হায়রে প্রেম

হায়রে প্রেম

মেয়েটির পথ চেয়ে রোজ বসে থাকে পাড়ার বখাটে ছেলে রাজু! সবাই তাঁকে আড়ালে রাজু মাস্তান বলে ডাকে! কম বেশি সবাই তাকে ভয় পায়। কম বেশি সবাই তাকে ঘৃণা করে। ঘৃণা আর ভয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

রাজু মাস্তান খোঁজ নিয়ে জানতে পারে মেয়েটি নতুন এসেছে তাদের এলাকায়। খন্দকার আজিজুল হকের বহুতল বাড়ির এক ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে। মেয়ের বাবা সরকারি কর্মকর্তা। মেয়ে ভার্সিটির মেধাবী ছাত্রী! রোজ ভার্সিটি যাবার সময় রাজু তাকে ফলো করে। মেয়েটি তা বুঝতে পারে কি না রাজু জানে না। সে নিজেও জানে এলাকায় তার প্রভাব আছে। কিন্তু মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলবে সেই সাহস তার হয়না। শুধু পেছনে ঘুরে নিজের মনের শান্তি খুঁজে। এমনই একদিন মেয়েটির পেছনে সে হোন্ডা আস্তে করে চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনের মত মেয়েটি সোজা চলে যায়না। রাজু’র দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে, এই যে শুনন? রাজু হোন্ডা থামিয়ে অন্য দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে।

মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করে এই যে শুনন? রাজু এবার বোকার মতো জিজ্ঞেস করে আমাকে বলছেন? হ্যা আপনাকেই জিজ্ঞেস করছি! এখানে আর তো কেউ নেই। রাজু ভদ্র ভাবে বলে, জ্বি বলুন! মেয়েটি কিছুটা রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করে , আমি কয়দিন যাবত খেয়াল করছি আপনি আমার পেছনে লেগেছেন। আমাকে সমস্ত রাস্তা ফলো করছেন, কিন্তু কেন এরকম করছেন? রাজু’র মুখে কোন জবাব নেই! সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সুন্দরী মেয়েটির মুখের পানে। মেয়েটির রাগ তার সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে! এবার মেয়েটি উত্তেজিত হয়ে বলে, কি কথা কানে যাচ্ছে না? রাজু’র মুখে কোন জবাব নেই, তাই হোন্ডা ঘুরিয়ে চলে যায়।

রাজু তার বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে জানতে পারে মেয়েটির বাবা সরকারি বড় কর্মকর্তা। অনেক উপর মহলে তার চেনা জানা। এখানে বদলি হয়ে এসেছেন কয়েক বছর হলো। এর আগে অন্য এলাকায় থাকতো। মেয়ের ভার্সিটি এখান থেকে কাছে তাই এখানে এসেছেন। মেয়েটির নাম সিন্থিয়া! বাবা-মা,র একমাত্র আদরের মেয়ে!

রাজু জীবনে অনেক মেয়ে দেখেছে কিন্তু এর মতো কেউ তাঁকে আকর্ষণ করেনি। ভাবে যে করে হোক মেয়েটিকে তার জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতে হবে। কিন্তু ভাবে সে পাড়ার মাস্তান। লেখাপড়া মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ। আর মেয়ে ভার্সিটির মেধাবী ছাত্রী। তাদের অর্থনৈতীক অবস্থান অনেক মজবুত। তার কাছে কোন ভাবেই তারা মেয়ে দেবেনা!

কিন্তু এই মেয়েটি ছাড়া রাজু’র জীবন মূল্যহীন। অনেক ভেবে সে সিদ্ধান্ত নেয় একটা মাত্র পথ খোলা আছে সেটা হলো। কোন ভাবে মেয়টি যদি তাঁকে ভালোবাসে তার প্রেমে পড়ে তবে, তার মেয়েটিকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবার সম্ভাবনা আছে।

তার বন্ধুরা রাজু মাস্তানের দেওয়ানা হবার খবর পায় এবং তাঁকে পরমর্শ দেয়। সে যদি মেয়েটিকে এতোটা ভালোবাসে তবে, সেটা তার সামনে দাঁড়িয়ে প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু রাজু’র মুখে চিন্তার ছাপ তার মতো ছেলের ভালোবাসা সিন্থিয়ার মতো মেয়ে কি গ্রহণ করবে? মনে হয় করবেনা! কিন্তু তার যে, তবে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে। সিন্থিয়া ছাড়া তার পৃথিবী একেবারে অন্ধকার! তবুও সে হাল ছাড়ার পাত্র নয়!

যে করে হোক মেয়েটির সাথে সে ভাব করেই ছাড়বে। তাই মাস্তানী থেকে সে নিজেকে সরিয়ে নিলো। বন্ধুরা তাঁকে ডাকে সে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। এলাকায় মুদীখানা খুলে, মেয়েটির দৃষ্টিতে পড়ার জন্য। কিন্তু তবুও মেয়েটির তার প্রতি কোন আকর্ষণ সৃষ্টি হয়না। প্রতিদিন সিন্ধিয়ার পেছন পেছন চলে ওর ভার্সিটির গেট পর্যন্ত। সাফল্য বলতে তার এই এটুকুই। এখন আর মেয়েটি তাঁকে উল্টে প্রশ্ন করে না। কিন্তু তাতে রাজু’র মনের জ্বালা আরও বেড়ে যায়।

এদিকে তার বন্ধুরা এক এক করে তার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে। যার ফলে সে অরক্ষিত হয়ে পড়ে! একদিন তার পুরনো শত্রু এই সুযোগে তার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করে। একদিন সে দোকানে নেই, এমন তার চিরশত্রু ঝন্টুর দল দোকানে ভাঙচুর করে। সে যখন ফিরে আসে তখন ওরা ফিরে যাচ্ছিলো। রাজুকে দেখে ওরা আবার নেমে এসে তার উপর চড়াও হয়। রাজু অনেক চেষ্টা করে নিজেকে বাঁচাবার কিন্তু বাঁচাতে পারে না।

তাঁকে রক্তাক্ত করে যখন চলে যাচ্ছিলো। তখন সে দেখতে পায় তার প্রিয়তমা ভয়ে কুঁকড়ে উঠে তার পানে তাকিয়ে আছে। এরপর তার আর কিছু মনে নেই। হাসপাতালে তার জ্ঞান ফিরে দুদিন পরে। তার রক্তাক্ত অচেতন দেহকে তার বন্ধুরা মিলে হাসপাতালে নিয়ে আসে। মাসখানেক পরে যখন সুস্থ হয়ে এলাকায় ফিরে তখন সবাই তার দিকে অবাক হয়ে তাকায়।

নিরিবিলি জায়গায় বসে ভাবতে লাগলো রাজু, সিন্থিয়া কেমন আছে? বন্ধুরা তাকে উপহাস করে, উপদেশ দেয়। এই মেয়েটার জন্যই তোর আজ এই অবস্থা! ভুলে যা তাকে, কোনদিন পাবিনা তুই তাকে। রাজু চুপ করে থাকে। কোন কথা বলে না, উঠে যায় সবার মাঝে থেকে। বন্ধুরা হাসতে লাগলো আর বলতে লাগলো এ পুরাই পাগল হয়ে গেছে!

রাজু দোকানটা আবার মেরামত করে চালু করে। আবার সে সিন্থিয়ার পিছনে পিছনে চলে। এমনই ভাবে চলতে থাকে কয়েক দিন। আবার একদিন সিন্থিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, শুনুন? এবার রাজু পালায় না! বলে, জ্বি!

আপনি আমার পিছনে ঘুরে কি সুখ পান? রাজু’র বুঝতে অসুবিধে হলোনা যে সিন্থিয়া সব টের পায়! তবুও যখন কড়া গলায় কথা বলে না, তবে এখনি সময়! তাই বলে, আমার আপনাকে কিছু বলার ছিলো। জ্বি বলুন আমি শুনছি। রাজু’র খুশিতে লাফিয়ে উঠতে মন চাইলো। সিন্থিয়া তাড়া দেয়, কি হলো বলেন? কি কথা! রাজু চলে যেতে যেতে বলে, আজ না আর একদিন। সিন্থিয়া অবাক ওর আচরণে। পরে মন থেকে এস ঝেড়ে ফেলে ভার্সিটি চলে যায়।

রাজু নতুন জামা কাপড় কিনে সবচেয়ে আধুনিক ডিজাইনের। জুতো, চশমা ঘড়ি যা প্রয়োজন। তার সাথে কিনে নেয় দুটি লাল টুকটুকে গোলাপ ও এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল! পরদিন ভোরবেলা থেকে সেজেগুজে হাতে ফুল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, পথের সবচেয়ে নিরিবিলি জায়গায়! কিন্তু সেদিন আর সিন্থিয়া আসে না! তবুও রাজু’র মুখে হতাশার ছাপ নেই! সে ফুলগুলো ফেলে দিয়ে নতুন ফুল কিনে আনে। এভাবে চলে যায় পনের দিন।

তার মনে প্রশ্ন জাগে ওর কোন অসুখ হলো না তো? এমনই একদিন মেয়েটির দেখা অবশেষে রাজু পায়। দেখে খুব প্রাণ চঞ্চল দেখাচ্ছে আজ সিন্থিয়াকে। অসুস্থ শরীর কি এতো প্রাণশক্তিপূর্ণ থাকে? কাছে আসতেই এই প্রথম বার রাজু সিন্থিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছেন?

সিন্থিয়া অবাক হয়ে বলে ভালো! সে আরও অবাক হয়ে যায় রাজু মাস্তান এর বেশভূষা দেখে। এযে কোন সিনেমার কোন হিরো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সিন্থিয়া জিজ্ঞেস করে, পথ কেন আটকালেন? রাজু বলে, সরি! আমি আপনার পথ আটকাইনি। সেদিনের না বলা কথাটা আজ বলার জন্যই আপনার সামনে বলবো!

সিন্থিয়া বলে, ও তাই! ঠিক আছে তারাতাড়ি বলে ফেলুন। আমার আবার জরুরি ক্লাশ আছে, মিস হয়ে গেলে অনেক ক্ষতি হবে! রাজু বলে, বেশি সময় নেবনা আমি। এই বলে, সে তার পিছনে লুকিয়ে রাখা দুটি লাল টুকটুকে গোলাপ ও এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা সিন্থিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়! এগুলো আপনার জন্য এনেছি পনের দিন ধরে আমি এই ফুল নিয়ে আপনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু আপনি আসেননি। আপনার কি অসুখ হয়েছিল? না! ভার্সিটি বন্ধ ছিলো! রাজু ভাবে সে কতবোকা! একবার ভার্সিটিতে খুঁজ নিলেই তো এতো কষ্ট করতে হতোনা । ভাবে কষ্ট তার হয়নি সে তো সারাক্ষণ তার প্রিয়ার কথাই ভেবেছে!

সিন্থিয়া বলে, আপনার দেয়া ফুল কেন নেব আমি? রাজু সাহস সঞ্চয় করে বলে, আমি আপনাকে ভালোবাসি! সিন্থিয়া আশ্চর্য ও রাগান্বিত হয়ে বলে, আমাকে আপনি ভালোসানে? হ্যা! এই জীবনের চেয়ে বেশি! সিন্থিয়া হেঁসে বলে, হায়রে! কপাল আমার। আমাকে ভালোবাসে এলাকার সবচেয়ে গুন্ডা বদমায়েশ ছেলেটা।

রাজু হাত জোর করে বলে, আমি সব ছেড়ে দিয়েছি! শুধু তোমার জন্য! তুমি ছাড়া আমার কোন মূল্য নাই। একবার শুধু বল ভালোবাসি? রাজু ফুল এগিয়ে দেয় সিন্থিয়ার দিকে। সিন্থিয়া ফুল গুলো নিয়ে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলে!

তা দেখে রাজু’র দম আটকে যাবার যোগাড় হয়! সিন্থিয়া চলে যাচ্ছে। রাজু পেছন থেকে বলে, একটু দয়া করো তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না! তবুও সে চলে যেতে লাগলো। এবার রাজু পেছন থেকে সিন্থিয়ার হাত ধরে বলে, তুমি একবার শুধু বলো, আমায় ভালোবাসো! শুনে আমার হৃদয়টা শান্ত হোক। প্রাণটা যে আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে!

হাত ছাড়ুন! না ছাড়বোনা তুমি একবার শুধু বলো ভালোবাসি। সিন্থিয়া এবার জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাজু’র গালে ঠাস করে চড় মারে! রাজু’র গালের চেয়ে হৃদয়ে গিয়ে লাগে ব্যাথা! এমন ব্যাথা যে, সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মাটিতে।

সিন্থিয়া তার পিতার কাছে সমস্ত কথা খুলে বলে। তার পিতা মেয়ের কথা শুনে বলে, কি এতোবড় সাহস! তোকে রাস্তায় আটকে অপমান করে। যা, তুই চিন্তা করিসনা আমি ওকে শায়েস্তা করার ব্যাবস্থা করছি। আনিস সাহেব একটা ফোন করলেন এবং বিস্তারিত জানালেন। অপর প্রান্তের লোকটা শুধু বললো কাল থেকে আর করবে না!

রাজু’র খাওয়া দাওয়ার রুচি কমে গেল।হৃদয় ভাঙার জ্বালায় রাতে ঘুম এলোনা। শুধু দুচোখে পানির স্রোত বয়ে গেল। কোন কালেই তো সে এতো দূর্বল ছিলো না? প্রশ্ন জাগে মনে! ভোর বেলা একটু ঘুম আসে!

হঠাৎ মানুষের চিল্লাচিল্লিতে তার ঘুম ভেঙে যায়! বিছানা ছেড়ে ঘরের দরজা খুলে দেখে তার দোকান কারা যেন ভাঙচুর করছে? সে ওখানে গিয়ে চিৎকার করে বলে , এই তোমরা কারা? আমার দোকান কেন ভাঙছিলে। তাকে দেখে সবাই থেমে যায়। একজন এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, তবে তুই রাজু? হ্যা!

তখন লোকটি তার কলার চেপে ধরে বলে, আয় গাড়িতে উঠে বস! রাজু’র শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে কিন্তু কয়েকজন বলে পেরে উঠে না! অবশেষে তাঁকে গাড়িতে করে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো এক নেতার সামনে। শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা! যার এক ইশারায় শহরে আগুন জ্বলে উঠে এবং পুড়ে ছাই করতে থাকে। যতক্ষণ তার অর্ডার না আসে আগুন জ্বলতেই থাকে!

সেই নেতা ওর নাম জিজ্ঞেস করে, ও বলে রাজু! আর অমনি লাঠি পেটা শুরু করে নেতার লোকজন! যখন তার শরীর আর মার নিতে পারছেনা, তখন ওরা থামলো নেতার কথায়! রাজু’র তখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই! তাঁকে কলার ধরে টেনে তুললো একজন। এবং হাটু গেড়ে বসাল তার শরীর পড়ে যাচ্ছে। একজন ধরে রেখেছে।

সারা শরীরে রক্তের দাগ। মেঝেতে রক্তের দাগ। এমন সময় সিন্থিয়ার ডাক পড়লো। নেতা জিজ্ঞেস করলেন, দেখতো মামণি, এটা সেই ছেলে কি না? সে মাথা নাড়ে হ্যা আঙ্কেল। তবে ওর গালে কয়েকটি চড় মেরে আস আমার সামনে। রাজু’র তখন অর্ধ অচেতন অবস্থা তবুও সে খেয়াল করলো। তার অবস্থা দেখে সিন্থিয়া কেঁপে উঠলো। সিন্থিয়া বলে, থাকনা আঙ্কেল অনেক হয়েছে! না মা তোমার একটা হক রয়েছে তো! সিন্থিয়া গিয়ে কয়েকটি চড় মারতেই রাজু’র দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত