বাসর রাতে মেয়েটি স্পষ্ট স্বরে জানিয়ে দেয় –
– এইযে শুনুন, আমি কিন্তু আপনাকে বিয়ে
করতে চাইনি রাহাত বেশ ভদ্র, মার্জিত ছেলে। হাসিমুখে জবাব দেয় –
– হ্যা, জানতাম।
– তো বিয়ে করলেন কেন?
– এমনি
– শুনুন, রাগাবেন না! এমনি কোন কিছু হয় না, রাহাত কি বলবে ভেবে পায় না। বিয়েটা ওর মায়ের ইচ্ছেতেই হয়েছে। মায়ের ইচ্ছের ওপর না বলতে পারেনি। রাহাত চুপ করে থাকে। ইতোমধ্যে মেয়েটি রেগে নাকের ডগা আর মুখ টকটকে লাল করে বসে আছে।
– কি ব্যাপার! চুপ করে আছেন কেন? সোজাসুজি বলে দিচ্ছি, আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না! আর আপনি আমাকে মোটেও স্পর্শ করবেন না! রাহাত হেসে মাথা নাড়ায়। সুন্দরীদের রাগলে বেশ লাগে। কিন্তু রাহাত আর রাগাতে সাহস পায় না। এমনিতেই যা তিরিক্ষি মেজাজ করে বসে আছে! রাহাত আস্তে করে গিয়ে নিজের বালিশে মাথা রেখে শোয়। দুজনেই ছাদের দিকে চেয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি রাহাতের উল্টোপাশে মুখ ফিরিয়ে শোয়। একসময় মেয়েটি নিজ থেকেই কথা বলা শুরু করে, এবার কন্ঠে আর কোন রাগ নেই, কেমন যেন কান্নাভেজা কন্ঠস্বর-
– আমি একজনকে ভালোবাসতাম! রাহাত অবাক হয়। ও জানত না এসব। খানিকটা অবাক সুরে বলে,
– উনি কোথায় এখন?
– ও বেঁচে নেই আর!
বলে মেয়েটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। রাহাতেরও বেশ মন খারাপ হয়। মেয়েটাকে কি বলে যে স্বান্ত্বনা দিবে তা ভেবে পায় না ও। রাহাত চুপ করে থাকে। আর ওদিকে মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে।
রাহাত নিজের হাতটা মেয়েটির মাথার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় একটু, কিন্তু আবার হাতটা সরিয়ে নেয় কি মনে করে । চুপ করে শুয়ে থাকে সে। পরদিন খুব ভোরে আজানের শব্দে ঘুম থেকে উঠে পড়ে রাহাত। উঠে দেখে মেয়েটি তখনো ঘুমিয়ে। অযু করে ফজরের নামাজ আদায় করে নেয় সে। তারপর কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে। ততক্ষনে আকাশ বেশ ফর্সা হয়ে উঠেছে। কিন্তু মেয়েটি তখনও ঘুমিয়ে। মেয়েটির নাম নিশাত। সকাল প্রায় নয়টা বেজে গিয়েছে তখন।
রাহাত ইজি চেয়ারে বসে একটা উপন্যাস পড়ছিল। হঠাৎ বিছানা থেকে নিশাতের গলার অস্ফুট আওয়াজ পেয়ে বিছানার দিকে তাকায়। দেখে, মেয়েটি ঘুম থেকে উঠেছে আর ঘোরের মাঝে কি যেন বলছে অস্ফুট স্বরে। রাহাত তাড়াতাড়ি নিশাতের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নিশাতের লম্বা চুল মুখের উপর ছড়িয়ে আছে এলোমেলোভাবে। রাহাত হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে দেয়ার সময় টের পায়, কপালটা ভীষণ গরম নিশাতের! রাহাত আঁতকে উঠে! ভীষণ জ্বর মেয়েটার! তড়িঘড়ি করে এক বালতি পানি আর মগ এনে নিশাতের মাথায় আস্তে করে পানি ঢালে রাহাত। কিছুক্ষণ পর শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। নিশাত উঠে বসতে চাইলে ওর হাত ধরে উঠে বসতে সাহায্য করে রাহাত। তারপর , রাহাত গিয়ে নিজ হাতে বানানো ব্রেকফাস্ট এনে নিশাতকে খাইয়ে দিতে যায়। মেয়েটা বলে ওঠে,
– ব্রেকফাস্ট কে বানিয়েছে?
-আমি ( অবনত মুখে )
– খাইয়ে দেয়া লাগবেনা,
এদিকে দিন, আমি খেয়ে নিচ্ছি রাহাত কিছু মনে করে না। চুপ করে নিশাতের কাঁপা কাঁপা হাতে খাওয়া দেখে অবাক চোখে। মুখ দেখে বুঝা যায়, মেয়েটি সারারাত ঘুমায় নি। তবে বুকে সূক্ষ্ণ অনুভূতি জাগানো মায়াবী মুখ মেয়েটার। রাহাত অপলক চোখে চেয়ে থাকে। রাহাত ভেবেছিল জ্বর বুঝি সেরে গিয়েছে।
কিন্তু সেদিন রাত্রে শরীর কাঁপিয়ে আবার জ্বর এলো নিশাতের। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে ও । তাড়াতাড়ি করে নিশাতকে হাসপাতালে নিয়ে যায় রাহাত। মেয়েটির কষ্ট দেখে বুকটা ভারী হয়ে আসছে ওর। হাসপাতালে নেয়ার পর , ডাক্তারের দেয়া ওষুধ খাওয়ানোর পর জ্বর কিছুটা কমে নিশাতের। কিন্তু চোখ দুটো খুলতেও যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। রাহাত নিজ হাতে রাতের খাবার রান্না করে আনে নিশাতের জন্য। মেয়েটি তখনো নিজ থেকে উঠে বসতে পারেনি। রাহাত ওকে উঠে বসায়। নিশাতের মুখ দেখে ভীষণ মায়া হছে ওর। চেহারাটা কেমন রোগা রোগা হয়ে গিয়েছে। রাহাত নিজ থেকেইনিশাতের দিকে খাবার এগিয়ে দেয় নিজ হাতে। নিশাত দুর্বল স্বরে বলে,
– আমাকে দিন, আমি খেয়ে নিচ্ছি এবার রাহাতের মন খারাপ হয় ভীষণ। অবনত চোখে নিশাতের দিকে খাবারের প্লেট এগিয়ে দেয়। অল্প করে খেয়ে নিশাত আবার শুয়ে পড়ে। ঘুমানোর আগে রাহাতকে বলে,
– আপনিও শুয়ে পড়ুন রাহাত হেসে মাথা নাড়ায়। নিশাত পাশ ফিরে শোয়। রুমের লাইট বন্ধ করে রাহাত নিশাতের পাশে বসে থাকে। জানালার ফাঁকে রাতের শহরের ঢাকা দেখা যায় ওই। আকাশভরা তারা,নিচের রাস্তায় গাড়ির হেডলাইটগুলোর ছুটোছুটি আর অন্ধকারের মাঝে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে রাহাত। এই যান্ত্রিক শহরে কেমন একা বোধ করছে আজ ও!
সারারাত ঘুমায়নি রাহাত। শেষরাতের দিকে আবার প্রচন্ড জ্বর উঠে নিশাতের। রাহাত তড়িঘড়ি করে এক বালতি পানি এনে নিশাতের মাথায় ঢালে অল্প করে আর ভীষণ গরম কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। যেন নিশাতের শরীরের উত্তাপগুলো শুষে নিতে চাইছে। তখন প্রায় ভোর হয়ে গিয়েছে। সূর্যের আলো একটু করে ছড়াচ্ছে চারিদিকে। রাহাত নিশাতের কপালে পানি ঢেলে চলেছে। একসময় নিশাতের জ্বর কমে যায় একটু করে। নিশাত চোখ মেলে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে একটি অনিদ্রারত রুগ্ন মুখ ওর দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসছে। নিশাত জিজ্ঞেস করে,
– আপনি ঘুমাননি?
– ইয়ে মানে, ঘুম আসছিলো না , তাই জেগে ছিলাম
– ও
– খুব ক্ষুধা লেগেছে আপনার, হু?
– হ্যা
– একটু অপেক্ষা করুন
রাহাতের দিকে চেয়ে নিশাত অবাক হয় ভীষণ। রাহাত তাড়াতাড়ি করে আনাড়ি হাতে বানানো ব্রেকফাস্ট নিয়ে এগিয়ে যায় নিশাতের দিকে। হাতে খাবার তুলে নিয়েও কি মনে করে আবার রেখে দেয় প্লেটে। তারপর, প্লেটটা এগিয়ে দেয় নিশাতের দিকে অবনত চোখে। নিশাত প্লেটটা হাতে নিয়ে অভিমানের সুরে বলে,
– খাইয়ে দিবেন না? অবাক চোখে নিশাতের দিকে তাকায় রাহাত! দেখে, মিটিমিটি হাসছে মেয়েটা। নিশাত আবার জিজ্ঞেস করে,
– কি, খাইয়ে দিবেন না আমাকে?
রাহাতের মুখে তখন বিশ্বজয়ের হাসি। সকালের সোনালী রোদ জানালার ফাঁক গলে তখন আছড়ে পড়ছে দুজনের গায়ে। হাসিতে উদ্ভাসিত চারিদিক। ভোরের আলো সাক্ষী হয়ে রইলো একটি নতুন সূর্যোদয়ের আর একজোড়া প্রাণের ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ইতিহাসে । ভালো থাকুক ভালোবসা গুলো।!