আব্বু আম্মু

আব্বু আম্মু

— রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কোন মেয়ের দিকে তাকাবিনা।
— আচ্ছা, তাকাবনা।
— নীচের দিকে তাকিয়ে হাটবি, ডানে বামে তাকিয়ে গাড়ী দেখে তারপর যাবি।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— টিফিনের টাকা যেন পকেট থেকে না হারায়, খেয়াল রাখবি।
— আচ্ছা, খেয়াল রাখব।
— টিফিন করে ক্লাসে বসে পড়বি, খেলাধুলা করে হাত পা ভাঙ্গার দরকার নেই।
— আচ্ছা, খেলবনা।
— এবার কপাল কাছে নিয়ে আয়।

কপাল কাছে নেয়ার পর অাম্মু কপালে চুমো দিল। তারপর বলল, “এবার লক্ষী ছেলের মত স্কুলে যা, স্কুল ছুটি হলে সোজা বাড়ি চলে আসবি।

এটা স্কুলে যাওয়ার সময় আম্মুর আর আমার প্রতিদিনকার রুটিন। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যেন কোন মেয়ের দিকে না তাকাই সেটা বলার একটা বিশেষ কারন আছে। অামার অাম্মু অনেক কষ্টে উনার নাম লিখাটা শিখেছেন। আম্মু লেখাপড়া জানেনা। কিন্তু আম্মুর অনেক বড় স্বপ্ন, আমি এলাকার সব ছেলে মেয়ের চাইতে বেশী শিক্ষিত হব। সেটা অাব্বুও চায়। আর সেজন্য যেদিন প্রাইমারী ছেড়ে হাইস্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাব সেদিন অাব্বু বলেছিল,
তিনটি কারনে ছাত্রজীবন ধ্বংস হয়ে যায়।

১, ছাত্র জীবনে টাকার প্রতি লোভ থাকলে।
২, নেশাগ্রস্থ হলে।
৩, ছাত্র জীবনে কোন মেয়ের সাথে প্রেম ভালবাসায় জড়ালে।

অার আমার অাম্মুও সেজন্য সবকিছু সাবধান করার পাশাপাশি এটাও সাবধান করে দেয় যেন রাস্তাঘাটে কোন মেয়ের দিকে না তাকাই।

অামার বাবা মা অামার বন্ধুর মত। সবকিছুই সহজভাবে বুঝাবে, সতর্ক করবে। অামার খুব ভাল লাগে।
যখন গাল আর ঠোটের উপর দিয়ে ছোট ছোট লোম গজাচ্ছিল তখন আব্বু আম্মুই বলেছিল, খবরদার বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে সেভ করতে যাসনে কিন্তু। তাহলে এই বয়সেই প্রতি সপ্তাহে সেভ করতে হবে। বছর খানেক যাক, সেভ করার বয়স হলে আমরাই তোকে বলব। অামিও চেষ্টা করি বাবা মায়ের প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য। সেজন্য এলাকায় আমাকে কিছু বলার আগে বাবা মায়ের কথা বলে। অমুকের ছেলেটা সোনার ছেলে।

সংসারের সারাদিনের খাটুনির পর আম্মু ঢুলু ঢুলু চোখে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে আমার পাশে বসে থাকত, আমি পড়তাম। যখন আমি বলতাম অাম্মু অামার ঘুম পেয়েছে। তখন পাশের রুমে বিছানা করে মশারি টাঙ্গিয়ে দিত। শুয়ে পড়ার সাথে সাথেইতো আর ঘুম আসতনা। প্রতিদিনই যখন চোখ বুজে শুয়ে থাকতাম, আম্মু মশারী সরিয়ে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে কপালে টুপ করে একটি চুমো দিয়ে আসত। আম্মু চুমো দেবার পর আমার চোখে ঘুম আসত। আম্মুর সেই চুমোর কত বড় শক্তি সেটা আমি জানি। প্রতিদিন বাড়ির বাইরে বের হলেও অাম্মু কপালে চুমো দিত। জিজ্ঞেস করতাম, আম্মু প্রতিদিন কপালে চুমো দাও কেন? বলত, আমারতো একটি মাত্র ছেলে। তাই কপালে চুমো দেই, যেন অামার ছেলে আমার কাছে অাবার ফিরে আসে।

তো একদিন চরাঞ্চল থেকে নৌকায় ফিরে আসছিলাম। একটি ট্রলার ধাক্কা দিলে নৌকার মাচার উপরের মানুষগুলো নদীতে পড়ে যাই, আমি সহ। ইঞ্জিন চালিত নৌকার সাইটে সবাই সাতরিয়ে ধরতে পারলেও আমি ছিলাম খানিকটা দূরে। প্রাণপন লড়ে সাতার কেটে যাচ্ছি নৌকাটি ধরার জন্য। ইঞ্জিন বন্ধ করলেও গতি কমছিলনা। মনে মনে ভাবতেছি, আমি কি আর আম্মুর চুমো খেতে পারবনা? এই মাঝনদীতে ডুবে মরব? হঠাৎ পিছন দিয়ে দুইজন যাত্রী নিয়ে এক স্পীড বোড আসল। অামার কাছাকাছি এসে স্পীডবোড থামিয়ে দিল। সামনে নৌকা ইঞ্জিন বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল আর আমি স্পীডবোডে করে সেই নৌকায় পৌছলাম।

আমাদের এলাকায় একটি ভাঙ্গা রাস্তা ছিল। ২০০৪ এর বন্যায় সে রাস্তা দিয়ে ছোটরা গেলে ডুবে যেত। বড়দেরই বুক পানি ছিল। আব্বু আমাকে কাঁধে করে সে জায়গাটুকু পাড়ি দিতেন। একদিন বলেছিলাম, আব্বু তুমিতো আমার অনেক বড়। আমি যে তোমার কাঁধে চড়ছি আমার গুনাহ হবেনা? বাবা বলল, পাগল ছেলে। বাবার কাঁধে চড়েইতো ঘোড়া দৌড়াবি। আবারো বললাম, বাবা তোমার কষ্ট হয়না? বলেছিল এই কষ্টটা, এই ব্যাথাটা তোর কাঁধে চড়েও আমি দেব। জিজ্ঞেস করেছি, কবে বাবা? বলেছিল, আমি যেদিন মরে যাব সেদিন আমার লাশের খাটটা তোর কাঁধে করে নিয়ে যাবি। ধুর, পারলামইনা চোখের পানিকে আটকাতে। বাবা মা তার সন্তানকে এত ভালবাসে কেন? আরো কম ভালবাসতে পারেনা? তাদের ভালবাসায় হিংসে হয় আমার। একমাত্র বাবা মা’ই পারে সন্তানের ভাতের থালায় পাতিলের শেষ মাছের টুকরো তুলে দিয়ে বলতে, ” আমি একটু আগে খেয়েছি, তুই খেলেই আমার খাওয়া হবে।”

বাবা মা’ই পারে সন্তানের অসুখে রাত জেগে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে বলতে, ” আল্লাহ আমার সন্তানের অসুখ আমাকে দিয়ে আমার সন্তানকে ভাল করে দাও। সন্তান দেখে ফেললে বলবে, আমি কাঁদছিনাতো, চোখে কি যেন একটা পড়ছে। আমি বলতেছি, তোমার ঘরের বউ তোমাকে ছাড়া ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু তুমি বাইরে থাকলে মায়ের চোখে কোনদিন ঘুম আসবেনা। কতদিন কত আস্তে আস্তে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে চেয়েছি, তাও আবার গভীর রাতে। আম্মু পাশের রুম থেকে বলে উঠত, বাবা আইছস??? আবারো পানি আটকাতে পারলামনা চোখের।

অ আব্বু, অ আম্মু আমি অনেক অনেক ভাল আছি দূর প্রবাসে। শুধু তোমাদের কথা মনে পড়ে আর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। এত ভাল ভাল খাবারও তোমাদের হাতে তুলে দেয়া খাবারের কাছে কিছুইনা। আমার মত যার বাবা মা দুনিয়ায় আছে, সারাটা পৃথিবীই তার। বাবা মা থাকতে তাদের সেবা করুন, তাদের মনে কষ্ট দিয়েননা। আব্বু, আম্মু আমি তোমাদের এত্তগুলা ভালবাসি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত