নাবিলার শ্বশুর বাড়িতে রমজানের ইফতার সামগ্রী নিয়ে বাবা মা এবার আমাকে পাঠালো।নাবিলা আমার ছোট বোন।
যেতে যেতে বিকেল হয়ে যাওয়ায় নাবিলার জামাই,শ্বশুর শাশুড়ী আমাকে আর আসতে দেয় নি ইফতারের আগে। লুবনা কল দেয় এরইমধ্যে আমাকে,লুবনা আমার স্ত্রীর নাম
আমিঃ আমি ইফতারের পরে আসবো,তুমি সব কিছু রান্না শেষ করেছো তো??
লুবনাঃ না এখনো শেষ হয় নি সব,এই তো করছি।
আমিঃ তুমি সব কিছুতে এতো স্লো কেনো লুবনা??? কিছুক্ষণ পরেই আজান দিবে,তোমার আলুর চপ হইছে??
লুবনাঃ এইতো চুলাই দিবো এখন বেগুনি ভাজা হইছে মাত্র।
আমিঃ শুনো,বাবার কিন্তু পায়েস পছন্দ, রান্না শেষ করে ইফতারের পরে একটু চট করে পায়েস করে দিও বাবাকে।
লুবনাঃ ঠিক আছে দিবো।
আমিঃ আর শুনো মায়ের জন্য কিন্তু লেবুর শরবত আর বাবার জন্য ট্যাং বানাবা।মনে থাকে যেনো।
আজকে যা গরম পড়েছে এক সুযোগে ওনাদেরকে একটু লাচ্ছি বানিয়ে দিও।
লুবনাঃ আর কিছু লাগবে??
আমিঃ এভাবে কথা বলছো কেনো আর কিছু লাগবে মনে হচ্ছে যেনো কাজ করতে করতে তুমি দম ফেলার সময় পাও না???
লুবনাঃ না তা না,জিজ্ঞেস করছি তোমার জন্য কিছু বানানো লাগবে কিনা তাই।
আমিঃ এইটুকু করেই মুখ অন্ধকার করে রাখো তোমাকে আর বেশী কিছুর কথা কি বলবো,আমার জন্য কিছু লাগবে না তোমার করা।
বলেই ফোন কেটে দিলাম। অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি,আসার পর থেকে নাবিলার সাথে দেখা হয় নি একবারও।
নাবিলা আমার আদরের ছোট বোন,সেই ছোটবেলা থেকে ওর প্রতিটি কষ্টের অংশীদার আমি ছিলাম। সেই বোনটা আজ কতো বড় হয়ে গেছে ভাবতেই অবাক লাগে।বাড়িতে কখনো নাবিলাকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে দিই নি বাবা মা আমি। লুবনা কে বিয়ে করে আনার পর থেকে লুবনাই ছিলো নাবিলার সবকিছুর সঙ্গী। দুজনের খুব ভাব ছিলো।
অনেকক্ষণ ধরে নাবিলা কে দেখতে না পেয়ে নিজেই গেলাম কিচেনের দিকে। গিয়ে দেখি নাবিলার ২ হাত ভর্তি কাজ,যেই ছোট বোনকে কখনো ১ গ্লাস পানি ঢেলে খেতে দিই নি,খাওয়ার পর প্লেটের পানি ফেলতে দিই নি,সে আজকে এক সংসারের কাজ সামাল দিচ্ছে। আমার কেনো জানি চোখ ঝাপসা হয়ে এলো,আমার পিচ্চি বোনটা আজ কতো বড় হয়ে গেছে। নাবিলা আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
নাবিলাঃ আরে ভাইয়া তুমি এখানে কেনো,যাও গিয়ে বস,ইফতারের পর কথা বলবো তোমার সাথে। এখন একটু ব্যস্ত আছি।
আমিঃ কেনো তুই এসব করছিস,তোর জামাইকে বলতে পারিস না তোকে কি এখানে কাজের মেয়ে পাঠিয়েছি নাকি???
নাবিলা মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো তখনি ওর ননদ সুমাইয়া ডেকে বললো,”ভাবী আমার জন্য হালিম বানাতে ভুলো না যেনো”
নাবিলাঃ না ভুলবো না এইতো এখনি বানাবো। আমি অবাক হয়ে গেলাম,ওই মেয়ের সাহস হয় কি করে আমার বোনকে হুকুম করে!!!
রাগে আমার হাত পা জ্বলতে লাগলো।
আমিঃ আমার তোর সাথে জরুরি কথা আছে,ইফতার করে নামাজের পর আমার কথা শুনবি আগে
নাবিলাঃ আচ্ছা শুনবো ভাইয়া,যাওতো এবার জিরিয়ে নাও একটু।
রাগে আমার মাথা গরম হয়ে আছে। আজানের আগে লুবনা আবার কল দিলো,কি করি আমি,নাবিলা কি করে জানার জন্য,এমনিতেই মেজাজ গরম তার উপর লুবনার কল পেয়ে আরো রাগ উঠে গেলো।
আমিঃ তোমার মতো কি পটের বিবি সেজে বসে থাকে নাকি আমার বোন,নাকি তোমার মতো এতো অবসর ওর,সারাদিন কাজ বাদ দিয়ে ফোন নিয়ে বসে থাকবে??
লুবনাঃ আমি আসলে তোমাকে বিরক্ত করতে ফোন দিই নি,আলুর চপ বানাতে গিয়ে হাতে গরম তেল আসছে,ডান হাত অনেকটা পুড়ে গেছে আসার সময় মনে করে একটা মলম এনো আমার জন্য। লুবনার এই কথা আমার রাগ আরো বাড়িয়ে দিলো।
আমিঃ সামান্য একটা কাজ ও যদি তোমাকে দিয়ে হতো লুবনা,সারাদিন তো এই পারো,কাজের ভয়ে নিজেই এসব অযুহাত তৈরী করে নাও,তোমার সাথে কথা বলতেই আমার ইচ্ছে করে না এখন।
বলেই ফোন কেটে দিলাম। আজানের পর ইফতার করে নামাজ পড়ে নাবিলার রুমে আসলাম।আমার আদরের বোনকে এই বাড়ির কাজের মেয়ে বানানো হয়েছে তার একটা বিহিত করতেই হবে আমাকে।
নাবিলাঃ বলো ভাইয়া বাসার সবার কি অবস্থা মা বাবা ভাবী কেমন আছে।
আমিঃ মা বাবা ভালো আছে,তোর ভাবী কল দিয়েছে একটু আগে হাত পুড়িয়ে ফেলেছে জীবনে যদি একটা কাজ পারে ও ঠিক মতো নাবিলা কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
আমিঃ তোদের বাসায় কাজের মেয়ে নেই কেনো,কেনো তোকে দিয়ে এসব কাজ করানো হয়,তুই আমাকে কেনো বলিস নি আগে??
নাবিলাঃ কি বলবো ভাইয়া আমার তো সব কিছু করা লাগে না আমার কাজে তো আমার জামাই সবসময় হেল্প করে আমরা ২ জন মিলেই রান্না করি। আজ তুমি আসছো বলেই তোমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য আমি নিষেধ করেছি আসতে।
আমিঃ তোর ননদ তো বড় হয়েছে,ও তো পারে তোর সাথে কাজ করতে,ও কেনো তোকে হুকুম দেয়???
নাবিলাঃ কষ্ট হয় তোমার খুব আমার এই কষ্ট দেখে তাই না ভাইয়া??
আমিঃ তোকে বুঝাতে পারবো না রে বোন,বুকের ভিতর কেমন ব্যথা হয়।
নাবিলাঃ ভাইয়া একবার ভেবে দেখেছো কি কখনো ভাবীও কিন্তু বাসায় এই কাজগুলো নিজেই করে,যখন আমি ছিলাম তখন আমার কাজ ও ভাবী করে দিতো। ভাইয়া,ভাবী ও তো কারো বোন,কারো মেয়ে,কখনো কি আমার জায়গায় ভাবীকে দাঁড় করিয়ে ভেবেছো ভাবী ও কারো কাছে কতো আদরের?? অথবা ভাবীর জায়গায় আমাকে দাঁড় করিয়ে দেখেছো কি,আমার কাজ গুলো প্রতিনিয়ত ভাবী করে যায়???
আজ আমাকে বলছো আমার ননদ সুমাইয়া কেনো আমাকে সাহায্য করে না,মনে আছে ভাইয়া,একদিন আমি শখ করে নুডলস রান্না করতে গেছিলাম,কিন্তু তেল পুড়িয়ে ফেলেছি,তেল ছিটকে আমার হাতে এসেছিলো আর তোমার সেকি কান্না,তুমি ভাবীকে চড় মেরেছো সেদিন কেনো ভাবী আমাকে রান্না ঘরে পাঠিয়েছে। সেদিন ভাবী পাঠায় নি আমি নিজেই গেছি তোমাকে বলার পরেও তুমি ভাবীকে কম কথা শুনাও নি। আমার প্রতিটি কাজে আমার স্বামি আমাকে সাহায্য করে কখনো কি তুমি ভাবীর একটা কাজে সাহায্য করেছো???
প্রতিদিন যে ভাবীকে এটা করো ওটা করো বলো,কখনো কি ভেবে দেখেছো,তুমি যেমন রোজা রেখেছো ভাবী ও তেমন রোজা রেখেছে,সারাদিন চুলার পাশে থেকে ভাবীর ও কষ্ট হয়,তুমি কি তাকে বলেছো তুমি সরো আজ আমি করছি??? রোজার কষ্ট কি তুমি একা পাও নাকি ভাবী ও পায়???
আমি কি বলবো,লজ্জায় মাথা তুলতে পারছি না। আসলেই তো। কখনো তো এভাবে ভেবে দেখি নি, স্ত্রী তো স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী,কিন্তু কই,তার ব্যথায় তো আমি কখনো ব্যথিত হই নি,তার কষ্ট কখনো আমাকে ছুয়ে যায় নি,পাশাপাশি শুয়ে থেকেও কখনো বুঝতে পারি নি কি হাহাকার ওর বুকের ভিতর। নিজেকে খুব অমানুষ মনে হয় আজকে। তখনি নাবিলার জামাই নিহাদ রুমে আসে কফি নিয়ে,এনে ২ মগ আমাদের দেয়।আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে
নিহাদঃ নাবিলার কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে,আমিই তাই বানিয়ে আনি ওর জন্য,আমার খুব ভাল্লাগে।
নাবিলাঃ তোমরা বসো আমি গিয়ে প্লেট গুলো ধুঁয়ে আসি।
নিহাদঃ তা করা লাগবে না,আমি সব ধুঁয়ে মুছে রেখে এসেছি তোমরা ভাই বোন মিলে গল্প করো।আমাকে যদি কাবাবে হাড্ডি মনে হয় তো বলো আমি পাশের রুমে যাই
আমিঃ না না থাকো তুমি।
নিহাদঃ না আপনারা গল্প করেন আমি যাই।সেহেরির জন্য রান্না করা লাগবে একটু পর,গিয়ে সব রেডি করি।আপনি কিন্ত আজ যেতে পারবেন না ভাইয়া আগেই বলে রাখি। নিহাদ চলে গেলো। নাবিলা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।আমি জানি সেই হাসির মাঝে মিশে আছে আমার জন্য নিরব তিরস্কার। দেরি না করে তখুনি বাসায় গেলাম,লুবনা কে দেখলাম পোড়া হাত নিয়ে রান্না ঘরে পায়েস বানাচ্ছে।
আমিঃ এই নাও,হাত দাও মলম লাগিয়ে দিই
লুবনাঃ এখন রাখো,ঘুমানোর আগে লাগাবো,এখন কাজ আছে একটু,তোমার কিছু লাগবে,চা??
আমিঃ না,আমার এখন তোমাকে লাগবে।
বলেই লুবনাকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে এলাম। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হাতে মলম লাগিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকতে বললাম।
আমিঃ আজ না হয় তোমার কাজ আমি করে দেখি প্রতিদিন তুমি কতো কষ্ট করো।বাবার জন্য পায়েস আজ আমিই রান্না করবো। এখন থেকে তোমার সব কাজে পাশে থাকবো প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী।