প্রায় ২০ মিনিট পর আমার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো।। খেয়াল করতে দেখলাম এনা নামের মেয়েটি এখনো হাপাচ্ছে আমার পাশে শুয়ে।। আমি ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে উঠে পড়লাম।। ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের কাপড় পড়ে বের হয়ে দেখি এনা এখনো শুয়ে আছে বিবস্ত্র অবস্থায়।। আমি তাকে কিছু না বলে রান্নাঘর থেকে কোরিয়ান চাকু নিয়ে আসলাম।। এনা আমার হাতে চাকু দেখে ভয় পেয়ে যায়।। আমি তখন একটি পৈশাচিক হাসি দিয়ে উঠি।। এনা চিৎকার করে উঠার আগেই তার গলায় চাকু চালিয়ে দেই আমি।। গলা কাটা মুরগীর মত লাফালাফি করা শুরু করে এনার দেহটা।। কিছুক্ষন পর একসময় তা থেমে যায়।। আমি রক্তগুলো পরিষ্কার করে এনার লাশটা একটা ব্যাগে ভরে ফেলি।। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি মাত্র রাত দুটো বাজে।। সকাল হতে এখনো অনেক দেরি।। তাই চটপট ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।। ব্যাগটি নিজের গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে আসি।। পরদিন হয়ত লাশটি ভেসে উঠবে কিন্তু সমস্যা নেই কোন প্রমান রাখিনি আমি।। কেউ আর আমাকে ধরতে পারবে না।।
.
এটা ছিল আমার ৩৫তম রুমডেট এবং একইসাথে ৩৫তম খুন।। এর আগে ৩৪ জন মেয়ের সাথেই আমি রিলেশন করেছি এভাবেই তাদের সাথে রুমডেট করে খুন করে নদীতে ফেলে দিয়েছি।। কোন প্রমাণ না থাকায় পুলিশ আমাকে ধরতে পারেনি।। আমি আগে এমন ছিলাম না।। শান্ত-শিষ্ট,মনোযোগী এক ছেলে ছিলাম।। মা জন্মের সময় মারা যায় আর বাবা সবসময় তার ব্যবসার কাজ করতে ব্যাস্ত থাকতেন।।যদিও টাকা-পয়সার কোন অভাব ছিল না আমার।। কিন্তু ভালবাসার অভাব ছিল অনেক।। এএভাবে একসময় ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাই আমি।।ভার্সিটিতে পড়ার সময় পরিচয় হয় মায়া নামের এক মেয়ের সাথে।। নামের সাথেই তার চেহারায় ছিল অন্যরকম এক মায়া।। বন্ধুত্ত হয়েছিল আমাদের।। বন্ধু হওয়ার দুবছর পর আমি তাকে প্রোপজ করি।। মায়া আমাকে এক্সেপ্ট করে।।
.
ভালো চলছিল তখন দিনগুলো।। ভার্সিটিতে যেতাম কথা বলতাম।। তখন দেখতাম আমার কিছু বন্ধু তাদের প্রেমিকাদের নিয়ে রুমডেট করে।। কিন্তু আমি কখনো মায়ার হাত ধরেও দেখিনি।। প্রায় একবছর পর দেখি মায়া আগের মত আমাকে সময় দেয় না।। ফোন করলে বিজি দেখায়।। মেসেজের রিপ্লে দেয় দেরি করে।। ততদিনে আমি মায়াকে অনেক ভালবেসে ফেলি।। তার এই অবহেলা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।। তাই একদিন তাকে দেখা করতে বলি।। সে বলে তার অন্য কাজ আছে।। অনেক কষ্টে তাকে রাজী করাই।। পার্কে আসার পর তার কাছ থেকে আমি এমন ব্যবহার করার কারণ জানতে চাই।। মায়া সেদিন বলেছিল ও নাকি আমার সাথে আর রিলেশন রাখতে চায় না।। আমার দোষ ছিল আমি তার হাত কখনো ধরে দেখিনি।। তাকে কখনো জড়িয়ে ধরিনি।। অন্যদিকে তার বান্ধবীরা তাদের প্রেমিক নিয়ে কতকিছু করে।। সেদিন আমি তাকে কিছুই বলতে পারিনি।। দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে থাকে।। মায়া চলে গিয়েছিল সেদিন।। আমি কেঁদেছি সেদিন।। অনেক কেঁদেছি কিন্তু সে ফিরে আসেনি।। অনেক চেষ্টার পরেও আর ফিরিয়ে আনতে পারিনি আমি তাকে।। কিছুদিন পর দেখি অন্য আরেক ছেলের সাথে হাত ধরে তার কাধে মাথা রেখে ঘুরছে মায়া।। প্রচন্ড কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল আমার।। তারপর নিজেকে পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।। সিগারেটটাকে সঙ্গী বানিয়ে নিয়ে এই পথে আশা হয়েছে আমার।।।
.
সকালবেলা বাইরে হাটার অভ্যেস আছে আমার।। প্রতিদিনের মত আজও বাসা থেকে বের হয়েছি।। পাশের বাসা পার হয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ উপর থেকে আমার মাথায় কিছু একটা পড়ে।। আমি সাথে সাথে উপরে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই।। আমিও আর কিছু না ভেবে হাটতে চলে যাই।।
পরদিন আবারো সেই বাসার নিচ দিয়ে যাচ্ছিলাম।। এইবার একটা চিরকুট পড়ল আমার সামনে।। উপরে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই।। আশেপাশে কাউকে না দেখে চিরকুট উঠিয়ে নিলাম।। চিরকুটে লেখা ছিল “কি মিস্টার কতদিন ধরে চুল দাড়ি কাটেন না? পুরো তো আফ্রিকান জংগল থেকে উঠে আসছেন বলেই মনে হয়।। আজই চুল দাড়ি কাটবেন।” হঠাৎ আমার মনে পড়ল দুসপ্তাহ ধরে দাড়ি কাটা হয় না।। চুলগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে,কাটতে হবে।। সেদিন বিকেলে চুল-দাড়ি কেটে ফেলি।।
.
আজও সেই বাড়িটার নিচ যাচ্ছিলাম।। প্রতিদিনের মত আজও একটি চিরকুট পেলাম।। চিরকুটে লেখা “ধন্যবাদ। এখন আপনাকে অনেক স্মার্ট লাগছে।” চিরকুট পড়ে আমার খুব হাসি পেয়ে গেল।। হাসতে হাসতে সেদিন চলে যাই আমি।। এভাবেই প্রায় এক সপ্তাহ চলে যায়।। প্রতিদিন একটা চিরকুট পেতাম।। সিগারেট নেশা করা এসব ছেড়ে দিতে বলত।। আমি এতটা কেয়ার করতাম না এসবের।। নিজের ইচ্ছেমত চলাফেরা করতাম।।
.
একদিন রাত ১২টায় বার থেকে বাসায় ফিরছিলাম।। সেই বাসার সামনে আসার পর দেখলাম নিচে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।। কাছে আসার পর দেখলাম মেয়েটা আর কেউ না বর্ষা।। পাশের বাসার বাড়িওয়ালার মেয়ে।। আমি আমার বাসায় ঢুকার সময় বর্ষা আমাকে ডাক দেয়।। আমি দাঁড়িয়ে যাই।। বর্ষা কাছে এসে আমাকে বলে,
-কি ভাবেন আপনি নিজেকে?
– কিছু না।। কেন বলুন তো?
– আপনার জন্য একটা মেয়ে এত রাত পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আর আপনি তার সাথে কথা না বলে চলে যাচ্ছেন?
– আমি তো আর জানি না যে আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।। আর আমি আপনাকে কখনো বলিনি যে আমার জন্য রাতে অপেক্ষা করুন রাস্তায়।।
– আপনি বলবেন তা না হলে কি অপেক্ষা করা যায় না?
– সেটা একান্ত আপনার ব্যাপার।।
– আপনি আমার কথা রাখছেন না কেন?
– কোন কথা? আপনার সাথে তো এর আগে কখনো আমার কথা হয়েছে বলে মনে হয়না।।
– কেন চিরকুটে যে লিখেছিলাম নেশা করা ছেড়ে দিতে? তবুও তো আজ নেশা করেছেন।। মদের গন্ধ আসছে আপনার শরীর থেকে।।
আমি অবাক হয়ে কতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম জানি না।। বর্ষার কথায় ঘোর কাটে আমার।।
– তারমানে প্রতিদিন চিরকুটগুলো আপনি ফেলতেন উপর থেকে?
– জী মিস্টার মাহিন সাহেব।।
– ওহ আচ্ছা।। আপনি কি আর কিছু বলবেন? আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে।। বাসায় গিয়ে ঘুমাবো।।
– আর কিছু বলব না।। শুধু নেশা করা ছেড়ে দিবেন।।
আমি আর কোন উত্তর না দিয়ে বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়ি।।
.
সেদিন থেকেই শুরু হয় বর্ষার অত্যাচার।। প্রত্যেকদিন সকালে ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিত মেয়েটা।। কয়েকবার সিম পরিবর্তন করার পর কাজ হয়নি।। কিভাবে যেন নাম্বার পেয়ে যেত।। বর্ষার একটি ছোট বোন ছিল তাকে দিয়ে একটি চিরকুট পাঠাত প্রতিদিন।। আমি বুঝতে পারতাম সে আমাকে ভালবাসে তাই এমন করে আমার সাথে।। কিন্তু কোন মায়ার বাধনে আমি জড়াতে চাইনি।। কোন এক অদৃশ্য শক্তির কারনে আমি তাকে ব্যবহার করতেও পারছিলাম না।। এভাবে চলতে থাকে।। দিন দিন মাত্রা বাড়তে লাগল।। তাই ঠিক করলাম বর্ষাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।।
.
কিছুদিন পর রাতে বাসায় ফিরার পথে দেখলাম বর্ষা দাঁড়িয়ে আছে।। সেদিন এমনি মেজাজ অনেক খারাপ ছিল তারপর আবার বর্ষা ডাক দেয়।। আগে থেকেই রাগ ছিল আমার বর্ষার উপর।। বর্ষা ডাক দিতেই আমি গিয়ে সজোরে একটি চড় বসিয়ে দেই ওর গালে।।
– ভালবাস আমাকে তাই না? ভালবাস? আরে ভালবাসা কাকে বলে বুঝো তুমি? আর একদিন যেন তোমাকে আমার চোখের সামনে না দেখি।।
কথাগুলো বলেই আমি চলে আসি নিজের বাসায়।। প্রচন্ড রাগে মাথা কাজ করছিল না তক্ষন আমার।। সেদিন রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে নেই।। সকালে খুব ভোরে উঠে আমাদের বাগানবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই।। ভেবেছিলাম সেখানে কিছুদিন শান্তিতে থাকতে পারব।। কিন্তু না সেটা হয়নি।। সেখানে গিয়ে আমি আরো অশান্তিতে পড়ে যাই।। প্রতিটা মূহুর্তে বর্ষাকে মিস করতে শুরু করি।। বর্ষার চিরকুট,প্রতিদিন সকালে ফোন দিত বর্ষা।। কিন্তু এখানে আসার পর একদিন ফোন দেয় নি বর্ষা।। এভাবে এক সপ্তাহ চলে যায়।। আমি আর থাকতে পারছিলাম না তাই চলে আসি নিজের বাসায়।।
.
বাসায় আসার পর বর্ষার চিরকুটের অপেক্ষা করতে থাকি।। কিন্তু কোন চিরকুট আসে না।। এখানে আসার দুদিন পর বর্ষার একটি চিরকুট পাই।। বর্ষার ছোট বোন এসে আমাকে চিরকুট দিয়ে যায়।। অনেক খুশি হয়ে চিরকুট হাতে নেই আমি।। বন্যাকে বর্ষা কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই তার মুখটা আধারে ঢেকে যায়।। বন্যার কথা শুনে আমার চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে।। দম বন্ধ হয়ে যায়।। বন্যা বলে বর্ষা নাকি আত্নহত্যা করেছে।। এই চিরকুট দিয়ে বর্ষা বলে গিয়েছিল যেন আমাকে দেয়।। আমি ফ্লোরে বসে পড়ি।। কাপা হাতে চিরকুট হাতে নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করি।।
.
প্রিয় মাহিন,
তুমি যখন চিঠিটা হাতে পাবে ততক্ষনে আমি অনেক দূরে।। তুমি আমাকে স্বার্থপর ভাবছ তাই না? তোমাকে একা রেখেই আমি চলে গেলাম।। কি করব বল? অনেক ইচ্ছে ছিল তোমাকে নিয়ে বাচার।। তোমাকে ভালবাসার।। কিন্তু আফসোস সেটা হল না।। তুমি যে এর আগে ৩৫ জন মেয়েকে খুন করেছ সেটা আমি জানি।। এটাও জানি তাদের মধ্যে একটা মেয়েও ভালো ছিল না।। তুমি যখন লাশ গুলো নিয়ে যেতে আমি বারান্দা থেকে সব দেখতাম।। ইচ্ছে ছিল তোমাকে আমার সব ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিব।। তোমাকে ভাল পথে ফিরিয়ে আনব।। সেটা আর হল না।। আমার বাবা জোর করে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন।। এই কথাটি সেদিন তোমাকে আমি বলতে চেয়েছিলাম।। কিন্তু তুমি আমার কোন কথা শুনো নি।। উলটো আমাকে থাপ্পর মেরে চলে গেলে।। পরদিন শুনলাম তুমি নাকি বাসা থেকে চলে গিয়েছ।। অনেক চেষ্টা করেছিলাম তোমার সাথে যোগাযোগ করার।। কিন্তু পারিনি।। তোমাকে অনেক ভালবেসেছিলাম।। কিভাবে আরেকজনের হয়ে যাব আমি? আমার ভালবাসা মিথ্যে ছিল না।। তাই চলে গেলাম আমি।। ভালো থেক তুমি।। পরপারে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।।
ইতি
বর্ষা
অঝোরে চোখ থেকে পানি পড়ছে আমার।। আমার ভুলের জন্য আজ বর্ষাকে চলে যেতে হল।। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আমি তোমাকে ভালবাসি বর্ষা।। সেই চিৎকার কেউ শুনতে পারবে না।। ছাদে চলে আসলাম আমি।। বাইরের আকাশে অনেক তারা।। সেই তারাগুলোর মধ্যেই হয়ত লুকিয়ে আছে আমার বর্ষা।। হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার বর্ষা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।। আমাকেও যেতে হবে বর্ষার কাছে।। ছাদের রেলিং উঠে দাড়ালাম।। শেষবারের মত আকাশ দেখে লাফ দিলাম নিচে।। বর্ষা আমি আসছি।। আমি আসছি তোমার কাছে বর্ষা।।।
———–সমাপ্ত———-
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা