কাছে আসার গল্প

কাছে আসার গল্প

→”আমি আর এভাবে তোমার সাথে থাকতে পারছিনা। আমি ডিভোর্স চাই।” হুমায়রার কথা শুনে আমিও চিৎকার করে বললাম “হুম সেটাই ভাল হবে। তোমার সাথে এভাবে থাকতে থাকতে আমারও অসহ্য এসে গেছে। আমি পারছিনা আর প্রত্যহ তোমার প্যানপ্যানানি সহ্য করতে। রাতটা পার হোক ডিভোর্স পেপার নিয়ে আসব।”

সকালেই কোর্টে গিয়ে সব পেপার রেডি করে নিয়ে আসলাম। পেপার গুলো টেবিলে রেখে লাঞ্চে বসলাম। খাবার বাটির ঢাকনা এক এক করে তুলে দেখি সব আমার পছন্দের খাবার রান্না করেছে। হুমায়রাকে আর ডাক দিলাম না খাবার টেবিলে। আমি একা খেয়ে নিয়ে হুমায়রাকে দ্রুত তৈরি হওয়ার জন্য তাগাদা দিলাম।

→আমি আবির একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদে কাজ করি। আর এখন যাকে ডিভোর্স দিতে যাচ্ছি সে হুমায়রা আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। দীর্ঘ সাড়ে চার বছর সম্পর্কের পর আমরা বিয়ে করে ফেলি। হুমায়রার বাসা নাটোরে,আর আমার ঢাকাতে। আমাদের পরিচয় হয় নীল সাদার জগৎ ফেসবুকের কল্যাণে। আমি তখন সবে মাত্র কলেজে পড়ি। নিজের স্বপ্নলোকের বাহারী লাল-নীল কল্পনা গুলো নিয়মিত কিছু শব্দে সাঁজিয়ে লিখতাম। কেউ কেউ এসব এলোমেলো শব্দগুচ্ছকে গল্প বলতো।

অনেকে সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করতো। আবেগে আমিও পাঠ্য পুস্তকের পড়ালেখা বাদ দিয়ে নিয়মিত শব্দ সাঁজাতাম। পোস্ট করতাম বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজে। এই লেখা পড়ে অনেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিতো,মেসেজ করতো। আর বিশেষ করে মেয়েরা এসব বেশিই পড়তো। আমি বুঝতাম এজন্যই রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সুনীল,জীবনানন্দ সবাই মেয়েদের প্রকৃতির সাথে মিশিয়েছে। প্রকৃতির রূপে এঁকেছে রমণীর চাঞ্চল্যতা, সরলতা। অধিকাংশ মেয়েই মনে হয় স্বভাবগত গল্পপ্রেমী। এই লেখালেখির সুবাদে পরিচয় হুমায়রার সাথে। নিয়মিত কথোপকথন আমাদের ধীরে ধীরে একে অপরের কাছে নিয়ে আসে। ভালোবাসার জন্ম হয় অস্পর্শীত বিভোর দু’টো মনে। অনুভূতির স্তুপ জীবন্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়ের আনাচে-কানাচে। শুরু হয় নতুন দিগন্তের সূচনা।

ওর পুরো নাম উম্মে হুমায়রা ইসলাম আনজুম। অনেক বড় নাম! আমি অবশ্য হুমায়রা বলে ডাকি। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বছরে তিন চারবার দেখা করতে যাওয়া। প্রথম নাটোরে যাওয়ার পূর্বে অবশ্য আমি হুমায়রার ছবি দেখিনি। যদিও বেশ কয়েকবার ছবি চেয়ে রিকুয়েস্ট করেছি। সে বরাবরই বলেছে “যেদিন আসবে সামনা-সামনি দেখিও”। আমি আর জোর করিনি। কে যেনো বলেছিল “হৃদয়ের দূর্বলতায় জোর করা বোকামী”। ঠিক যেনো তাই ভেবে আর পিড়াপিড়ি করা হয়নি।

প্রথম বার যখন দেখা করতে যাই ঢাকা টু পঞ্চগড় “দ্রুতযান এক্সপ্রেসে”। ট্রেনে থাকা অবস্থাতেই হুমায়রা এক ঘন্টা পরপর ফোন দিয়ে খোঁজ নিচ্ছিলো “কোথায় এখন? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?” ফোনের অপাশের মানুষটার কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছে ওদিকে ভীষণ অস্থিরতা। এই অস্থিরতার আভাস আমার যাত্রাপথের ক্লান্তিতে চলন্ত ট্রেনের জানালার পাশে এক পশলা নির্মল বৃষ্টির মত। হৃদয়কে শান্ত করে দেয়। দীর্ঘ ৬ ঘন্টা পর পড়ন্ত বিকেলে নাটোরে পৌছাই। স্টেশনে নামতে নামতে ফোন আসে আমি জিজ্ঞেস করি “কোথায় তুমি”?

→”টিকিট কাউন্টারের অপজিটে প্লাটফর্মে বসে আছি। কালো বোরকা পড়া মেয়েটা আমি।”

“ও আচ্ছা ঠিক আছে।” প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে দুজনে পাশের “….হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে” যাই। আমি ফ্রেশ হয়ে হুমায়রার অপজিট সিটে বসে তাকিয়ে থাকি। নিকাবের ফাঁকে দু’টো চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই ঠিকি,কিন্তু দীর্ঘ অস্থিরতা কেটে যে একটা প্রশান্তির আভা এসেছে তা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে কেঁদে ফেলে। আমি তাঁর চোখে স্পষ্ট জল দেখি। আমি টিস্যু এগিয়ে দেই লজ্জা পেয়ে মেয়ে মাথা নিচু করে জানতে চায় জার্নি পথে কিছু খেয়েছি কি না? আমি বলি “জার্নি পথে সাধারণত আমি কিছু খাইনা। আর ভাত ছাড়া অন্য খাবারে আমি তৃপ্তি পাইনা তা তুমি জানো।”

→”আচ্ছা এখন কি খাবে বলো?”
→ভাতই খাব আমি। তুমি কি খাবে?
→”হুম তিনবেলা ভাত ছাড়া আর কি কিছু খাওনা তুমি? আমি কিছু খাবনা, দুপুরে খেয়ে আসছি। তুমি বরং খেয়ে নাও আমি তোমার খাওয়া দেখবো।”

ভাত খাওয়া শেষ করে প্লাটফর্মে কিছুক্ষণ হাঁটিহাঁটি করি তাতে সূর্য ডুবতে শুরু করে। হুমায়রাকে সিএনজিতে তুলে দেই। হুমায়রা হিজাব মুখমন্ডল থেকে নামিয়ে দেয়। তাৎক্ষনিক আমার শরীর বিদ্যুৎ শক খায়। কয়েক মিনিটের দর্শনে আমার মনে হয় আমি উহাকে পাইয়াছি,সত্যি আমি উহাকে পাইয়াছি বহুকাল ধরে যাহা আমি চেয়েছি।
আমাদের প্রথম গোধুলী বিদায়ে আমার হাত ধরে অবুঝ শিশুর মত কেঁদে ফেলে মেয়েটা। আমার ভেতরটা নাড়া দেয় চোখেও জল আসে।

ঢাকা ফেরতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত প্লাটফর্মে বসে ভাবি এতো জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনকে হার মানায়। এ যেনো আমার সদ্য পাওয়া হুমায়রা। আমারে দু-দন্ড নয়,মুহূর্তে এক পৃথিবী সুখ দিয়েছে যে। এর পর কয়েক মাস পরপর নাটোর আসতাম দেখা করতাম। নাটরের চলনবিলের ডিঙিতে চড়ে বিশাল ঐ তেপান্তরে ঘুরে বেড়ানো। বিলের পদ্ম তুলে খোপায় গুঁজে দেওয়া। পাটুল এর মিনি কক্সবাজারে লোকাল স্টিমারে ঘুরাঘুরি। উত্তরা গণভবনে বসন্তের কোকিলের ডাকে কেটেছে অনেকগুলো বিকেল। অতপর আমার অনার্স শেষ হয় কোম্পানিতে জব নেই। এবং আমরা সামান্য সাড়ে চার বছর প্রেম করার পর বিয়ে করে ফেলি।

বিয়ের কিছুদিন পর হুমায়রার মাঝে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়। সারাদিন অফিসে কাজ করে ক্লান্তি নিয়ে ফিরে একটু হাসিমুখে গল্প করতে চাই। তখনি গোমড়া মুখে উল্টাপাল্টা কথা বলে খোঁচা দেয়। রাতে ভাত রান্না করেনা,এমনকি সকালে অফিস যাওয়ার পথে টিফিনে ভাত রান্না করে সাঁজিয়ে না দিয়ে পরোটা বা রুটি দেয়। যে মানুষটা তিন বেলা ভাত ছাড়া আমার চলেনা সে মানুষটার কপালে তিন বেলা রুটি! এমনিতে হ্যাংলা পাতলা মানুষ। আর বিয়ের পরের দূর্বলতায় শরীরের অবস্থা মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছিলনা। মাঝে মধ্যে আমারও প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হতো। আমি ভীষণ বোকা দিতাম। কিন্তু আজ একদম গালে কষে চড় বসিয়ে দিয়েছি। যদিও আমি এরকম কিছু করতে চাইনি। রাগ নিয়ন্ত্রন করতে পারিনি। আর তখনি হুমায়রা বলে বসলো “ডিভোর্স চাই”।

এতে অবশ্য দুজনেই খুশি। বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে ট্রেনে তুলে দিতে যাচ্ছি হুমায়রাকে। দেখে মনে হচ্ছে আজ বেশ খুশি। বাড়ি থেকে দুই কিলো রাস্তা স্টেশনের পথ। স্টেশনে গিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে সিটে বসিয়ে দিয়ে চলে আসি। ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে অবশ্য আরও ৩০ মিনিট বাকি। তারপরও আমি বাড়ি চলে আসি।

বাড়িতে ঢুকতেই দেখি বাড়িওয়ালা দাদিমা আর দাদুর ঝগড়া। মেজাজটা আরও বিগড়ে গেলো। বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা লোকমান চাচার মুদির দোকানে গেলাম। চাচাকে বললাম একটা হরিণ বিড়ির প্যাকেট দিতে আর একটা দিয়াশালাই। লোকমান চাচা আবার জানতে চাইলো আসলে আমি কি চাই? আবার বলি হরিণ বিড়ি আর দিয়াশালাই। চাচা কেমন করে যেনো তাকালো। তারপর হাতে দিলো। বিড়ির প্যাকেট হাতে বেঞ্চে বসে মাথা নিচু করে বসে আছি। ততোক্ষণে বাড়িওয়ালা দাদু আমার পাশে এসে বসেছে। আমাকে ধাক্কা দিয়ে হাত থেকে বিড়ির প্যাকেটটা নিয়ে বলে “ঐ মিয়া কেডা দিলো বিড়ির প্যাকেট”?

আমি বলি “আমিই কিনলাম দাদু”। দাদু হাত থেকে দিয়াশালাইসহ নিয়ে হাহাহা করে হাসতে থাকলো। বিড়িতে আগুন দিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়াটা আকাশের দিকে ছেড়ে দিয়ে বলল “তুমি মিয়া কিনবা বিড়ি? তুমি কবে থ্যাইকা বিড়ি খাইতে শুরু করলা হুনি”? আমি কিছু না বলে দাদুর হাত থেকে জ্বলন্ত বিড়িটা নিয়ে দিলাম এক টান। সাথে সাথেই খকখক করে কাঁশতে শুরু করলাম। আসলে আমি সাধারণত ধূমপান করিনা। আর এই কম দামি বিড়িতে মুখে টানার দিকটাই ফিল্টারটা দূর্বল হওয়ায় নিকোটিন সরাসরি কণ্ঠস্বর হয়ে তীব্রভাবে হার্টে আঘাত করে। ফলে এটা কড়া নেশার মত উপদ্রব হয়।

→”আচ্ছা আবির এতো হকাল হকাল বউকে কনে রাইখ্যা আইসলে?”
→”বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম, ডিভোর্স দিয়ে দিব দাদু।”

দাদু চমকে গিয়ে বিসম্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকায় “আচ্ছা হুনছিলাম ভালোবাইসা বিয়া করছো নাকি! তয় অহন এমন হইলো ক্যারে মিয়া”?

→”দাদু আর বইলো না,যেটুকু সময় বাসায় থাকি ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে।”

দাদু মুচকি হেসে বলল, “বোকা ছইল মিয়া তোমার দাদি আমার লগে কেমন সব সময় ঝগড়া করে, একটা বিড়িও শান্তি মত খাইতে দিবার চায়না। হেইগুলা আর খাইলে নাকি বাড়িতে ঢুকতে দিতো না! তো কই ৪২ বছরের সংসার জীবনে তো কহোনো ছাড়াছাড়ির কথা মাথায় আনি নাই। আসল কথা হইলো গে মাইয়া মানুষ একটু ত্যাড়া ওগো ওসব কথায় কান না দিয়ে বুঝাইতে হইবো। আরে মিয়া ঐ সব ঝগড়ার মাঝেও ভালোবাসা আছে অহন বুঝবা না, দু একটা দিন গেইলেই বুঝবা ঐ ঘ্যানঘ্যানানি কত ভালা আছিল।”

টঙ দোকান থেকে উঠে ফটাফট দাদুর বিড়ি টানার কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। বাসার দিকে দৌড় দিলাম আর পেছন ফিরে দাদুকে বললাম “দাদু তুমি বিড়ি খাচ্ছো দাদিকে ছবিগুলো দেখাবো সব।”
বাসা থেকে জয়দেবপুরের শিহাব ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম “ভাই কোথায় তুমি?”

→ “জয়দেবপুরে শিশুর জন্য আমরা সংগঠনের কার্যক্রমে আছি।”
আমি বলি “আচ্ছা তোমার ভাবি রাগ করে বাবার বাড়ি যাচ্ছে তো। একতা এক্সপ্রেস কি জয়দেবপুরে পৌছেছে?”
→”না ভাই এখনো আসেনি।”
→”আচ্ছা শুনো, ঞ বগির ১২/১২ W সিটে তোমার ভাবি আছে। তোমার ভাবি তো তোমাকে চিনে ট্রেন জয়দেবপুরে ঢুকলে গিয়ে বলবা “আবির ভাই এক্সিডেন্ট করছে একটু আগে ফোনে জানতে পারলাম।” আর আমি আসতেছি জয়দেবপুরে।

→”আচ্ছা ভাই ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।”

স্টেশনে গিয়ে দেখি হুমায়রা প্লাটফর্মে বসে কাঁদছে। আমি পেছন থেকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দেই। পিছনে ঘুরে আমাকে দেখতে পেয়ে উঠে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বুকে কিল ঘুষি মারতে থাকে অতপর এতোকিছুর জন্য স্টেশনে শত মানুষের মাঝে কান ধরে উঠাবসা করতে বলে।

আমি কান ধরে বসতে যাব এমন সময় খপ করে হাতটা ধরে টান দিয়ে বলে “এরে পাগল হয়েছে এতো লোকের মাঝে কি আমার স্বামীকে অপমানিত করবো আমি? ব্যাগ নাও কাঁধে চলো,বাড়ি চলো বিপাশা হাওলাদারের কণ্ঠে কবিতা আবৃতি শুনেছিলাম “ভালোবাসা রং বদলায়”। আসলে আমার মনে হয় ভালোবাসা রং বদলায়না,বরং আমাদের ভালোবাসা দেখার চোখ দু’টো উল্টো হয়ে থাকে। যে কোনো সম্পর্কের বিচ্ছেদের আগে আমাদের আগে একটু সময় নেওয়া দরকার। একে অপরের প্রতি আগ্রহ ভালোবাসাটা উপলব্ধির জন্য একটু একা থাকা প্রয়োজন। তাহলে পাশের প্রিয় মানুষটার শূণ্যতা বুঝতে পারবো। আর এভাবেই বিচ্ছেদ শব্দটা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে,ভালোবাসাগুলো জীবন্ত হোক অনন্তকালের জন্য।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত