অপ্রকাশিত ভালোবাসা

অপ্রকাশিত ভালোবাসা

বিকালের মৃদ্যু আলোতে আকাশের দিকে তাকালে হুট করে মন যেমন ভালো হয়ে যায় ঠিক তেমনি রাতের মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকালে হুট করেই মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। আমি এখন মরীচা ধরা জানালার গ্রিলে হাত দিয়ে মেঘে ঢাকা রাতের আকাশ দেখছি। এমন সময় কর্কশ শব্দে বিছানায় রাখা ফোনটা বেজে উঠলো। আমি ফোনটা রিসিভ করে বললাম,

— হ্যালো কে? ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
-আরে আমি! আমি বললাম,
— আমিটা আবার কে?
– আমি শ্রাবণী। আমার নাম্বারটা তোমার কাছে সেইভ নেই?
— সেইভ ছিলো কিন্তু কিছুক্ষণ আগে হাত থেকে পড়ে গিয়ে ফোনের ডিসপ্লেটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বুঝতে পারি নি। আমার কথা শুনে শ্রাবণী কতক্ষণ চুপ করে রইলো তারপর বললো,

– একটু আমাদের বাসায় আসতে পারবে? আমি নিচু স্বরে বললাম,
— না, এত রাতে আসতে পারবো না..

শ্রাবণী আর কিছু না বলে ফোনটা চুপচাপ রেখে দিলো। আমি মুচকি হেসে মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকাতেই মুখ থেকে নিমিষেই হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে মনটা আবারও বিষন্ন হয়ে গেলো মাঝরাতে শ্রাবণী খুব যত্নসহকারে শাড়ি পরেছে তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে শাড়িটা ঠিক মত পরা হয় নি। শ্রাবণী জানে, মা মরা মেয়েরা ঠিক মত শাড়ি পরতে পারে না। কারণ মা’ই প্রথম মেয়েকে শাড়ি পরানো শিখায়। মা বাদে অন্য কেউ শাড়ি পরানো শিখালে এর মাঝে ভুল থাকে। শ্রাবণীর বয়স যখন ৫ বছর তখনি শ্রাবণীর মা সুইসাইড করে। শ্রাবণীর সেই সময়টা মনে আছে। ঐদিন ওর মা খুব সুন্দর করে সেজেছিলো। তারপর শ্রাবণীকে কোলে নিয়ে ছাদে গেলো। শ্রাবণীকে ছাদের মাঝখানে রেখে ওর মা হাসতে হাসতে ছাদের কিনারাই গেলো আর চোখের পলকে উধাও হয়ে গেলো। শ্রাবণী চিৎকার করে মা মা ডেকেছিলো কিন্তু ওর মা সাড়া দেয় নি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রাবণী কোমরের নিচ অবধি লম্বা চুলগুলোকে ছেড়ে দিয়ে, খুব যত্ন সহকারে আচড়ালো। কপালে ছোট কালো টিপ আর দুইহাত ভর্তি কাঁচের চুরি পরলো।

কাচের জানালার পর্দাটা সরিয়ে শ্রাবণী বাহিরে তাকিয়ে দেখে ল্যাম্পপোষ্টের আলোর নিচে পিয়াস চুপচাপ বসে আছে। খুব ইচ্ছে করছে শ্রাবণীর পর্দার আড়াল থেকে সামনে আসতে। কিন্তু আজ চার বছর হয়ে গেলো শ্রাবণী কেন যেন পর্দা সরিয়ে সামনে আসতে পারে নি। শ্রাবণীর সাথে পিয়াসের পরিচয় ভার্সিটির নবীন বরণ অনুষ্ঠানে । শ্রাবণী আর ওর বান্ধবীরা মিলে আইসক্রিম খাচ্ছিলো হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা ছেলে এসে শ্রাবণীকে বলেছিলো, ” তুমি যখন খুব ছোট তখন তোমার মা মারা গিয়েছিলো। তাই না?” শ্রাবণী অবাক হয়ে বলেছিলো,

-আপনাকে কে বলেছে?

ছেলেটি শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, “তোমার মা বেঁচে থাকলে তোমার শাড়ি পরার ক্ষেত্রে এমন ভুল হতো না। ” এই কথা বলে ছেলেটি চলে গিয়েছিলো। আর সেই ছেলেটিই হলো পিয়াস এই নিয়ে শ্রাবণীর জন্য ২১টা পায়েল কিনলাম। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো কোনো এক মধ্যরাতে ওর সামনে হাটু গেড়ে বসে, ওর বাম পায়ে একটা পায়েল পরিয়ে দিবো। কিন্তু কোনো একটা অজানা কারণে এমনটা হয়ে উঠে নি। বাসায় এসে পল্টুকে বললাম দুপুরের খাবারটা দিতে। পল্টু খাবারটা রেখে যখন চলে যাচ্ছিলো তখন আমি পল্টুকে বললাম,

— সকালে কি তোর শ্রাবণী আপা মেসে এসেছিলো? আমার কথা শুনে পল্টু বললো,
– কই না তো, আপা তো আসে নি। আমি মুচকি হেসে পল্টুকে বললাম,
— আচ্ছা যা তুই।

পল্টু চলে গেলো। পল্টু মিথ্যা বললেও আমি তরকারীর ঘ্রাণ পেয়ে বুঝে গিয়েছিলাম আজ শ্রাবণী এসেছিলো। ও প্রায়ই আমার এইখানে আসে। পল্টুকে দিয়ে বাজায় করায় তারপর নিজ হাতে রান্না করে চলে যায়। খাবার শেষ করে যখন আবার বাসা থেকে বের হবো তখন পল্টু আমার কাছে এসে মাথা নত করে বললো,

– ভাইজান, আমি আপনারে মিথ্যা বলছি। আপামণি আসছিলো আজকে বাসায়। আমি বললাম,
— ও আচ্ছা। পল্টু তখন বললো,
– ভাইজান, আপার মাথায় কি সমস্যা আছে? আপা প্রতিবার এসে আপনার রুমটা সুন্দর করে সাজায়। হাসি মুখে আপনার জন্য রান্না করে। কিন্তু বাসা থেকে যাবার সময় রুমটাকে আবারও অগোছালো করে আর কাঁদে। আর আমায় বলে যায় আমি যেন আপনাকে না বলি উনি যে বাসায় এসেছিলেন। আমি মুচকি হেসে পল্টুকে বললাম,

— তোর আপার আমার সাথে সংসার করার খুব শখ। মুখে কিছু বলতে পারে না তো তাই এইসব করে আমায় বুঝিয়ে দেয় অনেকক্ষণ ধরে আমি আর শ্রাবণী চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ শ্রাবণী বললো,

– কাল আমার বিয়ে। ঘরোয়া ভাবেই হবে। পরে অনুষ্ঠান করে সবাইকে জানানো হবে। আমি হাসি মুখে বললাম,
–ছেলে নিশ্চয়ই অনেক বড়লোক? শ্রাবণী মুচকি হেসে বললো,
-হ্যাঁ, আমাদের চেয়েও অনেক বড়লোক। আমাদের ১টা বাড়ি আর ওদের ২টা। আমাদের দুইটা গাড়ি আর ওদের তিনটা। ছেলেদের গাজীপুরে ৩টা ফ্যাক্টরিও আছে। বাবা বলেছে আমি সারাজীবন সুখে থাকবো। শ্রাবণী কথা শুনে আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। আমার চুপ করা দেখে শ্রাবণী বললো,

– পিয়াস, আজ রাতে আমার বাসায় আসতে পারবে? আর আসার সময় বিছানার তোশকের নিচ থেকে একটা পায়েল নিয়ে এসো।

এই কথা বলে শ্রাবণী চলে গেলো আর আমি ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছি আজ রাতেও শ্রাবণী শাড়ি পরেছে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো আজ শ্রাবণীর মনে হচ্ছে শাড়িটা ঠিকঠাক ভাবেই পরেছে। খোলা চুল, দুহাতে কাঁচের চুড়ি আর কপালে কালো টিপ দিয়ে শ্রাবণী জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে ল্যাম্পপোষ্টের আলোর নিচে পিয়াস বসে নেই। পিয়াসকে না দেখে খুব অস্বস্তি লাগছিলো শ্রাবণীর৷ এই চারবছরের মধ্যে এই প্রথম পিয়াস আসলো না। কি করবে শ্রাবণী বুঝতে পারছিলো না। সে ভাবলো ছাদে গিয়ে হাঁটলে হয়তো অস্থিরতা কিছুটা কমবে। ছাদে যখন উঠলো তখন দেখলো ছাদের কার্ণিশ ধরে ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণী তখন ওর মাকে বললো,

-মা আমি জানি তুমি কেন সুইসাইড করেছিলে। তুমি রাশেদ মামাকে ভালোবাসতে কিন্তু নানা তোমাদের সম্পর্ক মেনে নেয় নি। বিয়ের পর তুমি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু যেদিন জানতে পারো রাশেদ মামা সুইসাইড করেছে তুমিও সেদিন বিকালে সুইসাইড করেছিলে। জানো মা, আমার কেন যেন মনে হয় পিয়াসও সুইসাইড করেছে। আমিও মা পিয়াসকে খুব ভালোবাসি। এখন মা আমি কি করবো? শ্রাবণী দেখলো ওর মা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। শ্রাবণী তখন চিৎকার করে বললো,

-মা যেও না। একটু দাঁড়াও মা, আমি আসছি তোমার কাছে..

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত