প্রেমহর্ষ

প্রেমহর্ষ

– আপু, ছেলেটার সাথে এমন করা তোর মোটেও ঠিক হচ্ছে না। সে তোকে সত্যই ভালবাসে।
– আরে রাখ তোর ভালবাসা। কিছুদিন প্রেম করবো, ঘুরবো ফিরবো, মজা করবো, এইতো। এর থেকে আর ভাল কিছু হয় নাকি?

– দেখ আপু, সবাই কিন্তু তোর মতো না। একটা ছেলে যখন প্রেমে পড়ে। তখন সে তার প্রেমিকাকে নিয়ে গভীর চিন্তা করে। সে একটা সুন্দর ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে।
– নেহা, তুই ছোট মানুষ ছোট’র মতো থাকবি। আমি কী করবো, না করবো, সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
– আপু এসব করে কী লাভ বল?
– মজা লাগে। তুই এসব বুঝবি না।
– মজা? তিন মাস অন্তর অন্তর একেকটা ছেলের সাথে রিলেশন করতে মজা লাগে?
– তুই প্রেম কর, তাহলেই বুঝবি।
– আমার দরকার নেই এসবের।
– শোন, একটা উদাহরণ দেই। মন খুলে শোন।
– হু।

– এইযে, যেই জামাটা এখন তুই পড়ে আছিস। সেটা কি দুই মাস পর তোর ভাল লাগবে?
– না, তখন আরেকটা নতুন জামা কিনবো।
– হ্যাঁ ঠিক তাই। তেমনি আমার কাছে তিন মাস পর পর একেকটা ছেলে পুরাতন হয়ে যায়।
– দেখ আপু, জামা আর রিলেশনের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা।
– তুই তোর রুমে যা। জ্বালাইস না আমায়। যা তো এখন।
– যাচ্ছি, তবে একটা কথা মনে রাখিস। তোর এই নোংরামির জন্য একদিন তোকে পস্তাতে হবে।
– পরের চিন্তা পরে। আগে লাইফটা ইনজয় কর।

নেহা তার বোনের কথার আর কোনো প্রত্যুত্তর না করে তার রুমে চলে গেল। ওদিতে নবনী রাসেলের সাথে চ্যাটিং করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মিস নবনী আক্তার। বয়স ২০। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তার বোন নেহা এবার ইন্টার প্রথম বর্ষে। তাদের মধ্য বয়সের ব্যাপক তারতম্য থাকলেও, একই সঙ্গে বেড়ে ওঠার কারণে তারা একে অপরকে তুই তুকারি করে কথা বলে। রাসেল, অনার্স চতুর্থ বর্ষ। ঢাকা শহরের একটা মেসে থাকে সে। পড়ালেখার পাশাপাশি একটা জবও করে। প্রতি মাসে বাড়িতে বেশ কিছু টাকাও পাঠায়। বাড়িতে তার তিনজনের ছোট্ট পরিবার সেই টাকায় বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই দিন পার করে।

চেহারা অতোটা দর্শনদারি না হওয়ায় তার কপালে কখনো প্রেম জুটেনি। সে ভেবেছিল, প্রেম যদি জীবনে না-ই আসে। তবে একেবারে বিয়ের পরে বউয়ের সাথেই সে প্রেম করবে। কিন্তু না, সৌভাগ্যক্রমে তার কপালে একটা প্রেম জুটলো।

সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিলো। রাসেল ক্যাস্পাস থেকে বের হয়ে রাস্তায় পাশে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎই নবনী তার পাশে এসে তার মাথার উপরে ছাতা ধরে বললো, একটা ছাতা নিয়ে বের হতে পারেন না? বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডা করবে তো।

নবনীকে দেখার পর সে অনিমেষ নেত্রে বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে ছিল। সে কখনো কল্পনাতেও ভাবেনি এতো সুন্দর একটা মেয়ের সাথে তার সাক্ষাত হবে। পরে মেয়েটির ডাকে সে চোখ নামিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে ‘হ্যাঁ’ বলে। তার এমন কাণ্ড দেখে নবনী একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো, এই ছাতাটা নিয়ে আপাতত বাসায় যান। কালকে মনে করে নিয়ে আসলেই হবে।

সেই থেকে শুরু নবনীর সাথে রাসেলের প্রেমের যাত্রা। অগোছালো ছেলেটা দিন দিন বেশ গোছালো হয়ে উঠলো। রুমমেট নাঈম তার এমন পরিবর্তন দেখে মাঝে মাঝেই বলে, ভাই কি প্রেমে টেমে পড়ছেন নাকি? রাসেল শুধু হাসে। কোনো উত্তর দেয় না।

নেহা, নবনীর বোন। একদিন তারা তিনজনে অর্থ্যাৎ রাসেল, নবনী আর নেহা ঘুরতে বের হয়েছিল। নেহা রাসেলের চাল-চলন, কথা বলা, সবকিছু দেখে বুঝে গিয়েছিল, ছেলেটি অতি সহজ সরল। আর এই সহজ সরল ছেলেটির সাথে তার বোনের এই মিথ্যে প্রেমের ব্যাপারটা সে নিতে পারছিল না। নবনী শুধু রাসেল নয়, এর আগেও বহু ছেলের সাথে সম্পর্ক করেছে। কারো কারো সাথে আবার যৌবনের তাড়নায় দৈহিক সম্পর্কও করেছে। তার কথা হলো, লাইফটা আগে ইনজয় করতে হবে। হোক সেটা মনের আনন্দ দিয়ে কিংবা দেহের আনন্দ দিয়ে।

রাসেল তার বেতনের টাকা থেকে এখন সঞ্চয় করা শুরু করেছে। তার এখন প্রধান টার্গেট হলো, একটা সুন্দর ঘর বাঁধবে সে। বাড়িতে তার মাকেও জানিয়েছে বিষয়টা। মা এসব প্রেম পিরিতি বোঝে না। তিনি শুধু জানেন, তার ছেলে বিয়ে করবে। তিন মাস হতে চললো। এর মাঝে নবনী একদিন তাকে তার বাসায় ইনভাইট করলো। রাসেল নির্দিষ্ট সময়ে নবনীর বাসায় এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু সেদিন তার বাসা একদম খালি ছিল। তার বাবা মা আর ছোট বোন কী একটা অনুষ্ঠানের কারণে যেন বাইরে গিয়েছিল। নবনীকে তার বাবা বারবার যেতে বলার পরেও সে যায়নি।

রাসেল ভেবেছিল, হয়তো নবনী তার বাবা মায়ের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য বাসায় ডেকেছে। কিন্তু এসে দেখছে বাসায় কেউ নেই। নবনী ফাঁকা বাসাতে রাসেলের সাথে সংস্রবে লিপ্ত হতে চাইলে রাসেল আপত্তি করলো। সে বললো দেখো নবনী আমরা বিয়ের পরেই না হয় এগুলো করি। নবনী তার বুকের ওড়নাটা সরিয়ে বললো, এদিকে দেখো। যদি তোমার মনে কাম জাগে, তবে এখনই নয় কেন? রাসেল বললো, নবনী একটা অর্ধনগ্ন নারীকে দেখলে যেকোনো পুরুষের মনেই কাম জাগবে। কিন্তু বিয়ে ব্যতীত আমার দ্বারা এসব হবে না।

নবনী এবার রাসেলের মনে বেশ আঘাত দিয়ে বললো, তোমার পুরুষত্ব নিয়ে আমার সন্দেহ জাগে। তাইতো আমি তোমাকে আমার বাসায় ইনভাইট করেছি। নবনীর কথাটা রাসেলের মস্তিষ্কের মধ্যে গিয়ে আঘাত করলো। সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও নবনীর সাথে সংস্রবে লিপ্ত হলো। অবশ্য এর পূর্বে সে নবনীকে বলে নিলো, এই বছরের মধ্যেই সে তাকে বিয়ে করতে চায়। নবনী এতে মুচকি হাসলো মাত্র।

সম্প্রতি নবনী আরেকটি ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। ছেলেটির বাসা তার বাসার পাশেই। সে এখন আর রাসেলের কোনো টেক্সট কিংবা ফোনকলের রেসপন্স করে না। ক্যাস্পাসে দেখা হলে কথাও বলে না। তার এই হঠাৎ পরিবর্তন রাসেলকে ঘুমাতে দেয় না। কেননা তার মস্তিষ্ক, দেহ, মন জুড়ে কেবলই নবনীর বসবাস। নবনীর সাথে সে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তা সফল হয়ে ওঠে না। পূর্বে তার সাথে যোগাযোগ করাটা যতটা না সহজ ছিল, এখন তার থেকে বহুগুণে কঠিন। মাঝে মাঝে সে তার বাসায় নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু এক পলক তাকে দেখবে বলে। সে শুধু নবনীকে একটি কথায় বলতে চায়, হঠাৎ তাকে এমন ইগনোর করার কারণ কী?

সেদিন কী একটা কারণে যেন সে ধানমণ্ডি বত্রিশে গিয়েছিল। সেখান থেকে সে মিরপুরের বাসে উঠতে যাবে, ঠিক তখনই তার চোখ গেল ধানমণ্ডি লেকের প্রবেশ পথে। সে দেখে নবনী একটা ছেলের হাত ধরে হাসতে হাসতে লেকের মধ্যে ঢুকছে। রাসেল আর বাসে না উঠে তার পিছু নিলো। কিয়ৎকাল পর সে নবনীর সামনে গিয়ে বললো, ছেলেটা কে?

নবনী কিছু বলার আগেই ছেলেটা বললো, আমি ওর বয়ফ্রেন্ড। আপনি কে? রাসেল নবনীকে বললো, ছেলেটা যা বলছে তা সত্যি? নবনী কোনো উত্তর করলো না। বরং ছেলেটিকে বিষয়টা স্কিপ করতে ইশারা করলো। অতঃপর রাসেল নিজেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো। মোহ ফুরালে অমৃতেও স্বাদ থাকে না। আর তাছাড়া ছেলেটি রাসেলের থেকে শতগুণে দর্শনদারি। রাসেল মেসে ফিরে বাড়ি যাবে বলে ব্যাগপত্র গোছাতে লাগলো। ঠিক তখনই নেহা অর্থ্যাৎ নবনীর বোন তাকে কল করলো। রাসেল কল রিসিভ করলে নেহা বললো, ভাইয়া আপনি কল রিসিভ করেন না কেন? দেখেন কতবার আপনাকে কল করেছি। আপনি রিসিভ করেননি। রাসেল বললো, এখন কী বলবে বলো?

– একটু দেখা করতে পারবেন?
– না, আমি বাড়ি যাচ্ছি। দেখা হবে না।
– প্লিজ ভাইয়া, একটু দেখা করে যান। প্লিজ।

নেহার এমন রিকুয়েস্টে সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেখা করতে গেল। নেহা তাকে তার বোনের হয়ে সরি বললো। সাথে সে রাসেলকে একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলো। সে বললো, ভাইয়া আপনার আপত্তি না থাকলে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। রাসেল তার এমন কথার জবাবে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে বললো, এটা সম্ভব না। তোমার বোনের হয়ে তোমার সরি বলা শেষ হলে তুমি আসতে পারো। নেহা বললো, কেন সম্ভব না?

রাসেল তাকে তার বোনের সাথে হওয়া শারীরিক সস্পর্কের ব্যাপারে অবগত করলো। তবুও মেয়েটা তাকে বিয়ে করতে চায়। কেননা সে জানে, হাজার ঝড় তুফান হয়ে গেলেও এই মানুষটা তাকে ছেড়ে যাবে না। তার ছোট্ট মাথায় শুধু একটা জিনিসই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। আর সেটা হলো, সে রাসেলকে বিয়ে করবে। সেই বছরই রাসেলের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার পর দুই পরিবারের সম্মতিতে তার আর নেহার বিয়ে হলো। এই বিয়েতে নেহার পরিবারের সবার মত থাকলেও নবনীর মত ছিল না। এর জন্য সে নেহাকে অনেক বকাঝকাও করেছে। কিন্তু নেহা সেসব কানে নেয়নি।

রাসেল এখন ভাল একটা চাকরি করে। বেশ মোটা অংকের বেতনও পায়। গ্রাম থেকে সে তার বাবা, মা আর ছোট ভাইকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। নেহাও খুব সুখেই আছে রাসেলের সাথে। নেহা ঠিক আগের মতোই তার পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গিয়েছে। নবনীর অনার্স শেষ হয়েছে। ফলাফলও প্রকাশ হয়েছে। এখন সে মাস্টার্সে ভর্তি হবে। কিন্তু সম্প্রতি সে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হাসপাতালে গিয়ে সে চেকাপ করালে রিপোর্ট দেখে ডাক্তার তাকে জানায়, তার মধ্যে এইআইভি ভাইরাস বাসা বেঁধেছে।

এরপরে আরও বেশ কিছু বছর কেটে গিয়েছে। আজ রাসেলের মেয়ের সাততম জন্মদিন। নেহা রাসেল এবং তার পরিবার ছোট্ট পরিসরে তারা নিজেরাই তার মেয়ের জন্মদিন পালন করছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে খবর আসে নবনী মারা গিয়েছে। নেহা তার বোনের মারা যাওয়ার কারণ জানতে গিয়ে অবগত হয় যে, তার বোনের শরীরের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাস ছিল। ঠিক তার কিছুদিন পর সে এবং রাসেল হাসপাতালে গিয়ে নিজেদের চেকাপ করিয়ে জানতে পারে, তাদের মধ্যে সেই ভাইরাস নেই।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত