এক থালা ভালবাসা

এক থালা ভালবাসা

:নাকফুলটা খু‌লে ফে‌লেন।
:হুম। খু‌লে ফে‌লেন। স্বামী মারা গে‌ছে। মে‌য়ে‌দের নাকফুল পড়‌তে নেই।

ওরা এসব কি বল‌ছে! মান‌ুষগু‌লো কি পাগল হ‌য়ে গে‌ছে! সিফাত ফ্যালফ্যাল ক‌রে শ্বাশুড়ীর দি‌কে তাকায়। নাকফুল কেন খুল‌তে হ‌বে। রাজিবের দেয়া নাকফুল। রাজি‌বের কি এমন হয়ে‌ছে! ওর ফোনটাই না হয় ধর‌ছেনা! এ আর তেমন কি। হয়ত মি‌টিংয়ে ব্যস্ত। নয়ত বাইকে। ও যখন বাইকে থা‌কে তখন প্রায়ই ধ‌রেনা। এ সিফা‌তের কা‌ছে নতুন নয়। আর আজ রে‌ডিস‌নে দাওয়াত আছে। সিফাত‌কে বারক‌য়েক ব‌লে‌ছে।

:জানো, আজ রে‌ডিস‌নে দাওয়াত…রে‌ডিস‌নে দাওয়াত মুখ ঝাম‌টে উঠে‌ছিল সিফাত।
:বারবার কেন বলছ?
:তোমা‌কে রে‌খে একা যাব!
:আমি একা না।
:হুম। দুইজন। আমা‌দের ভালবাসার চিহ্নখানা।

রাজিব ওর পে‌টে হাত রা‌খে। সিফাত হা‌সে। হাস‌লে ওর গা‌লে টোল প‌ড়ে। রাজিব মুগ্ধ হ‌য়ে দে‌খে। সিফা‌তের হা‌সি‌তে পাগল হ‌য়েই ও প্রে‌মে প‌ড়ে‌ছিল। গোলাপ ফর্সা মুখ। যেন দুধসা‌গ‌রে দু‌ধে গোলা‌পের পাপ‌ড়ি নিংড়ে দি‌য়ে‌ছে কেউ। চেরী রাঙা না‌কে হী‌রের নাকফুলটা বড্ড মা‌নি‌য়ে‌ছে। মেঘকা‌লো চুল। খোলা চু‌লে যেন মধ্যরা‌ত্রি নে‌মে আসে। রাজিব চুল ছুঁয়ে দে‌খে। স্বপ্ন নয়ত! নাহ্, স্বপ্ন নয়। বাস্তব। ওর বউ। সিফাত।

:নাম কি রাখ‌বে?
:কার? পেট ছুঁয়ে দেখায় রাজিব।
:কেম‌নে বলব?
:কেন?
:জা‌নিনা‌তো ছে‌লে না মে‌য়ে?
:এবার আলট্রাস‌নো কর‌লেই জান‌বে।
:থাক, জানার দরকোর নাই।
:কেন?
:জান‌লেই প্রত্যাশা বে‌ড়ে যা‌বে।

সিফাত কাঁদে, ডুকরে কাঁদে। ওর গাল বে‌য়ে জ‌লেরধারা না‌মে। চোখ আর না‌কের জল এক হ‌য়ে আসে। কান্নার দম‌কে বু‌কে ব্যথা না‌মে। কে খবর দি‌য়ে‌ছে। হুম তাইতো? কে খবর এনেছে। সিফাত দৌ‌ড়ে ডাইনিংয়ে আসে। ওর শাশুড়ীমা স্তব্ধ ব‌সে। চেয়ার ঘে‌সে দাঁড়া‌নো বাসার ভাড়া‌টে ম‌হিলারা। কেউ মাথায় হাত বুলা‌চ্ছে, কেউ সান্তনা দি‌চ্ছে। সিফাত পাগ‌লের মতন দাঁড়ায়। ওকে দে‌খে শাশুড়ীমা দাঁত খিঁচি‌য়ে ওঠেন।

:এই মাতারী, এই মাতারীর লাইগাই আমার পুত আজ নাই। হু হু ক‌রে কাঁদেন সা‌বিহা বেগম। চোখ বড় বড় ক‌রে তাকায় সিফাত।
:মা, কে খবর আনে‌ছে রাজিব নাই!
:দেক, মাতারী কয়‌ কি?
:জ্বি, মা, আমি জান‌তে চা‌চ্ছি, কে খবর আন‌ছে?
:আমার মোবাইলে কল আইছে।
:কার?
:কে জা‌নে কার? রা‌ফিন গে‌ছে জানবার।

সিফাত হা‌তের ফোন থে‌কে রা‌ফিন‌কে ডায়াল ক‌রে। ফোন ধর‌ছে না রা‌ফিন। দুরুদুরু বু‌কে অপেক্ষা ক‌রে সিফাত। সিফাত জা‌নে, এমন ঘটনা ঘট‌তে পা‌রে। ওর বাবা ওকে আজ থে‌কে আটমাস আগে ব‌লে‌ছিল। জা‌হিদ পা‌টোয়ারীর একমাত্র মে‌য়ে সিফু, সিফাত পা‌টোয়ারী। বিজন্যাস ম্যাথ পড়‌তে এসে রাজী‌বের প্রে‌মে পড়া। কো‌চিংয়ের ভাইয়া। দুমা‌সেই প্রেম দানা বেঁ‌ধে প‌রিণ‌য়ে রূপ নেয়। ঘোর বি‌রোধ ক‌রে‌ছেন জা‌হিদ সা‌হেব। পা‌টোয়ারী সা‌হেব হুম‌কিও দেন। কোন কাজ হয়‌নি। বাবার আলিশান অট্টা‌লিকা, পা‌জে‌রো জিপ ছে‌ড়ে মে‌য়ে তার পনের টাকার রিকশায় চড়া ছে‌লে রা‌জি‌বের ঘ‌রে এসে ওঠে। ঠাঁই বল‌তে মোহাম্মদপু‌রের চারতলা বা‌ড়িখানা। মারা যাবার আগে শ্বশুরমশাই এটাই রে‌খে গে‌ছেন রা‌জিব‌দের দু’ভাই‌য়ের জন্য। রা‌জিব আর রা‌ফি‌নের জন্য।

সিফাত বারান্দায় দাঁড়ায়। দালা‌নের বাইরের শেওলা ধরা অবয়‌বে বিষা‌দেরা ভর ক‌রে‌ছে। উঁকি দেয় সিফাত। রাস্তায় এক ল্যাংড়া ফ‌কির গান গাইতে গাইতে যা‌চ্ছে। সব‌জির ঠেলা দেখা যা‌চ্ছে। ও বা‌ড়ির রেহানা বুয়া‌কে দেখা যা‌চ্ছে। ওরা এখ‌নো জা‌নেনা রা‌জি‌বের কথা। মোবাইলটা বে‌জে ওঠে। বাবা! বাবা কেন ফোন কর‌বে? আজ আটমা‌সের ওপ‌রে। কোন তপ্ত বাক্য কেন, সাধারন কথাও বি‌নিময় হয়‌নি বাপ‌মে‌য়ের মা‌ঝে। সিফু এখন মি‌সেস রা‌জিব খান। পা‌টোয়ারী সা‌হেব ওকে কেন ফোন দে‌বেন! ও ধর‌বে কিনা ভাব‌তে ভাব‌তে সবুজ বাট‌নে প্রেস হ‌য়ে গেল।

:সিফু, মা বাবার এতটা মোলা‌য়েম কন্ঠ বহু যুগ প‌ড়ে বোধক‌রি শুনল সিফাত।
:কেন ফোন ক‌রেছ?

ওপাশ খে‌কে কাঁদে, বাবা কাঁদে। সিফাতও কাঁদে। অন্ত‌রে কোথায় যেন জন্মদাতার জন্যও জায়গা ছিল লু‌কো‌নো। লু‌কো‌নো জায়গাটুকুন আজ প্রকাশ পেল যেন।

:তুই রেডী হ‌য়ে স্কয়া‌রে চ‌লে আয়।
:কেন? অভিমান তা‌কে বাবা ডাক‌তে বাঁধা দেয়। কেঁপে ওঠে ঠোঁটগু‌লো। তির‌তির ক‌রে কাঁপে নাক।
:রা‌জিব আইসিওতে।
:কি?

সিফা‌তের বু‌কে যেন প্রাণ ফি‌রে আসে। ঢিপ‌ঢিপ বা‌জে বু‌কের ভিতর। হা‌তের মোবাইলখানা আরও জো‌রে চে‌পে ধ‌রে সিফাত।

:চ‌লে আয়।
:আস‌ছি।

সিফাত কোনরক‌মে ওড়না চড়ায় গা‌য়ে। চো‌খের শঙ্কা এখনও কা‌টে‌নি। এটা কি বাবার ফাঁদ! না‌কি স‌ত্যি। সিএন‌জি‌তে চ‌ড়ে সিফু। রাস্তার প্র‌তিটা ঝাঁকু‌নি ওকে রা‌জি‌বের দি‌কে ত্বরা‌ন্বিত কর‌ছে। ওর প্রেম, ওর ভালবাসা, ওর সন্তা‌নের বাবার কিছু হ‌লে ওর সন্দে‌হের তীরখানা ও ওর জন্মদাতার দি‌কেই ছু‌ড়ে দিত। হ্যাঁ, তাই। কিন্তু বাস্তবতা কি ভিন্ন হ‌তে পা‌রে!
সিফাত লিফ‌টের জন্য দেরী ক‌রে না। সিঁড়ি ভা‌ঙে, দৌড়ায়। হাপায় সিফাত। রা‌ফিন ওকে দেখে দৌ‌ড়ে আসে।

:ভাবী আস‌তে পে‌রেছ?
:রা‌জিব কই রা‌ফিন?
:আছে।
:কেমন?
:তালই হেল্প না কর‌লে কি যে হত! সিফাত আড়চো‌খে দে‌খে। বাবা-মা দাঁড়ি‌য়ে। বিধ্বস্ত। মা এগি‌য়ে আসে।
:সিফু…

সিফাত ঠোঁট কাম‌ড়ে সামলায় নিজ‌কে। মা মাথায় হ‌াত রা‌খে। অশ্রু ঝ‌রে সিফুর চোখ থে‌কে। মা তার আঁচ‌লে মে‌য়ের চোখ মো‌ছেন। মা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে কাঁদে সিফাত। বাবা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়ি‌য়ে থা‌কেন। মে‌য়ের কা‌ছে আস‌তে ভয় পান যেন। বাবা আর মে‌য়ের ভালবাসায় চ‌ব্বিশ বছ‌রে কোন কম‌তি ছিলনা। আজ পঁচিশ বসন্ত পে‌রি‌য়ে যেন কোথায় বরফ জমাট বেঁধেছে। শীত যেন জাপ‌টে ধ‌রে‌ছে সে সম্প‌র্কে। সিফু চোখ সরি‌য়ে নেয়। দুর্বলতা না‌কি অভিমান কে জা‌নে। বি‌নি সূ‌তোয় যে বাঁধন গাঁথা, সে মালা কি কেউ ছি‌ড়তে পা‌রে! যে বাঁধন স্রষ্টা রক্ত‌ে দিয়ে‌ছেন, ছেড়ার সাধ্য কার! সিফু বাবা‌কে এ‌ড়ি‌য়ে, সে দৃ‌ষ্টি উপেক্ষা ক‌রে পোশাকটা গা‌য়ে জ‌ড়ি‌য়ে ভেত‌রে ঢু‌কে যায়। রা‌ফিন ভাবীর হাতটা একবার ধ‌রে।

:ভাবী, তালই না থাক‌লে ভাইয়া‌কে বাঁচা‌নো সম্ভব হতোনা সিফু জলভরা চো‌খে একবার তাকায় রা‌ফি‌নের দি‌কে। শাশুড়ীমাও এ‌সে পৌঁছে‌ছেন।
:বৌমা, তু‌মিই আগে যাও।

সিফাত মাথা নে‌ড়ে ভেত‌রে চ‌লে যায়। বাসায় ওর ওপর যে আচরন ক‌রে‌ছে শাশুড়ীমা, সিফু কিছু ম‌নে ক‌রে না। কারণ, সন্তা‌নের অমঙ্গ‌লে মাথা ঠিক ছিলনা তার। সিফুর বু‌কের কো‌নে কোথায় যেন ব্যথা ক‌রে। ওর বাবাও যা ক‌রে‌ছেন, যে হুমকি দি‌য়ে‌ছেন, সন্তানের অমঙ্গল আশঙ্কায় ক‌রে‌ছেন। সিফু খা‌নিক থমকায়। বে‌ডে রা‌জিব। অচেতন। ভা‌গ্যিস হেল‌মেট ছিল মাথায়। বাইক এক‌সি‌ডেন্ট আরও নির্মম হয় সবসময়। বেঁচে গে‌ছে রা‌জিব ভা‌গ্যের জো‌রে। রা‌জি‌বের অচেতন মুখের দি‌কে তাকায় সিফু। তার ভালবাসার মানুষ‌টি, ভালবাসার পুরুষ। ক্ষ‌ণি‌কের জন্য বাবার মুখ‌টিও ভে‌সে ওঠে। ভালবাসার নয়‌কি! যে পুরুষ এক‌টি মে‌য়ের প্রথম ভালবাসা, সে পুরুষ, বাবা। সিফাত কাঁদে। স্বামীর জন্য, না‌কি বাবার আদ্রতায়, কে জা‌নে! বের হয় সিফু। আটমাস পর মা‌য়ের কাঁধে মাথা রা‌খে ও। পরম ভালবাসায় আত্মজা‌কে জড়ায় মা।

:তোর বাবা বড্ড ভয় পে‌য়ে‌ছিল? সিফু কাঁদে।

:কেন, মা? বাবা‌তো কতবার রা‌জিব‌কে খুন কর‌তেও চে‌য়ে‌ছে!
:সে‌তো রা‌গের কথা! বাবারা রাগ ক‌রে কত‌কিছুই ব‌লে। তোর বাবা‌কে ফোন ক‌রে‌ছিল পু‌লিশ। রা‌জি‌বের সেভ করা নম্বর থে‌কে। তোর বাবা পাগলের মতন ছু‌টে গে‌ছে। কাপড়টাও পা‌ল্টে‌নি। বারবার বির‌বির কর‌ছিল আমার মে‌য়ে যেন আমি থাক‌তে বিধবা না হয় আল্লাহ। শুধু আমার মে‌য়ের জন্য সবুর কর প্রভু।

সিফু মা‌য়ের কাঁধের ওপর মাথা রে‌খে তাকায় ওর জীব‌নের প্রথম ভালবাসার পুরু‌ষের পা‌নে। সারা‌দি‌নের ক্লা‌ন্তি‌তে ম্রিয়মান এক মাঝবয়সী পুরুষ। ওর বাবা, জা‌হিদ পা‌টোয়ারী। চো‌খে জল চিক‌চিক কর‌ছে তার। পরা‌জিত আজ অভিমানী পিতা, জয়ী তার আত্মজা। হে‌রে গে‌ছেন ভালবাসায়, মে‌য়ের কা‌ছে। সিফু এগি‌য়ে যায় বাবার কা‌ছে। বাবা দু’হা‌তে জড়ি‌য়ে ধ‌রেন মে‌য়ে‌কে। এইতো সে ছোট্টদু‌টো হাত। ভাল‌বে‌সে যে হাতদু‌টো আঁক‌ড়ে ধরত তা‌কে। অভিমানী মানুষ দুজন ডুক‌রে কাঁদে। মা, রা‌ফিন, শাশুড়ীমা সবাই একটু দূ‌রে স‌রে সময় দেন ওদের‌কে। বাবা মে‌য়ে কাঁদে, ডুক‌রে, ফুঁপি‌য়ে, সুর ক‌রে। ভালবাসা নে‌মে আসে হাসপাতা‌লের জানালার কাঁচ গলে। মে‌য়ে আধো‌বো‌লে বির‌বির ক‌রে।

:বাবা, তু‌মি নানা হচ্ছ। বাবা হা‌সে, আন‌ন্দে। বাবা কাঁদে, আন‌ন্দে। ভালবাসারা ভীড় ক‌রে ওদের চারপা‌শে, গোপ‌নে, আপ‌নে, প্রকা‌শ্যে। চাঁদের মতন এক থালা ভালবাসা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত