল। আমার জন্যই কেঁদেছিল। কারণ আমি কোনোদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিনি। জন্ম থেকেই আমার হাঁটুর নিচ থেকে পোলিও রোগীদের মত বাঁকা। আমার স্বাভাবিক পা নেই। প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত আব্বু নিয়ে যেত স্কুলে। হাইস্কুলে উঠার পর রিক্সা ঠিক করা ছিল আমার জন্য। সাথের ছাত্ররাও বেঞ্চে তুলে বসিয়ে দিত। এস. এস. সি ফেল করার পর আর লেখাপড়া করিনি।

নিজের পায়ে চলতে পারতাম না বলেই তো সবার সাথে খেলতে পারতাম না। তখনও ঊর্মি বসে আমার সাথে খেলত। দু’দিন পর ঊর্মির বিয়ে। আমার খেলার সাথী, অব্যক্ত ভালোবাসাকে হারাচ্ছি। যদিও কখনো বলা হয়নি, “ঊর্মি আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলেও মন থেকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসি তোমায়।”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত