ফেরা

ফেরা

ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করতেই আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ভীষণ রকমে অবাক হয়ে গেলে মানুষ যেভাবে স্তব্ধ হতে পারে ঠিক তেমন। উপচে পড়া খুশিতে চোখের কোণে চিকচিক করে উঠলো জলেরা। রেহানের একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরি হয়েছে। ওর ইচ্ছে ছিল ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরি করবে।

উপরওয়ালা ওর ইচ্ছেটা অবশেষে পূরণ করলো। কিন্তু এই কথাটা রেহান আমাকে একবার জানালো না! হয়তো ব্যস্ত ছিল, ইচ্ছে থাকলেও কখনও কখনও সময় হয়ে ওঠেনা। যাই হোক আমিই বরং রেহানকে একবার কল দেই।
রেহানের নাম্বারে কল করতেই দেখি ওয়েটিং। হয়তো ব্যস্ত আছে, সবার সাথে কথা বলছে। আমি বরং এবার খবরটা সবাইকে দেই। রিমা, লুবনা, সাহানা, আকিবসহ একে একে সবাইকে খবরটা জানালাম। সবাই বেশ খুশি। সবার এক কথা খাওয়াতে হবে। আমি বললাম, ‘আচ্ছা! আচ্ছা! অবশ্যই খাওয়াবো।’

মা’কে একবার জানানো দরকার। খুব খুশি হবেন। তার আগে ফেসবুকে গিয়ে একটা মেসেজ করে রাখি রেহানকে। খুশি হবে দেখলে। ফেসবুকে ঢুকতেই দেখি রেহানের পোস্ট। দুই মিনিট আগে দিয়েছে। বন্ধু বান্ধবী নিয়ে রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে। কি মনে করে যেন রেহানের চাকুরির পোস্টটা আবার খেয়াল করে দেখতেই দেখি পোস্টটা গতকাল রাতের। আর এখন বাজে দুপুর দুইটা ত্রিশ মিনিট। পোস্টের কমেন্টগুলো ভালো করে লক্ষ্য করলাম। জানতে পারলাম রেহান চাকুরির কনফার্মেশন লেটার পেয়েছে বিকেলে। আমার ভেতরটাতে কেমন যেন একটা করে উঠলো। কেন যেন মনে হচ্ছে অনেক কিছু গড়মিল হয়ে গেছে। খুশির জলের পরিবর্তে দু’চোখে এখন স্থান পেয়েছে একটা অজানা ভয়ের সঙ্কা। এমন কেন মনে হচ্ছে জানিনা। মনকে খুব শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম।

হাত থেকে ফোনটা রেখে দিলাম। রেহান চাকুরীর খবর পেয়েছে গতকাল বিকেলে। এখন প্রায় একদিন হতে চললো। অথচ একটা বার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না। রেহান আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছে অন্য কোনো ভাবে? মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না যে বিষয়টা কঠিন নয় সহজ। আমি রেহানকে কল দিলাম। রিং হলো কিন্তু রিসিভ হলো না। বেশ কয়েকবার কল করে ফোনটা রেখে দিলাম।

রেহানের সাথে আমার সম্পর্ক চার বছর শেষ হলো। রেহানকে আমি চিনি সম্পর্কের আরও দুই বছর আগে থেকে। তখন আমি সবে মাত্র কলেজের ছাত্রী। বয়সে আমার চার বছরের বড়। পরিচয়ের সুত্রপাত হয় একটা বিয়ে বাড়িতে। আমাদের সম্পর্কটা অনেকের মত ভালো বন্ধুত্ব থেকেই গড়িয়েছে প্রেমে। খুব ভালোবাসি আমরা একে অপরকে। প্রথম অবশ্য আমি রেহানকে পাত্তা না দিলেও, শেষে এসে কিভাবে যেন প্রচন্ড দূর্বল হয়ে পরি। আমাকে না জানিয়ে প্রায়ই হুটহাট রেহান আমার ভার্সিটির গেঁটে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি বড় বড় চোখ করে তাকাতেই বলতো, ‘খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আইসক্রিম তো তোমার অনেক পছন্দ। তোমাকে রেখে কিভাবে খাই, তাই চলে এলাম। চলোনা আইসক্রিম খাই।’

আবার কখনওবা হাতে এক প্যাকেট পপকন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলতো, ‘রাস্তায় দেখলাম গরম গরম পপকন ভাঁজছে। তুমি খেতে পছন্দ করো, তোমার কথা মনে হলো। তাই নিয়ে চলে এলাম।’
আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারতাম পপকন, আইসক্রিম এগুলো শুধুই বাহানা মাত্র। রেহান আসলে আমাকে দেখার জন্যই এখানে আসে। আমাদের পরিচয় থেকে এখন পর্যন্ত আমরা রেস্টুরেন্টে খুব কমই বসেছি। কারন আমিই চাইতাম না বেকার রেহানের উপর কোনো ধরনের চাপ পরুক। আমাদের প্রেম হতো নদীর ধারে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, রেহানের হাত ধরে রেল লাইনের রেলিংয়ের উপর হাঁটার চেষ্টাবস্থায়, টংয়ের দোকানে, ভার্সিটির সামনে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকাতে, আইসক্রিম খেতে খেতে, বাদাম ছুলতে, কফির মগে, এক প্যাকেট পপকনে, তেলে ভাজা খেতে খেতে, ফুসকা চটপটি কিংবা ঝালমুড়িতে, রিক্সায় পাশাপাশি বসাতে।

আমাদের খুব বেশি দেখা হওয়ার সুযোগ না থাকলেও। সবার চোখ লুকিয়ে মাঝে মাঝে ঠিকই সময় বের করে নিতাম। অনেকদিন যখন হয়ে যেত তখন রেহান নানা বাহানা খুঁজতো দেখা করার জন্য। ‘অনেক দিন পেয়ারা মাখা, চানাচুর মাখা খাওয়া হয় না।’ রেহানের এমন কথাতেই আমি বুঝে নিতাম ওর আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। যখন বলতাম, ‘তুমি কি কেবলই পেয়ারা মাখা, চানাচুর মাখা খাওয়ার জন্য এখানে এসেছো?’

রেহান খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতো, ‘একদমই নাহ্! তোমাকে দেখার জন্যই এসেছি।’
রেহানের মুখ থেকে এই কথাটা শুনতে আমার বেজায় ভালো লাগতো। আমি ইচ্ছে করেই ওর মুখ থেকে কায়দা করে কথাটা বলিয়ে নিতাম। তারপর নিজেই লজ্জা পেয়ে হেসে দিতাম। সন্ধ্যায় রেহান নিজ থেকে কল করেছে। আমি ফোনের কাছে থাকার কারনে কল আসার সাথে সাথেই রিসিভ করে ফেললাম। ‘কল করেছিলে আমি আজ ভিষণ ব্যস্ত ছিলাম। রিসিভ করতে পারিনি।’ রেহানের কথা শুনে মনে হলো ও কেবলই ওর দায়বদ্ধতা থেকে কল করেছে। প্রতিত্তোরে বললাম, ‘কি করো? আর কোথায় ছিলে সারাদিন?’

‘এই তো বাসায় এসেছি মাত্র, এখন ফ্রেশ হবো। সারাদিন বাহিরে ছিলাম।’
‘ফ্রেশ হয়েই কল দিতে।’
‘নাহ্ তুমি বলো, কিছু বলবে? আমি ফ্রেশ হয়ে আবার বাহিরে বের হবো। সজীবের বাসায় যাবো’
‘তোমার চাকুরীর কথাটা আমাকে একবার বললে না কেন?’
‘মনে ছিল না আমার আসলে।’
‘মনে ছিল না! রেহান এটা কি কোনো অজুহাত হতে পারে?’
‘দেখ তৃষ্ণা আমি খুব ক্লান্ত। এই মুহূর্তে তোমার সাথে তর্ক করার মত ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই আমার নেই।’
‘আমি তোমার সাথে তর্ক করি নি রেহান।’
‘আমি রাখছি।’

আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা রেখে দিল রেহান। আমি তারপর বেশ কয়েকবার কল করেছি। ও কয়েকবার কেটে দিয়ে ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। রেহান বেশ কয়েকদিন ধরে আমার সাথে স্বাভাবিক আচারন করছে না। কিছু একটা বললেই খুব রেগে যায়, আবার কি হয়েছে জানতে চাইলে এড়িয়ে যায়। এতদিন আমি বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখি নি। ভেবেছি চাকুরি হচ্ছে না, হয়তো তাই মেজাজ বিগড়ে থাকে। চাকুরিটা পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে৷ টেনেটুনে সম্পর্কটাকে আমিই ঠিক রেখেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিষয়টি আসলেই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রেহানের ব্যবহার আমাকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে যাচ্ছে। কি হয়েছে আসলে ওর?

বাড়ি থেকে বেশ কয়েকবার আমার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা হয়েছিল। নানা অজুহাতে একটার পর একটা বিয়ে ভেঙ্গে দিতাম রেহানের সাথে সংসার বাঁধার স্বপ্নে। শেষমেশ একদিন মায়ের কাছে ধরাও পড়ে যাই। বাধ্য হয়ে রেহানের কথা বলে দিই। বাসায় কেউ রাজি নয়, ছেলে বেকার কবে চাকরি পাবে তার খবর নেই। এতদিন তাঁরা আমাকে ঘরে বসিয়ে রাখবে নাকি! তাছাড়া বেশ ভালো সম্বন্ধ আসছে, এগুলো হাতছাড়া করলে পরে পচঁতাতে হবে। এধরনের বিভিন্ন কথাকে উপেক্ষা করে, সবাইকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে থামিয়ে রেখেছি রেহানের জন্য। রেহানকে বাবার একদমই অপছন্দ, তবুও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিয়েছেন তিনিও। মা তো এখন প্রায়’ই রেহানের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে থাকে। রেহানের উপরে যেন কোন চাপ সৃষ্টি না হয় তাই সব ঝামেলা আমি একাই সামলিয়েছি। প্রথম প্রথম পরিবারের সবাই বেশ কথা শোনাতো রেহানের জন্য। আমি সে সব ভুলে যেতাম, যখন রেহানের সাথে আমি আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুরু করে দিতাম।

ইদানীং রেহানের এমন পাল্টে যাওয়া ব্যবহারে কষ্ট পেলেও মনের কোণায় একটা আশার আলো পুষে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, রেহান হয়তো আমাকে সারপ্রাইজ দিবে তাই এমনটা করছে নাটকের মত। কিন্তু না, আমি আসলে ভুল ছিলাম। রেহানের এমন এড়িয়ে চলা আচারণ আমাকে দিন দিন হতাশ করে তুলছে। আমি বুঝতে পারলাম আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হতে চলছি। উপায় না পেয়ে রেহানের সাথে সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে রাজি হলো না। কথায় কথায় ঝগড়ার দিকে এগিয়ে যায় আমাদের কথপোকথন। শেষমেষ আমার সাথে রেহান সব জায়গা থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল।

আমার ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো। চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার মত অনুভূত হলো। মনে হচ্ছে আমি একা, আমি ভীষণ একা। বাধ্য হয়ে আমি রেহানের বন্ধুর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু সেখান থেকেও আমি কোনো ধরনের পরামর্শ পেলাম না। এত কিছুর পরেও কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে এসবই ক্ষনিকের। খুব শিঘ্রই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। রেহান আমাকে ছেড়ে থাকতেই পারে না। কিন্তু এগুলো আদৌও সত্য নাকি মনের সান্ত্বনা আমি এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছি না।

অথচ একটা সময় রেহান আমাকে সবসময় সাহস দিত। বলতো, একদিন দেখবে আমরা মিলেমিশে খুব ভালো থাকবো৷ আর তখন পরিবারের সবাই খুব খুশি হবেন। মাঝে মধ্যে রেহান আচমকা আমার দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলতো, ‘তৃষ্ণা ছেড়ে যাবে না তো কখনও? খুব ভালোবাসি তোমাকে। ছেড়ে গেলে আমি ডুবে যাব, একদম অন্ধকারে ডুবে যাব।’ আমি মুচকি হেসে উঠলে রেহান বলতো, ‘হেসো না। সত্যিই আমি পাগল হয়ে যাব, তুমি চলে গেলে।’ আমি যখন বলতাম, ‘আমি তোমাকে কখনও ছেড়ে যাব না। বিশ্বাস রাখো আমার উপর। আর তোমাকে ছেড়ে আমিও বা থাকবো কি করে!’

রেহান তখন আমার হাত দু’টো ঠোঁটের কাছে নিয়ে আলতো করে চুমো খেত। রেহান আমার পাঁচ আঙুলের ফাঁকে ওর পাঁচ আঙুল রেখে বলতো, ‘তোমার আঙুলগুলো তৈরিই হয়েছে আমার আঙুলের জন্য।’ আমি শুধু হাসতাম। কিছু বলতাম না। রেহানের মত আমি আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারতাম না। কিন্তু রেহান ঠিক বুঝে নিত, আমি ওর প্রতি কতটা দূর্বল। আমার মন খারাপ থাকলে কখনও রেহানকে বলতে হত না। ও কিভাবে যেন ঠিক বুঝে নিত, সেটা হোক সামনাসামনি বা ফোন কলে কিংবা মেসেজে। জিজ্ঞেস করতো, ‘কি হয়েছে স্বেচ্ছায় বলবে নাকি আমার বলাতে হবে?’

পার পাবো না জেনেও কতক্ষন ওকে জ্বালাতাম তারপর ঠিকই বলতে হত। রেহানের অস্বাভাবিকতাও আমি টের পেতাম। ও আমার কাছে কিছুু লুকাতে চাইলে আমি বুঝে ফেলতাম। একজন যখন অন্যজনকে খুব ভালোবাসে তখনই একজন অন্যজনের সবকিছু খুব সহজেই বুঝে ফেলার ক্ষমতা অর্জন করে।

ভার্সিটি থেকে বের হবো ঠিক তখন দেখি রেহান ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে। আমি দূর থেকেই ওকে দেখে নিয়েছি। কেননা প্রত্যেকদিনই আমি রেহানকে আমার ভার্সিটির গেঁটে খুঁজি। মনের ভেতর কেমন যেন একটা আঁতকে উঠলো। আমি সেটা গুরুত্ব না দিয়ে বেশ খুশি হয়ে উঠলাম। নিশ্চিত রেহান কোনো সারপ্রাইজ দিবে, এই জন্যই এতদিন আমাকে এতটা কষ্ট দিয়ে পরখ করে নিল। এক মুখ হাসি নিয়ে রেহানের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বললো, ‘তোমার ফোন অফ ছিল। তাই বাধ্য হয়ে এখানে আসতে হলো। চলো একটা রেস্টুরেন্টে বসি। কথা ছিল।’
আমি কথার উত্তর না দিয়ে রেহানের সাথে রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখি বন্ধ হয়ে রয়েছে ফোনটা।

রেস্টুরেন্টে সামনাসামনি বসে আছি আমরা দু’জন। রেহানকে বেশ সুন্দর লাগছে। অনেক বেশি স্মার্ট। সেই বিয়ে বাড়ির থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম। সুট কোর্ট, টাই, পায়ে দামি সু, চুলে জেল, হাতে দামি ঘড়ি সব মিলিয়ে ভীষন সুন্দর।
‘কি খাবে?’ ‘কিছুই খাবো না। তুমি না বললে কি কথা আছে বলো।’ তারপর খানিকটা নিরবতা যাপন করে রেহান বললো, ‘তৃষ্ণা আমি আমাদের সম্পর্কটাকে এখানে থামিয়ে দিতে চাই। আমি চাইনা আর আমরা এগোই।’

রেহানের কথাগুলো আমার কানে আগুনের ফুলকির মত প্রবেশ করলো। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেনো? আমার কোনো দোষ ?’ ‘তোমার দোষ নেই। আমার পরিবার চায় আমি আমার কাজিন শায়লাকে বিয়ে করি। আর এটাই তাঁদের শেষ মতামত।’ আমার ভেতরে কেউ একজন মনে হলো খুব শক্তি দিয়ে জোরে একটা ধাক্কা দিল। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি চাও?’

‘দেখ মা বাবার দোয়া ছাড়া আসলে জীবনে আমরা সুখি হতে কখনোই পারবো না। তাই বাবা মায়ের অমতে গিয়ে এমন কিছু করতে চাই না আমি।’ চোখের জলগুলো আঁটকে রেখে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘বিয়ে কবে?’ আমার এমন প্রশ্নে বেশ হতভম্ব হয়ে গেল রেহান। আমতা আমতা করে অপরাধীর মত উত্তর দিল, ‘বাগদান গতকাল হয়ে গেছে। আর বিয়ে আগামী মাসে।’ এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আমি সবথেকে বেশি অসহায়। আমি রেহানকে ‘শুভ কামনা’ বলেই রেস্টুরেন্ট থেকে চলে এলাম জরুরী কাজের বাহানা করে।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সোজা নদীর তীরে চলে এলাম। নদীর কাছে এলে একসঙ্গে অনেক কিছু পাওয়া যায়। পানি, বাতাস, আকাশ, মেঘ, নীরবতা। এই জন্যই নদী আমার ভীষণ পছন্দ। রেহানের বলা প্রতিটি কথা কানে বাজছে। তাহলে সজীব ভাইয়ের কথা সত্যি ছিল। সজীব ভাইয়ার থেকে জেনেছিলাম রেহানের নাকি শায়লার সাথে একমাস ধরে কথা হয়।

শায়লার প্রতি রেহানের আকর্ষণ ছিল আমি ওর জীবনে আসার আগেই। কিন্তু শায়লা পাত্তা না দেওয়ায় রেহান আমাকে নিয়ে সিরিয়াস হয়। কিন্তু এক মাস আগে শায়লা নিজেই রেহানের সাথে যেচে পড়ে যোগাযোগ করে। তারপর থেকে নিয়মিত যোগাযোগ আর এখন রেহানের চাকুরী পাওয়ার পর শায়লা পারিবারিকভাবে বিয়ের কথপোকথনের দিকে এগোচ্ছে। শায়লার প্রতি রেহানের আসক্তির কারন হিসেবে রেহান যেটা প্রকাশ করেছে তা হলো শায়লা অনেক মেধাবী এবং বুদ্ধিমতী। আর তাছাড়া শায়লা আর রেহান সমবয়সী। রেহানের ধারণা আমার থেকে শায়লাকে বিয়ে করলে রেহানের সংসার জীবন ভালো হবে। নিজেদের ভেতর বোঝাপড়াটা মজবুত থাকবে।

এসব কথা সজীব ভাইয়া একদিন নিজ থেকেই বলে আমাকে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় নি। ভেবেছি হয়তো সজীব ভাইয়া মিথ্যে বলছে, নয়তো রেহান তাঁকে এসব বলতে শিখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ যখন আচমকা জিজ্ঞেস করে বসলাম রেহানকে ওর বিয়ে কবে। তখন ওর থতমত অবস্থা দেখে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, সজীব ভাইয়ার কথাগুলো আসলেই সত্যি ছিল। মানুষের চোখ কখনও মিথ্যা বলেনা, রেহানের চোখও বলেনি। আমি রেহানের চোখের দিকে তাকিয়ে পড়ে নিয়েছি আমাকে না চাওয়াটা।

নিজের মধ্যে ভাঙচুর হতে থাকে। আমার এতদিনের চেনা রেহান আজ কতটা অচেনা। আমার বিশ্বাস হতে চায় না, এসব সত্যি। বারবার মনে হয় এসব স্বপ্ন, একটুপর ঘুম ভেঙে যাবে আর সব আগের মত ঠিক হয়ে যাবে। রাতে অনেক কষ্টে যখন একটু ঘুম চোখের পাতায় ভর করে। তখন হঠাৎ ধড়ফড় করে জেগে উঠি। মনে হয় যেন কেউ আমার সর্বস্ব কেঁড়ে নিচ্ছে। চারিদিকের এত মানুষ, এত কোলাহলের ভীড়ে আমি প্রতি মুহূর্তে শূণ্যতায় তলিয়ে যেতে থাকি। সারাদিন একটা হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক কাজ করে, অথচ আমার হারিয়ে ফেলার মত এখন কিছুই নেই বাকি। হঠাৎ হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠি, আবার নিজেই নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করি। নিজেকে কতকিছু বুঝিয়ে ভাতের লোকমাগুলো গিলে ফেলি। আমার অবস্থা দেখে বাসার সবাই সন্দেহ শুরু করেছে। একদিন মা এসে আমার হাতটা ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে সত্যি করে বলতো?’

আমি তখন কিছু বলতে পারিনি। শুধু মা’কে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না করে দিলাম। নিজেকে সামলে নিতে খুব কষ্ট হয়েছে। রেহানকে ভুলে যেতে পারিনি। তবে চাপা দিয়ে রেখেছি। কিন্তু মাঝে মধ্যে যখন নাটক, সিনেমা, গল্প কিংবা উপন্যাসের পাতা, অথবা চোখের সামনের কোনো দৃশ্য আবার আমায় পিছনে টেনে নিয়ে যায়। তখন চাপা দেওয়া আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, তারপর এক পশলা চোখের জলে নিভিয়ে দিয়ে আবার চাপা দেই।

পড়াশোনায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে বেশ যাচ্ছিল সময়। তারপর পড়াশোনা শেষে চাকুরির চেষ্টায় কাটছে আমার ব্যস্ত সময়। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেই। ভালো পদ৷ চাকুরিটা হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
এবং হয়েও গেল। চাকুরিজীবনের আজ প্রথম দিন। কোম্পানির সবার সাথে পরিচিত হতে গিয়েই পাঁচ বছর পরে রেহানের মুখোমুখি আমি। রেহান খুব ইতস্ততা বোধ করলেও আমি রেহানের বস হিসেবে খুব স্বাভাবিক আচারণ করার চেষ্টা করছি।

মায়ের হাত ধরে সেদিন খুব করে অনুরোধ করেছিলাম, আমি না বলা পর্যন্ত যেন তাঁরা কখনও বিয়ের জন্য আমাকে বাধ্য না করে। মা কথা রেখেছিলেন। আজ পাঁচ বছর হয়ে গেল আমাকে তাঁরা বিয়ের জন্য বলেন নি। আমি এই পাঁচ বছরে অনেক চেষ্টা করেছি সংসার বাঁধার মনমানসিকতা তৈরি করার। কিন্তু আমি বরাবর ব্যর্থ হয়েছি। আমি কোনোভাবেই কাউকে নিয়ে চিন্তা করতে পারিনি, অনেক জোর করেছি নিজেকে শোধরানোর জন্য। কিন্তু পারি নি। তাই ছেড়ে দিয়েছি সে প্রত্যাশা। অফিস শেষ করে বের হয়ে গেঁটের কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে কেউ একজন ডাক দিল, ‘তৃষ্ণা একটু দাঁড়াও’ পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখি রেহান। ‘তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে দয়া করে আমাকে একটু সময় দাও।’

আমি কিছু বলার আগেই রেহান এক নিঃশ্বাসে বললো, ‘আমি তোমাকে কত খুঁজেছি জানো? কোথাও পাইনি তোমায়। তৃষ্ণা আমি তোমাকে এখনও আমি রেহানকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এক্সিউজমি! আপনি তখন থেকে আমাকে তুমি করে নাম ধরে সম্বোধন করে যাচ্ছেন। আমি আপনার বস। আপনার উচিত যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। একজন বসের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় আমার মনে হয় আপনার জানা আছে। আর আমি আপনাকে চিনিনা। একই কোম্পানিতে কাজ করার সুবাধে আজ আমাদের পরিচয়। এর বাহিরে আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারেনা। আশা করি মাথায় রাখবেন আর পরবর্তীতে এরকম ভুল দ্বিতীয়বার যে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন৷’

কথাগুলো বলেই হনহন করে গাড়িতে উঠে পড়লাম বাসার উদ্দেশ্যে। আমি জানি রেহান কি বলবে। রেহানের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয় নি। বিয়ের তিনদিন আগে শায়লা তাঁর প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। শায়লা রেহানের সাথে যোগাযোগ করেছিল রেহানকে ভালোবেসে নয়, শায়লার প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক ভঙ্গ হয় যার কারনে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য ভালো সময় কাটানোর জন্য রেহানের সাথে যোগাযোগ করে। কারণ শায়লা ভালো করেই জানতো রেহানের একটা দূর্বলতা শায়লার প্রতি অনেক আগে থেকেই রয়েছে। রেহানের চাকুরি হয়ে গেলে শায়লা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেও যখন তাঁর পুরানো প্রেমিক আবার ফিরে আসে তখন সে সেদিকেই ছুটে যায় সব ফেলে।

তারপর অবশ্য রেহান আমাকে না পেয়ে আমার সব বন্ধু বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করেছিল আমার সাথে একবার দেখা করার জন্য। কিন্তু আমি বারণ করে দিলে আমার বন্ধুদের থেকে কোনো ধরনের সাহায্য পায়নি রেহান। তবে রেহানের অজান্তেই সজীব ভাইয়ার সাথে আমার যোগাযোগটা এখন পর্যন্ত আছে। সজীব ভাইয়ার কাছ থেকেই রেহানের খবর নিতাম। সেখান থেকেই জানতে পারি ঘটনা।

রেহানকে আমি ভালোবাসি এখনও আগেরই মত। তবে অন্ধ ভালোবাসা নয়৷ অন্ধ ভালোবাসার কাছে বিবেক বুদ্ধি আর যুক্তির দাম থাকে না। অন্ধ ভালোবাসায় শুধুমাত্র আবেগের প্রধান্য থাকে। আবেগ দিয়েই প্রিয়জনের সব ভুল ক্ষমা করে দিতে পারে নিঃসংকোচে। কিন্তু আমি রেহানের চাইতেও নিজেকে বেশি ভালোবাসি। তাই যেখানে আমার জন্য ভালোবাসা নেই, সেখান থেকে আমি সবসময় দূরত্ব বজায় রেখে চলি। নিজেকে বিসর্জন দিয়ে আমি রেহানের ভুলগুলো কোন যুক্তিতে ক্ষমা করবো, যেখানে পাঁচ বছর আগে রেহানের যুক্তিতে আমি নয় শায়লা স্থান পেয়েছিল! যারা মনে করেন, ভালোবাসলে তাঁর সব ভুল ক্ষমা করা যায়। তাঁরা ভুল ভাবেন। কারন বাস্তবতা খুব কঠিন। বাস্তবতায় আবেগের স্থান নয়, দিনশেষে বিবেক আর যুক্তির’ই জয়। রেহানের জায়গায় আমি অন্য কাউকে বসাতে পারবো না এটা যেমন সত্য, তেমনই সত্য সেই জায়গায় ফিরে আসা রেহানকেও বসানো কোনোদিন সম্ভব নয়। তবে একটা কথা সত্য, কেউ ভালোবাসা উপেক্ষা করে ফেলে চলে গেলে তাঁকে ফিরে আসতেই হয়। কেউ হয়তো ভুল শুধরাতে পারে আর কেউ ভুলের দায় নিয়ে মরে।

এই কোম্পানিতে জয়েন করার কারনও হলো রেহান। সজীব ভাইয়ার থেকে এটাও জেনেছিলাম রেহান এই কোম্পানিতেই চাকুরীরত। ওর সাথে সংসার না হোক, প্রতিদিন দেখা তো হবে। এটাই আপতত আমার সান্ত্বনা। বাসার সামনে চলে এসেছি, তাড়াতাড়ি চোখের জলগুলো মুছে এক মুখ মিথ্যে হাসি নিয়ে প্রতিদিনের মত আজও আমার প্রবেশ।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত