-তোকে আমি কখনো বলেছি যে তোকে আমি ভালবাসি?
-না।
-তাহলে, হুট করে বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাইলি ক্যান?
-আমি তো তোকে ভালবাসি।তোর আমাকে ভালবাসতে হবে না,আমি তোকে ভালবাসি, অনেক ভালবাসি।তুই আমার সাথে বিয়ের পরেও খাউখাউ-ঘাউঘাউ করিস। আমার প্রবলেম নেই।
-তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে,হৃদয়! পুরা আউলায়ে গেছিস তুই।
-মাথা আমার ভাল ছিলটা কবে?
-তুই জানিস আমি ইভানকে ভালবাসি,তবুও তুই।।
-ওই ছাগলা দাঁড়িওয়ালাকে তুই ভালবেসে ফেলেছিস আমার অনুপস্থিতে।আমি দুই বছর দেশের বাইরে ছিলাম আর তুই টুপ করে ওকে ভালবেসে ফেললি!এটা কিছু হল?আমার মনে হয় তুই ওকে ভালবাসিস না।এটা তোর মোহ!
-তোর মাথা!আমি তোকে কখনো বিয়ে করব না।
-তোর বিয়ে আমার সাথেই হবে।ওই ছাগলার সাথে আংকেল-আন্টি কখনো তোর বিয়ে দিবে না।তোদের সেইম এজ,ইভান এখনো চাকরী পায় নি,মাত্র থার্ড ইয়ার!আর আমাকে আংকেল-আন্টি জন্ম থেকে চেনে,আংকেলের বন্ধুর ছেলে,প্রতিষ্ঠিত পাত্র পাচ্ছে।আমাকে রেখে ওই ছেলের সাথে কখনোই তোর বাবা-মা তোকে বিয়ে দিবে না অদিতি।
-আমি পালিয়ে বিয়ে করব!দুই-তিন বছর পর বাবা-মা ঠিকই মেনে নেবে।আমি ইভানকেই বিয়ে করব, তোকে না।
-ওকে,খুবই ভাল কথা।ছাগলাকেই বিয়ে কর।তোদের বিয়েতে আমাকে অবশ্যই সাক্ষী রাখিস,হাজার হোক তোর বেস্ট ফ্রেন্ড তো আমিই,বয়ফ্রেন্ড না’হয় অন্য কেউই হল!আগে দেখ ঐ মুরগী তকে বিয়ে করতে রাজী হয় কি না।রাজী না হলে কিন্তু আমাকেই বিয়ে করিস।
হৃদয়ের গালে কষে এক থাপ্পড় মারার ইচ্ছা অনেক কষ্টে দমন করলাম। শয়তান ছেলে একটা।জানে আমি অন্য একজনকে ভালবাসি, তবুও অস্ট্রেলিয়া থেকে CA শেষ করে এসেই বাসায় বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছে।বাবা-মা ওকে খুবই পছন্দ করে।এই শয়তানটা আমার দুই বছরের বড়,কিন্তু পিচ্চিবেলা থেকে দুইজন মারপিট করে,খামচাখামচি, ঝগড়া করে বড় হয়েছি। এখন আফসোস হচ্ছে,কেন এরকম ইবলিশ একটা ছেলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড!ব্যাটা তুই বিদেশ থেকে একটা টুকটুকে মেম বউ বিয়ে করে আনতি! আমি কেন?দুনিয়ায় আর মেয়ে নাই নাকি?ব্যাটা খবিশ!কত কনফিডেন্স!আমিই ওর বউ হব?তোর কনফিডেন্সের আমি খ্যাতা পুড়ি!আমি ইভান ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করব না।ইভানকে আবার বলে ছাগলা!তুই নিজে কি?তুই হলি শয়তান,খবিশ,খাটা স,তেলাপোকা, মাকড়সা।।
-ইভান, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
-কি বল এগুলা?
-হুম।এখন বল কি করবা?
-আমি কি করব?
-তুমিই তো করবা।চল,বিয়ে করে ফেলি।
-মানে?
-মানে আবার কি?বিয়ে করে ফেলি,তারপর বাসায় বলি।প্রথম প্রথম অমত করলেও পরে সবাই মেনে নিবে।
-অদিতি আমাকে একটু ভাবার সময় দাও প্লিজ।
ইভান দুইদিন ভাবার সময় নিয়েছে।আমার বিয়ের আছে আর মাত্র বারো দিন!কত কাজ।মা, আমাকে আর হৃদয়কে পরিচিতদের বাসায় কার্ড দিতে পাঠিয়েছে।এই ছেলেটাকে আমি আর সহ্যই করতে পারছি না।দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে হাসছে!ওর থোঁতা মুখটা মেরে একেবারে ভোঁতা করে দিতে ইচ্ছে করছে!
-কি রে?তোর ছাগল বিয়ে করতে রাজী হল?আমাকে তোর ফ্রেন্ড হিসেবে সব বল,আগে যেমন সব শেয়ারকরতি,আমি হেল্প করব।হবু বর হিসেবে দেখিস না। -চুপ থাক হৃদয়! খুন করে ফেলব একেবারে।
-খুন করবি?কর তো!পেপারে নিউজ হবে,”বউয়ের হাতে স্বামী খুন” গ্র্যান্ড হবে! সবসময় তো স্বামীর হাতে বউ খুন হওয়ার নিউজই পড়ি!তুই উল্টা কর! এই ছেলে এত কথা কেন বলে?মাথা ধরে গেল!
-তোর মাথা ধরেছে নাকি?
-তোর বকবক শুনলে যে কারো মাথা ধরতে বাধ্য।
-আচ্ছা,আর বকবক করব না,শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দে,কবে বিয়ে করছিস ইভানকে?
-পরশু দিন।
-বাহ,ভাল।কংগ্র্যাচুলেশন।
-থ্যাংকস।
কাল আমি ইভানকে বিয়ে করছি। আমার মাথার ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে একদম। বারান্দায় বসে আছি আর চুপচাপ আকাশ দেখছি।বিয়ের আগের দিন কি প্রতিটা মেয়েরই এমন হয়?কাল থেকে বাবা-মা,আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোন সবার চোখে আমি খারাপ মেয়ে হয়ে যাব,শুধু একজনের চোখে আমি সেই আগের অদিতি হয়েই থাকব,হৃদয়ের চোখে।আমার কোন বিপদ হলে ওই এগিয়ে এসে আমাকে রক্ষা করবে,ঠিক আগে যেমন করত।এ কি?যে পাজীর জন্য আমাকে বিয়ে করতে হচ্ছে আমার তার কথা কেন মনে পড়ছে?
বান্ধবীর বাসায় আড্ডা মেরে বাসায় ফিরেছি,প্রাইভেট পড়তে যাই নি,মায়ের বকা খাওয়া থেকে বাঁচাল হৃদয়।ক্লাস নাইনে হায়ার ম্যাথে মান্থলি টেস্টে ডাবল জিরো পেয়েছি,মা রেগে-মেগে বলছে আমার পড়া-লেখা বন্ধ করে দেবে আর হৃদয় বলছে “জিরো পেয়েছে তো কি হয়েছে আন্টি?এই গাধী যদি টার্মে সেভেন্টি ফাইভে সেভেন্টি থ্রী না পায় তো আমিই পড়া-লেখা ছেড়ে দিব।”
নিজের পড়া বাদ দিয়ে আমাকে অংক করাচ্ছে হৃদয়। আরও কত স্মৃতি।সব কিছু থেকে সব সময় আমাকে বাঁচিয়ে এসেছে এই শয়তানটা, আমার একমাত্র ভাল বন্ধু,সব সময়ের বন্ধু।যেদিন ওর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা শুনেছিলাম সেদিন আমি এতই কেঁদেছিলাম যে আমার কান্না দেখে মানুষ ভাবছিল আমার কে না কে মারা গেছে! ওর উপর এত রাগ উঠে যাচ্ছিল!আমাকে একা ফেলে রেখে কি সুন্দর চলে যাচ্ছে! বলেছিলাম,”তুই ওখানে যেয়ে নতুন নতুন বন্ধু পেয়ে আমাকে ভুলে যাবি,না রে?আমার কথা তো তোর তখন মনেই পরবে না।” আমার বাচ্চাদের মত কথা শুনে ও শুধু হেসেছিল আর বলেছিল, “তোকে ভোলা আমার জন্য অসম্ভব রে পাগলী! আমি আবার ফিরে আসব আর তোকে আমার করে নেব একেবারে।”
হৃদয় ওর কথা রেখেছে।ফিরে এসেছে আমাকে ওর করে নেওয়ার জন্য,কিন্তু আমিই ওকে টুক করে ভুলে গেছি।চোখ ভেঙ্গে কান্না আসছে।চোখের সামনে একটা স্মৃতিই ভাসছে,বার বছরের হৃদয় সাঁইসাঁই করে সাইকেল চালাচ্ছে,সাইকেলের পেছেনে দশ বছরের আমি বসে আছি।মনে হচ্ছে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় বসে আছি,সাইকেল পড়ে গেছে সাথে আমি আর হৃদয়ও। হৃদয়ের কিছুই হয় নি,কিন্তু আমার হাতে রাস্তায় পড়ে থাকা টিনের কোনা ঢুকে গলগল করে রক্ত পড়ছে,আমি কাঁদছি না কিন্তু হৃদয় আমার হাত চেপে ধরে হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছে যেন ওই ব্যাথা পেয়েছে!
আজব!আমি ইভানের কথা না ভেবে হৃদয়ের কথা কেন ভাবছি? ইভানকে বিয়ে করতে যাচ্ছি।প্রথমে বনানীতে দেখা করব তারপর কাজী অফিসে যাব।বাসায় জানে আমি হৃদয়ের সাথে ওর একটা ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।হৃদয়ের সাথেই বের হয়েছি কিন্তু ও অর্ধেক রাস্তা থেকে ফিরে গেছে। “ছাগলাকে বিয়ে করে গাধী থেকে ছাগলী হয়ে যাচ্ছিস তোকে অভিনন্দন।” কথাটা শুনে এক ঘুষিতে ওর চাপা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল।আজ আমার বিয়ের দিন,শুভ দিন।তাই আর কিছু বলি নি।ব্যাটা বিয়েতে থাকতে চাচ্ছিল,আমি ভাগিয়ে দিয়েছি।আবার কি না কি ঝামেলা পাকায় তার নেই ঠিক। ইভান দাঁড়িয়ে আছে।ওর তো পাঞ্জাবী পড়ে আসার কথা,কিন্তু পড়ে আছে টিশার্ট।থাক,আমিও তো সালোয়ার-কামিজই পড়ে আছি।
-ইভান,আমি খুব সরি।তুমি আমাকে মাফ করে দাও।আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।আমি কখনোই তোমাকে ভালবাসি নি,ঘোরের মধ্যে ছিলাম একটা ,আমার সব ভালবাসাই অনেক আগে থেকেই শুধু ঐ ফাজিলটার জন্য,আমি আগে বুঝি নি।তুমি আমাকে ছেড়ে দাও ইভান!আমাকে ক্ষমা করো ।
-তোমার ক্ষমা চাইতে হবে না অদিতি ।আমি ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম তোমার কাছে।আমিও তোমাকে আজ বিয়ে করার জন্য আজ আসিনি,তোমাকে ফিরিয়ে দিতেই এসেছিলাম।তোমার আর আমার সম্পর্কটা কেমন যেন খাপছাড়া লাগত আমার আগে থেকেই,তোমার সব কথা সবসময় শুরু হত হৃদয় ভাইয়াকে দিয়ে শেষও হত তাকে দিয়েই।আমি কিছু মনে করি নি।জীবনে সুখী হও আর তোমাদের বিয়ের কার্ড তো দাও!আমার বউকে পরে বলতে তো পারব আমি আমার প্রেমিকার বিয়ে খেয়েছি।হা হা হা হা হা হা হা।।
-তোর বিয়েটা তাহলে আর হল না!আহারে।
-বিয়ে হবে তো!আর এক সপ্তাহ পর হবে।
-কিন্তু যার সাথে হবে তাকে তো তুই ভালবাসিস না।
-তো কি হইছে? সে তো আমার ভালবাসা চায় না।আমার হাঁউকাঁউ চায়।
-না,তা ঠিক না।হাঁউকাঁউ চায় ঠিক,
কিন্তু মাঝে মাঝে অল্প অল্প ভালবাসাও তাকে দিস।একদম অল্প দিলেও তার চলে যাবে।আর কিছু লাগবে না। হৃদয়ের বাইকের পিছনে আমি।বাইক সাঁইসাঁই করে ছুটে চলছে,মনে হচ্ছে আমার রাজপুত্র আমাকে তার পংখীরাজ ঘোড়ায় করে নিয়ে যাচ্ছে।