আনরোমান্টিক বর

আনরোমান্টিক বর

বিয়ের এগারো দিনের মাথায়-ই বুঝতে পারলাম বর আমার সেই লেভেলের আনরোমান্টিক। আনরোমান্টিকতার যদি কোনো উচ্চতর স্তর থাকে তাহলে আমার উনি সেই স্তরেই অবস্থান করছেন। বাসর রাতে যখন ঘোমটা টেনে বসেছিলাম তখন তিনি সোজা রুমে এসে বালিশ নিয়ে খাটের একপাশে শুয়ে পড়লো। তার মুখ থেকে একটা কথাই তখন শুনতে পেলাম,

– আজকে অনেক ধকল গিয়েছে তাই এখন ঘুমিয়ে পরো।

আমিও ভাবলাম হয়তো তিনি এখনও কম্ফোর্টেবল না। এটা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়ে সেই রাতের মতো ঘুমিয়ে পরলাম। কিন্তু বিয়ের পাঁচ ছয়দিনের মধ্যেও তো সকল স্বামী রোমান্টিক থাকে যেটা আমি আমার বান্ধবীদের কাছ থেকে শুনেছি, সেই রোমান্টিকতার ‘র’ ও পেলাম না আমার উনার মধ্যে।

কোথায় স্বামীরা এসে হঠাৎ করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরবে, সকলের আড়ালে চোখ টিপ দিবে, তা না, তিনি শুধু সকালে উঠেই অফিস আর অফিস থেকেই বাড়ি। এইটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মানুষ তো একটু বলবে যে আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে, তিনি সেটাও বলে না। কত কত ঢঙ করে যে উনার সামনে ঘুরেছি আল্লাহ মালুম। তাও তিনি একনজর দেখে চোখ ফিরিয়ে ফেলবে। এইতো সেদিন সন্ধ্যায় জামাকাপড় আনতে ছাদে উঠে দেখলাম পাশের ফ্ল্যাটের ভাবির স্বামী ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করছে। আমিও তাড়াতাড়ি করে নেমে উনার অফিস থেকে আসার অপেক্ষা করতে থাকলাম। অফিস থেকে আসার পর শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিলাম, টাই খুলে দিলাম, শার্টের বোতাম খুলে দিলাম, যেই প্যান্টে হাত লাগাতে যাবো তিনি ছিটকে দুরে সরে গিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললেন,

– আজ হঠাৎ এতো ভালোবাসা? তোমার আচরণ আমার ভালো ঠেকছে না। কিছু লাগবে নাকি তোমার?? আমিও তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে উনার কাছে গিয়ে পেটে হালকা হালকা ঘুসি দিতে দিতে বলতে লাগলাম,

– ওগো, শুনো না গো। তুমি তো একটুও রোমান্টিক না। অথচ দেখো পাশের ফ্ল্যাটের সাথী ভাবির হাজব্যান্ড কি সুন্দর করে ছাদে তার বউয়ের জন্য ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করছে। তুমিও তো একটু ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করতে পারো। তোমার এই কিউট, সুইট, গোলুমোলু বউটার জন্য এমন কিছু করতে পারবে না? বলেই উনার দিকে দরদমাখা মুখ নিয়ে তাকালাম। তিনি হয়তো বিরক্ত হয়েছিলেন কিন্তু আমার দরদমাখা মুখ দেখে বিরক্তির ছাপটা আর মুখে আনলেন না। বললেন,

– আচ্ছা, ঠিকাছে তুমি বাইরে থেকে কিছু খাবার অর্ডার করো আমি ফ্রেশ হয়ে আয়োজন করছি। এখন তো আর তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়াও যাবে না যেহেতু তুমি নিজেই বলেছো। তাই আমরা দুজনে মিলেই ডিনারের আয়োজনটা করি। কেমন?

আমার খুশি দেখে কে! লাফাতে লাফাতে মোবাইল নিয়ে ফুড পান্ডা থেকে খাবার অর্ডার করলাম। ইশ, আজকে অন্তত বরটাকে একটু হলেও রোমান্টিক করতে পারবো। খাবার দিয়ে যাওয়ার পর ছাদে গিয়ে দেখি তিনি খুব সুন্দর করে ডিনারের আয়োজন করছেন। ছোট ছোট মোমবাতি, পাশে কোকাকোলা দিয়ে গ্লাস ভর্তি। চারপাশে রোমান্টিকতা বিরাজ করছে। আমিও গিয়ে খাবারটা রেখে সুন্দর করে সেজে ছাদে রওনা দিলাম। ভেবেছিলাম আমরা কিছুক্ষণ হাতে হাত রেখে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকবো আর দুজন দুজনকে খাইয়ে দিবো। কিন্তু কিসের কি! আনরোমান্টিক বরটা গপাগপ খেয়েদেয়ে উঠে চলে গেলেন। রাগে নিজেও খেলাম না। তিনিও সাধলেন না আমায়। পরে অবশ্য লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়েছি কারণ আমি আবার খাবার সামনে রেখে না খেয়ে থাকতে পারি না। আরেকদিন বরকে বললাম,

– আচ্ছা, শুনো না গো। পাশের বাড়ির মিতু ভাবী তার হাজব্যান্ডের সাথে সিলেটে হানিমুনে গেছে। আমরাও একবার কক্সবাজার গিয়ে ঘুরে এলে মন্দ হয় না। চলো না গো, একবার যাই। তিনি বিরক্ত মুখে বললেন,

– এই তোমার কি আশে পাশের ভাবীদের আজাইরা খোঁজ খবর না নিলে হয় না! এই ভাবী এই করছে, ঐ ভাবী ঐ করছে, খালি এগুলাই বলতে থাকো। আমি আর আজকে রাগ, অভিমান দেখালাম না। শুধু গম্ভীর গলায় বললাম,

– তুমি এমন কেন? হু! কোথায় একটু রোমান্টিক হয়ে বলবে যে, ঠিকাছে আমরাও হানিমুনে যাবো। সেটা না, খালি আজাইরা পেঁচাল পাড়ো। আজকে যদি তুমি যাইতে রাজী না হও তাহলে আমি কালকেই বাপের বাড়ি চলে যাবো। এই আমি বলে দিলাম, হুহ। বলেই রান্নাঘরে গিয়ে জোরে জোরে আওয়াজ করে রান্না করতে লাগলাম। রাতের বেলায় বিছানা গোছানোর সময় বর এসে বলল,

– আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা কালকেই কক্সবাজার ঘুরে আসবো।

এই বলে তিনি ঘুমিয়ে পরলেন‌। সেদিন রাতে আমার আর ঘুম হলো না। ঘুম রেখে মেকআপ বক্স, জামাকাপড় সব গুছিয়ে রাখলাম কক্সবাজার যাওয়ার জন্য। পরদিন বিকেলে বরের অফিস থেকে আসার অপেক্ষায় আছি। তিনি আজকে তাড়াতাড়িই আসবেন বলেছেন। বর আসার পর লাগেজ পাঁচ ছয়টা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। অথচ তিনি ভাবলেশহীন। হঠাৎ করে এসে আমাকে দরজা থেকে টেনে বসার ঘরে নিয়ে সোফায় বসালেন। পাশে তিনিও বসলেন। টেবিলের উপর ল্যাপটপ রেখে কক্সবাজারের অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর ছবি দেখাতে লাগলেন একটার পর একটা। আর বললেন,

– এই যে দেখে নাও। কক্সবাজারের এসব ছবি দেখেই তুমি মনে মনে ঘুরে এসো। ঐ খানে গেলে তো অনেক ভীর থাকবে। ঘামের গন্ধ, চোরদের ভয় এসব থাকবেই, এর থেকে ভালো ল্যাপটপে ফ্রেশ ছবি গুলো দেখে কক্সবাজার ট্যুর করে নাও।

এই বলে তিনি দরজা থেকে লাগেজ গুলো নিয়ে রুমে চলে গেলেন। আর আমি ভ্যাবলা কান্তের মতো একবার তার চলে যাওয়ার দিকে তাকাই আর একবার ল্যাপটপের ছবি গুলোর দিকে তাকাই। এতো সুন্দর ভ্রমণ জীবনে প্রথমবার করলাম। এই হলো আমার আনরোমান্টিক বরের নমুনা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত