আরমান হোশেন বহু বছর পরে, তার মৃত স্ত্রীর ডায়েরি টা খুলেছে। আসলে সময়-হীন মানুষ ছিলেন এতো বছর। এখন ছেলে, মেয়ে, বউরা সব সামলান। আরমান হোশেন এর ২ ছেলে ১ মেয়ে, সবাই উচ্চ শিক্ষিত। আর সবাই টাইম মেন্টিং করে চলা ফেরা করে। কারো সাথে কারো বিজনেস নিয়ে মিটিং করা, বা নাস্তার টেবিল ছাড়া তেমন কথা হয় না। আরমান হোশেন এর নাতী-নাতনি আছে, তবে তারা ও এখন অনেক টা বড়।
তাই নিজেকে এখন বেশি একলা লাগে আরমান হোশেন সাহেব এর। আরমান হোশেন নাতনি- নাতী বেশি আদর করলে বউ, মেয়ে রাগ করে। তাদের মতে বাচ্চাদের ডিসিপ্লিন এর মধ্যে চলতে হবে। আরমান হোশেন অহেতুক আশকারা দিয়ে যেন নষ্ট না করে। আরমান হোশেন এর এখন আর আগের মতো দাপট নেই, বুড়ো হয়ে গেছে বলে হয়তো। আরমান হোশেন সকালে হাঁটতে গেলে সমবয়সী বন্ধুদের দেখা মিলে। তাদের ও এক গল্প, তবে তাদের মাঝে অনেকর জীবনসঙ্গীনি আছে। আবার অনেক এর নেই। সকালটা ভালো গেলে ও সারাদিন একা একাই কাঁটে। বাসায় কয়জন সার্ভেন্ট আছে। তবে তাদের সাথে আর উনি কি কথা বলবে এই বয়সে।
রেনুকে সে সবার থেকে বেশি মিস করে, তার জীবনসঙ্গীনির ও এমন লাগতো একা-একা। তাকে ঠিক মতো কখনোই সময় দেইনি আরমান হোশেন! শুধু টাকার পিছনে ছুটেছে। আজ সব আছে তবে কথা বলার মানুষ নাই। তার উপর অনেক অভিযোগ আছে রেনু বেগম এর-তবে কখনো প্রকাশ করেনি। হাসি মুখে সব চালিয়ে নিতো। আর তা আরমান হোশেন রেনু বেগম এর ডায়েরি পড়ে জানতে পারলো! যেখানে লেখা আছে, অনেক টা অগোছালো শব্দ! হাতে লেখা তেমন ভালো না, তবে পড়তে কষ্ট হচ্ছে না আরমান হোশেনের। তার কাছে এখন যথেষ্ট সময় আছে,রেনু বেগম এর অগোছালো কথা বুজতে পারবে।
ডায়েরিঃ আমার যখন ১৩ বছর শেষ করে ১৪ বছরে পরে, তখন আব্বা আপনার সাথে বিয়ে দেই। আপনারে তো বড় ভাইয়ের থেকে ও বড় লাগতো আমার। খুব ভয় ও করতো আপনারে, কেমন জানি রাগী-রাগী ভাব ছিলো আপনার মাঝে। এই বাড়িতে আসার পরে আমার ভয় লাগতো খালি। আব্বা আসলে আমি কতো কান্নতাম তার সাথে যাওয়ার জন্য। উনি নিতেন না!আবার নিলে, আপনার আম্মা লোক পাঠিয়ে নিয়ে আসতেন। আমার তখন অনেক কষ্ট হতো সখীদের ছাইড়া, আমগো বাসার মানুষদের ছাইড়া আসতে। তবে আপনার আম্মার ভয়ে চলে আসতাম আপনাদের বাড়িতে।
রাত হলেই ভয় লাগতো কখন আপনি কাছে ঢাকেন তাই। তবে আপনার গাঁয়ের গন্ধ আমার অনেক ভালো লাগতো। ভায়ে কখনো কই নাই। যখন বড় ছেলেটা হয়, তখন আমার ১৬ বছর। আপনার আম্মা আপনারে আসতে দেইনাই আমার কাছে। জানেন তখন কতো দেখতে মন চাইছে আপনারে। আম্মার এক কথা এমন ( আতুর ঘরে)ঘরে পুরুষ মানুষ আসন বারণ।বড় খোকা হওয়ার পরে, আমার রাতে অনেক ঘুম আসতো তবে ঘুমাইতে পারতাম না। আম্মা কইছে পোলাপান হলে মা-র ধৈর্য্য বাড়াইতে হয়। আমি তার কথার মানে তেমন বুজতাম না। তবে বুজতাম বড় খোকারে দেইখা রাখতে করছে।
দু’বছর পরে যখন ছোট ছেলে আর মেয়েটা একলগে হয়। আম্মা আপনারে তখন ও আসতে দেই নাই আমার কাছে। সাথে বড় খোকারেও তখন বেশি কষ্ট হয় ছিলো আমার। বেশ কয়েক বছর পরে আম্মা যখন মারা যাই। তখন থেকে খুব একা লাগতো নিজেরে। তখন বাচ্চারাও ইস্কুলে যাই। আম্মা থাকতে বকলে ও কথা তো বলতে পারতাম। আপনাদের বাসায় কাজে মানুষ ছিলো, তাদের সাথে সারাদিন কি কথা কই বলেন? আবার আপনি তো মাঝে-মাঝে বিদেশ গিয়া অনেক দিন থাকতেন। জানেন? আছিয়া খালা কইতো, জামাইরে হাতের মুঠোয় আনোস না। পরে দেখবি তোর কপাল ফুঁড়ছে। তখন আমি হাসতাম আর কইতাম আর এ না উনি ও আমারে ভালোবাসে! আমার মতো ভয় লাগে তাই কই না।(তবে আমি জানতাম, আপনি আমারে ভয় পান না। শুধু বলার সময় নেই আপনার কাছে।)
জানেন? তখনো ভালো ছিলাম বাচ্চারা স্কুলে থেকে আসলে। অনেক সময় আমরা সাথে কথা কইতো এটা ওটা চাইতো। যখন তারা বড় হলো, তারা ও আপনার মতো সময় নেই বলে ছুটতো। আর তাদের বন্ধু-বান্ধবী দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে একটু আমতা আমতা (নাখুশ) করতো। তাই পরে-পরে আমি তেমন সামনে আসতাম না। যেমন আপনার বন্ধু- আত্নীয় রা আমারে নিয়ে হাসতো। আমি চাইতাম না বাচ্চাদের ও এমন হক তাই। জানেন? পরে-পরে আপনারা কেউ আমার রান্না খেতে চাইতেন না। ইংরেজিতে কি যে বলতেন, আমি বুজতাম না।
তবে এটা বুজতাম আমি কখনোই আপনার আমার বাচ্চাদের মনের মতো যোগ্য মা, বউ হতে পারি নাই। তবে এই বাড়ির যোগ্য বউ ছিলাম। তাই তো সব ঠিক রাখতে পারছি। আপনার মা আমার হাতে চাবি দিয়ে কইছিলো। এই দিলাম মরনের আগ পযন্ত তুই শক্ত কইরা সব ধইরা রাখবি।আমি তোরে অনেক সখ কইরা আমার পুলার লাইগা আনছি। স্বামী, সংসার, সন্তান ঠিক মতো সামলাবি। আমি চেষ্টা করছি কতটা পারছি জানি না। জানেন? আপনি বিদেশ থেইক্কা একবার এক জোর বালা আনছিলেন। আপনার সাথে সংসার কারা বয়স মেলা হয়ছে। এটা আপনে আমারে প্রথম দিছিলেন। আমি ও খুব যন্তে বিয়ের শাড়ীর লগে রাইখা দিছি কাউরে ধরতে ও দেই নাই। এখনো আছে আলমারিতে খুঁজলেই পাবাবে কেউ।
জানতে? আপনার লগে রিকশাতে কইরা, ঘুরার কতো সখ ছিলো আমার। তবে ভয়ে কইতে পারি নাই। আপনার তো আবার গাড়ি ছাড়া চলতে পারেন না। তাই আর কই না। আপনারে নিয়া বাচ্চাদের নিয়া খুব ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো তবে আপনার সময় নেই। বাচ্চাদের সময় নেই,তাই কখনোই বলি নাই। জানেন? লেখাটা ওখানেই শেষ , আরমান হোশেন তাড়াতাড়ি কয়টা পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকেন। দেখে সব সাদা! আর কোন লেখা নেই, পৃষ্ঠা উল্টাতে – উল্টাতে শেষ পৃষ্ঠায় দেখে লেখা।
ইতি,
আপনার অযোগ্য বউ রেনু। আরমান হোশেন ডায়েরি টা জড়িয়ে নিরবে কাঁদতেছে। আজ যে তার ও কথা বলার মানুষ টা খুব প্রয়োজন। তার শেষ জীবনে জীবনসঙ্গীনির খুব প্রয়োজন।
ফিরে আসো রেনু, আমার ও কত কথা জমেছে তোমার সাথে বলবো। দুজন মিলে সারা শহর রিকশাতে ঘুরবো। তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করবো। তুমি যে আমার শূন স্থান! কখনো ভালোবাসি বলিনি, তবে তোমায় সত্যিই খুব ভালোবাসতাম! তোমার গুণে এখনো এই সংসার ঠিকে আছে। তুমিই আমার যোগ্য বউ রেনু। আরমান হোশেন তার পুরো জীবনে। আজকে কাঁদতেছে তার জীবনসঙ্গীনির জন্য।