রাত বারোটা পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে চুপিচুপি বাসার দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ ধরে। একেতো শীতকাল, প্রচন্ড শীত তার উপর ছাদের কার্নিশ থেকে কুয়াশা জমে পানির ফোটা টপটপ করে গায়ের উপর পড়ছে আর লাফিয়ে উঠছি। মনে হচ্ছে বরফের টুকরো পড়ছে। আরো বিপদ হচ্ছে, দুপুরে বের হবার সময় শীতের কাপড় পরিনি রোদ ছিলো বলে। আর এখন শীতে দাতে দাত লেগে ঘোড়ার দৌড়ানোর শব্দের মতো “ঠক ঠক,ঠক ঠক” বেসুরা ধ্বনি হচ্ছে।
“আগামীকাল থেকে বাসায় ফিরতে আর দেরি হবে না, আল্লাহ তুমি আম্মাজানরে ঘুম থেকে সজাগ করিও না”,-প্রতিদিন রাতেই দরজায় দাঁড়িয়ে এ শপথ করি। কিন্তু বদের হাড্ডি বন্ধুগুলার জন্য একদিনও বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরতে পারিনা। অথচ দরজা আম্মাজানই খুলে রোজ রোজ। আর বকা,ঝাড়ি সেই লেভেলের খেতে হয় !!!
আজ আর দরজায় টোকা দিয়ে শব্দ করলাম না। দরজার টোকার আওয়াজের শব্দে আম্মাজান ঘুম থেকে উঠলেই আমি শেষ,রক্ষা নেই। বুদ্ধি খাটিয়ে ছোট বোন লিজাকে কল দিলাম।
সতেরো বার কল করার পর ফোনটা কেটে দিলো। মানে নিশ্চিন্ত হলাম ছোট বোন লিজার ষোলটা কল লেগেছে সজাগ হতে। আর সতেরো নাম্বার কলে ফোনের রিংটোনের শব্দে ঘুম থেকে উঠেছে, আমার নাম্বার দেখে কল কেটে দিয়ে দরজা খোলার জন্য ঘুম থেকে উঠে আসতেছে।
টানা পাচ মিনিট কনকনে শীতের মধ্যেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম, দরজা খোলার কোন নামগন্ধ নাই। এদিকে দু’হাটু একসাথে লেগে যাচ্ছে শীতে। অধৈর্য হয়ে আবার ফোন দিলাম, রিসিভ করার সাথে সাথেই ঝাড়ি দিলাম-
-ঐ জারিয়া(এই নামে ডাকলে রেগে যায়), দরজা খোলস না ক্যান?
সতেরো বার ফোন দিলাম তোরে, তারপর ফোন কাইটা দিয়া কোন খবর নাই! লাপাত্তা হয়ে গেছস নাকি? শীতে মরে গেলাম। বইন দরজা খোল তাত্তারী।
ওপাশ থেকে হুংকারের আওয়াজ শুনে টাসকি খেলাম।
–ঐ তুই ঝাড়ি দেস কারে রে? তোর বইন কেডায়? লিজা মাত্র মোবাইল দিয়া গেলো আমার মাথার পাশে। শোন, তুই বাইরেই থাক। ঘরে আইছ না আর। যা, তুই তোর বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে গিয়া ঘুমা,বাদারদের সাথে যাহ। টুট..টুট…টুট…
বুঝতে আর বাকী নেই, জারিয়াই আমাকে ইচ্ছা করে আম্মাজানের বকা খাওয়াইছে।
এক মাসে শীত যায় না, অসময় সবারই আসে। সেইদিন আমিও ঝাড়ি খাওয়াবো,ছাড়বোনা।
বাইরে দাড়িয়েই চুপচাপ ঝাড়ি হজম করছি। অথচ দরজাটা খুলছে না। না আর সহ্য হচ্ছে না। “ঐ ঝারিয়া দরজাডা কি খোলবি নাকি?”-বলে দরজায় টোকা দিলাম। দরজা টোকা দিতে গিয়ে বোকা হয়ে গেলাম, “একি,দরজা খোলাই আছে”। শুধু শুধু ঝাড়ি গুলো খেতে হলো, আগেই দরজা ধ্বাক্কা দিলে খুলে যেত। শীতের মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব কষ্ট করতে হতো না।
দরজা খুলে চুপচাপ আমার রুমে ঢুকছি, আর ঝারিয়া ম্যাডাম খিকখিক করে হাসছে।
কিছু বললাম না। রুমে ঢুকেই আস্তে করে দরজা লাগিয়ে খিল লাগিয়ে দিলাম।
টেবিলে তাকিয়ে দেখি “টেবিলের উপর খাবার ঢেকে রেখেছে”। আহা, কি শান্তি। সব রেডিমেট। এক নিমিষে খেয়ে ফেললাম। পানি খেতে যাবো, অথচ পানিই নাই।
দরজায় টোকা দিচ্ছে কে? এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললাম। পানি হাতে দাঁড়িয়ে আছে জারিয়া ম্যাডাম। হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এক ঢোকে পানি ঢেলে দিলাম গলায়। “উফ! কি ঠান্ডারে। হাত ধুয়ে খাবারের প্লেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “যা, আমি ঘুমাবো”।
লিজা বললো, “ভাইয়া,পানি নেই অথচ তুই হাতমুখ না ধুয়েই খেয়ে ফেললি?”
বললাম, “শীতেরদিনে এতো কষ্ট করতে নাই,খাওয়ার আগে শার্টে হাত মুছে নিছি। জ্বালাইস না, যাহ ভাগ।”
বলেই ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
কোন কথা নেই, রুমের লাইট অফ করে দিয়ে একদম কম্বলের নিচে চলে গেলাম। কম্বলটা মাথার উপরে টেনে নিয়ে বালিশের নিচে গুঁজে দিলাম।
একটু পর টের পেলাম মাথায় হালকা হালকা ঠান্ডা লাগছে। তবু পাত্তা দিলাম না। শীতকাল তাই হয়তো ঠান্ডায় জমে আছে,পরে আস্তে আস্তে গরম হয়ে যাবে।
কিন্তু বিপদ হচ্ছে আশপাশ থেকে বিশ্রি রকমের গন্ধ আসছে।
আসলে ব্যাপারটা কি? মাথায় ঠান্ডা লাগবে, মেনে নিলাম,কিন্তু এমন দুর্গন্ধ কেন? শুঁকতে শুঁকতে টের পেলাম বালিশ থেকে প্রস্রাবের বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ আসছে। আর বালিশটাও সেঁতসেঁতে হয়ে আছে। নিশ্চিত পিচ্চি ভাগিনাটা এই আকাম করেছে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
অন্ধকার রুমের মধ্যেই বালিশটাকে হাত দিয়ে ছুড়ে মাড়লাম একদিকে। ধাম করে আওয়াজ হলো। বুঝতে বাকী রইলনা দরজায় গিয়ে বালিশটা পড়েছে। দরজাটা কাঠের হলো শব্দটা কম হতো, ষ্টীলের দরজা লাগিয়েছে আব্বাজান। চিরস্থায়ী দরজা। যেন আর বদলাতে না হয়।
আওয়াজ শুনে আম্মাজান চিৎকার করে উঠলো- “ঐরে, কি শুরু করলি? ঘুমাইতে দিবিনা নাকি? রাইত বিরাইত টইটই করে ঘুরস আর ঘরে আইলে জ্বালাস। তোর পড়াশুনাও নাই। মাইনেষের বাড়িতে কামলা খাট নাইলে রিকশা চালা,তাও ভালা। টুট.টুট..টুট…
চুপ করে কতক্ষন ঘ্যানরঘ্যানর শুনলাম, বালিশটা কাছে থাকলে কানে চাপা দিয়ে রাখতে পারতাম। আস্তে আস্তে আম্মাজান ঘুমিয়ে পড়লো। আমিও অবচেতন মনে বালিশ ছাড়াই কখন ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই।
মাঝরাতে টের পেলাম পেটের নিচে কাতুকুতু লাগছে। লাফিয়ে উঠে দেখি মোবাইল। ভ্রাইব্রেশন করে রেখেছিলাম,আম্মাজানের ভয়ে, যেন রিংটোনের শব্দ না হয়।
ফোন হাতে নিয়ে দেখি সোনামণির নাম্বার। প্রায় এক বছরের ফ্রেন্ডশিপ আমার আর সোনামণির সাথে।
রিসিভ করলাম…বললোঃ
–কয়টা কল দিছি তোরে?
–জানিনা সোনামণি, খাড়া দেইখা লই ।
–ঐইত..ঐইত….ফোন কাটবিনা শালা। দাড়া…
ফোনটা কেটে দিলাম,কয়টা কল দিছে তা দেখার জন্য। তাকিয়ে দেখি সাতটা মিসডকল আসছে।
ফোন ব্যাক করে টাকা নষ্ট করার দরকার নেই। জানি, সোনা-ই ফোন দিবে। ফোনটা বালিশের কাছে রাখতে যাবো, আবার ফোন দিলো সোনামণি।
রিসিভ করলাম, বললোঃ
–তোরে কি আমি বলছি কল কেটে “কয়টা কল দিছি” দেখতে?
–তাইলে আমারে জিজ্ঞেস করছিস ক্যান, “কয়টা কল দিছি?”
–উফ! তুই একটা গাধা। আর আমারে সোনা, সোনামণি বলে ডাকতে না করছিনা। ডাকস ক্যান? এক বছর ধরে এক কথা বার বার বলতেছি।কানে ঢুকে না?
–ডাকবোই। তোর নাম স্বর্ণা, স্বর্ণা থেকে সোনা আর সোনা থেকে সোনামণি। হিসাব সহজ। আমারে শালা ডাকস ক্যান, তাই আমিও তোরে সোনা, সোনামণি ডাকবো।
–তোর নাম শ্যামল, শ্যামল থেকে শ্যামলা আর শ্যামলা থেকে শালা। হিসাব সহজ। তাই তুই-ও শালা।
–এ কেমন বিচার!!!
–এটাই সুবিচার। শোন, কয়টা বাজে? কোন খেয়াল খবর আছে তোর?
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো, এমনিতেই প্যারায় আছি ঘরে,তার মধ্যে মাঝ রাতে ফোন করে জিজ্ঞেস করে কয়টা বাজে? আক্কেলজ্ঞ্যান নেই নাকি? বললামঃ
–এতো রাইতে “কয়টা বাজে” জানার জন্য ফোন দিছোস? ঘুমাইতেও দিবি না?
–আরে বল না, কয়টা বাজে?
–দাড়া, দেখে নেই মোবাইলে।
–ঐইত…কল কাটলে তোর কপালে খারাপি আছে। এখন রাত আড়াইটা বাজে। কল কাটতে হবে না তোর।
–আড়াইটা বাজলে কি আর না বাজলে কি? ঘুমাতো।
–শালা আজ আমার জন্মদিন, উইশ করবি না?
–কস কি? হ্যাপ্পি ডাউনলোড ডে, শুভ হোক তোর পয়দা দিবস।
–এভাবে উইশ করে??? বাদ দে, গিফট দিবিনা?
–হ দিমু, আগামীকাল সবচেয়ে দামী গিফট দিমুনে।
–কি গিফট দিবি?
–তুই বলছিলিনা, আমার সব চাওয়া পূর্ন হলে তুই খুশি হবি? সেই খুশিটা উপহার দিমু তোরে।
–তাই, কি চাওয়া পূর্ন হবে শুনি? যেটা আমাকে উপহার দিবি।
–তোরে টুশির কথা বলেছিলাম না একদিন, ঐ যে ট্রয়শি নাম মেয়েটার। ইন্সট্রাগ্রামে পরিচিয় হয়েছিলো। আগামীকাল তাকে প্রপোজ করবো। কথাবার্তা ফাইনাল। তোকে দূরে দাড় করিয়ে ট্রিয়শিকে প্রপোজ করবো। এটাই আমার পক্ষ থেকে তোর জন্য উপহার।
খুশি হবি না?
–হুম, খুশি হবো। আচ্ছা ঘুমা তাইলে। রাখছি,বায়,গুড নাইট।
–ঐইত…ঐইত….
যাহ, কেটে দিলো। কখন কিভাবে প্রপোজ করবো কিছুই বলতে পারলাম না। টিপসও নিতে পারলাম না। কিভাবে প্রপোজ করলে টুশি খুশি হবে, হাতে কি নিয়ে তার সামনে দাঁড়ালে সারপ্রাইজড হবে? এগুলোও তো জানার দরকার…
অথচ কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিলো স্বর্ণা।
ফোন ব্যাক করলাম স্বর্ণার নামারে, কল ঢুকছেনা আর। নাম্বার অফ করে দিয়েছে হয়তো। বুঝলাম না, হঠাৎ কি হলো মেয়েটার।
তবে কি স্বর্ণা আমাকে….?
ধুর, কি ভাবছি আমি!!! ও তো আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড।
যাক সমস্যা নেই, আগামীকাল ট্রয়শিকে প্রপোজ করতে যাওয়ার সময় স্বর্ণাকে সাথে করে নিয়ে যাবো, টিপসগুলোও জেনে নিবো…
ফোন চার্জে লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম…
কখন কিভাবে প্রপোজ করবো কিছুই বলতে পারলাম না। টিপসও নিতে পারলাম না। কিভাবে প্রপোজ করলে টুশি খুশি হবে, হাতে কি নিয়ে তার সামনে দাঁড়ালে সারপ্রাইজড হবে? এগুলোও তো জানার দরকার…
অথচ কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিলো স্বর্ণা।
ফোন ব্যাক করলাম স্বর্ণার নামারে, কল ঢুকছেনা আর। নাম্বার অফ করে দিয়েছে হয়তো। বুঝলাম না, হঠাৎ কি হলো মেয়েটার।
তবে কি স্বর্ণা আমাকে….?
ধুর, কি ভাবছি আমি!!! ও তো আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড।
যাক সমস্যা নেই, আগামীকাল ট্রয়শিকে প্রপোজ করতে যাওয়ার সময় স্বর্ণাকে সাথে করে নিয়ে যাবো, টিপসগুলোও জেনে নিবো…
ফোন চার্জে লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
একঘুমে একদম দুপুর পেরিয়ে এলো। ঘুম থেকে উঠে আগে স্বর্ণাকে ফোন দিলাম, বললামঃ
–কিরে সোনামণি, রাতে হুট ফোন রেখেদিলি ক্যান?
–এমনিই রাখছি।
–আচ্ছা, শোন। রাতে বলেছিলাম না, তোকে জন্মদিনের উপহার দিবো? তোকে দূরে দাড় করিয়ে ট্রয়শিকে প্রপোজ করবো?
–হ্যা বলেছিলিতো,আচ্ছা যদি তোর প্রপোজাল একসেপ্ট না করে?
–আরে করবে করবে, আর না করলে তুই তো আছিসই। তোকে প্রপোজ করবো। তখন তুই একসেপ্ট করলেই হবে। হাহাহা।
–ফাইজলামী করিস নাতো, তা কখন যাবি প্রপোজ করতে?
–এখনই বের হচ্ছি। তুইও বের হো। তোকে ছাড়া ট্রিয়শিকে প্রপোজ করতে পারবো না। ভয় লাগে। তুই হচ্ছিস আমার সাহস। আমার ভরসা।
–সত্যিই আমি তোর সাহস? আমি তোর ভরসা?
–হ্যা, সত্যি।
–সত্যি হলে তুই ট্রয়শি মেয়েটাকে….
–ট্রয়শিকে কি?
–কিছু না বাদ দে। বাসা থেকে বের হয়ে ফোন দিস, রাখছি।
রাখছি বলেই স্বর্ণা ফোনটা রেখে দিলো। বুঝতেছিনা,গতকাল রাত থেকে স্বর্ণা এমনভাবে হুটহাট ফোন রেখে দেয় কেন? আগে ঘন্টারপর ঘন্টা বাচালের মতো কথা বলতো, কিন্তু গতকাল ট্রিয়শির কথা বলার পর থেকে এমন করছে। যাকগে, রেডি হয়ে আগে বাসা থেকে বের হই পরে দেখা যাবে…
হাতমুখ ধুয়ে ছোট বোন লিজার রুমে ঢুকলাম। এদিকওদিক তাকিয়ে খেয়াল করলাম লিজা নেই। চটপট ড্রেসিনটেবিল থেকে ফেইস পাউডার খুজে বের করলাম। আলতোভাবে সারা মুখে লাগিয়ে নিজের চেহারাটাকে ফর্সা বানিলে নিলাম। কারন হচ্ছে, স্বর্ণা রোজ রোজ আমাকে রাগায়, আর বলে “তার অমুক চাচাতো ভাই ফর্সা, অমুক মামাতো ভাই ফর্সা”। তাই ফেইস পাউডার মাখিয়ে আমিও ফর্সা হয়ে গেলাম। ট্রয়শিকে প্রপোজ করবো,তাই কোন অংশে নিজেকে কম রাখা যাবে না। সাজগুজে একদম অবহেলা করা যাবে না।
খুঁজাখুঁজি করে রোজ কালারের লিপজেলটা একটু ঠোঁটে লাগিয়ে ঠোঁটটা গোলাপি কালার করে নিলাম।
এদিকওদিক তাকিয়ে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।ড্রয়ার থেকে জেলের টিউওবটা বের করলাম। গত শনিবারে চুলের স্টাইলিং এর জন্য হার্ডজেল কিনেছিলাম। দুহাতে মাখিয়ে চুলে লাগিয়ে দিলাম তারপর চোকা করে মিশরের পিরামিডের মতো ব্যাকহাম স্টাইল করলাম চুলের। দেখি, কি করে আজ আমার প্রপোজাল ফিরিয়ে দেয় ট্রয়শি।
হ্যাংগার থেকে ফুলহাতা শার্ট টা গায়ে দিলাম। দুহাতের একদম কব্জি বরাবর শার্টের বোতাম লাগালাম আর গলার পাশে শার্টের একদম উপরের বোতাম লাগিয়ে ভদ্র, সুন্দর ভাবে ফরমাল সাজে পরিপাটি করলাম নিজেকে।
বাসা থেকে বেরিয়ে “কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বিশ্বরোড” যাওয়ার রিকশা নিলাম। দশ টাকার ভাড়া, খুব বেশি দূরে না।
রিকশাতে বসে স্বর্ণাকে ফোন দিয়ে জানালাম- “আমি বের হয়ে গেছি,টুইও বের হয়ে ক্যান্টনমেন্ট চলে আয়। তারপর ঐখানে পৌছে ট্রয়শিকে ফোন দিবো। চলে আয় এক্ষুনী”।
ক্যান্টনমেন্ট পৌছে রিকশা থেকে নেমে স্বর্ণাকে ফোন দিয়ে জানলাম, সে আসতে আর ১০/১৫ মিনিট লাগবে।
খেয়াল করলাম আশেপাশের লোকজন আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
ফেসপাউডার লাগিয়ে এসেছি, হয়তো স্মার্ট স্মার্ট দেখাচ্ছে। ব্যপার না, সুন্দর দেখলে অনেকেই তাকায়।
হুট করে প্রচন্ড প্রস্রাবের বেগ পেয়েছে। যখনই কোন ইম্পরট্যান্ট কাজে বের হই তখন হুটহাট জরুরীভাবে প্রকৃতির ডাক আসে। আজও তার ব্যতিক্রম না।
এদিকওদিক তাকিয়ে একটা দেয়ালের কর্নারে জায়গা পেলাম।
আরো সুবিধা হচ্ছে দেয়ালে লিখা আছে- “এখানে মুতিবেন,না মুতিলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা”।
যখন প্রচন্ড বেগের ছোট কাজটা করার কোন জায়গা পাচ্ছিলামনা ,তখন ছোট একটামাত্র বিরামচিহ্নের(কমা) ভুল ব্যবহারের কারনে সুবর্ণ সুযোগ পেলাম।
এখানে দাঁড়িয়ে প্রস্রাবের কাজটা সেরে ফেলা যাবে।
আস্তে করে এগিয়ে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কাজটা সেরে ফেললাম।
কাজ শেষ ঘুরে দাড়াতেই কেয়ারটেকার হাজির…
-ভাই এখানে তো প্রস্রাব করা নিষেধ।
–কোথায় নিষেধ লিখা আছে?
–দেখতে পাচ্ছেন না, এখানে লিখা আছে “এখানে মুতিবেন,না মুতিলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা”
–লিখা দেখেই তো কাজটা করলাম, লিখা আছে না মুতিলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দিবেন। দেন দেন, পঞ্চাশ টাকা দেন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
শুরু হয়ে গেলো তুমুলঝগড়া। পাশ দিয়ে স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা যাচ্ছিলো, মিটমাট করার জন্য দুটা ছেলেকে ডাক দিলাম।
অবশেষে বিচার হলো, কমার ভূল ব্যবহারের জন্য আমাকে সরি বলবে লোকটা।
আমি লোকটার কাধে হাত রেখে বললাম- সমস্যা নেই,সরি বলতে হবে না আর পঞ্চাশ টাকাও দেওয়া লাগবে না।
আস্তে আস্তে হেটে “ইংরেজ কবরস্থান” এসে বসলাম। স্বর্ণার অপেক্ষা করছি। খুব সুন্দর আর মনোরম পরিবেশ। মাথার উপরে বড় বড় গাছের ডালপালা ছড়িয়ে আছে।
স্বর্নাকে ফোন দিলাম-
–কই তুই?
–এইতো চলে এসেছি।
–তুই কই?
–আমি ইংরেজ কবরস্থানে বসে আছি,আয়।
হঠাৎ করে মাথায় উষ্ণতাযুক্ত কি যেন একটা অনুভব করছি। হালকা গরম গরম লাগছে। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি গাছের ডালায় কাক বসে আছে। বুঝতে বাকী নেই, কাক আমার মাথায় আকাম করেছে। জেল লাগিয়ে পিরামিড আকৃতির বেকহাম স্টাইল করেছিলাম, তাই হয়তো কাকেরও সহ্য হলো না। তাই আমার মাথায়ই মলত্যাগ করলো।
এখনই পরিষ্কার করা যাবে না, লেপ্টে যাবে। আগে শুকাক, তারপর টিস্যু দিয়ে হালকা করে মুছে ফেলবো।
সামনে তাকিয়ে দেখি স্বর্ণা আসছে। আমার দিকে কয়েকবার বিস্ময়যুক্ত দৃষ্টিতে তাকালো। কয়েকবার তাকিয়ে আস্তে আস্তে বেঞ্চে আমার একপাশে বসলো। আমিও কিছু বলছিনা। দেখি ও কি করে?
একটু পর সে তার ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। কাকে যেন ফোন দেওয়ার জন্য নাম্বার উঠিয়ে কানে ফোন লাগালো।
কি আশ্চর্য, আমার ফোনেই রিং বাজছে। আমার দিকে তাকিয়ে হুট করে লাফিয়ে উঠলো স্বর্ণা। বললো..
–তুই?
–হ্যা, আমি। আমার পাশে বসে আমাকেই ফোন দিচ্ছিস কেন?
–ঐ শালা, মুখে কি লাগিয়েছিস? চেনাই তো যায় না। আমার কি দোষ!!! মুখে এগুলো লাগিয়েছিস ক্যান?
–তুই-ই তো খালি আমার কাছে তোর চাচাতো মামাতো ভাইদের প্রশংসা করিস, বলিস তোর অমুক ভাই সুন্দর, অমুক ভাই স্মার্ট!!!
–হাহাহা, এই জন্য মুখে মেয়েদের ফেসপাউডার মাখবি? আবার দেখি ঠোটেও লিপজেল লাগিয়েছিস! আর চুলের এই অবস্থা কেন? কি ক্ষেত মার্কা স্টাইল করেছিস। মনে হচ্ছে এভারেস্ট পাহাড় মাথায় নিয়ে ঘুরছিস। দেখি, এদিকে আয়, চুল ঠিক করে দেই।
–ঐ, না না। চুল ধরা যাবে না। কাক আমার মাথায় দুই নম্বর কাজ করেছে। আগে শুকাতে হবে। তারপর…
–হাহাহা। আজ ট্রয়শিকে প্রপোজ করতে এসে তোর এই অবস্থা। এই নে পানির বোতল। মুখ ধো আর চুলও পরিষ্কার কর।
স্বর্ণার হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে মুখ ধোলাম, চুল পরিষ্কার করলাম।
স্বর্না জিজ্ঞেস করলো,
–“ট্রয়শি কখন আসবে”?
–ওর ঘন্টাখানেক দেরি হবে আসতে,অপেক্ষা কর।
–ওহ আচ্ছা।
–আচ্ছা শোন, কিভাবে প্রপোজ করবো স্বর্ণাকে? কিছু কিনে আনতে হবে? দাঁড়িয়ে প্রপোজ করবো না বসে প্রপোজ করবো।
স্বর্না নিচের দিকে তাকিয়ে ফোন টিপাচ্ছে, অন্যমনস্ক হয়ে আছে। আমার কথা মনে হয় খেয়াল করলো না। আবার বললাম,
–কিরে, কি হয়ছে? তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম।
–হুম, শুনেছি। কোন রকম প্রপোজ করে দে। তুই খুব ভালো মানুষ। এমনিতেই একসেপ্ট করে ফেলবে।
ঘন্টা পেরিয়ে গেলো, অথচ ট্রয়শির আসার কোন খোজ খবর নেই। এদিকে একেরপর এক আমিই কথা বলে যাচ্ছি। স্বর্ণা শুধু টুকটাক উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে নিরব থাকছে। স্বর্নাকে বললাম-
–কিরে সোনা, আজ তুই কোন কথা বলছিস না কেন? কি হইছে তোর?
–কিছু হয়নি। কখন ট্রয়শি আসবে আর কখন প্রপোজ করবি? সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেছে।
–এখনি করবো, চল।
–এখনই করবি!!! আর কোথায় যাবো?
–ট্রয়শির কাছে যাবো। তারপর প্রপোজ করবো।
আমি স্বর্ণাকে নিয়ে রিকশা নিলাম। রিকশার ডানপাশে আমি বলসলাম আর বামপাশে স্বর্ণা। রিকশা চলছে… দুজই চুপচাপ। মাঝেমাঝে আমি স্বর্ণার দিকে তাকালেও স্বর্ণা আমার দিকে মোটেও তাকাচ্ছেনা। আমি বুঝে গেছি।
“আর যাই হোক, মেয়েরা তাদের বেষ্ট ফ্রেন্ডের অধিকারও অন্যকাউকে দিতে পারেনা।” দুটি বিপরীত লিংগ কখনই ফ্রেন্ড হয়ে থাকতে পারে না, একসময় না একসময় প্রেমে পড়বেই।”
স্বর্ণারও তাই হয়েছে, যখন শুনেছি ট্রয়শি নামের এক মেয়েকে জীবনসংগীনী করার জন্য আমি প্রপোজ করবো। ঠিক তখন থেকেই সে অন্যমনা হয়ে গেছে। মানতে পারছেনা “তার ফ্রেন্ড অন্যমেয়ের হয়ে যাবে”।
ফ্রেন্ডশিপের পর থেকে স্বর্ণাকে কখনোই তার নাম ধরে ডাকিনি। সোনা ডেকেছি,নয়তো সোনামণি। আজ মেয়েটাকে স্বর্ণা বলে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে… হুট করে ডেকে বললাম:
–স্বর্ণা…
আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। এই প্রথম তাকে তার নাম ধরে ডাকলাম। বললো…
–কি?
–লাভ ইউ… জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোকে চাই। থাকবি?
আমার দিক দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। খেয়াল করলাম তার চোখ থেকে টপ করে পানি ঝরে পড়লো। লোকানোর চেষ্টা করছে…
বললাম, কাঁদছিস ক্যান পাগলী? এই নে, তোর টিস্যু তোকেই দিলাম। চোখ মুছে ফেল।
চোখ মুছে আমাকে বললো,
–ওই তোর ট্রয়শি কই? প্রপোজ করবিনা?
–আরে ধুর,ট্রয়শি ময়শি কেউ নাই। মিথ্যে বলেছিলাম। তুই ছাড়া আমার কে আছে বল?
–মিথ্যুক, ফাজিল,শয়তান ছ্যামড়া। নাম, এক্ষুনী নাম রিকশা থেকে নাম বলছি।
এই মামা,রিকশা থামান তো। স্বর্না অনেকটা জোর করে নামিয়ে দিলো আমাকে, তারপর সেও নামলো। বললোঃ
–তুই উঠে বামপাশে বস, আমি ডানপাশে বসলে তোর কাধে মাথা রাখতে পারবো। এটাও বুঝিস না?
রিকশা চলছে…
আমার কাধে তার মাথা লেপ্টে রেখেছে স্বর্ণা। ফোন থেকে একটা গান ছাড়লাম। ইয়ারফোন একটা আমার কানে আর একটা স্বর্ণার কানে গুঁজে দিয়ে প্লে বাটনে চাপ দিলাম।
গান চলছে…
আমি ভোরের শিশির হয়ে, যদি কোনদিন মুছে যাই।
আমি এই পৃথিবী ছেড়ে, যদি কোনদিন হারিয়ে যাই।
তুমি কি আমার জন্যে কেঁদে কেঁদে, চলে যাবে অন্য কোথাও?
তারপর পুশ বাটনে চেপে গানটা আটকে রাখলাম। স্বর্ণা আমার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিলো। কেড়ে নিয়ে আবার প্লে বাটনে চাপ দিয়ে আমার চোখে চোখ রাখলো।
সেখান থেকে গান চলছে,যেখানে আটকে রেখেছিলাম…
কি করে ভাবলে তুমি,যাবে আগে আমায় ছেড়ে।
ব্যথাভরা শুন্যতায় আমি ভাসি অথৈ জলে, নিকোষ আধারে।
আমিও তোমার জন্যে কেঁদে কেঁদে, চলে যাবো দূরে
তোমার কাছে….
………………………………………………(গল্পের সমাপ্তি)…………………………………………