পাগলামি

পাগলামি

কিরে আপু, তোর বুকে খামচির দাগ কিসের? আপু কিছু বল্লো না! চুপ করে শোয়া থেকে উঠে চলে গেলো। আমি জানি আপু এখন ওয়াশ রুমে যাবে। বের হবে অনেক পর। তারপর দেখবো আপুর চোখ দুটো লাল গোলাপ হয়ে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আপুর চোখ বেয়ে রক্ত ঝরবে এখনি। আমি চেয়ে থাকতে না পেরে চোখ ফিরিয়ে নিবো।

আমি রুহানি, এতক্ষণ যার কথা বল্লাম, সে আমার বড় বোন। তার দুই অক্ষরের একটা সুখী নাম আছে। নাম টা হচ্ছে, রুপা। কেউ যখন আপুকে নাম ধরে ডাকে আমার সুখ হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, আপু যদি আমার ছোট হতো তাহলে নাম ধরে ডাকতাম! কিছুদিন হলো আপুর একটা বড় ধরনের অসুখ হয়েছে! মাঝরাতে যখন আমার ঘুম কাটে, ফুপানো কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। কখনো কখনো আপু ঘুমিয়ে থাকে তবুও চোখ দিয়ে টপ টপ জ্বল পরে। কাল থেকে বড় ধরনের অসুখের সাথে কৌতূহল লক্ষ্য করলাম। কাল সকাল ১২টায় বাহির থেকে আপু যখন বাসায় ফিরলো হাতে একটা নতুন চিরুনি দেখলাম।

–আমি হাসি মুখে আপুকে বল্লাম, আপু অনেকদিন নতুন চিরুনি ব্যবহার করিনা, তোর চিরুনিটা দে তো।
–আপু হিংসুটে মুখ করে বল্ল, যা আছে সব নিয়ে নে। এই চিরুনিতে হাত দিবিনা।
–আমি বল্লাম, কেন চিরুনি কি নাঈম ভাই দিয়েছে?
–আপু শান্ত গলায় বল্ল, হু দিয়েছে। তোর কোন সমস্যা?
–আমি আর কিছু বল্লাম না।

দুপুর বেলায় গোসলে যাবার সময় আপুকে দেখলাম চিরুনি টা বুকের ভেতরে নিয়ে গোসল খানায় ঢুকলো। বের হবার সময়ও সেটা বুকেই! দুপুরে খাবার প্লেটের পাশে চিরুনি রেখে আপু ভাত খাচ্ছে। একই ঘটনা ঘটলো রাতের খাবার সময়ও! শোবার আগে আপুর দাত ব্রাশ শেষে চিরুনীকে ব্রাশ করালো!

–আমি অবাক হয়ে বল্লাম, নতুন চিরুনিও ব্রাশ করতে হয়?
–আপু সাভাবিক ভাবেই বল্লো, হু হয়।
–আমি হাসিমাখা মুখ করে বল্লাম, চিরুনি কি প্রতিদিন তোর আমার মত খায় নাকি?
–আপু চিরুনি ধুতে ধুতে বল্ল, হু খায়। আমার বুকের ভালোবাসা খায়। আপুর কথায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার চোখ বেয়ে পানি আসবে মনে হচ্ছে!

–নিরবতা ভেঙ্গে আবার বল্লাম, চিরুনীকে গুসল করাবি না?
–আপু হাসিমুখে বল্লো, করাবো। ওকে গোসল করানোর জন্য আলাদা একটা সাবান কিনেছি।

চিরুনি নিয়ে আপু শুয়ে আছে। অন্যান্য দিন গালের নিচে হাত রেখে শুইতো, আজ শুইলো চিরুনি রেখে। আমি জানি আজ থেকে আপু এভাবেই ঘুমাবে! একটু পর টের পাবো চিরুনীর বুকে মুখ লুকিয়ে আপু কাদছে। তারপর যখন ঘুম পাবে, চোখ লেগে আসবে, চিরুনীটা বুকে নিয়ে আপু ঘুমাবে। এখন বুঝতে পারলাম, সকালে আপুর বুকে কিসের দাগ ছিলো!

আপু ওয়াশ রুম থেকে বের হলো। আমার মনে হলো আপুর চোখে লাল লিপস্টিক লাগিয়েছে। আমি নিরব ভঙ্গিমায় বল্লাম, নাঈম ভাই কে জানিয়েছিস তোর যে বিয়ে ঠিক হয়েছে? আপু হু হু করে কেদে উঠে বল্ল, তার সামনে এই কথাটা আমি বলতে পারিনি! আপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আপু কেদে কেদে বলতে লাগলো সেদিন নাঈম আমাকে নিয়ে তার ভার্সিটিতে গিয়েছিলো। তার সব বন্ধু মিলে, তার সমস্ত মুখে রঙ মাখলো। তার রঙমাখা মুখ দেখে আমি আবারো তার প্রেমে পড়লাম।

ক্ষানিকটা পর আমি আর সে ভার্সিটির গেস্ট রুমটায় বসেছি। একজন একটা বিরিয়ানির বক্স দিয়ে গেলো। সুখী সংসারের মত সে আমায় খায়িয়ে দিলো। ভার্সিটির অন্যান্যরা ব্যাস্ত হৈহল্লোর নিয়ে, আর সে ব্যাস্ত আমায় নিয়ে। তার এক বন্ধু এসে বল্ল, কে রে এটা? সে সাভাবিক ভাবেই বল্লো, তোর ভাবি। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করলাম। কলেজ থেকে ফেরার সময় সে আমার মাথাটা শক্ত করে তার বুকে চেপে ধরে বল্ল, ভালোবাসি। আমি চুপচাপ তার বুকের ভেতর মিশে যেতে চাইলাম। আমি আপুকে ছেড়ে দিয়ে চোখের পানি গুলো মুছতে মুছতে বল্লাম, নাঈম ভাই কল দিচ্ছে, কথা বল। আপু ফোনটা কানে নিয়ে কান্না চেপে ধরে বল্লো, যানো নাঈম আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

–একটু চুপ থেকে আবার বল্ল, হ্যা আমি সত্য বলছি।
–আরেকটু চুপ থেকে আবার বল্ল, নাঈম বিশ্বাস করো আমি সত্যি বলছি।

আপু কান থেকে ফোনটা হাতে নিলো। আমি বুঝলাম ফোনটা নাঈম ভাই কেটে দিয়েছে! আপু আবার ট্রাই করছে কথা বলার জন্য কিন্তু রিং হচ্ছে না। ওপাশের ফোনটা সুইচড অফ। আপু সারাদিন ট্রাই করলো, কাজ হলো না। আজ পঞ্চম দিন এখনো ট্রাই করছে, একটা রিং ও হচ্ছে না। এখন আর আপু কাদে না। শুধু চিরুনীটার দিকে চেয়ে থাকে। আজও চিরুনীটা গুসল করিয়ে কুলে নিয়ে বসে আছে। আপু এখন আমার সাথেও কথা বলে না। বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। আজ চার দিন যাবৎ আপু গুসল করেনা অথচ বিয়ের বাকি আর দুদিন। গত এক সপ্তাহ আপুকে আমার পাশের বিছানায় দেখিনা। যখনই আপুর দিকে তাকাই দেখি চিরুনি এপাশ ওপাশ করছে, কখনো চিরুনির দাত গুনে, কখনো চিরুনির ফাক দিয়ে আকাশ দেখে। আমার মনে হচ্ছে, আপু মানষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। পাগল মানুষ ঘরে থাকতে চায় না। আপুর এখন ঘরের বাহির হওয়ার বাকি।

বিয়ের আগের দিন সকালে আপুর খোজ পাওয়া গেলো না। কিছুই নিয়ে যায়নি শুধু চিরুনিটা নিয়ে গেছে। এক মেহমান এসে বল্ল, সাতসকালে এক মেয়েকে বোরকা পরে বের হতে দেখলাম হাতে একটা চিরুনিও ছিলো।
আপুর বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো। আজ ৪০ দিন আপুর কোন খোজ নেই। নাঈম ভাইয়ার ফোন টা এখনো অফ। আপুর ফোন দিয়ে নাঈম ভাইয়ার আইডিটা প্রতিদিনই খুজি কিন্তু পাইনা। আইডি ডিজেবল! তাহলে কি নাঈম ভাই ও নিখোঁজ! ২ বছর পর নাঈম, দুবছর আগের কথা, রুপার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলাম। বিচ্ছিন্ন না করে উপায় ছিলো না। আমি তখন বেকার যুবক। বেকারদের ভালোবাসায় মানায় কিন্তু বিয়েতে মানায় না। থাক না সেসব কথা!

কাল একটা চাকরি পেয়েছি। লম্বা বেতন! অফিস থেকে বল্ল, অফিসিয়ালি কিছু কাগজ পত্র নিয়ে যেতে। দুই বছর পর আজ ভার্সিটি যাচ্ছি! গলার টাই টা লাগাতে লাগাতে মনে মনে বল্লাম, রুপা বোধহয় এখন আমাকে দিব্বি ভুলে গেছে। সুন্দর একটা মেয়েও হয়তো হয়েছে। আমি দীর্ঘ আক্ষেপ নিয়ে নিশ্বাস ফেল্লাম। যার অর্থ, প্রেমের বিরহ এখনো আমায় ছাড়েনি। মিনিট সাতেক ধরে আমি হাটছি। হাটতে হাটতে ভার্সিটির গেইটের সামনে আসলাম। পরিচিত ছোট ভাই সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছি? আমি হাসিমুখে বল্লাম, তোমাদের দেখে ভালো লাগছে। আর জরুরি কিছু কাগজে পত্রের জন্য আসা। গেইটের অপর পাশে লক্ষ করলাম, কয়েকটা মেয়ে একটা পাগলের সাথে দুর্ব্যবহার করছে।

–আমি এগিয়ে গিয়ে বল্লাম, কি হয়েছে আপু? ওনার সাথে এমন করছেন কেন?
–মেয়েটা আমার দিকে জামার হাতা তুলতে তুলতে এগিয়ে এসে বল্ল, আমি এই ভার্সিটির ভিপি। যার সাথে ইচ্ছে দুর্ব্যবহার করবো, আপনার কোন সমস্য?
–আমি এক আকাশ নিরবতা নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম।
–মেয়েটা আবারো বল্ল, দেখবেন আমি কি পারি? কথাটা বলে, পাগলটাকে জুরে একটা থাপ্পড় মারলো।

থাপ্পড়ের আঘাতে মুখের সামনের চুল গুলা সরে গেলো। হাতের দিকে চেয়ে দেখি, একটা চিরুনি শক্ত করে ধরে আছে। আমি স্পষ্ট চিনলাম, এটা আমার প্রেম! রুপার চোখ দুটি ছলছল করছে।

–ভার্সিটির ভিপি মেয়েটা হাসছে, সাথে তার বান্ধবী গুলাও।
–আমি ভিপি মেয়েটার সামনে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে এক চিলতে হাসলাম।
–ভিপি মেয়েটা খানিক অবাক হলো।
–আমি আরো একটু ভড়কে দেবার জন্য ভিপি মেয়েটার অবাক মুখে কশিয়ে একটা চর বসিয়ে দিয়ে বল্লাম, ভিপি একদম জায়গায় ভরে দেব।

ভিপি মেয়েটা লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। বান্ধবি গুলা স্তব্দ হয়ে এক পা পিছনে সরে গেল। ভার্সিটির সামনের ছাত্র ছাত্রী সবাই “থ” হয়ে দাড়িয়ে আছে। আমার প্রেম, লাফ দিয়ে হেসে উঠলো। আমি রুপার সামনে গিয়ে মুখ থেকে চুল সরাতে সরাতে বল্লাম, চিরুনীকে গুসল করাবে না? আমার বাসায় সাবান আছে, পানি আছে। রুপা উদাসীন হয়ে আমার চোখের দিকে তাকালো। আমি দ্রুত টাই খুলে, শার্টের বুতাম খুলে, বুকের দাগ টা তার চোখের সামনে ধরে বল্লাম, এইযে তোমার কামরের দাগ। ঐযে গেস্টরুমে দাড়িয়ে দিয়েছিলে।

রুপা গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলো আমায়! ঢেকুর তোলা কান্নায় বল্ল, যানো নাঈম আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। রুপার চোখের জ্বল আমার কাধে টুপটাপ পরছে। আমি রুপাকে সোজাসাপটা কোলে করে হাটা শুরু করলাম।
পুরো ভার্সিটি টা আমার দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে। পিছন থেকে ভার্সিটির ছোট ভাইটা চেচিয়ে বল্ল, ভাই কাগজ গুলা নিবেন না? আমি হাটা না থামিয়ে, একবুক সুখ নিয়ে মিনমিন করে বল্লাম, এখন কাগজ নেবার সময় না। এখন, টুপটাপ চখের জ্বলে ভালোবাসার সাগর হবার সময়!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত