ভালোবাসা

ভালোবাসা

ঝুমুর গেইটে এসে দাড়ালো। সুমন বাইক নিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়েই সোজা বাইরে বেড়িয়ে গেলো৷ আজকে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। তবুও ঝুমুরের মন খারাপ হলো। অন্তত ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিতে পারতো। ঝুমুর ভাবতে লাগলো আজকাল সুমন অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে। অনেক কম ভালোবাসে। নাকি বাসেনা সেটাও বুঝতে পারছে না। নিজেকে করা এই অদ্ভুত প্রশ্ন গুলোর কোনো মানে নেই। তবুও ঝুমুরের ভাবতে ইচ্ছে করে। একটা সময়ে এসে জীবন কেন বিরক্তিকর হয়ে যাবে?

সারাদিন ঘরে বসে এটা সেটা করা। সন্ধার পর হাসবেন্ড ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করা। অবশ্য আগে সুমনের জন্য অপেক্ষা করতে যেমন ভালো লাগতো এখন সেই ভালো লাগার পরিমাণ অনেকটা কমে গেছে। দূরত্ব যেন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ এসব হওয়ার কথা ছিলোনা। ঝুমুরের অনেক স্বপ্ন ছিল। সবচেয়ে বড় স্বপ্ন যেটা ছিলো তা হলো সারাজীবন সুমনকে ভালোবাসবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে ভালোবাসবে। কিন্তু আজকাল কেন জানি আগের মত ভালোবাসা হয়না। ইচ্ছে করলেও সেই আগের মত ভালোবাসাটা কেন জানি আসেনা ঝুমুরের।

ঝুমুর হঠাৎ ভাবলো ছেলেরাই কেন সবসময় একটা নির্দিষ্ট সময়কে স্পেশাল করে তুলবে? কেন সবসময় ছেলেরাই একটা মেয়েকে ভালোবাসতে গিয়ে মেয়েটার পিছু নিবে, বাড়ির সামনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করবে এক পলক দেখার জন্য, কিংবা মেয়েটার যাতায়াত পথে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকবে এক পলক দেখার জন্য। এসব তো চাইলে মেয়েরাও করতে পারে। ঝুমুর মনে মনে ভাবলো হ্যাঁ আমি করতে পারি। অন্তত এই পরিস্থিতিতে তো করতেই পারি। ঝুমুর তার শাশুড়ী জাহানারা বেগমের রুমে এসে দেখলো জাহানারা বেগম কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। ঝুমুর জাহানারা বেগমকে বলল, “কি ব্যাপার এত সাজুগুজু করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?” জাহানারা বেগম বললেন,

– “একটু মার্কেটে যেতে হবে। তুই যাবি?” ঝুমুর এটাই চেয়েছিলো। সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলো। বলল,
– তাহলে চলো তোমার ছেলের অফিসের পাশে একটা মার্কেট আছে না? ওইটাতে যাই।
– ওটাতো অনেক দূর।
– হলে হোক। ওটাতেই যাবো। জাহানারার বেগম মুচকি হেসে বললেন,

– তোকে নিয়ে আছি বড় ঝামেলায়। মাঝে মাঝে কি সব বায়না করিস না! ঠিক আছে চল। মার্কেট থেকে কেনাকাটা শেষ হলে ঝুমুর বলল,

– তুমি চলে যাও। আমি আজকে উনার সাথে বাসায় ফিরবো।জাহানারা বেগম বললেন,

– সুমনের তো অফিস ছুটি হতে এখনো অনেক দেরি। এতক্ষণ তুই কি করবি?
– রাস্তায় দাড়িয়ে ছেলেদের ইভটিজিং করবো। যাও তো তুমি। আমি উনার অফিসের ভেতর ওয়েটিং রুমে বসে থাকবো। তোমাকে এগিয়ে দিতে হবে?

– হ্যাঁ একটা রিক্সা ঠিক করে দে। এতগুলো ব্যাগ এখন আমারই নিয়ে যেতে হবে। ঝুমুর জাহানারা বেগমের হাত থেকে কয়েকটা ব্যাগ নিয়ে বলল,

– এগুলো আমি নিয়ে আসবো। বাসায় পৌছে ফোন দিবা। ঝুমুর জাহানারা বেগমকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে সুমনের অফিসের দিকে রওনা হলো।

এখন বাজে দুপুর দুইটা। সুমনের লাঞ্চের সময় এখন। ঝুমুর ওয়েটিং রুম ছেড়ে অফিসের বাইরে এসে দাড়ালো৷ এক জায়গায় অনেক্ক্ষণ বসে থাকতে বিরক্ত হচ্ছিলো। এখানে ওয়াই-ফাই এর স্পিড অনেক কম৷ ঠিকমতো ব্রাউজিং করাও যাচ্ছিলো না। ঝুমুর দেখলো সুমন আর তার সাথে একটা মেয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এসে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকেতেছে। ঝুমুর তার ওড়না দিয়ে মুখ ভালোভাবে বেধে ওদের পিছু নিলো। সুমন দের পাশাপাশি একটা চেয়ারে গিয়ে বসলো। ঝুমুরের এটা ভেবে মন খারাপ হলো ওর দেওয়া লাঞ্চ না খেয়ে সুমন অন্য একটা মেয়ের সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছে। সুমনের বিপরীতে বসা মেয়েটা সুমনকে বললো,

– তো কি খাবেন সুমন সাহেব? আজকে আপনার পছন্দ মতো খাবার অর্ডার করি। সুমন বললো,

– আমার জন্য অর্ডার করতে হবেনা। আমি বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছি। আমার বউয়ের হাতের রান্না। ঝুমুর অনেক ভালো রান্না করতে পারে। মেয়েটা বললো,

– ঠিক আছে তাহলে আমার জন্যই অর্ডার করি। এই বলে মেয়েটা একটা লোককে ডেকে কি যেন অর্ডার করলো। ঝুমুর আর সেদিকে নজর দিলো না। ঝুমুরের মনে অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো। সুমন চাইলেই বাসা থেকে আনা খাবার ফেলে দিতে পারতো। কিন্তু সেটা করেনি। সুমনকে অল্প কিছুক্ষণ এর জন্য সন্দেহ করায় ঝুমুরের মনে অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগলো। অফিসের প্রয়োজনে কিংবা সারাদিন একই কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে যে কারো সাথে বাইরে আসতেই পারে। এতে সন্দেহ করা ঠিক হয়নি৷ তবুও ঝুমুর ঠিক করলো আজ বাসায় গিয়ে ইচ্ছে মত বকে দিবে। বিরক্ত হলে একা একা বাইরে বের হবে৷ কোনো মেয়ে নিয়ে বের হতে হবে কেন?

খাওয়া শেষ হলে বিল দিয়ে ওরা বাইরে চলে গেলো। ঝুমুরও ওদের পিছু পিছু বের হয়ে এসে রাস্তায় দাড়ালো। কিছুক্ষণ পর ঝুমুর দেখলো দুইটা ছেলে বাইক নিয়ে সুমন আর সুমনের পাশের মেয়েটাকে ক্রস করে যাওয়ার সময় মেয়েটাকে বাজে কিছু বলেছে। মেয়েটাও রাগ করে ছেলেগুলোকে বকতেছে। সুমনকে দেখে মনে হচ্ছে এখানে কিছুই হয়নি। ওরা দুজন রাস্তা পার হয়ে আবার অফিসে চলে গেলো। ঝুমুর অফিসের ওয়েটিং রুমে বসে দেখলো নেটওয়ার্ক স্পিড এখন আগের থেকে ভালোই আছে।

রাত আটটা বাজলে সুমনের ছুটি হলো। ঝুমুরের আজকের সময়টা স্বাভাবিক রুটিন দিনের চেয়ে অনেক ভালো কেটেছে। সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা হলো। সারাক্ষণ মনে হয়েছে সুমনের খুব কাছাকাছি ছিলো সে। বাসায় থাকলে সেটা একদম মনে হতো না। সুমন অফিস থেকে বের হয়ে পার্কিং এ আসলো। ঝুমুরও সুমনের পিছু পিছু আসলো। সুমন বাইকে উঠে চাবি ঘুরিয়ে বাইক স্টার্ট দিতেই ঝুমুর সুমনকে ডাক দিলো। সুমন ঝুমুরকে এই অসময়ে এখানে দেখে অনেক অবাক হলো।

ঝুমুরকে কাছে ডাকলো। ধমক দিতে যেয়েও কেন জানি দিলো না। ঝুমুর ঘুম থেকে উঠার পর মেকাপ হীন অবস্থায় থাকে। তখনই ঝুমুরকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে। মুখের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। সুমন লক্ষ্য করলো ঝুমুরের কপালে কালো টিপ ছাড়া আর তেমন কোনো সাজগোছ এর চিহ্ন নেই। এজন্যই বোধহয় ধমক দেওয়া হয়ে উঠেনি। সুমন ঝুমুরের হাত থেকে শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে বাইকের পাশে ঝুলিয়ে রেখে ঝুমুরকে বাইকের পিছনে বসতে বললো। ঝুমুর একটা ফুচকার দোকানের সামনে বাইক থামাতে বললে সুমন থামালো। দুইজন দুই প্লেট ফুচকা নিয়ে চেয়ারে বসলো। সুমন ফুচকা তেমন একটা পছন্দ করেনা। কিন্তু এখন না খেলে ঝুমুর কষ্ট পেতে পারে। সুমন বলল,

– আচ্ছা তুমি ‘এইযে, ওই, শুনছেন’ এসব না ডেকে আমার নাম ধরে ডাকতে পারো না? তুমি আবার বউ, নাম ধরে ডাকার অধিকার তো তুমি রাখো তাই না? ঝুমুর বলল,

– নাম ধরে ডাকলে প্রেমিক প্রেমিক মনে হয়। আমার হাসবেন্ড চাই। প্রেমিক লাগবেনা। ঝুমুরের ইচ্ছে করছিলো ওই মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করতে, তারপর ইচ্ছে মত বকে দিতে। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। আলাভোলা একটা ছেলে, কথা বলার সময় মনে হয় তার পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই অসহায় একটা মানুষ। এভাবে কাউকে বকাবকি করা যায় নাকি?

খাওয়া শেষ হলে সুমন বাইক স্টার্ট করলো। ঝুমুর বাইকে উঠতেই দুপুরের ঘটনাটা আবার পুনরাবৃত্তি হলো। দুপুরে হয়েছিলো সুমনের অফিসের মেয়েটার সাথে এখন হয়েছে ঝুমুরের সাথে। বাইকে করে তিনটা ছেলে ঝুমুরকে বাজে ভাবে কিছু বলেছে। সুমন আর দেরি না করে বাইকটার পিছু নিলো। ঝুমুর বারবার করে বারণ করতে লাগলো ব্যাপারটা বাদ দিতে। কিন্তু সুমন নাছোড়বান্দা। এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। রাগে সুমনের হাত কাঁপছিলো। সুমন যে ওই ছেলেগুলোর পিছু নিয়েছে ওরা বুঝতে পারেনি। তাই ওদের ধরতে খুব বেশি অসুবিধা হলোনা। ওদের ক্রস করার সময় পেছনে বসা যে ছেলেটা ঝুমুরকে বাজে কথাটা বলেছিলো সেই ছেলেটাকে এক হাত দিয়ে টান দিয়ে বাইক থেকে ফেলে দিলো। বাইক চালক কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললো। ওদের পুরো বাইকটা রাস্তায় পড়ে গেলো। এই ফাঁকে সুমন বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলো। কিছুদূর আসার পর ঝুমুর বললো,

– কি দরকার ছিলো এসব করার? আপনার যদি কিছু হয়ে যায়? আজকে না হয় বেঁচে গেলাম, এরপর অন্যদিন ওরা যদি আপনার কিছু করতে আসে?

– যা হবার দেখা যাবে। ইচ্ছে তো করছিলো মেরে ফেলি। তাছাড়া তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এই কাজটাই করতাম। ঝুমুরের দুপুরের ঘটনাটা মনে পড়লো। সুমন তখন ওই ছেলেগুলোর উপর একটুও রাগ দেখায়নি এমনকি মেয়েটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেনি। এটাই হয়ত প্রিয়জন আর প্রয়োজন এর মধ্যে পার্থক্য। তবে সুমনের কাজটা ঠিক হয়নি। ঝুমুর বললো,

– থাক এখন আর ডায়লগ বাজি করতে হবেনা। দুপুরে দেখেছি তো কি করেছেন।
– তুমি তখন ওইখানে ছিলা?
– হ্যাঁ, আম্মু মার্কেটে কিছু কেনাকাটা করতে এসেছিলো। সাথে আমিও ছিলাম। আম্মুকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আপনার অফিসে বসে ছিলাম। কি করবো বাসায় ভালো লাগেনা!
সুমন বললো,

– তুমি আমার পাশে যারিনকে দেখে উল্টাপাল্টা কিছু ভাবোনি তো? সুমন বাইকের স্পিড কিছুটা কমিয়ে আনলো। স্পিড বাড়ালে শব্দ বেশি হয়। কথা বলতে সমস্যা হয়। ঝুমুর সুমনকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

– আমি জানি আপনি উল্টাপাল্টা কিছু করার মানুষ না।

গন্তব্য বাসায় হলেও আপাতত দুজনেরই ইচ্ছে করছে আজ সারারাত এভাবেই থাকতে। সারারাত বাইকে করে ঘুরবে। পুরো শহরটাকে দেখবে। অধবা শহরের মানুষকে দেখাবে দুটি সুখি মানুষ। ঝুমুরের হঠাৎ মনে হলো ভালোবাসা একটুও কমেনি৷ শুধু ভালোবাসা প্রকাশ করার নিয়মটা পাল্টেছে। প্রতিনিয়ত পাল্টে যাওয়া নিয়মগুলো আয়ত্ত করে নিতে পারলে ভালোবাসার কমতি কখনোই মনে হবেনা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত