ভালোবাসার মর্যাদা

ভালোবাসার মর্যাদা

আফরাঃ তোমার রেগুলার পিরিয়ড হয়? [শান্ত কণ্ঠে]

তুবাঃ হ্যা, হয়। কেন? [কান্নাজড়িত কণ্ঠে]

আফরাঃ পিরিয়ড হলে পেট ব্যাথা হয়?

তুবাঃ হ্যা, কিন্তু কেন?

আফরাঃ তুমি কি জানো, পিরিয়ড হয় যে নাড়ির জন্য সেটা কেটে ফেললে আর পিরিয়ড হবে না?

তুবাঃ হ্যা জানি।

আফরাঃ তুমি চাইলে সেই নাড়ি কেটে ফেলতে পারতে, তাহলে কেটে ফেল নাই কেন? সেই নাড়ি কেটে ফেললে তো আর এই অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করতে হত না তোমাকে।

তুবাঃ সেই নাড়িটা কেটে ফেললে তো আমার আর কখনো বাবু হবে না।

আফরাঃ বাবুর জন্য তুমি এতদিন কষ্ট করবা?

তুবাঃ হ্যা, বাবু না হলে তো আমি সম্পূর্ণ নারী হতে পারব না। একটি মেয়ে মা হলেই তো সে পূর্ণ নারী হয়।

আফরাঃ তুমি তো জানো ডেলিভারি কতটা রিস্কি, তোমার জীবনও চলে যেতে পারে। তবুও তুমি বাবু নিবা?

তুবাঃ হ্যা, জানি। তবুও আমি বাবু নিব। কারণ আমিও মা হতে চায়। [কান্না অনেকটা কমে গেছে]

আফরাঃ তাহলে তুমি সুইসাইড করতে গেছিলা কেন?

তুবাঃ মানে? [অবাক হয়ে]

এতোক্ষণ আফরা আর তুবা কথা বলছিল, তুবার রুমের বারান্দায় বসে। আফরা তুবা দুই খালাত বোন। ওরা একি সাথে কলেজে পড়ে। বোনের থেকে বন্ধুত্বটা বেশি ওদের মাঝে। তুবা গতরাতে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারে নাই। তুবার ছোট ভাই বুঝতে পেরে তার আম্মুকে বলে দেয় আর ওর আম্মু এসে তুবাকে সুইসাইড করা থেকে বাঁচায়। রাতে তুবাকে কেউ কিছু বলে নাই। কোন কিছু জানতেও চায় না, সুধু তুবার আম্মু তুবার সাথে রাতে থাকে। রাতেই আফরাকে তুবার বাসায় আসতে বলা হয়। কারণ আফরা পারে তুবা থেকে কথা জানতে আর তুবাকে বুঝাতে। সকালেই আফরা তুবার বাসায় আসে। আর জানতে পারে তুবার সুইসাইড করার কারণ।

তুবা প্রায় তিন মাস থেকে একটা ছেলেকে পছন্দ করে। এক মাস ছেলেটাকে দেখার পর ছেলেটাকে প্রোপজ করে। ছেলেটা রাজি হয়ে যায়। তারপর দুই মাসের মত সময় তারা রিলেশনশিপে ছিল। গতকাল সকালে হটাৎ করে ছেলেটা বলে সে আর রিলেশন কনটিনিউ করতে পারবে না। কারণ জানতে চাইলে বলে সে আর তুবাকে পছন্দ করে না। তুবা সারাদিন ছেলেটাকে বুঝায় কিন্তু ছেলেটা কোন ভাবেই তুবার কোন কথার গুরত্ব দেয় নাই। যার ফলে সে রাতে সুইসাইড এটেম্প নিতে যাচ্ছি।

আফরাঃ আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি ব্যাপারটা। তুবা কান্না একে বারে থামিয়ে দিয়েছে আর খুব আগ্রহসহ কারে আফরার কথা শুনতে লাগল।

আফরাঃ একটি মেয়ে ছোট থেকেই মা হতে চায়, খেলার ছলে মা হয়, পুতুল খেলার সময় থেকে একটি অবুঝ মেয়ে মা হওয়ার আগ্রহ দেখাই। এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তারপর পিরিয়ড হয়, সে মেয়েটা তখন জানতে পারে পিরিয়ড না হলে সে মা হতে পারবে না। পিরিয়ডের অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করেও সে কখনো নাড়ি কাটতে চায় না। কারণ সে জানে নাড়ি কাটলে তার কষ্টটা কমলেও সে কখনো মা হতে পারবে না। তারপর বিয়ে করে প্রেগন্যান্ট হয়, তখনো সে হাজার কষ্ট সহ্য করে শুধু মাত্র মা হবার জন্য। পেটে থাকা অবুঝ বাচ্চার জন্য সে কত কি করে। সে মেয়েটা কিন্তু জানে না তার পেটের বাচ্চটা কেমন দেখতে, ছেলে নাকি মেয়ে। সে কিছু জানে না তবুও সে মেয়েটা বাচ্চার জন্য হাজারো কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করে, শুধু মাত্র মা ডাক শুনার জন্য। আফরা এতটুকু বলে থামল, তুবা অধিক আগ্রহ নিয়ে আফরার কথা শুনছে। আফরা অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে যার কারণে যে কেউ তার কথা কুব মনোযোগসহ শুনতে পছন্দ করে।

আফরাঃ তারপর আসে সেই সময়, যে সময়টা প্রতিটা মেয়ের জন্য কষ্টকর। ডেলিভারির সময় মেয়েটা মারাও যেতে পারে তবুও সে কোন কিছু না ভেবে শুধু বাচ্চাটার জন্য ডেলিভারি করতে যায়। বাচ্চা যেমনই হোক না কেন বাচ্চা হবার পর সে মা হবার আনন্দে আত্নহারা হয়ে যায়। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?

তুবাঃ হ্যা, আমি বুঝতে পারছি।

আফরাঃ এখানে শুধু কষ্টেরই কথা বললাম। এখানে প্রাপ্তিটা কি জানো?

তুবাঃ হ্যা, মা হওয়া। একটি ছোট বাচ্চার মুখ থেকে মা ডাক শুনা।

আফরাঃ হ্যা, তুমি বুঝেছ। এবার বল এত কষ্ট করার পর সে বাচ্চাটা কত আদরের হবে?

তুবাঃ অনেক আদরের হবে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এত কষ্ট করার পর সে বাচ্চাটাই তো সব থেকে আদরের হবে। সেই বাচ্চাটাই তো তখন মেয়েটার বাচার কারণ হয়ে যাবে।

আফরাঃ হ্যা, আর যদি সেই বাচ্চাটা বড় হয়ে তার মাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যায় তখন তার মায়ের কেমন হবে বলতে পারো?

তুবাঃ খুবই খারাপ হবে। এতো কষ্ট করার পর, এতো কিছু সহ্য করার পর যদি সন্তান মায়ের সাথে না থাকে তাহলে তো সেই মা আর সহ্য করতেই পারবে না।

আফরাঃ হ্যা, ঠিক বলেছ। এখন বলতো আমার এই গুলো কথা বলার কারণ কি?

তুবাঃ জানি না।

আফরাঃ আমার এত গুলো কথা বলার কারণ তুমি। তোমার জন্য আমি এত গুলো কথা বললাম। তুমি রাতে সুইসাইড করতে চেয়েছিলা, তখন কি তোমার মনে হয় নাই তোমার সে হাজারো কষ্ট সহ্য করা মায়ের কথা। যে শুধু তোমার জন্য কিশোরি বয়স থেকে কষ্ট সহ্য করে আসছে। তোমাকে না দেখেও তোমাকে ভালোবেসে পেটে ধারণ করেছে, ছোটখাট ব্যাগের মত ভাড় পেটে নিয়ে ১০ মাস হেটে বেড়িয়েছে। তার এই আকাশ সমান ভালোবাসা পায়ে ফেলে তুমি কিভাবে সুইসাইড করতে গিয়েছিলে?

তুবাঃ আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে, আমি বুঝতে পারি নাই। তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আবির [তুবার বয়ফ্রেন্ড] এভাবে আমাকে ছেড়ে দিবে আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। [কান্না করে]

আফরাঃ আবির তোমার জন্য কি করেছে যে তুমি ওকে ভালোবাস?

তুবাঃ সে তো আমার জন্য কখনই কিছু করে নাই। শুধু কথাই বলেছে আমার সাথে।

আফরাঃ যিনি তোমার জন্য এত কষ্ট করে তোমাকে জন্ম দিয়েছে তার কথা না ভেবে তুমি আবিরের কথা ভেবে মরতে চায়ছিলা যে তোমাকে ভালোওবাসে না? [অবাক হয়ে]

তুবাঃ আমি ভুল করে ফেলেছি। তখন আমার মাথায় কিছু আসছিল না।

আফরাঃ আজ তোমাকে আরো কিছু কথা বলি। আমি জানতাম না যে তুমি কোন ছেলের সাথে রিলেশনশিপে আছো, জানলে তোমাকে বুঝাইতে পারতাম। সে যায় হোক, প্রথমত রিলেশন হারাম তাই আবিরের সাথে কথা বলায় তুমি অন্যায় করেছ। আর দ্বিতীয়ত আত্বহত্যা করা হারাম তবুও তুমি সেটা করেছ। অবৈধ সম্পর্ক আর আত্বহত্যা করে তুমি জাহান্নামে যেতে চেয়েছিলাম। আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তিনি তোমাকে সুযোগ দিয়েছেন নিজের ভুল সুধ্রে আল্লাহর পথে ফিরে আসার জন্য। আর একটা কথা যেটা না বললেও নয়, যে ছেলে তোমাকে ভালোবাসে নাই কখনো তার জন্য তোমার জীবন দিতে যাচ্ছিলা, এটি করে তুমি তোমার মায়ের ভালোবাসার অপমান করেছ। তোমার উচিত ছিল অন্যের কথা না ভেবে তোমার মায়ের কথা ভাবা, যিনি তোমার জন্য নিজের সর্বস্ব দিয়ে তোমাকে ভালোবাসে। তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করে।

তুবাঃ হ্যা, তুমি ঠিক বলেছ।

আফরাঃ তুমি যে বুঝতে পেরেছ এতেই আমি খুশি। আশা করি এমন হারাম কাজে আর নিজেকে জরাবা না আর মায়ের ভালোবাসার অপমান করবা না। আল্লাহ তোমাকে যা কিছু দিয়েছেন তার মধ্যে তোমার মা একটি অন্যতম নিয়ামত। সেই নিয়ামতের সঠিক মর্যাদা না রাখতে পারলে তোমার যোগ্যতা নেই তার সন্তান হবার।

তুবাঃ এভাবে বলো না প্লিজ। আমি আর এমন কাজ করবো না। আর আমি যা করবো সেটা শুধু আমার আম্মুর জন্য করবো, অন্য কোন ব্যক্তির জন্য না। আমি বুঝতে পেরেছি আম্মু আমার জন্য কতটা কষ্ট করেছে।

আফরাঃ আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কথায় খুশি হলাম। খালা তোমার এই কাজের জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে। যার জন্য তিনি এখনো কান্না করছেন। তুমি খালার সাথে কথা বলো আর মাফ চেয়ে নাও।

তুবাঃ হ্যা, আমি যে কাজ করেছি তার জন্য আমি লজ্জিত। এখন আমি বুঝতে পেরেছি কত বড় অন্যায় কাজ করতে গেছিলাম আমি। ছি! এখন নিজের অপরই রাগ লাগছে।

আফরাঃ রাগ করো না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, যিনি তোমাকে একটা সুযোগ করে দিয়েছেন। আর তওবা করো।

তুবা এবার উঠে গিয়ে তার মায়ের কাছে যায়। আর আফরা আকাশ পানে তাকিয়ে থেকে নিজের অজান্তে বলে ফেলল, ‘আম্মু আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি তোমার ভালোবাসার অপমান করবো না কখনো, তোমার ভালোবাসার মর্যাদা রাখবো, ইয়া আল্লাহ তুমি আমাকে তওফিক দান করো’

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত