শেষ থেকে শুরু

শেষ থেকে শুরু

ডিভোর্সের পেপারটাই একটা সই করে পাঠিয়ে দিয়েন’ছোট্ট একটা কাগজে কথাটা লিখে বাপের বাড়ি চলে এসেছিলাম। সৌরভ নামের এই লোকটার সাথে ২টা বছর আমি সংসার করছি, সে এখনো জানেনা আমি কি খেতে ভালোবাসি কি রং আমার পছন্দ। বাসর ঘরে একবার শুধু আমাকে বলেছিলো আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে, সেটাই ছিলো প্রথম আর শেষ বার যখন তিনি আমার প্রসংশা করেছিলো।২ বছরের ভেতর কখনো আমার নামটাও ধরে ডাকেনি একবারো সে।মনের ভুলেও না।

সারাদিন সে ব্যাস্ত থাকে অফিসের কাজে।রাতে বাড়ি ফিরে ঠিকমত কথাও বলেনা আমার সাথে। দুইপাশে দুজন মুখ ফিরিয়ে সুয়ে থাকি।মাঝে মাঝে শরীরের ক্ষুধা মেটাতে সে কাছে আছে।তবুও সেটা খুবি কম।আমাদের সম্পর্কটা এখনো আপনি তেই আটকে আছে।সকালে উঠে তার নাস্তা তৈরি করে দেওয়া।দুপুরে তার জন্য খাবার তৈরি করা।আর রাতে তার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করা,তার জামাকাপড় কাচা, সেগুলো গুছিয়ে রাখা এটাই ছিলো আমার নিত্যদিনের কাজ। মাঝে মাঝে মনে হতো সৌরভ কে জিঙ্গাসা করি,আমাকে কি তোমার যন্ত্র মনে হয়? সেইদিন ছিলো আমাদের বিবাহবার্ষিকী।সারাদিন অপেক্ষা করার পর দেখলাম তার মনে নেই যে আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। তার জন্য আজ তার পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়ে বসে আছি।আর সে বাসায় ফিরলো রাত ১২ টাই।

আমি-এত দেরি হলো যে আপনার আজ?

সৌরভ-অফিসে কাজ ছিলো।

আমি-খেতে আসুন।

সৌরভ-খিদে নেই।অফিসে একটা পার্টি ছিলো তাই সেখানেই খেয়ে নিয়েছি।আপনি খেয়ে নিন।

আমি-আজকের দিনটার কথা মনে আছে আপনার?

সৌরভ- কেনো আজকে কি?

আমি-না কিছু না।

খুব টায়ার্ড আমি।সুতে গেলাম। কথাটা বলে সৌরভ ফ্রেশ হয়ে সুতে চলে গেলো। মানুষটা এত আনরোমেন্টিক।নিজের বিবাহবার্ষিকীর কাথাও মনে থাকেনা তার।সেদিন সারাটা রাত খাবারগুলো সামনে নিয়ে কেঁদেছিলাম সৌরভ একবারো উকি দিয়েও দেখেনি। আমি যে তার পাশে নেই সেই রাতে, তাতে তার কোনো খেয়ালি নেই।

অনেক ভেবে দেখলাম এমন একটা মানুষের সাথে সংসার করা অসম্ভব। এতদিন সহ্য করেছি বাবা মায়ের কথা ভেবে।আমারো তো ইচ্ছা করে স্বামীর ভালোবাসা পেতে।আমারো তো ইচ্ছা তার সাথে বাইরে ঘুরতে যেতে,আমারো তো ইচ্ছা করে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলুক তোমাকে ভীষন ভালোবাসি আতিকা।২বছরে ২ বার বাপের বাড়ি যাওয়া ছাড়া কখনো কোথাও নিয়ে যাইনি সে। তবে আর না। জড়িয়ে ধরা তো দুররে কথা মুখ ফুটে দুবছরে একবারো বলেনি ভালোবাসি তোমাকে কথাটা। এভাবে আর না।চলে এলাম বাপের বাড়ি।

জানি বাবা মা আমাকে বোঝাবে তবুও আমি এবার আর ফিরবো না।স্বামী স্ত্রী ভেতরে ভালোবাসা না থাকলে সেটা আবার কিসের সংসার?

বাড়ি চলে এসেছি আজ দুদিন।হঠাৎ মা এসে বললো,,

মা-জামাই ফোন দিয়েছে আতিকা নে ফোন ধর।

আমি- না মা, আমি কথা বলবো না ঐ লোকটার সাথে।

মা-আরে বলছে কি দরকার।নে ধর তো।

আমি-ঠিক আছে দাও।

আমি-হ্যালো,জ্বী বলুন।

সৌরভ-আমার টাই টা কোথাই রেখেছেন?আর আমার সাদা সার্টটা কোথাই?

আমি-আলমারির ডান পাশে ভাজ করে রাখা আছে দেখুন।

সৌরভ কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলো।ডিভোর্সের কথাটা লিখে এসেছিলাম, লোকটা একবারো সে বেপারে কোনো কথাই বলেনি।আশ্চর্য মানুষ একটা।এর সাথে থাকা যাই নাকি।গোমড়ামুখো একটা। খুব কান্না পাচ্ছে আমার।ভেবেছিলাম হয়তো বলবে ফিরে এসো,তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।ভালোবাসি তোমাকে ভীষন। পরের দিন সৌরভ আবার কল দিলো।

আমি-আবার কেনো কল দিয়েছেন?

সৌরভ-আমার কালো টিসার্টটা কোথাই?আর টাউজারটা?

আমি-আলামারির নিচে ওগুলো ভাজ করা আছে দেখুন।একটু খুজে নিতে পারেন না।বার বার আমাকে কেনো কল করেন।একা থাকতে শিখুন।নিজের জিনিসগুলো নিজে গুছিয়ে আর খুজে নিতে শিখুন। কথাগুলো বলে আমি কল কেটে দিলাম কিছুক্ষন পর সৌরভ আমাকে আবার কল দিয়ে বললো,

আমি-আবার কেনো কল দিয়েছেন?

সৌরভ-বলছি যে, বেগুন কীভাবে কাটবো?ইয়ে মানে রান্নার বুয়া আজ আসেনি।বলছি কি কি দেবো বেগুনে?বলছি যে ঝাল কয়টা দেবো?

আমি-জানিনা আমি।আপনার যা ইচ্ছা করুন।

সৌরভ-ইয়ে শুনুন বলছি যে বেগুনে তো পানি দিছি তা সে বেগুন ভেসেই আছে ডুবছেই না।তাহলে সেদ্ধ হবে কি করে।

আমি-তা আমি কি জানি। কেনো আজ আর আর অফিস থেকে খেয়ে আসেন নি।কথাটা বলে আমি রাগে রাগে ফোনটা কেটে দিলাম।দেখলাম মা আর ছোট বোন দরজার পাশে দাড়িয়ে হাসছে।আমার কথা শুনে।

আমি-তোমরা চুরি করে আমার কথা শুনছিলে।এটা কিন্ত একদম ঠিক না।মা আরো জোরে জোরে হাসতে হাসতে চলে গেলো সেখান থেকে।

পরের দিন সৌরভ আবার কল দিলো।

সৌরভ-বলছি যে কাজের বুয়াটা আসেনি।

আমি- আসেনি তো আমি কি করবো?(রেগে রেগে বললাম)।

সৌরভ- আসলে বলছিলাম কি হাত কেটে গেছে। ফাসটেট বক্স টা কোথাই রেখেছেন।

আমি-মানে?কীভাবে কাটলো?

সৌরভ-তরকারি কাটতে গিয়ে।

আমি-ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে আছে দেখুন।ডেটল দিয়ে পরীষ্কার করে নিবেন আগে।

সৌরভ-আতিকা!

সৌরভের মুখে আমার নামটা শুনে বুকের ভেতরটা যেনো মোচড় দিয়ে উঠলো।বিয়ের ২বছর পর আজ সে প্রথম বার আমার নামটা ধরে ডাকলো।এই ডাকের ভেতর যেনো
আমি একটু একটু ভালোবাসা খুজে পেলাম।

আমি-জ্বী বলুন।(কান্না কান্না কন্ঠে)।

সৌরভ-আমি ভালো নেই আতিকা।(কান্না কান্না কন্ঠে)।

আমি- কী বললেন? হ্যালো!হ্যালো!হ্যালো।বুঝতে পারলাম সৌরভ ফোনটা কেটে দিয়েছে।মানুষটার এত জেদ।ভাঙবে তবু মচকাবে না।আমিও দেখি কতক্ষন সে না মোচকে থাকে। পরেরদিন সকাল ১১ টাই একটা অচেনা নম্বর থেকে কল আসলো। আমি রিসিভ করলাম,

আমি-হ্যালো আছসালামুয়ালাইকুম।কে বলছেন?

-ভাবিসাব আমি সৌরভ দাদাবাবুর বাসা থেইকা কইতাসি।

-কে আপনি?আর আপনি সৌরভের বাসায় কি করছেন?

-ভাবিসাব আমি সৌরভ দাদাবাবুর বাইতে কাম করি।

-তো তুমি আমাকে কেনো কেনো কল দিয়েছো।আর আমার নাম্বার কোথাই পেলে?

-ভাবিসাব এইসব কতা অহন বাদ দেন।সৌরভ দাদাবাবুর ভীষন শরীর খারাপ।বিছনা থেইকা উটবার পারতেছে না।খালি বাতরুমে ঢুহে আর বাইর হই।অহন তো আর উডবারো পারতেছে না।

আমি কথাটা শোনা মাত্র দৌড়ে চলে গেলাম সৌরভের কাছে।২টা বছর মানুষটার সাথে ছিলাম।সে নাইবা ভালোবাসুক আমি তো বাসি।সেই টানেই ছুটে গেলাম।গিয়ে দেখি সে বিছানাই পড়ে আছে।বুঝতে পারলাম তার উল্টা পালটা খাবার খেয়ে পেট খারাপ করেছে।ডক্টর ডাকলাম,সেলাইন দিলো, ঔষধ দিল তাকে।টানা দুটো দিন পর সুস্থ হলো সে।দুটো দিন আমি ওখানেই ছিলাম।

-আমি গেলাম।এর পর থেকে একটু সাবধানে খাওয়াদাওয়া করবেন।এবার এসেছি বলে ভাববেন না,পরের বার এমন হলে আবার আসবো।আমি কথাগুলো বলছি আর সৌরভ জানালা দিকে মুখ ফিরিয়ে বাইরে দিকে তাকিয়ে আছে। ভালো থাকবেন আসছি আমি।

আমি চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম ঠিক তখনি সৌরভ আমার হাতরা টেনে ধরলো।আমাকে এক টাকে ওর বুকে নিয়ে বললো’যাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়, যাকে এতটা ভালোবাসো, যার জন্য গত দুইটা রাত জেগে বসে ছিলে তাকে ছেড়ে চলে যাবে? আমি হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে বললাম’আমি যাকে ভালোবাসি সে তো আমাকে বাসে না।শুধু শুধু মায়ায় জড়িয়ে কি লাভ?

সৌরভ আমাকে আবার টান দিয়ে ওর বুকে টেনে নিয়ে বললো, যেওনা, আমার ভীষন একা লাগে।রোজ রাতে ঘরে ফিরে যখন দেখি তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই, টেবিলে তোমার বসার জায়গাটা ফাকা তখন বুকের ভেতরটা ভীষন ফাকা ফাকা লাগে।তুমি না চলে গেলে আমি বুঝতেই পারতাম না আমি কতটা ভালোবাসি তোমাকে।আসলে মানুষ ঠিকি বলে প্রিয়জন দুরে গেলেই তবে তার শুন্যতাটা অনুভব করা যাই।আসলে আমি এমনি, আমি আনরোমেন্টিক।ভালোবাসার কথাটা ঠিকমত বলতে পারি না।তুমিও কখনো কিছু বলোনি তাই ভেবেছিলাম তুমি হয়তো এতেই খুশি।তুমি চলে গিয়ে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছো।তোমাকে আমার প্রয়োজন আতিকা, সারাটাজীবন এই ভাবে আমার পাশে থেকো।তোমার এই আনরোমেন্টিক বরটাকে একটু রোমেন্টিক করে নিও।তবুও ছেড়ে যেওনা আমাকে।

আমি- আমি শুধুই আপনার প্রয়োজন? প্রিয়জন তো নয়।

এখন প্রয়োজন বলে কাছে টানছেন প্রয়োজন শেষ হলে আবার দুরে ছুড়ে ফেলনেব।আমি বরং আসি।

সৌরভ- তুমি আমার প্রয়োজন প্রিয়জন সব।তোমাকে ছাড়া আমার চলবেই না।ভালোবাসি আমি তোমাকে আতিকা।তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গেছো।আমি চাই তুমি আমার জন্য রোজ রাতে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করো।আমি আসলে অন্যদের মত এত রোমেন্টিক না ঐ ভাবে ভালোবাসার কথাটা বলতে পারিনা বুঝিয়ে।তবে তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না এটা আমি বুঝে গেছি এই কয় দিনে। কথাটা বলে সৌরভ আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আর বললো খুব ভালোবাসি তোমাকে।আমি আর পারলাম ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে।আমি ওকে সেই বিয়ের প্রথম দিন থেকেই ভালোবাসি।আমিও ওর বুকে মাথা গুজে দিয়ে বললাম আমিও আপনাকে ভীষন ভালোবাসি।

সৌরভ -তাহলে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে কেনো।

আমি-আপনাকে একটু শিক্ষা দেবার জন্য।

সৌরভ -যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আমার আর না।তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই পারিনা।তোমাকে ছাড়া আমি অসম্পুর্ন।

আমি- আমিও তোমাকে ছাড়া অসম্পুর্ন।

সৌরভ-এখনো আপনি করে বলবে?একবার বলো, তোমাকে ভীষন ভালোবাসি সৌরভ।

আমি মাথাটা নিচু করে লজ্জা রাঙা মুখে বললাম,’আমিও তোমাকে ভীষন ভালোবাসি সৌরভ। সৌরভ আমার মুখটা ওর দুহাত দিয়ে উচু করে ধরে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো এবার আমার একটা ছোট্ট আতিকা চাই। আমি লজ্জাই আবার সৌরভের বুকে মাথাটা গুজে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

সৌরভ -আর ছেড়ে যেওনা আমাকে।

আমি- থাকতে পারি একটা সর্তে।

সৌরভ -কী সর্ত?

আমি-রান্না করে খাওয়াতে হবে পারবে তো?

সৌরভ – সে করতে পারবো তবে পেট খারাপ হলে আমার দোষ না কিন্ত,হা হা হা। ২ বছর পর এই মানুষটার মুখে এমন হাসি দেখলাম। সৌরভ আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কপালে আবার একটু চুমু দিয়ে বললো, আগের দুবছর ভুলে যাও।এই শেষ থেকেই আমাকে নতুন জীবনের শুরু হোক আবার। আর কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দেবোনা কখনো তোমকে দেখো।আমিও পরম শান্তিতে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে রইলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত