ফিরে পাওয়া ভালোবাসা

ফিরে পাওয়া ভালোবাসা

-আপনি কি সিগারেট খান নাকি? মাম বোতলের মুখটি খুলতে খুলতে মেয়েটি প্রশ্ন করলো আমায়।

-হ্যা খাই।

দ্বিধাহীনভাবেই উত্তর দিলাম আমি। কথাটি বলে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি আমার সামনের সিটে বসেছে। দেখে মনে হচ্ছিল পড়াশোনা করে। হাতে বিসিএস সম্পর্কিত বইও দেখেছিলাম একটু আগে। আমি কুমিল্লা থেকে ট্রেনে উঠেছি। কিশোরগঞ্জ আসবো।

-নাহ খাবেননা আর। ছেড়ে দিন এটা!

মেয়েটি বললো আমায়। কথা বলার ধরনটা অনেকটা কাছের মানুষের মতো। কথা শুনে মনে হচ্ছিল সে যেন আমার খুব নিকটের কেউ! আমি বললাম,

-আসলে, এটা আমার সঙ্গী হয়ে গেছে। না খেলে চলেনা। দিনে কম হলেও এক প্যাকেট খেতে হয়। মেয়েটি বললো,
-প্রতিদিন আপনি এক প্যাকেট সিগারেট খান? অনেকটা অবাক হয়েই সে জানতে চাইলো। আমি বললাম,
-হুমমম, এক প্যাকেটই লাগে আমার। না হয় চলেনা।

-কেন? এত সিগারেট খেতে হয় কেন?

-সবকিছু বলব?

-হ্যা, যদি আপনার অসুবিধা না থাকে তাহলে সবকিছুই বলতে পারেন আমায়। যেতে যেতে দুজনে গল্প করেই না হয় সময়টা কাটিয়ে দেয়া যাবে।

-আসলে, কেউ একজন আমাকে ভালোবেসে আমার সাথে ঘর বাঁধবে বলে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ও খুব ভালোও বাসতো আমায়। তারপর আর….

-হ্যা বলুন! তারপর….?

-এসব বলে লাভ নেই। বাদ দিন। আপনি কোথায় যাবেন? ভৈরব নাকি কিশোরগঞ্জ?

-কিশোরগঞ্জ যাব। আপনি কিন্ত আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। আপনার যদি মর্মস্পর্শি কোন অতীত থেকে থাকে তাহলে সেটা আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন। তাতে হয়ত আপনার কিছুটা হালকাও লাগতে পারে। প্লিজ বলুন!

মেয়েটির দিকে তাকালাম আমি। চোঁখে মুখে প্রচণ্ড আগ্রহের ছাপ। আমারো কেন জানি সব বলতে ইচ্ছে করলো। বলতে শুরু করলাম আমি;

-আজ থেকে দুবছর আগের কথা। তখন আমি সবেমাত্র অনার্স কম্প্লিট করেছি। পরিবারের অবস্থা এমন ছিল যে, এরপর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হলে আমাকে চাকরী করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে হবে এবং পাশাপাশি ফ্যামিলিকেও সাপোর্ট দিতে হবে। এমতাবস্থায় একজনের সাথে আমি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। অবশ্য, সে আমার আগে থেকেই পরিচিত ছিল। ও প্রচণ্ড ভালোবাসতো আমায়। একদিন শখ করে ওর জন্য লাল রংয়ের দুটি চুড়ি কিনি আমি। কিন্ত দেয়ার মতো কোন সুযোগ ছিলনা। যা কথা হবার সব ফোনেই হতো। দেখাও করতে পারতামনা। অবশেষে একদিন সুযোগ পাই। ওর এক বান্ধবীর সাথে পরিচয় ছিলো আমার ছোটবোনের। ওরাও যেন কিভাবে সবকিছু জেনে যায়। ওদের দুজনের মাধ্যমে চুড়ি দুটো আমি আমার নিলুকে দিই।

চুড়িগুলো হাতে পড়ে নিলু আমাকে ছবি পাঠায়। এর তিনদিন পরেই ফোন করে নিলু কান্নাকাটি করা শুরু করে। আমি কিছুতেই ওর কান্না থামাতে পারছিলামনা। অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর ও বলে, ওর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পাত্র ওর রিলেটিভ। কথাটি শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। আমি পাগলের মতো হয়ে যাই।

একদিক থেকে ওর হাউমাউ করে কান্নার আওয়াজ অন্যদিকে এই বিষয়টির ভাবনা আমাকে অস্থির করে তুলছিল। আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্ত আমার কিছুই করার ছিলনা। আমার পরিবারের অবস্থা তখন খুব বাজে ছিল। ছোট বোনটার বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছিল কিন্ত টাকাপয়সার অভাবে ওর বিয়েটা দেয়া সম্ভব হচ্ছিলনা। তার উপর মা অসুস্থ আর বাবার তেমন আয়ও ছিলনা। আমার উপরেই সবকিছু এসে পড়ে। আমার সাহসে দিচ্ছিলনা তখন ঘরে নিলুকে বিয়ের কথা বলার। নিলু আমাকে বলে, ‘আমার টাকাপয়সা, বাড়ি-গাড়ি কিছু চাইনা। শুধু তোমাদের ঘরের এক কোণে আমার জায়গা হলেই চলবে। আমি এক কাপড়ে তোমার ঘর করব। কোনদিন কোনকিছু নিয়ে কোন বায়না করবনা। আমাকে তুমি বিয়ে করে নিয়ে যাও।’

সেদিন ওর বলা প্রতিটি কথা আমাকে মাঠির নিচে দাবিয়ে দিয়েছিল। আমি ওর ভালোবাসার কাছে হেরে গিয়েছিলাম। ওর ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা কিছুই ছিলনা। আমি ওর জীবনটা নষ্ট করতে পারিনি। আমি ওকে অনেক বলেকয়ে ওর রিলেটিভের সাথে বিয়ে করে নিতে মানিয়ে দিই। সেটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ত্যাগ। ওর বিয়ের পর আমি নিজে থেকেই ওর সাথে সবধরণের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিই। কারণ, ওর বিয়ের পরও ওর সাথে যোগাযোগ রাখলে ওর পরিবারে অশান্তি হতে পারে। ওর সংসার ভেঙে যেতে পারে। সেই থেকে কখনোই কোনভাবে ওর কোন খবর নিইনি। ইচ্ছে করেই বাড়ি থেকে এই দূরে এসে কাজ নিয়েছি। তবে এখনো আমি ওকে ভুলতে পারিনি। খুব ভালোবাসি ওকে। বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলাম আমি। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। কথা শেষ করে দেখি মেয়েটি তার ডায়েরিতে আমার বলা সব কথা তুলে নিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-এগুলো লিখলেন কেন? কি করবেন এসব দিয়ে?

-নাহ, তেমন কিছুনা। লিখে রেখে দিলাম আরকি। আচ্ছা, আমি কি আপনার এই কাহিনীটি পাবলিশড করতে পারি? মানে, অনলাইনে ছড়িয়ে দিতে পারি?

-আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এভাবেই গল্প করতে করতে আমরা কিশোরগঞ্জ রেল স্টেশনে এসে পৌঁছে যাই। তখনো মেয়েটির নাম আমি জানতামনা। বিদায় নেয়ার সময় জিজ্ঞেস করলাম,

-আপনার নামটাই তো জানা হয়নি আমার!

-ওহ তাই তো। আমি মিথিলা রহমান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করেছি।

-ওহ ভেরি গুড! আমি রিয়াদ। রিয়াদ আহম্মদ। আমি কুমিল্লায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জব করছি। মুচকি হেসে উত্তর দিলাম। মেয়েটিও মুচকি হেসে আমার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

রাত এগারোটা বাজে তখন। বাড়িতে নিজের রুমে শুয়ে ফেসবুকিং করছি। এমন সময় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসলো একটা। ‘মিথিলা রহমান’ একটি পুতুলের ছবি দেয়া। সাথে মেসেজও আসলো। ‘আমিই সেই। আজকের ট্রেনে আপনার সহযাত্রী। একটি গল্প লিখেছিলাম। যার মূল আকর্ষণ আপনি। ফ্রেন্ড না হলে তো মেনশন দিতে পারবোনা।’ আমিও মেসেজের রিপলাই দিয়ে রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নিলাম। কিছুক্ষণ পরেই নোটিফিকেশন আসলো। মিথিলা মেনশন দিয়েছে কোথাও।

ক্লিক করতেই তার টাইমলাইনে চলে গেলাম। ট্রেনে আমার বলা পুরো কাহিনী নিয়ে গল্প লিখেছে ও। সাথে আগে পরে তারও কিছু বিষয়। ভালো লাগলো পড়ে। কমেন্টে ধন্যবাদও জানালাম। ওর ফলোয়ার প্রায় দশ হাজারের উপরে। অনেক মানুষ ওর গল্প পড়ে। টাইমলাইন দেখে সেটাই বুঝা যাচ্ছিল। তিনদিন পর কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছি। সেই ট্রেনে করেই। আজ আমি একা। মিথিলা নেই। ফেসবুকে ঢুকে অযথাই স্ক্রল ডাউন করছি। টুংটাং করে আওয়াজ হলো একটা। মেসেজ এসেছে। ক্লিক করলাম। মেসেজটি;

-‘তুমি কি করে পারলে আমার সাথে এই দুবছর কোন যোগাযোগ না রাখতে???’ সেই চিরচেনা টাইপিং! ও সবসময় চ্যাটিংয়ে আমায় কিছু জিজ্ঞেস করলে প্রশ্নবোধক চিহ্ন একটার স্থলে তিনটে ব্যবহার করতো। আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো। হাত দুটো কাঁপছিল আমার। কোমরকম টাইপ করলাম,

-নিলু!

ও আমাকে ওর নম্বরটা দিয়ে বললো কল দাও। কল দিলাম আমি। হুবহু সেই দুবছর আগের কান্নাই ভেসে আসলো আমার কানে। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। হাউমাউ করে ওর সাথে কেঁদে উঠলাম। অনেকক্ষণ ও কাঁদলো। আমিও কাঁদলাম। মিনিট দশেক পরে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,

-তোমার স্বামী কেমন আছে? কোন উত্তর দিলোনা ও। আবার জিজ্ঞেস করলাম,

-তোমার স্বামী কেমন আছে?

-নেই।

-নেই মানে?

-বিয়ের চারমাস পর সড়ক দুর্ঘটনায় ও মারা যায়।

-আর বাচ্ছা! তোমার বাচ্ছা কেমন আছে।

-আছে। ভালো আছে।

-বিয়ে করবে আমায়?

-সমাজ কি বলবে?

-সমাজ কি বলে না বলে সেটা আমি দেখবো। তুমি শুধু একবার হ্যা বলো বাকিসব আমি ম্যানেজ করে নিব।

এর তিনমাস পর আবার ছুটিতে আসি। সবকিছু ম্যানেজ করে নিলুকে বিয়ে করি। চাকরিতে যাবার সময় ওকে আর রেখে যেতে পারিনি। সঙ্গে নিয়েই রওয়ানা দিই। আর কাকতালীয়ভাবে স্টেশনে টিকিট কাটতে গিয়ে দেখা হয়ে যায় সেই মিথিলার সাথে। নতুন বিয়ে হয়েছে ওর। সেও তার স্বামীর সাথে চট্টগ্রামে যাচ্ছিল। আমি অবশ্য ওকে মেসেজে সব বলেছিলাম। ও আসতে পারেনি। ওর সাথে হাসাহাসি করে কথা বলতে দেখে বিষয়টা ভালো লাগেনি নিলুর। তারপর যখন কাছে ডেকে এনে নিলুকে বললাম, ‘এই সেই মিথিলা রহমান যার লিখা গল্প পড়ে তুমি আমাকে আবার ফিরে পেয়েছ!’ মিথিলাকে দেখে নিলু বলে উঠলো, ‘আপনিই সেই মিথিলা রহমান!’ দুজনেই তখন হাসিতামাশায় মেতে ওঠে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত