সেদিন লাবণীকে ঐ অবস্থায় দেখার পর পিছনের সমস্ত রাগ ঘৃণা আর মনে ধরে রাখতে পারি নি। কখনো লাবণীকে এমন অবস্থায় দেখবো ভাবি নি আমি। অবশ্য অহংকার যে পতনের মূল এমন বাক্যের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। আমি লাবণীর অহংকার, দম্ভ আর কিছু গ্রাম্য কুটিলতাকে একপাশে রেখেই ছোটবোনের মত ভালবাসতাম। কিন্তু মাঝে মাঝে সে আমার সাথেও তার রূপ পাল্টে পুরনো বৈশিষ্ট্যে ফিরে যেত। সেসব কথা পরে হবে। লাবণী এখন আমার বাসায়। আমার হাজবেন্ড হসপিটাল থেকে ওকে সোজা আমার বাসায় এনে তুলেছে, হয়ত স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার পর সে আবার রাগে ফুঁসে উঠবে,রেগে যাবে নয়ত ঝগড়া শুরু করবে কোমর বেঁধে! আমিও তাই চাই তবু সে সুস্থ হোক।
অারিফ সদর হাসপাতালের বেডে বিষপানের রোগী হিসেবে আবিষ্কার করে লাবণীকে। কিন্তু এমন অচেনা জায়গায় লাবণী কি করে আসবে? লাবণীকে এমন অবস্থায় চিনতে পেরেই অারিফ আমাকে দ্রুত হাসপাতালে যেতে ফোন করে, লাবণীকে দেখে প্রথমে আমিও অবাক না হয়ে পারলাম না! আরিফ লাবনীকে চিনে আমাদের রিলেশনের সময় থেকে কিন্তু আমাদের বিয়ের আগে লাবণীর সাথে তিক্ততার জন্য বিয়েতে আসে নি সে,বিয়ের পরও আরিফের সাথে তার আর কথা হয় নি। লাবণীর তখনও জ্ঞান ফিরে নি। আরিফ তার কেস স্টাডি করার জন্য ভর্তি খাতা নিয়ে দেখে ডোমেস্টিক ওফেন্স এ সুইসাইড এটেম্পট করেছে লাবণী,কীটনাশক খেয়েছে। “কিন্তু লাবণী এখানে কোথায় আসলো?” আরিফের দিকে আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। আরিফ ব্যাপারটা হালকাভাবে নিয়ে বলছে, “হয়ত এখানেই তার বিয়ে হয়েছে!”
–তাহলে সাথে কেউ নেই কেন?
—হয়ত কেউ ছিল, কেস স্টাডি অবশ্য বলছে প্রতিবেশীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।
— কি জানি! আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।
আরিফ আমাকে প্রশ্ন করছে,”তুমি কি লাবণীর কাছে থাকবে? ” হ্যাঁ শুক্রবার ছুটির দিন হওয়াতে লাবনীর কাছে থাকতে আমার কোন সমস্যা হয় নি,, শনিবারও ছুটি তাই দুইদিন লাবনীর কাছে হসপিটালেই থাকলাম কিন্তু রবিবার অফিস যেতে হবে ভেবে লাবণীকে আমার বাসায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এদুদিনে তাকে হাসপাতালে কেউ দেখতে আসে নি। পুরোটা সময় আমিই তার সেবাযত্ন করেছি। আরিফকে বলে লাবণীর শারিরীক কন্ডিশন চেকআপ করালাম, এখন অনেকটাই সুস্থ তবে সেবা আর পর্যাপ্ত রেস্ট দরকার।
বাসায় একটা পার্মানেন্ট কাজের মেয়ে আছে আর একজন ছুটা বুয়া। সবাইকে বলে দিয়েছি লাবণীর সেবাযত্ন করতে। আমিও যতটা পারছি করি। রাতে অফিস থেকে ফিরে দেখি লাবণী খোলাচুলে বারান্দায় বসে আছে। চুলগুলো হাওয়ায় দুলছে,সেই আগের মত কোমর ছেড়ে যাওয়া চুল নেই তার, পিঠের মাঝ বরাবর পর্যন্ত হবে। আরিফ আর আমি লাবণীর সাথে আজ কথা বলব বলে সিদ্ধান্ত নিই।আরিফ আমাকে আগে গিয়ে গল্প শুরু করতে বলে। বৈশাখের রাত। কালবৈশাখী ঝড় আসার সমূহ সম্ভাবনা। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে সাথে দমকা হাওয়া। সে হাওয়ায় লাবণী বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে আছে।
দুতলার বারান্দা হওয়ায় বাতাস আরও ভালভাবেই লাগছে। অনেক্ষণ ধরে ওর এখানে বসে থাকা দেখছি, আমিও একটা চেয়ার টেনে লাবণীর পাশে এসে বসলাম। বারান্দার আলোটা জ্বেলে তার পাশে বসতেই খানিক চমকে উঠলো যেন সে এতক্ষণ অন্য জগতে ছিল! আমিও নিশ্চুপ হয়ে ওর পাশে বসে রইলাম,আরিফ ভিতরের ঘরে টিভি দেখছে। নিরবতা ভেঙে কোমল স্বরে ডাকলাম,”লাবণী।” নিরুত্তর রইলো সে। আবার ডাকলাম এবার আমার দিকে ফিরে তাকালো খানিকটা। “আজও কথা বলবি না আমার সাথে?” লাবণী দুএকবার তাকিয়ে দুচোখ নামিয়ে নেয় আমার থেকে। লাবণীর এভাবে দুচোখ নামিয়ে নেয়াটার অর্থ আমি বুঝেছি।
আমি নিশ্চিত এটা লাবণীর জীবনে হেরে যাওয়ার মান অপমানবোধ,লজ্জিত হওয়া কিছুটা। হয়ত এভাবে তাকে লজ্জায় কুঞ্চিত হতে হতো না,যদিনা আমি তার সামনে থাকতাম। হয়ত আমার সামনে তার এ অবস্থায় অাসার জন্য সে ভেতরে ভেতরে লজ্জিত হচ্ছে। লাবণী আমার সাথে কথা বলে নি, পুরোটা সময় মাথা নিচু করে বসেছিল সে। আমি তাকে বিব্রত করতে চাইনি বলে সেখান থেকে উঠে আসি। লাবণীকে ধাতস্থ হতে আরও কিছু সময় দিতে হবে। সোমাকে বললাম ওকে ঘরে নিয়ে খাইয়ে দিতে। লাবণীকে খাওয়াতে গিয়ে সোমা ফিরে আসে ভাতের প্লেট নিয়ে,” আন্টি, উনি তো খায় না। দুপুরেও খায় নি, কি করতাম?”
—ঠিক আছে জুস আর কলা কিছু ওর রুমে রেখে আয়।
সোমাও কথামত তাই করলো। আমি লাবণীর রুমে একটু কম যাই, ও নিজেকে আরও গঠন করে নিক তারপর, লাবণী স্বাভাবিক হোক। রাতে ঘুমানোর আগে পর্দা সরিয়ে দেখি অঘোরে ঘুমাচ্ছে লাবণী। সেই আগের মিষ্টি মায়াবী মুখে অনেকদিনের ক্লান্তির ছাপ, চোখের নিচে কালি জমেছে অনেক স্তরের। নিজের যত্ন নেয় না বললেই চলে। অনেকটা সময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসলাম। আরিফের নাইট ডিউটি নেই আজ অনেকদিন পরে। একটানা নাইট ডিউটি করে আজ বেশ ক্লান্ত সে। দিনের বেলা তো ডাক্তারদের ঘুমানোর কোন জো নেই।
—“তুমি ঘুমাও নি কেন এখনো?”
— তোমার অপেক্ষা করছিলাম।
— কি করছে লাবণী?
— ঘুমাচ্ছে
— কথা হলো?
— না,বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে কথা বলে নি।
— আর দুএকটা দিন যাক সে নিজেই কথা বলবে।
— হুম আমিও তাই ভাবছি।
লাইট অফ করে শুয়ে আছি। আরিফ আমাকে ডাকলো, ” চৈতি, লাবণীকে দেখার পর থেকে তুমি কেমন গুমোড়ে আছো,কিন্তু কেন? ”
— আসলে আমি ওকে এভাবে দেখব ভাবি নি তাই। আর লাবণী স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমিও স্বাভাবিক হতে পারছি না।
— এত ভেবো না তো, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। লাবণী তোমার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে এমনটা ভাবো, দেখবে সব ভাল লাগবে। ওর সামনে যাবে,গল্প করবে, হাসবে দেখবে ওর ভাল লাগবে।
— হুম করবো। ঘুমাও এখন
বাহিরে ঝড় নেমেছে, দমকা হাওয়া, জানালার পর্দা উড়ছে। আরিফ আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না। একবার লাবনীকে দেখতে তার রুমের দিকে গেলাম, অন্ধকারে জড়সড়ো হয়ে বিছানায় বসে আছে সে।
এবার আমি কাছে গেলাম, গলায় মৃদু আওয়াজ করে তার পাশে গিয়ে বসলাম, এবারও চমকে উঠলো সে। পাশেই ড্রয়ার থেকে মোমবাতি খুঁজে বের করে জ্বালিয়ে দিলাম কিন্তু বাতাসের প্রকোপে মোমবাতিটা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে,নিভে গিয়েও আবার জ্বলে উঠছে। “কি হয়েছে লাবনী, ঘুমাস নি? “এবার লাবণী অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আমার দিকে একনজরে তাকিয়ে রইলো,এ তাকানোতে কোন লজ্জা নেই,মান অপমানবোধ নেই শুধু সেই পুরনো দিনের সেই চৈতি আপুকে চিনে নেয়া শুধু।
রাত তিনটা বাজে, ঝড় থেমে গেছে। আমারও দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে এসেছে কিন্তু লাবণী ঘুমাচ্ছে না। জোর করে তাকে শুইয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে তার সাথে গল্প করতে শুরু করলাম। গল্পে গল্পে সেই পুরনো দিনের মত লাবনীর চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলাম। লাবনীর মাথায় আগে যখন বিলি কেটে দিতাম তখন সে পরমানন্দে ঘুমাত। আমার নিজের ছোটবোনের চেয়েও আদরের ছিল লাবণী। লাবণীর চুলে বিলি কাটতে কাটতে কখন আমি তার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। ভোর ৬টায় আরিফের হাসপাতালে যেতে হবে, বাথরুম কিচেনে আমাকে না পেয়ে খানিকটা অবাক হয় আরিফ। সে আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করে লাবণীর বিছানায়। একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছি।
আজ অফিসে যেতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল, বসের মুখে শোনলাম আজ হেড অফিস থেকে ভিজিটে আসবে। অনেক কাজ এলোমেলো হয়ে আছে, দ্রুত হাতে কাগজপত্র সম্ভাব্য সব গুছিয়ে রাখতে গিয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো,একটু বিরক্তিও লাগলো কিন্তু স্ক্রিনে সোমার নাম দেখে খানিকটা অবাক হলাম,লাবণীর কিছু হয়নি তো!
ফোন রিসিভ করে হ্যালো হ্যালো করছি কিন্তু কেউ কথা বলছে না। ব্যস্ত তাই ফোনটা কেটে দেই,হঠাৎ মনে হল সোমার নাম্বার থেকে লাবণী নিশ্চয়ই আমাকে কল করেছে। এ অভ্যেসটা তো আমার ছিল। লাবণী যখন আমার সমস্ত ভালবাসা, ভরসা ভেঙে ওর বয়ফ্রেন্ডের বন্ধুর হয়ে আমার জীবনে ঝড় তোলে বিশ্বাসঘাতকতা করলো তখন লাবণীকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম বলে গ্রামের সেই ঝগড়াটে মহিলাদের রূপ নিয়ে অামাকে নানান ভাষায় বকাঝকা করে এবং অসম্মান করে। লাবণীর ঐরূপ কুরুচিপূর্ণ আচরণে আমার সেদিন প্রচন্ড ঘৃণা চাপে, ইচ্ছে করছিল দুই গালে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় বসাই কিন্তু পরক্ষণেই নিজের সম্মানের কথা ভেবে পিছিয়ে আসি।ছোটবোন ভাবলেই যে সবাই ছোটবোন হয় না তা সেদিন আমি অনুভব করেছি।
আরিফের সাথে বিয়ের পর যখন প্রায়ই লাবণীকে মিস করতাম তখন এভাবে আরিফের নাম্বার থেকে তাকে কল করতাম, চুপ করে থেকে তার গলার স্বরটা শুনতাম আর চোখের জলের ফোঁটা নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়তো।বড্ড বেশি ভালবাসতাম যে। অফিসের ব্যস্ততা চুকিয়ে বসকে বলে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম,প্রচন্ড রোদে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রিক্সা পেলাম। বাসায় পৌঁছতে ঘন্টাখানেক সময় লেগে যাবে। রিক্সা চলছে তার গতিতে, আমি ভাবছি লাবনীর কথা। মেসে একমাত্র আমার ভরসার স্থান ছিল পুঁচকে লাবণী, আমার রুমমেট। মেসে অন্যদের সাথে মিষ্টি সম্পর্ক থাকলেও ভালবাসার সম্পর্ক ছিল লাবণীর সাথে।
দীর্ঘদিন আমার রুমে একটা সীট খালি,দুজনের এক রুম নিয়ে থাকি আমি। সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই আন্টি আমার রুমে আরেকজন উঠবে বলে জানান। আমিও হাসিমুখে সমস্যা নেই বলে দেই। রাতে একা থাকি, তাছাড়া একজন গল্প করার মতন কেউ হবে বলে খুশিই হলাম। পরদিন বেডিংপত্র নিয়ে হাজির হলো সেই পুচকে লাবণী, অনেক মায়াবী হাসিখুশি মুখের আড়ালে তার গ্রাম্যতা লুকিয়ে থাকতো যেন। দেখলেই ভালবাসতে ইচ্ছে করতো ওকে,এখনও ঠিক তাই।তবে এখন তো ভয় মনে আমার! নিজের হাতে প্রথম দিন লাবণীর বিছানা, টেবিল, বুক সেলফ সব সাজিয়ে দিলাম।
ধীরে ধীরে হয়ে গেলাম দুজন দুজনার, তখন আর দুজন আলাদা বিছানায় থাকি না। আমার যা আছে তাই যেন লাবণীর। আমার ব্যাগ,জুতা,ওড়না,হিজাব,চুড়ি, ঘড়ি, লিপিস্টিক সব। মাঝেমাঝেই লাবণী মেসের অন্যদের সাথে ঝগড়া বাঁধায়,কোমর বেঁধে ঝগড়া করে রান্নার সিরিয়াল নিয়ে, বাথরুম পরিস্কার নিয়ে,গোসলের সিরিয়াল নিয়ে।অামি অন্যদেরকে সরি টরি বলে ওকে সেইফ করি, ওর কাজগুলোও করে দেই কখনো যেন কোন অশান্তি না হয়! সময় বাড়ার সাথে সাথে লক্ষ্য করে দেখি লাবণীর স্বার্থে আঘাত লাগে এমন কিছুতে সে আমাকেও সামান্যতম ছাড় দেয় না! আমাকেও দু চার কথা শুনিয়ে দিতে কুন্ঠিত হয় না। আমি তো মহা আবেগী! বালিশে মুখগুঁজে সেদিন কাঁদি তবুও মানিয়ে নিই ওর সাথে।
অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছি,বাবা মা আমায় বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমি চাকরি না করে বিয়ে করবো না সোজা বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি,কিন্তু এতে কোন কাজ হবে না,বাবা বিয়ে দিবেনই। কলেজের এক কান্ডজ্ঞানহীন ছেলে রাশিদ, বখাটেপনা যার কাজ, সেদিন এক মেয়ের ওড়না টেনে নিয়ে চলে গেছে।কেউ তাকে কিছু বলেনা ভয়ে। কিছুদিন হলো এই বজ্জাত ছেলেটা আমার পিছু লেগেছে।আমি সারাক্ষণ ওই বদমায়েশের ভয়ে তটস্থ থাকি। ইজ্জতের ভয় কার না থাকে?
আমি নিজেকে ওই শয়তানের থেকে নিরাপদে রাখতে নতুন বোরখা বানাই, হিজাব কিনি। কলেজে তেমন না গেলেও প্রাইভেটে যেতে যেন ওই ছেলে আমার পিছু না লাগে! সিম পাল্টে নতুন সিম কিনেছি যার নাম্বার শুধু আমার বাবা মা ভাইবোন আর লাবণী জানে। ফোনে টাকা রিচার্জ পর্যন্ত আমি বাবাকে দিয়ে করাতাম যেন রাশিদ ঘুরাক্ষরেও আমার নতুন নাম্বার পেয়ে না যায়! যেদিন অবিশ্বাস্যভাবে রাশিদ আমার নতুন নম্বরে ফোন করে আমার মেসে ঢুকে আসার হুমকি দেয় সেদিন অামি অবাক না হয়ে পারলাম না কিছুতেই! কোথায় পেল রাশিদ আমার নাম্বারটা?
রাশিদের বন্ধু তুর্য লাবণীর বয়ফ্রেন্ড। লাবণীকে সে প্রায়ই রাশিদ আর তুর্যর সাথে দেখে। নাঈমা যখন আমাকে কথাগুলো বলছিলো,লাবণী কোথা থেকে এসে সব শুনে নেয়। সে কি রাগের ফোঁসফোঁসানি তার! সে কি রুদ্রমূর্তি! নাঈমাকে যা নয় তা বলে গালিগালাজ করে সে। লাবণীর প্রেমের ব্যাপারটা আমিও জানতাম, অনেক বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করেছি কোন কাজ হয়নি, কিন্তু লাবণী আমাকে বিপদে ফেলে আমার নাম্বারটা রাশিদকে দিবে সেটা আমি ভাবতে পারি নি। তবে নাঈমার কথা মিথ্যে হতে পারে না, যোগসূত্র কিছু তো আছেই!
সেদিনের পর থেকে লাবণী আমার সাথে কথা বলে না। নিজের মত করে চলাফেরা করে। আর রাশিদ! আমার জীবন অতিষ্ট করার সব কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বাবা মায়ের কথা মেনে আরিফের সাথে আমি এনগেইজমেন্ট করে নিয়েছিলাম,লাবনী আমার এনগেজমেন্টেও যায় নি সেদিন। লাবণীর কথা ভাবতে ভাবতে রিক্সাটি বাসা প্রায় অতিক্রম করে যাচ্ছে,হঠাৎ হুঁশ হলো। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকে দেখি লাবণী ঘুমাচ্ছে। আমি নিজের রুমে একটু বিশ্রাম নিতে খাটে গা এলিয়ে দিলাম।
দুচোখ বন্ধ করতেই চোখে ভেসে উঠলো সেই বিভীষিকাময় নোংরা কম্পিউটারাইজড ছবি গুলো যার সবকয়টাতেই নোংরা ড্রেসে,নোংরা কর্মকান্ডে আমার মুখটা জুড়ে দেয়া হয়েছিল যেন সত্যিকারই আমি সেটা। ছবিগুলো আরিফের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল রাশিদ। রাশিদ আরিফের ঠিকানা, পরিচয় সব লাবনীর থেকে পায়। এমনকি আরিফের বাবা মায়ের হাতেও পৌঁছে সে ছবি।লাবণীর ফোনে আমার যতগুলো ছবি ছিল সব রাশিদকে দিয়েছিল সে,যাকে বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ।
লাবণীকে সেদিন জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে নিজের সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছি আমি নিজেই। মেসের আন্টি এবং অন্য রুমমেটদের সামনে সে এমনভাবে আমাকে অপমান আর তিরস্কার করেছে যেন রাশিদের সাথে আমি এগুলো সত্যিই করেছি আর লাবণী নিজে তার প্রমাণ। আমার এত ভালবাসার লাবণী নিজের মুখে যখন বলছে এসব তখন অন্যরা কেনইবা অবিশ্বাস করবে? পরের দিন মেস ছেড়ে চলে আসি,আরিফের সাথে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলি। আরিফের বাবা মা সব জেনে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিতে উদ্যত হোন, আমার মা বাবাকে নানানভাবে অপমান করেন তারা । আরিফ আমার জীবনে এক আরাধ্য দেবতা যেন, সে আমার হাতে হাত রেখে সেদিন আমার হাত কোনদিন ছাড়বে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। আমি স্বস্তি খুঁজে পাই জীবনে।
লাবণীকে আমি কখনোও ঘৃণা করি নি, ছোটবোন ভেবে ভালবেসে এসেছি বরাবর। লাবণী অল্পবয়সের ভালবাসায় মোহান্বিত ছিল অতিমাত্রায়। টিনএইজের ভালবাসাটাই এমন। তাদের কাছে ভালবাসার মানুষ ছাড়া আর কেউ যেন আপন নয়,অন্যরা সবাই বিরক্তিকর, শুধু ভালবাসার মানুষটাই আপন। বাবা মায়ের সামান্য শাসনও তখন পাহাড়সম বিষের মত লাগে।লাবণী তুৃর্যর ভালবাসার আবেগে ডুবে রাশিদকে বন্ধু ভেবে নিয়েছিলো, আর আমি যেন তার সাত জন্মের শত্রু হয়ে গিয়েছিলাম! তাই সে রাশিদকে আমার নতুন ফোন নাম্বার,আমার বিয়ের খবর, অারিফের ঠিকানা সব জানিয়ে দেয়। । লাবণীর প্রতি সেদিন আমার অনেক রাগ হয়,অনেক কষ্ট হয় তবে সে শাস্তি পাক এমন চিন্তা মাথায় আসে নি। শুধু বলেছি সে একদিন হলেও বুঝবে সে কি করতে চেয়েছে।
চোখের কোণ বেয়ে পানি টপাটপ করে গড়িয়ে পড়ছে। বিছানায় কেউ বসেছে বেশ বুঝতে পারছি,কিন্তু আমার আবেগকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। নিঃস্বার্থভাবে কাউকে ভালবাসার শাস্তি পেয়েছিলাম যে সেদিন! আংটি পড়ানোর পর আমাদের বিয়ে ভাঙার পথে।দুই পরিবার উল্টে গেছে কিন্তু আমি আর আরিফ! পালিয়ে বিয়ে করি দুজনে সেদিনই।
হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন আমার দুটি পা জড়িয়ে ধরেছে! ফিরে দেখি লাবণী! কি ব্যাপার? “আপু আমাকে তুমি মাফ করে দাও,আমার অন্যায়ের শাস্তি আমি আজ পাচ্ছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করো আপু। “কেঁদেই চলেছে লাবণী। গলার স্বরটা স্বাভাবিক করে বললাম,” নারে তোর উপর আমার কোন রাগ অভিমান নাই,অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন আমি আর কিছু না। দুজনেই অনেক্ষণ নিশ্চুপ….
— আচ্ছা তুই বিষ কেন খাইলি?”
লাবণীর মুখ কাচুমাচু হয়ে শুকিয়ে গেছে।আমি আবার জোর করলাম,বল কেন বিষ খাইলি?” মাথা নিচু করে সে বলে,”জীবনের জ্বালা আর সইতে পারছিলাম না আমি। পরিবারের অমতে তুর্যকে বিয়ে করার ৭মাস পর সে আমাকে ডিভোর্স দেয়,বাধ্য হয়ে বাবা মার কাছে ফিরে জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে রইলাম যেন। বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে তিন সন্তানের এক মদ্যপ বুড়োর কাছে বাবা আবার বিয়ে দেয়। পান থেকে চুন খসলেই বেধড়ক মারধর আর সহ্য করতে পারি নি আপু।”
—তোর বাবা ভাই তোর জন্য কিছু করেনি?
—-তার ঘর থেকে পালিয়ে যখন আবার বাবার কাছে ফিরে এলাম,ওরা আমাকে বাড়িতে থাকতে দেয়নি। আমার কপাল তো আমি পুড়েছি। ফিরে গেলাম নরক যন্ত্রণায় আবারও।এ জীবন বড় অতিষ্ট হয়ে গেছে আপু,আমি আর পারছিলাম না। বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করছিলো না তাই বাধ্য হয়েই..।”আমাকে জড়িয়ে ধরে হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠে লাবণী।
—জীবনে স্বাবলম্বী না হলে কত যে অসহায় একটা মেয়ে তা আমি টের পাচ্ছি আপু, আবেগ ভালবাসা কেবল রঙিন চশমা আপু। সময় থাকতে কেন বুঝলাম না? অঘোরে কেঁদে যাচ্ছে লাবণী।
আজও সেই পুরনো স্নেহে লাবণীকে বুকে আগলে নিতে ইচ্ছা করছে, বলতে ইচ্ছে করছে লাবণী কাঁদিস না, আমি তো তোর পাশে আছি, ভয় কিসের তোর? কিন্তু আমি বলতে পারি নি। আমি যে এখন আগের মত নিজের দুর্বলতাকে প্রকাশ করে ফিরি না! আমি লাবণীর হাত ধরে পাশে না থাকতে পারলেও দূর হতে পাশে থাকবো, হাত ধরে পাশে থাকলে আবার যে সে আমাকে কোনদিন আঘাত করবে না তার কি নিশ্চয়তা! দেখি লাবণীর জন্য আমি কি করতে পারি? তবে সেটা আড়াল থেকে অবশ্যই।