-মা, এইটা তুমি কি রঙের শাড়ি পরে আসলে? এই বয়সে লাল রং কেউ পরে? আমার শাশুড়ি ঘুরে ঘুরে তোমার শাড়ির দিকে দেখছে ।তোমাকে দেখে আমারই কেমন লাগছে । আমি তানির কথা শুনে খুব লজ্জায় পড়লাম ।
আমতা আমতা করে মেয়েকে বললাম – আসলে তোদের বাসায় আজকে দাওয়াত শুনে কালরাতে তোর বাবা এই শাড়িটা কিনে নিয়ে আসলো ।এই রং দেখে আমিও তোদের বাসায় পরে আসতে চাই নাই ।কিন্তু তোর বাবাকে তো চিনিস ।যা বলে না করলে কেমন রাগ করে । তাই পরতে হল । দুপুরে খেয়ে বিকাল পর্যন্ত তানির বাসায় থাকবার কথা থাকলেও শাড়ির কথা বলার পর থেকে আমার খুব অশস্থি লাগছিলো ।তাই দুপুরের খাবার খেয়েই তানির বাবাকে নিয়ে বের হয়ে আসলাম ।তানিও খুব একটা জোর করলনা থাকবার জন্য । আমি এমনেতেই উজ্জ্বল রঙের শাড়ি কম পরি ।ইস! বেয়াই বেয়ান কি ভাববে ।সব দোষ এই মানুষটার । কি যে হল উনার! কালকে এতবার বলার পরেও শাড়িটা পাল্টে আনতে গেলনা । আবার আজকে আসার সময়ও বললাম পরবোনা। তাও উনার কি রাগ!শাড়িটা পরার পরে বউমাও একবার বলল এই শাড়ি পরে যাবেন মা !
-কি ব্যাপার খালেদা তুমি এতো তাড়াহুড়া করে চলে আসলে কেন ? আছরের নামাজটা পড়েই আসতাম ।এখন তো রাস্তায় আজান দিবে ।নামাজটা কাজা হবে ।
– কাজা হলে বাসায় গিয়ে কাজা নামাজ পড়বে । তোমাকে এতবার বললাম এই বয়সে এই রঙের শাড়ি পরলে লোকে হাসবে ।তুমি শুনলে আমার কথা ?
– উনি গম্ভির কণ্ঠে বললেন কেন কেউ তোমাকে কিছু বলেছে ?
– বলবেনা , তানির শাশুড়ি কেমন কেমন করে দেখছিল । এতো ঝলমলে শাড়ি পরার বয়স কি আছে !তানি বলছিল আমরা চলে আসলেই ওকে কথা শুনতে হবে । কি লজ্জায় পড়লাম আমি বলোতো ।আজকেই বাসায় গিয়ে এই শাড়ি বউমাকে দিয়ে দিবো । মানুষটা আর কোন কথা বলল না । সারা রাস্তায় মুখ গম্ভির করে রাখলো । এই ঘটনার ঠিক দুইদিন পরেই সকাল বেলায় মানুষটা আমাকে বলল খালেদা চল আজকে সারাদিন আমরা বেড়াতে যাবো। কোন হলে গিয়ে ছবি দেখব , রাতে একবারে বাহিরে খেয়ে বাসায় আসবো । আজকে তুমি একটু ভালো করে সেজে নিও । কারো বাসায় তো যাবনা। তাই কেউ কিছু বলার ভয় নেই । এই কথায় আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললাম । এইগুলো তুমি কি বল!! বউমা আর তমাল আজকে বিকালে কোন বন্ধুর বাসায় পাটীতে যাবে । বাচ্চাদের নিবে না । আমরাও বাহিরে গেলে বাচ্চারা থাকবে কার কাছে ? উনি রাগ করে বললেন – ওরা তো প্রায় সময় বাচ্চাদের আমাদের কাছে রেখে বেড়াতে যায় । আমরা তো যাই না । আজকে আমরা যাবো।
ওদের বল আজকে যেতে না । আর গেলেও যেন বাচ্চাদের নিয়ে যায় । আমি করুণ সুরে বললাম । এইতো ওদের বেড়াবার বয়স, কেন এমন করছ? অশান্তি করোনা । আমাদের বেড়াবার বয়সতো আমরা পার করে এসেছি ।
উনি রাগে গজগজ করতে করতে বাইরে চলে গেলেন । কিছুক্ষন পরেই বাসায় আসার সময় আমার জন্য একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে আসলেন । দেখে আমার এতোভালো লাগলো । কতদিন পরে আমার জন্য উনি ফুল আনলেন । নাতিরা দৌড়ে দাদার হাত থেকে ফুল নিতে চাইলো । উনি বললেন না এই ফুল তোমাদের দিদার জন্য তোমরা নষ্ট করনা । আমি তাড়াতাড়ি ফুলগুলো নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম ।বউমা যদি আবার দেখে ফেলে তাহলে কি ভাববে ! মানুষটা আমাকে বললেন তোমার ভালো লেগেছে খালেদা ? আমি কপট রাগের সুরে বললাম । একটু লুকিয়ে আনতে পারলেনা ?যদি বউমা দেখে ফেলত ?
– উনি অবাক হয়ে বললেন বউমা দেখলে কি হতো? আমি তোমার জন্য ফুল আনতে পারিনা !
– পারোতো ।পারবেনা কেন , কিন্তু কি বলতো উনি আর আমাকে কথা বলতে দিলেন না । টেনে আমার খোঁপায় একটি ফুল গুজে দিলেন । পরেরদিন দুপুরে রান্না করছি এইসময় কাজের মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল ও খালাম্মা খালু নাকি আপনার জন্য কাইলকা ফুল আনছে ? ওর এই কথা শুনে আমি বিষম খাবার জোগাড় হল । নিজেকে সামলে গম্ভির মুখে জানতে চাইলাম কে বলছে তোকে এই কথা ? ও খালাম্মা আপনি আমারে রাগ করেন ক্যান ? ভাবিরে দেখলাম উনার বান্ধুবিরে হাসতে হাসতে বলতাছে খালুর মনে নাকি বুড়া বয়সে রং লাগছে ।আপনারে ঝকমকে শাড়ি কিনে দেয় , ফুল আনে , আপ্নারে সাথে নিয়া রাত জাইগা ছবি দেখে ।
অপমানে আমার চোখ মুখ জ্বালা করতে লাগলো ।কালকে রাতে মানুষটাকে বলেছিলাম এতো রাতে ছবি দেখার দরকার নেই ।তবু উনি দেখবেনই । টিভি হলো ড্রইংরুমে । বউমা মনে হয় রাতে দেখেছে । আর এখন নিজের বন্ধুদের সাথে উনাদের নিয়ে হাসি তামাসা করছে ।ছিঃ ছিঃ কি লজ্জার কথা ।আজকেই মানুষটার এইসব বন্ধ করতে হবে। গত একমাস আগে চাকরি থেকে অবসর নিবার পর থেকেই উনার ভীমরতি হয়েছে । রাগ করে রুমে গিয়ে দেখি উনি কিসের বই পড়ছে । বইটা হাত থেকে নিয়ে বন্ধ করে বললাম তুমি পাগলামি করো আর আমাকে কথা শুনতে হয় । উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কিহয়েছে!! সবশুনে উনি চুপ করে থাকলেন । আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলাম । মেয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল । ঘুম থেকে উঠে তানিকে দেখে খুশী হয়ে বললাম কিরে তুই যে আজকে আসবি বলিস নাই তো !!
-আমার তো আজকে আসার কথা ছিলনা মা ।বাবাইতো ফোন করে আসতে বলল । আমি অবাক হয়ে বললাম কেন ? কি হয়েছে ? তোর বাবা কোথায়? বাবা, ভাইয়া, ভাবি সবাই ড্রইংরুমে । তুমি আসো আমার সাথে । আমি খুব অবাক হয়ে তানির সাথে ড্রইংরুমে আসলাম । তমাল আমাকে দেখেই বলল মা আগে চা নিয়ে আসো । আমি উঠতে যাবো এমন সময় মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন খালেদা তুমি আমার পাশে বস । বউমা তুমি যাও চা নিয়ে আসো । তমাল বলল – বাবা তুমি তো জানোমায়ের হাতের চা ছাড়া আমি খেতে পারিনা ।
-এখন থেকে অভ্যাস কর বউয়ের হাতের চা খাবার ।
– এই কথা বলছ কেন বাবা !
-বলছি কারন আর ১৫ দিন পরেই তোমার মাকে নিয়ে আমিপাকাপক্ত ভাবে খাগড়াছড়ি চলে যাবো ।
-সেকি!! কি বলছ বাবা কেন ? আর খাগড়াছড়ি কেন ?
– খাগড়াছড়ি কারন ঐ খানে আমি গত একবছর আগে একটি ছোট বাড়ি কিনেছি ।
যে বাড়ির কিছু কাজ বাকি ছিল । ঠিক করেছিলাম চাকরি থেকে অবসরে গেলে তোমারমাকে সারপ্রাইজ দিবো । তাই তোমাদের কাউকে এতদিন জানাইনি । ভেবেছিলাম মাঝে মাঝে তোমাদের সবাইকে নিয়ে ঐখানে বেড়াতে যাবো । কিন্তু এখন ঠিক করেছি বেড়াতে নয় । তোমার মাকে নিয়ে একেবারে গিয়ে থাকবো ।মেয়েটা এবার মুখ ফুলিয়ে বলল ভাবি কি তোমাদেরসাথে খারাপ ব্যাবহার করেছে ? উনি মুছকি হেসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন তুমিওকরেছো । শুন তোমাদের আজকে কিছু কথা বলি । আমার সাথে তোমার মায়ের চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে ।
তোমরা জানো আমাদের ছিল যৌথ পরিবার ।আমি চাকরি করতাম ঢাকাতে । তোমার মা থাকতো তোমাদের দাদির কাছে । তাই যৌবন বয়সে তেমন করে আমি তোমারমাকে নিয়ে নিজের শখ আহ্লাদ মিটাতে পারি নাই । আমাদের সময় যৌথ পরিবারের বউরা স্বামীকে নিয়ে একা কোথাও বেড়াতে যেতে পারতো না ।এমন কি দিনের বেলায় দুইজনে একসাথে দাঁড়িয়ে কথা বললেও বাড়ির সকলে এই নিয়ে তামাসা করতো ।সেই ভয়ে আমি ছুটিতে বাড়ি গেলেও তোমার মাকে রাতে ছাড়া দুইটি কথা বলার জন্য কাছে পেতাম না ।কখনো তোমার মায়ের জন্য আলাদা করে কিছু কিনতে পারতাম না ।কারন আমি বাড়িতে গেলেই কি এনেছি তাই দেখার জন্য বোনেরা , ভাবিরা মা সবাই একসাথে আমার ব্যাগ খুলত । তারপরে একে একে তোমাদের জন্ম হল । তোমার দাদি মারা গেলেন । তোমারাও বড় হচ্ছ ।তোমাদের ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য ঢাকাতে বাসা নিয়ে আসলাম । সেই সময় সরকারী চাকুরেদের বেতন ছিল খুব কম ।
তোমাদের ভালো লিখা পড়ার জন্য খুব ভালো স্কুলে তোমাদের ভর্তি করালাম । মাসে বেতন পেলে তোমাদের স্কুলের খরছ , টিফিনের খরছ , বাসা ভাড়া মাসের বাজার করার পরে মাস শেষ হবার আগেই আমার হাত খালি হয়ে যেতো। তাই তোমার মাকে নিয়ে বাড়তি কোন কিছু করার কথা ভাবতেও পারিনি সে সময় । দুই ঈদেই বোনাস পেলে তোমার মাকে বলতাম দামি একটা শাড়ি কিনতে ।কিন্তু ও মার্কেটে গিয়ে তোমাদের জন্য বেশি দাম দিয়ে জামা জুতা কিনে ফেলত । বাকি টাকা দিয়ে সংসারের জন্য জিনিস কিনত । আমি মাঝে মাঝে রাগ করতাম । ও আমাকে বলতো তোমরা বড় হলে ওকে দামি শাড়ি কিনে দেবে । তোমাদের রেখে আমরা কখনো কোথাও বেড়াতে যাই নাই ।মাঝে মাঝে ওর জন্য ফুল আনতাম । একদিন তোমাদের মা আমাকে বলল আর ফুল আনবেনা । ফুল শুকিয়ে গেলে ফেলে দিতে হয় কি লাভ? সেই টাকা দিয়ে যেন তোমাদের জন্য চিপস আনি তোমরা খুশী হবে ।
সেই থেকে ফুল আনাও বন্ধ হল । আমরা আমাদের জীবনের যৌবন এভাবেই ফেলে বৃদ্ধ বয়সে চলে এসেছি । এখন আমার বেতনের টাকা আমার কাছেই থাকে । আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি । তোমরাও বিয়ে করে সংসারী হয়েছ । অবসরে যাবার পরে লক্ষ্য করলাম তোমার মায়ের এখনো অবসর নেই । রান্না তাকে এখনো করতে হয় । কারন তোমরা তার হাতের রান্না ছাড়া খাবেনা । তোমার মাকে আমি পছন্দ মতো শাড়ি কিনে দিলে তোমাদের সন্মান নষ্ট হয় । ফুল আনলে , রাত জেগে ছবি দেখলে তোমাদের হাসির খোরাক হতে হয় আমাদের। যে তামাসার ভয়ে বিয়ের পর পর আমি কিছুই করতে পারতাম না সেই তামাসা আমার ছেলে মেয়েরা এখন আমাকে নিয়ে করে !!! জীবনের সবটুকু শেষ করে এখনো যদি অন্যর পছন্দ মতো চলতে হয় তাহলে কি পেলাম এই জীবনে ? তাই ঠিক করলাম আমরা আমাদের মতো থাকবো।
তোমাদের ইচ্ছা হলে আমাদের গিয়ে দেখে আসবে । যদি ইচ্ছা না হয় তাহলে যেতে হবে না । অন্তত জীবনের শেষ দিনগুলো নিজেদের মতো বাঁচতে চাই । তোমাদের উপর কোন রাগ থাকবেনা । আমি আর তোমাদের মা সবসময় চেয়েছি তোমরা ভালো থাকো এখনো চাই । ছেলে মেয়েদের ছেড়ে আসতে আমারও মন কেমন করছিলো । কিন্তু মানুষটার কথা ভেবে মনকে শক্ত করলাম।ঠিক বলেছে মানুষটা । ছেলে মেয়ের কথা চিন্তা করতে করতে মানুষটার চাওয়া পাওয়ার কথা ভুলেই গেছি ।নিজের কত অপূর্ণ স্বপ্ন থেকে গেলো জীবনে । এখন না হয় বাকিটা জীবন সবকিছু ভুলে দুজন শুধু দুজনের কথাই ভাববো ।