– বেশি দাম দিয়ে শাড়ি কেনার টাকা ছিলো না। তোমার যদি পছন্দ না হয় তবে রেখে দিও। তন্দ্রার হাতে শাড়ির প্যাকেটটা ধরিয়ে রাতুল বেরিয়ে গেলো। তন্দ্রা প্যাকেট খুলে দেখলো সুতির লাল পাড়ের একটা সাদা শাড়ি। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব বেশি হলে সাতশ কি আটশ টাকার হবে শাড়িটা। মুচকি একটা হাসি দিয়ে শাড়িটা আলমারিতে তুলে রাখলো তন্দ্রা। বিয়ের পর এই প্রথম কিছু কিনে এনেছে রাতুল। ভাবতেই ভালো লাগছে। অভাবের সংসারে বিলাসিতা করার সুযোগ নেই। মধ্যবিত্তদের এই এক সমস্যা।
রাতুল আর তন্দ্রার বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছিলো। তন্দ্রা কেবল ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে, বাবা রিটায়ার্ড হবে তাই তাড়াতাড়ি বিয়েটা দেয়াই উপযুক্ত ভাবলেন। মানুষের একটা বদ্ধ ধারণা আছে, রিটায়ার্ড হয়ে গেলে নাকি মেয়ের ভালো বিয়ে হবে না। তন্দ্রার অমতেই বিয়েটা ঠিক হয়। তন্দ্রা ভার্সিটিতে পড়তে চেয়েছে, বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ও যেতে পারছে না। রাতুল কেবল বি.সি.এস দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে। তার ছোট দুই বোনের পড়াশোনা চলেছে। একজন ইন্টারে তো আরেকজন ক্লাস এইটে পড়ে। বাবা মারা যাবার কারণে আয়ক্ষম ব্যাক্তি শুধুই রাতুল। রাতুলের মাও বুড়ো হয়েছেন, ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ আনলে তার ও সুবিধা।
তন্দ্রা যখন বউ হয়ে আসে তখন তার বয়স কেবল উনিশ। সংসারের স ও তার বুঝা হয় নি। অথচ তার মা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সে এখন সংসারের বড় বউ; শাশুড়ী, ননদের যত্ন করা, বরের মন জয় করাই তার ধর্ম কর্ম। নিজের স্বপ্নের বিসর্জন যে সব নারীকেই দিতে হয়। এটা তো নতুন না, তার স্বপ্ন তার সংসারের চার দেয়ালে আটকে থাকবে। নিজের সবটুকু দিয়ে সেই সংসারকে সে আগলে রাখবে, সংসারের কোণায় কোণায় আনন্দের জাদুমন্ত্র ছড়িয়ে দেয়। অথচ তার ঝুলিতে কিছুই থাকে না।
বিয়ের প্রথম রাতে তার রাতুলের সাথে প্রথম দেখা, একটা পুরুষ ও বুঝি এতটা সুদর্শন হয়। পুরুষের বুঝি রুপ হয়। হা করিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে একটু কাশি দেলো রাতুলের। রাতুলের কাশিতে ধ্যান ভাঙলো, অনেকটা লজ্জায়ও পড়ে গেছে তন্দ্রা। রাতুল ওকে স্বাভাবিক করতে পাশে বসতে নিলে আরো গুটিয়ে নেয় তন্দ্রা।
– তাড়া নেই, পুরুষ বলেই যে শুধু শরীরে আধিপত্য করবো এরুপ পুরুষ আমি নই, যেহেতু একসাথেই থাকবো তাই আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব থাকাটাই বেশি দরকার। তুমি সময় নাও। বলেই রাতুল ফ্রেশ হয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো। তন্দ্রার মনে যে ভয় ছিলো সেটা কিছুটা হলেও কেটেছে। সকল পুরুষ যে শুধু পুরুষত্ব খাটায় সেই ধারণাটা ভুল। কিছু পুরুষ ভালো বন্ধু ও হয়।
তন্দ্রার সংসার জীবন শুরু হলো। শাশুড়ী, বর, শাশুড়ীদের নিয়ে বেশ চলছিলো। তবে কোথায় যেন একটা চাপা কষ্ট রয়েই গেলো। খুব সাহস করেও রাতুলকে কথাটা বলা হয় না, সেও ব্যস্ত তার সংসারের প্রয়োজন মেটাতে। সারাদিন খেটে রাতে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে। একদিন ননদদের পড়াতে যেয়ে শাশুড়ী মা খেয়াল করলেন, তন্দ্রার পড়ার প্রতি অদ্ভুত আগ্রহ। সকলের আড়ালে শুধু ঘাটাঘাটি করে বই পত্র। তখনি তিনি ঠিক করলেন ছেলের সাথে কথা বলবেন। পরদিন সকালে,
– বাবা কি অফিস যাচ্ছিস?
– হ্যা মা কিছু বলবে?
– বলছি বউ মার পড়ালেখাটা আবার শুরু করলে হয় না??
– আমিও অনেকবার ভেবেছিলাম মা, তুমি আপত্তি করবে বলে বলা হয় নি।
– নারে একটু কষ্ট হবে তবে ঠিক পেরে উঠবো দেখিশ।
রাতুল তার মার সাথে কথা বলেই অফিসের জন্য বেড়িয়ে পড়লো। রাতে বাড়ি ফিরলো সাথে কিছু বই নিয়ে। তন্দ্রাকে চমকে দেবার জন্য তখন ও কিছুই বলে নি রাতুল। রাতে ঘুমাবার সময় বই গুলি বের করে দিয়ে বলে,
– সংসার চালালেই তো হবে না, পড়াশুনাটাও করতে হবে নাকি! বই গুলো রাখো ভার্সিটির এডমিশন দিতে হবে তো নাকি।
– এগুলো আমার।
– তো, একটু কষ্ট হবে কিন্তু আমি জানি তুমি পারবে।
কি বলে ধন্যবাদ দেয়া উচিত সেই ভাষাটুকুই নেই তন্দ্রার। যে স্বপ্ন সে বিসর্জন দিয়ে সংসার সামলাতে এসেছে তবে সেই স্বপ্ন কি পূরণ হবে। নিজেকে সামলাতে পারলো না, রাতুলকে জরিয়ে ধরেই কেঁদে দিলো। এভাবে কাঁদতে দেখে রাতুলের কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না।
– এই পাগলী কাঁদছো কেন?
– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমি যে আবারো পরতে পারবো এটা আমার জানা ছিলো না।
– ধুর পাগলী।
এভাবে রাতুলের হাত ধরেই স্বপ্নের দিকে পা বাড়ায় তন্দ্রা। পড়াশুনোর চাপ, সংসার সব মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার। শাশুড়ি, ননদেরা ও কম সাহায্য করে নি। সারাদিন ঘরের কাজ তারপর রাত জেগে পড়া এভাবেই দিন কাটতে লাগলো তন্দ্রার। যতরাত বসে সে পরতো রাতুল ও তার সাথে জেগে বসে থাকতো। সারাদিন পরিবারের মানুষের জন্য উপার্জন করে রাতে না ঘুমিয়ে বউয়ের পাশে বসে থেকে তার পড়ায় সাহায্য করা পুরুষদের নজির পাওয়া ভাড়। লোকটাকে যত দেখে ততই সম্মান যেন বেড়ে যায় তন্দ্রার মনে। সংসারে অভাব যে ছিলো না তা নয়, কিন্তু সুখ ছিলো অফুরন্ত।
অবশেষে ভার্সিটির দরজায় পা রাখে তন্দ্রা। জগন্নাথ ভার্সিটিতে বাংলায় ভর্তি হয়। ঘরের কাজ সামলে পড়াশুনা যেন হাপিয়ে উঠেছে তন্দ্রা। এর মাঝে শাশুড়ী মা মারা গেছেন। স্বামী, ননদ সবাই যেন ভেঙে পরেছে। তন্দ্রা তখন এক হাতে সব সামলাতে হচ্ছে। ঠিক করলো পড়াশুনোটা ছেড়ে দিবে৷ সংসারে মন দিবে। রাতুলকে বলতেই সে ক্ষেপে গেলো।
– তোমার পড়াশুনো যাতে নষ্ট না হয় তাই আমি তোমাকে বাচ্চার জোর ও দেই নি, আর তুমি কিনা সেটাই ছাড়তে চাচ্ছো। আমার যে খুব ইচ্ছা তুমি খুব বড় সরকারি চাকরি করবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তন্দ্রা আমি যখন থাকবো না তখন যাতে তোমার কোনো কিছুর কমতি না হয় তার জন্য আমি তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চাই।
রাতুলের সাহায্য ব্যতীত এই সময়টা পার করা হয়তো তন্দ্রার পক্ষে সম্ভব হত না। রাতের পরে ভোর যেমন আসে দুঃখের দিনগুলোর পর সুখের দিন ও আসে। রাতুলের প্রমোশনের পর প্রমোশন হয়। একে একে দুই বোনের ভালো পরিবারে বিয়ে দেয় রাতুল আর তন্দ্রা। তন্দ্রার পড়াশুনো ও শেষ হয়। তিন বারের বেলায় বি.সি.এস পাশ করে। চাকরির পোস্টিং পড়ে চিটাগং। নতুন চাকরি, নতুন জায়গা। তন্দ্রার একা কি পারবে!! ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে রাতুল। তাও অনেক কষ্টে তন্দ্রাকে রাজি করিয়েছে যাতে সে চাকরিটা করে। শুরু হয় তন্দ্রার চাকরি জীবন। একবছর পর রাতুল ও পোস্টিং নেয় চিটাগং। নিজেদের ছোট্ট সংসার শুরু হয়।
দিন কারোর জন্য থেমে থাকে না, আজ আঠাশ বছর হয়ে গেছে। রাতুল মারা গেছে বছর হয়েছে। তন্দ্রার চাকরি ও শেষের দিকে। এখন তাদের সংসারে অভাব নেই, নেই কোনো কিছুর কমতি। এখন আর তন্দ্রাকে সাতশ টাকার শাড়ি পড়তে হয় না। তার আলমারি ভর্তি দামি দামি শাড়ি। তবে তার এসবে এখনো কোনো আগ্রহ নেই। তার অলংকার দুইটি মেয়ে যারা এখন একজন ডাক্তারি পরছে আর একজন ইংলিশে অনার্স। আজ সে যা তার পেছনে অবদান তার বরটার। যে না থাকলে হয়তো আজ সংসারের চার দেয়ালের মধ্যেই তাকে আটকা পরে থাকতে হত। আলমারি খুলে সেই লাল পাড়ের শাড়িটা বের করলো তন্দ্রা। তার স্বামীর দেয়া প্রথম উপহার আজো যত্নে রেখে দিয়েছে। শাড়িটা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো রাতুল তাকে বলছে,
– কাজলটা দেও তো টিপ দিয়ে দেই যাতে কারোর নজর না লাগে। ভাবতেই চোখ ভিজে এসেছে তন্দ্রার। আজ মানুষটা নেই, তবুও সে আছে। যদি আরেকবার বলা যেত ‘ভালোবাসি’ মন্দ হতো না।