অভিমানী

অভিমানী

–মামা একটা টিকিট দিন,,
–কই যাবেন মামা?(কাউন্টার এর লোক)
— মামা ঢাকা যাবো….

অনন্যা সুপার বাসের কাউন্টার থেকে একটা কিশোরগঞ্জ টু ঢাকা টিকিট সংগ্রহ করে বাসে উঠলাম। সাধারণত জার্নির সময় প্রকৃতি দেখতে ভালো লাগে আমার, তাই আমি জানালার পাশের সিটে বসি। কিছুক্ষন পর বাস ছেড়ে দেয়, জানালা দিয়ে তাকিয়ে ভাবছি কতইনা সুন্দর আমাদের এই গ্রাম। চারিদিকে নানা রকম গাছ, গাছের ডাল সবুজ পাতাই ঘেরা। চারিদিক শুধু সবুজ আর সবুজ, এই গাছপালা নদীনালা, ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে যেন প্রকৃতির রূপ আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যরূপ দেখে কবিরা অনাহাসে কতো কবিতা লিখেছেন তার হিসাবই করা কঠিন ব্যাপার। হঠাৎ ভাবনা কেটে যায় লক্ষ করলাম ফোনটা কম্পিত হচ্ছে, ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি লিটন আংকেল কল দিয়ছে,,,

— নমস্কার আংকেল কেমন আছেন??
— হ্যা নমস্কার, বাবা ভালো আছি। তুমি এখন কোথায়??
— এইতো আংকেল আমি এখন ভৈরব আছি,,
— আচ্ছা বাবা সাবধানে এসো।
— আচ্ছা আংকেল ভালো থাকবেন রাখি।

বলেই কলটা কেটে দিই, প্রকৃতির এই রূপে কখন যে ডুবে গিয়েছিলাম বুজতেই পারিনি। এইযে দেখুন আপনাদের আমার পরিচয়ই দেওয়া হয়নি, আমি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, আমার নাম আকাশ বাবা মায়ের একমাত্র পুত্র। আর একটু আগে যে ফোন করেছিল উনি হচ্ছেন আমার বাবার বন্ধু। আর আমি ঢাকা গিয়ে উনার বাসাতেই উঠবো।

কারন,আজ আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে, যেখানে আছে বাবা মায়ের অনেকগুলো ইচ্ছেপূরণ। ভাবতেই আমার আনন্দে চোখে জল চলে আসে যে, বাবা মা এবং আমার স্বপ্ন পূরন হওয়ার সূচনা ঘটেছে। বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি একদিন ঢাকা ভার্সিটিতে পড়বো, অনেক বড়ো হবো। হ্যা, আমি তাদের স্বপ্ন পূরন করতে পেরেছি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়ার সুযোগ পেয়েছি। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর আমি আমার গন্তব্য স্থানে পৌছাই, বাবার দেওয়া ঠিকানা অনুসারে একটা রিকশা নিয়ে আংকেল এর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। কিছুক্ষণ পর বাসার কলিংবেল বাজানোর পর একটা মহিলা দরজা খুলে, হয়তো উনিই মমতা আন্টি।

–নমস্কার আন্টি, কেমন আছেন??(মুখে একটু হাসি এনে)
— এইতো বাবা ভালো আছি, ভেতরে আসো।
— জি,,,
— রাস্তাই কোন প্রবলেম হয়নিতো বাবা??
— না আন্টি কোন প্রবলেম হয়নি।
— তুমার বাবা মা কেমন আছেন??
— জি আন্টি ভালো আছেন।
— আচ্ছা তুমি ফ্রেস হয়ে আসো,আমি খাবার রেডি করছি।

বলেই উনি চলে গেলেন। আমার এখানে কেমন যেন খারাপ লাগছে, সবকিছু নতুন পরিবেশ একটা আনইজি ফিল হচ্ছে। বাবা মাকে ফোন করে জানালাম যে পৌছে গেছি, একটু পর আন্টি খাবার হাতে আসলেন।

— নাও বাবা খেয়ে রেস্ট নাও।
— জি আন্টি, বলেই খাওয়া শুরু করলাম। খেতে খেতে জিগ্যেস করলাম,,,
— আন্টি আংকেল কে দেখছিনা, উনি কোথায়??
— তুমার আংকেল অফিসে, রাতে আসবে।
— ও আচ্ছা,,

খাওয়ার পর আন্টি আমার রুম দেখিয়ে দিলেন, আমি রুমে গিয়ে শুয়ে পরলাম।  বাবা বলেছিল আংকেলের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে আছে, একজন ছেলেকে দেখলাম সোফাই বসে টিভি দেখছে কিন্তু অন্যজন কে দেখলাম না। হয়তো কোথাও গিয়েছে, ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম নিজেও বলতে পারবোনা আপনাদের কি বলবো। কারও ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে গেল, তাকিয়ে দেখি সেই ছেলেটা। আমি উঠে বসতেই,,,,

— ভাইয়া আপনাকে বাবা ডাকছেন(ছেলেটি)
— ও আচ্ছা, ছেলেটাকে দেখে মনে হলো তার ভিতরে যেন ভয় কাজ করছে। ছেলেটার বয়স আনুমানিক ছয় বছর হবে।

— এদিকে আসো ভাইয়া, তোমার নাম কি??(পাশে বসালাম)
— আমার নাম রকি,,,
— ও, কোন ক্লাসে পড়ো??
— ক্লাস ওয়ান।
— ও ভালো, বলেই ছেলেটাকে নিয়ে আংকেল এর কাছে যায়।
— কেমন আছেন আংকেল??
— এইতো ভালো আছি বাবা, তুমি কেমন আছো??
— জি ভালো আছি,,
— তোমার বাবা মা কেমন আছেন??
— ওরা ভালো আছে আংকেল,,
— বসো এখানে,,
— জি আংকেল।

এই ঋতু আমাদের জন্য চা নিয়ে আইতো মা,,মনে মনে ভাবলাম ঋতু হয়তো উনার মেয়ে। লক্ষ করলাম পাশের রুম থেকে একটি মেয়ে চা আর কিছু বিস্কিট নিয়ে আসছে। মেয়েটাকে দেখে আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম, এতো সুন্দর ও মানুষ হয়। মেয়েটাকে না দেখলে হয়তো বুঝতামনা। মেয়েটির রূপের কি বর্ণনা দিবো, মেয়েটাকে দেখেতো আমি নিজেকেই ভুলে গেলাম। মেয়েটার চোখ গুলো যেন হরিণের মতো টানাটানা, নাকটা যেন বাঁশির মতো। মুখটা যেন পূর্ণিমারচাঁদ, হঠাৎ একটা শব্দে হকচকিয়ে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি মেয়েটি টি টেবিলে চা রাখছিল। মুহূর্তেই লজ্জায় পড়ে গেলাম, আমার এই তাকানো কেউ দেখেনিতো?? আমি নিচে তাকিয়ে নিজেকেই গালি দিলাম। আর একটু হলেইতো ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যেত। আর কিছুক্ষণ তাকালে হয়তো মেয়েটার মায়াজালে আটকে যেতাম। ভাগ্যিস নিজেকে কন্ট্রোল করতে পেরেছি।

–মা এ হচ্ছে আকাশ, তোকে বলেছিলাম না গ্রামের তোর কাকার কথা।তার ছেলেই আকাশ, ও এখানেই থাকবে। ও অনেক মেধাবী ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে।

–নমস্কার,, (ঋতু)
— নমস্কার, কোন রকম বললাম, এখনো আমার লজ্জা কেটে উঠতে পারিনি।
–আকাশ ঋতু এইবার এইচএসসি পরীক্ষা দিবে, তুমি একটু তাকে হেল্প করো বাবা।
— জি, আংকেল। আংকেল আবার বলতে লাগলো,,,,
–জানিস মা, আকাশের বাবা অনেক ভালো একটা মানুষ।

সে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে, সে যদি সাহায্য না করতো তাহলে আজকে হয়তো এখানে থাকতে পারতাম না।আমরা অনেক ছোট কালের বন্ধু। একসাথে স্কুলে যেতাম, আড্ডা দিতাম,স্কুল পালানো থেকে আরো অনেক কিছু।সময় হলে অন্য একদিন বলবো। আচ্ছা তোরা কথা বল আমি আসছি। বলেই উনি চলে গেলেন, আংকেল এর মুখে বাবার প্রশংসা শুনে বুকটা গর্বে ফুলে গেল। লক্ষ করলাম কথা বলার সময় আংকেল এর চোখে জল জমা হয়েছিল। হয়তো আংকেল তা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যেই উঠে চলে গেলেন। আসলেই আমার বাবা আমার দেখা একজন মহান ব্যক্তি। যে নিজের কথা চিন্তা না করে অন্যকে নিয়ে ভাবে। হয়তো আংকেল কে ও এরকম কোন সাহায্য করেছে।

কিছুক্ষণ বসে থেকে আমি চলে আসি আমার রুমে। এভাবে কিছুদিন কেটে যায়, আজ আমার ভার্সিটির প্রথম ক্লাস, তাই সকালে ঘুৃম থেকে উঠে আগেই রেডি হয়ে গেলাম। ভার্সিটি লাইফের প্রথম ক্লাস বলে কথা। কোনরকম খেয়ে বেরিয়ে পরলাম, একটা রিকশা নিয়ে সোজা ভার্সিটি চলে গেলাম। প্রথমে এতো ভালো লাগেনি, কারন এখানে আমি একা। চেনা পরিচিত কেউ নেই আমার, তাই প্রথম দিনটি কোন রকম কেটে গেল। প্রায় বিকেল হয়ে গেল, একটা রিকশা নিয়ে বাসাই চলে আসলাম। বাসাই এসে কিছু খেয়ে ছাদে চলে গেলাম, এর আগে আমি এই বাসার ছাদে উঠিনি। আজকে ইচ্ছা হলো তাই এলাম, ভালোই লাগছে ছাদটা। নানা রকম ফুল গাছ, ছাদের কোনাকুনি দোলনা আছে। সবকিছু মিলিয়ে ভালই লাগলো আমার। হঠাৎ লক্ষ করলাম ফোন বাজছে,

— হ্যা, বাবা কেমন আছো??( আমার মুখে হাসি ফুটে ওটে)
–ভালো আছি, তুই কেমন আছিস??
–ভালো বাবা, মা কেমন আছে?
–হা ভালো আছে,

নে তোর মায়ের সাথে কথা বল।( ফোনের ওপাশ থেকে মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে,বাবার কাছ থেকে এক প্রকার কেড়েই নিচ্ছে ফোনটা। কথা বলার জন্য, হয়তো অনেক কথা জমে আছে তার। ভাবতেই আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়)

–হ্যালো, মা….
–( ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে, ফোনটা ধরেই মা কাঁদছিল)
— মা, তুমি কাঁদছো কেন??( কোন রকম বললাম, গলা ধরে আসছিল)
— কই নাতো,কেমন আছিস বাবা??
— হ্যা মা ভালো আছি, তুমি কেমন আছো মা??
–হ্যা, বাবা ভালো আছি।ভার্সিটির প্রথম দিন কেমন কাটলো বাবা??
–হ্যা মা ভালো।
–ওইখানে তোর কোন সমস্যা হচ্ছে না তো বাবা??
— না মা, ওরা অনেক ভালো মানুষ, এই কিছুদিনেই কতো ফ্রি হয়ে গেছে ওরা।যেন আমি তাদের নিজের সন্তান।
–শুনে খুশি হলাম বাবা, কোনদিন ওদেরকে কোন কারনে কষ্ট দিসনা বাবা। লক্ষ রাখিস তোর কারনে যেন কেউ কষ্ট না পায়।

–মা, তোমার ছেলে কি কাউকে কষ্ট দিতে পারে??(একটু অভিমানী গলাই)
— ওরে বাবা, আমার ছেলেটা কি আমার সাথে অভিমান করেছে নাকি??
— হ্যা করেছে, তুমি এমন ভাবে বললা কেন।তোমার ছেলেকে তুমি চিনোনা?
–আরে বাবা আমি এমনি বলেছি, আর তুই??
— মা কোথায় ভেবেছি তুমি অভিমান ভাঙ্গাবে, এখন দেখছি আমার মায়ের অভিমানই আগে ভাঙ্গাতে হবে।
— হাহাহা, আচ্ছা বাবা তোর বাবা ডাকছে পরে কথা বলি??
— আচ্ছা মা ভালো থেকো।।

ফোনটা কেটে দিলাম, আমি জানি আমার মা ভালো নেই। আমাকে ছাড়া আমার মা অনেক কষ্টে আছে আমি জানি। তারপর ও কষ্ট গুলো ছাপা দিয়ে রেখেছে, কারন তার ছেলে জানলে কষ্ট পাবে ভেবে। আসলে জানেন কি, বিশ্বের প্রতিটা মা নিজের সন্তানের ভালোর জন্য নিজের আনন্দ গুলো বিসর্জন দিয়ে দেয়। কারন তারা চাই তার সন্তান ভালো থাকুক। আমার মাও তাদের মাঝে একজন। কারন তার ছেলে বড় হবে বলেই তার ছেলেকে দূরে পাঠিয়েছে পড়ার জন্য। হয়তো অনেক রাতে ছাপা কান্নাই বালিশ ভিজাই। মায়ের কথা ভাবতেই কখন যে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে টেরই পাইনি। হঠাৎ কারো আসার শব্দে চোখ মুছে ফেললাম। ঋতুকে দেখলাম আমার দিকেই আসছে, এই কয়েকদিনে তার সাথে মোটামুটি ফ্রি হয়ে গেছি। মেয়েটা একটু চাপা স্বভাবের হলেও কেন যেন আমার সামনে কম কথা বলে। হয়তো লজ্জা পাই, আসলে আমিও একটু লজ্জা পাই। তাই হয়তো ও কথা বলতে সংকোচ বোধ করে। তবে মেয়েটা অনেক মিষ্টি ভাবে কথা বলে।

— কি ভাবছেন ??(ঋতু)
— কই কিছুনা, এমনি বসে আছি..
— কেমন কাটলো ভার্সিটির প্রথম দিন??(নরম গলায়)
— জি ভালো,,(অন্যদিক তাকিয়ে)
— আচ্ছা আপনি ছেলে না মেয়ে??(রাগী লুক নিয়ে)
–মানে??(অবাক হয়ে গেলাম আমি)
— মানে এইযে আমি কথা বলছি আপনি লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন।এতো লজ্জা ছেলেদের থাকলে চলে???(একবারে কথা বলে থামল) মনে মনে ভাবলাম কি মেয়েরে বাবা, কোনোরকম কথা ঘুরিয়ে…

— কলেজে যাননি??
–আপনি জানেন আমি কলেজে গেছি, তারপরও কেনো জিগ্যেস করলেন??(ভ্রু খুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে কতাটি বললো ঋতু) কথাটি শুনে আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। মেয়েটাকে প্রথমে অনেক মায়াবী মনে হয়েছিল, এখনতো একটু অন্যরকম…..

— না মানে ইয়ে….
— হয়েছে হয়েছে আর মানে মানে করতে হবেনা, আচ্ছা আপনি এদিকে তাকান তো,,(তার দিকে ইশারায়)
–কোন দিকে (আমি নিচে তাকিয়েই আছি)
–সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন ঠিকাছে?? ( একটু ধমক দিয়ে) আমি কোন রকম খাচুমাচু হয়ে জবাব দিলাম…

–ঠিকাছে…
— কি ঠিকাছে??
–আমি আপনার চোখে চোখ রেখে কথা বলবো।
–এইতো গুড বয়, আচ্ছা আমি আপনার বড় না ছোট??
— ছোট…
–তাহলে আপনি আমাকে আপনি করে বলেন কেন??
–না মানে অপরিচিত তাই…
— আমি আপনার ছোট তাই তুমি করে বলবেন ঠিকাছে??
— জি আচ্ছা।(চোখ সরিয়ে ফেললাম)
— আপনাকে না বললাম, চোখে তাকিয়ে কথা বলতে(রাগি গলাই)
— কিছু মনে করবেন না, আমি আসলে অপরিচিত কারো চোখে তাকিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করি..
— ওওও!! সমস্যা নাই ঠিক করে ফেলবো।

কথাটি বলেই মুচকি হেসে চলে গেল। আর আমি হা হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। নিজেই নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে, নিজে নিজেই কিছুক্ষণ বিড়বিড় করলাম। আকাশ তোকে একটা মেয়ে শাসিয়াছে আর তুই??? কিছুই বললি না!!

প্রায় তিনবছর কেটে যায়,আমি আর ঋতু এখন খুব ভালো বন্ধু। ও আমাকে তুমি করে বলে এখন, ঋতু এখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হয়। আমরা দুজন একসাথেই ভার্সিটি যায় এখন। দিনগুলো ভালোই কাটছিল। ঝগরা,খুনসুটি, অভিমান সবকিছু মিলেই আমাদের দিনগুলো কাটছিল। ভার্সিটি লাইফে একটাও প্রেম আসেনি কারন ঋতু। একটা মেয়ের দিকে তাকাতেই পারিনা আবার প্রেম। আচ্ছা ও কি আমাকে ভালবাসে? হয়তো ভালবাসে, আমি ভালবাসিনা তা না আমিও ওকে খুব ভালবাসি। কিন্তু আমাদের এ সম্পর্ক কখনওই হওয়ার নই। কারন আমি যে আংকেল আন্টিদের কষ্ট দিতে পারবোনা। আমি যে বাবা মাকে কথা দিয়েছি আমার কারনে ওরা কখনওই কষ্ট পাবেনা।

–ঋতু তুমি রেডি??
— হা, তুমি নিচে গিয়ে একটা রিকশা ঠিক কর আমি আসছি।(পাশের রুম থেকে)
— আচ্ছা ঠিক আছে। বলেই আমি নিচে নেমে যায়। এই মামা থামেন চলো চলো তাড়াতাড়ি উঠো দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঋতু রিকশাই উঠে গেলো,

— আচ্ছা আকাশ একটা কথা বলবা??(নরম গলাই জিগ্যেস করে ঋতু)
— হুম বলো
— তুমি কি কাওকে ভালবাস??
— হঠাৎ এই কথা?
— না এমনি জানতে ইচ্ছা হলো তাই তার কথা শুনে আমি হো হো করে হেসে দেই।
— এই তুমি হাসছো কেন??(চোখ গুলো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে)
— না এমনি( হাসি আটকাবার চেষ্টা)
— আমার কথার উত্তর পেলাম না।
— ভালবাসবো কেমনে বলো? তুমিতো কোন মেয়ের দিকে তাকাতেই দাওনা।
— আচ্ছা আকাশ, আমি যে তুমার উপর এই অধিকার কাটাই তুমি কি রাগ করো? কথাটি খুব নরম গলাই বলে মাথা নিচু করে ফেলে ঋতু।

— না না রাগ হবো কেন? তুমিতো আমার খুব ভালো একটা ফ্রেন্ড।তাই আমার উপর অধিকার কাটানোর অধিকার তুমার আছেই।
— শুধুই কি আমরা ফ্রেন্ডস??

আমি আর কিছুই বলিনি, রিকশাটা বামে থামালাম। ভাড়া মিটিয়ে দুজন দুদিকে চলে গেলাম। কিছুদিন ধরেই ও এরকম প্রশ্ন করছে। ও আমাকে অনেক ভাবেই বোঝানোর চেষ্টা করছে যে ও আমাকে ভালবাসে। তা বুঝেও আমি তার কথা এরিয়ে যায়। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর ঋতুকে দেখলাম হনহন করে চলে যাচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার ওতো আমাকে রেখে চলে যাওয়ার কথা না। আমি দৌড়ে ওর কাছে গেলাম, ঋতু একটা রিকশাই ওঠে পরে। আমি ওঠবো ঠিক সে মুহূর্তে আমাকে নামিয়ে চলে গেল। ব্যাপারটা কি হলো কিছুই বুঝলাম না। ও কেন এরকমভাবে চলে গেল?? আমি একটা রিকশা নিয়ে বাসাই চলে আসি। ঋতু ঋতু!! ওকে ডাকতে তাকি…

— কি হয়েছে বাবা?
— আন্টি ঋতু কোথায়??
— ওতো ছাদে চলে গেছে, কেন তোমাকে বলেনি?
— আচ্ছা আন্টি আমি দেখছি বলেই ছাদে চলে গেলাম। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে দেখলাম ও চোখ মুছে। আমি তার পাশে দাঁড়াতেই ও মুখ ঘুরিয়ে ফেলে।

— ঋতু কি হয়েছে তুমার, এভাবে চলে আসলে কেন??
–(কোন সাড়াশব্দ নেই)
— ঋতু এদিকে তাকাও(আমি তার মুখটা ধরে আমার দিকে ঘুরাই)
— একি তুমি কাঁদছো কেন, কি হয়েছে বল আমাকে!!
–(চুপ)
— কেউ কি তুমাকে কিছু বলেছে বল আমাকে,,
— তুমি এখান থেকে চলে যাও প্লিজ (এক জারি দিয়ে হাতটা নামিয়ে দিল)

অবাক হয়ে গেলাম তার ব্যবহারে। যে মেয়ে আমাকে ছাড়া কোন কিছুই ভাবেনা, আর ও আমাকে চলে যেতে বলছে!!!! আমি ওর হাতটা ধরতেই ও আমাকে থাপ্পড় মারে। আমি গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ও নিচে চলে গেল, এই প্রথম ও আমাকে থাপ্পড় মারল। ভাবতেই ভিতরটা মুচড়ে উঠলো।আমি কি কোন ভুল করেছি ও কেন আজ আমার সাথে এমন করলো?? কোন কিছু না ভেবে রুমে চলে গেলাম। ঋতু তিনদিন আমার সাথে কোন কথা বলেনি। ভার্সিটি যায়নি, কেমন যেন একটা আচরন করছে আমার সাথে। আমার অনেক কষ্ট লাগছে ওর এ রকম আচরন দেখে। পরেরদিন ছাদে গিয়ে দেখি ও দোলনাই বসে আছে।আমি তার পাশে যেতেই ও চলে যেতে লাগলো….

–দাড়াও ঋতু
–আমার একটা কাজ আছে আমাকে যেতে হবে।
–তুমি এরকম করছো কেন প্লিজ বল একবার, কেন আমার সাথে কথা বলছোনা। তুমি কথা না বললে আমার কষ্ট হয় তুমি জানোনা??
–কেন কষ্ট হওয়ার কি আছে, আমি কে তুমার?? আর তুমারতো অনেক মেয়ে ফ্রেন্ডস আছেই, তাহলে আমার কি প্রয়োজন??(গলা ধরে আসছে ওর) এতক্ষণে বুঝলাম কেন ও আমার সাথে এরকম করলো।

— তুমি কার কথা বলছো
— কেন ওইদিন ক্যাম্পাসে হাতে হাত ধরে লুতুপুতু করছিলা এখন মনে নেই??
–ঋতু ল্যাংগুয়েজ ঠিক করো, ওরা আমার ফ্রেন্ডস
— ও আচ্ছা ফ্রেন্ডস, আজ আমাকে একটা কথা বলো, তুমি কি আমাকে ভালবাস??
–কি বলছো তুমি এসব ঋতু………(কথা বলার আগেই ও আাবার বললো)
— থাক আর বলতে হবেনা, আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি।
— দেখ ঋতু আমি জানি তুমি আমাকে ভালবাস, কিন্তু আমার পক্ষে তুমাকে ভালবাসা সম্ভব নই।
— কিন্তু কেন আকাশ, আমি কি দেখতে খারাপ নাকি তুমার অযোগ্য??
— ঋতু তুমি আমার অযোগ্য না, আমিই তুমার অযোগ্য।

তুমি জানোই আমি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আর তুমি অনেক ভাল একটি পরিবারের মেয়ে।কোথায় তুমি আর কোথায় আমি।আর দেখো আংকেল আন্টি আমাকে তাদের নিজ ছেলের মতো করে এতদিন ভালবেসেছে।আমি তাদের বিশ্বাস ভাঙ্গতে পারবোনা।সরি…

–ও আচ্ছা, তুমার কথা শেষ??
–ওকে আজকের পর থেকে তুমি আর কখনো আমার সামনে আসবা না, তুমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
কান্না করতে করতে চলে গেল। আজ অনেক কষ্ট লাগছে আমার, ভালবাসার মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারলামনা যে পাগলি তোমাকে অনেক ভালবাসি, না বলা কথা গুলো হয়তো আর কখনো বলা হবেনা।
আমি রুমে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম,

–আন্টি আমাকে কিছুদিনের জন্য বাড়িতে যেতে হবে।
–কেন বাবা কোন সমস্যা হয়েছে??
— না আন্টি অনেকদিন হলো বাড়িতে যাওয়া হয়নি তাই।
–আচ্ছা বাবা সাবধানে যেও।
— জি আন্টি।

আমি রুম থেকে বেরিয়ে পরি, মনে মনে ভাবছি হয়তো আর কখনো এই বাসাতে আসবোনা।কারন আমার প্রিয় মানুষটি যে আমাকে নিষেধ করেছে। আমি বাসে করে আবার গ্রামে চলে আসলাম। বাবা মা দেখে অনেক খুশি হলো।

–কেমন আছিস বাবা(মা)
— এইতো মা ভালো,
— বাবা তোর কি কিছু হয়েছে, হঠাৎ না জানিয়ে চলে আসলি যে?? ঋতুর সাথে কি ঝগড়া করে চলে আসলি নাকি??
— না মা, এমনি।বলেই ঘরে চলে গেলাম।

তিনদিন হয়ে গেল ঋতু একটা কল বা মেসেজ ও দেয়নি। ওর সাথে কথা না বলতে পেরে অনেক কষ্ট লাগছে।কিছুই ভালো লাগছেনা,আমি এখন বুঝতে পারছি আমার ভিতরে ওর শূন্যতা। তারপরও আমি তার সাথে যোগাযোগ করবো না। কারন ওতো আমাকে নিষেধ করেছে। আমি কল দিয়ে ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে দেখা করি,তাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।অনেকদিন পর তাদের সাথে দেখা হয়ে ভালই লাগছে। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো,তাকিয়ে দেখি আন্টি কল দিয়েছে।

–হ্যালো আন্টি……
— বাবা ঋতু হাসপাতালে ভর্তি তুমি তাড়াতাড়ি আসো ও সুইসাইড করতে ছেয়েছিল।

(আন্টি কান্না করে দিলো)
আমি কোনকিছু না ভেবে মাকে জানিয়ে তাড়াতাড়ি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।মা বাবাও আমার সাথে আসলো।
আমি বাসে বসেই কান্না করে দিই, আজ আমার জন্যই ওর এ অবস্থা হয়েছে।ওর কিছু হয়ে গেলে কখনওই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা। আমি আন্টির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলাম, গিয়ে দেখি আন্টি কান্না করছে।আংকেল আমাকে দেখেই একটা থাপ্পড় মেরে বলে কাউকে ভালবাস তাহলে তাকে ফেলে কেন চলে গেলে? যাও ও ওই রুমে আছে,,,ধীরে ধীরে তার রুমে ডুকলাম,দেখলাম ঋতু শুয়ে আছে।ধীরে ধীরে তার কছে গেলাম,আমাকে দেখেই ও ওঠে বসলো। এই কয়দিনে মেয়েটার কি অবস্থা হয়েছে, চোখের নিচে কালি পরে গিয়েছে।অনেক শুকনো হয়েগেছে মেয়েটা।ভাবতেই চোখে জল চলে আসলো।

— কি মরে গেছি কিনা দেখতে এসেছো?? ওর মুখে মরার কথা শুনে ভেতরটা কেপে উঠলো। কোনকিছু না ভেবে ওকে একটা থাপ্পড় মারলাম,

–কেন এমন করলে তুমি, তুমার যদি কিছু হয়ে যেত?
–তাতে কি তুমিতো আমাকে ভালবাস না,যদি ভালবাসতে তাহলে আমাকে ফেলে চলে যেতে পারতানা।(অন্যদিকে তাকিয়ে)
–তুমিই তো বললে চলে যেতে,,,
–আমি বললেই কি তুমি চলে যাবা?? পাগলীটা কান্নাই কথা বলতে পাররছেনা। ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেই,
–পাগলী আমাকে কি ক্ষমা করা যায়না??

ও কোন কথা বলছেনা,কেঁদেই চলেছে।আমি তার চোখের জল মুছে দিলাম,তার মুখটা আমার মুখের কাছে আনি।ওর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে অনেক কেঁদেছে আমার পাগলীটা।

–ঋতু তুমি প্লিজ কান্না থামাও, আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে পাগলী। তুমি বল তুমি যে শাস্তি দিবে আমি মেনে নিবো।প্লিজ এখন কান্না থামাও প্লিজ।

— এদিকে আসো,,,(কাঁপা গলাই)
–কি?
— এদিকে আসতে বলছি( একটু জোরে) আমি তার কাছে যেতেই,,,,ঠাস!! ঠাস!! দুইটা থাপ্পড় মারলো।
— আর কখনো ফেলে চলে যাবা??(কান্না করে দিলো)
–কখনো না,,
— আমি যদি কখনো রাগে বলি চলে যেতে…
–তা ও যাবোনা।
–আমাকে কষ্ট দিবা?
–কখনা না,
–তাহলে কি করবা??(আমার দিকে তাকিয়ে)
–শুধু ভালবাসবো।(হাতটা ধরে)
–এ্যা, আসছে ভালবাসতে, এখনো প্রপোজই করেনি আসছে আমার হিরো ভালবাসতে।(মুখে ভেংচি কেটে মুখ সরিয়ে)
–বাবু এখানে কোন ফুল নেই..
–ফুল লাগবেনা গাধা, এমনিই হবে(কানে টান দিয়ে)

আমি হাটু ভেঙ্গে বসে তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে বাবু তুমি কি আমার নাতির টাম্মি হবা, আমার মায়ের বৌমা হবা, কথা দিচ্ছি কখনো তুমাকে কষ্ট দিবোনা।কখনো তুমাকে ছেড়ে যাবোনা।দুজনে একসাথে বুড়ো হবো যদি তুমি আমার হাতটি ধরো। ভালবাসি তুমাই অনেক ভালবাসি। পাগলীটা আমার বুকে ঝাপিয়ে পরে কান্না করে দিলো। আমি ও ভালবাসি এই পাগলকে।পাগলীটার কপালে আলতো করে চুমু একে দিলাম।তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

— বাবু
–হুম
— খুব লেগেছে না??(আমার গালে হাত দিয়ে)
— হুম
–আরো দিবো??(মুচকি হেসে)
— দাও,
— চোখ বন্ধ করো..

আমি চোখ বন্ধ করলাম, ধীরে ধীরে অনুভব করলাম ওর নিশ্বাস আমার নাকে এসে পরছে। ওর ঠোট দুটো আমার ঠোটে রাখে। মুহূর্তেই সব কষ্ট ভুলে গিয়ে ওকে জড়িয়ে নিই নিজ বাহুডোরে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত