বউ আমার খুব লাজুক পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাঁর লজ্জায় ভরা। তাই আমি ওর নাম দিয়েছি লজ্জাবতী লতা। লজ্জায় সে আমার সামনে আসতে পারে না। শ্বশুর বাড়ি যখন যাই একা কখনো রুমে আসেনা শুধু রাতের বেলা ছাড়া। সব সময় সাথে করে একমাত্র ছোট শালী লোপাকে নিয়ে আসবে। আমার মত এত বিশাল বড় কপাল কার আছে বলেন বউয়ের সাথে শালী ফ্রি। আমার পাশে বসতে বউয়ের লজ্জা, হাত ধরতে লজ্জা, আমার সাথে কথা বলতেও তার লজ্জা, আমার সাথে ঘুরতে যেতে লজ্জা । তাঁর এত লজ্জা আমার সামনে যখন আসে এক হাত ঘোমটা দিয়ে।
প্রতিটা পুরুষ চায় তার বউ হাসি মুখে কথা বলবে, গল্প করবে, খাওয়ার সময় প্লেটে খাবার বেরে দেবে, পাশে বসে বাতাস করবে মাঝে মাঝে শাড়ীর আঁচল দিয়ে কপাল মুছে দেবে। আমার বউয়ের বদলে আমার শালী লোপাই এই কাজগুলো করে আর লাবনী পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে এক হাত মাথায় ঘোমটা দিয়ে। বাহিরে ঘুরতে গেলেও লোপাকে সাথে করে নিয়ে যেতে হবে না হলে লাবনী বাহিরে যাবেনা। অনিচ্ছা শর্তেও শালীকে সাথে নিয়ে যেতে হয়। বউ,শালী দুজনেই খুব রুপবতী কিন্তু লোপার চোখে আছে অন্য রকম এক অদ্ভুত মায়া যা যেকোন মানুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে। এই আকৃষ্ট থেকেই প্রেমে পরে যাবে।। লাবনী খুব চুপচাপ আর লোপা খুব চঞ্চল।
লাবনীর সাথে হঠাৎ করেই পারিবারিক ভাবে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেছে। ও আমার দাদার বন্ধুর নাতনী। দাদা জানের এক কথা বিয়ে করলে এই মেয়েকেই করতে হবে । কি আর করা না বলতে পারিনি। তাই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম। তিন কবুল বলে প্রবীত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। লাবনী ওর বাবার বাসাতেই আছে এখনো তুলে আনা হয়নি আর তিন মাস পর ওর মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হলেই বড় অনুষ্ঠান করে তুলে আনবো। পুরুষ মানুষ বউ রেখে কি আর বেশিদিন দূরে থাকা যায়। আমিও তাই দুইদিন পর পর শ্বশুর বাড়ি চলে আসি। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় লাবনীর উপর মনে মনে ভাবি আর আসবো না কিন্তু বেহায়া মন মানতে চায়না। বউকে দেখার জন্য খালি মনের মধ্যে আকুম বাকুম করে তাই তো সব অভিমাণ ভুলে শ্বশুর বাড়ি চলে আসি।
কাউকে কিছু না বলে শ্বশুর বাড়ি চলে এলাম। আমি অবাক আজ লাবনীকে খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে চেহারায় কোন লাজুকতা নেই। লোপাকে ছাড়া একাই সব কিছু করেছে। বিকালে আমি আর লাবনী বাহিরে ঘুরতে বেরিয়েছি কিন্তু কেন জানি আজ খুব অস্থির লাগছে। কি যেন নেই। সব কিছু কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । খুশি হবার বদলে বুকের বা পাশে প্রচন্ড ব্যাথা লাগছে। তাই তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এলাম। একদিন পরে,,,, রাতে ডিনারের সময় লোপার দেখা পেলাম নিমিষেই মন ভালো হয়ে গেলো।
লাবনী পাশে ঘুমিয়ে আছে তবুও আমার দুচোখে কোন ঘুম নেই। আমি উপলব্ধি করতে পারছি যে আমি লোপাকে ভালোবেসে ফেলেছি।তাই তো এতদিন লোপাকে একনজর দেখার জন্য, লোপার কাছে আসার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে যেত। তাইতো পাগলের মত ছুটে চলে আসতাম। বউয়ের কাছে আসাটা তো শুধু বাহানা মাত্র। আসল উদ্দেশ্য তো লোপা। যেটা আজ পুরোপুরি বুঝতে পারছি। সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি কি আর করব কিছুই মাথায় কাজ করছে না। নিজের চুলগুলো সব টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। অফিসে জরুরী কাজের কথা বলে শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এলাম।
এখন আমি কি করবো আচ্ছা লোপা কি আমাকে ভালোবাসে??? ওইদিন কেনো ও আমার সাথে একটা কথাও বলেনি এমনকি ডিনারের সময় আমার দিকে তাকায়ওনি। চুপচাপ খেয়ে চলে গেছে। যে কিনা চিল্লাপাল্লা করে দুষ্টুমি করে বাড়িটা মাতিয়ে রাখতো। তাহলে কি লোপাও আমাকে ???? লোপার কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দূর থেকে লোপাকে দেখে বুকের ভিতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ওর মুখটা কেমন জানি শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি পরেছে। লোপার হাত ধরে টেনে গাড়ীতে উঠালাম।
দুজনে মুখোমুখি দাড়িঁয়ে আছি। বিয়ের পরে ওরা দু’বোনকে এখানেই প্রথম ঘুরতে নিয়ে এসেছিলাম। কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা, যদি ফিরিয়ে দেয় খুব ভয় হচ্ছে। । সব ভয় ভীতি ভেঙ্গে বলেই ফেল্লাম লোপা আমি তোমাকে ভালবাসি। ও মাথা নিচু করে দাড়িঁয়ে আছে। আমি কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোপা আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিয়েছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা। আমি যেমন মনে প্রাণে ওকে চাই ঠিক সে ভাবে ও আমাকে চায়।
উকিলের সাথে কথা বলে সবকিছু রেডি করে ফেলেছি। ডিভোর্স পেপারটা সাইন করে আজেই পাঠিয়ে দেবো লাবনীর কাছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি লোপাকে নিয়ে পালিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। যেই ভাবা সেই কাজ লোপাকে নিয়ে চলে আসলাম ঢাকাতে। জানি প্রথম কিছু দিন বাবা মা আমাদেরকে মেনে নেবে না। সন্তানের মায়ায় বেশি দিন দূরে থাকতে পারবে না আজ হোক কাল হোক মেনে নেবেই। কিন্তু লোপার বাবা -মার বিষয় অনিশ্চিত।
দেখতে দেখতে দুইটা বছর কেটে গেছে। অনেক সুখে আছি আমরা। আমার পরিবার লোপাকে মেনে নিয়েছে বিয়ের তিন মাস পরেই। দুই বছর পরে লোপাদের বাড়ি যাচ্ছি। লোপার বাবা অসুস্থ, লোপাকে দেখতে চায়। শুনেছি লাবনী এখনো বিয়ে করেনি ওদের এলাকার কলেজে লেকচারাল হিসাবে জয়েন্ট করেছে। মনের মধ্যে সংশয় কাজ করছে লাবনীর সামনে কিভাবে দাঁড়াবো..?? গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে কারো কান্নার আওয়াজ।
দু’বছর আগে দরজার ওপাশের রুমটাতে লাবনীর সাথে আমার বাসর রাত হয়েছিলো। আজও আমার শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা ফুল দিয়ে আমাদের জন্য বাসর ঘর সাজিয়েছেন। শুধুমাত্র রুমটা আলাদা। লোপা আর লাবনীর রুমটা পাশাপাশি। আচ্ছা আমি কি লাবনীর সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। এগুলো কি ভাবছি আমি..?? আমি যা করেছি ঠিকি করেছি লাবনীর মত আনসোশ্যাল মেয়ের সাথে সংসার করা যায় না। লোপাই আমার জন্য পারফেক্ট। ঘুমন্ত অবস্থায় আমার লোপাকে অপ্সরীর মত লাগে। আর এ মুখ দেখে হাজার বছর কাটাতে পারবো।
লোপাদের বাড়িতে এক সপ্তাহ ছিলাম। এই সাতদিনে লাবনীর সাথে একবারো দেখা হয়নি। আমার শ্বাশুরির সাথে দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু উনি আমার সাথে কোন কথা বলেননি হয়তো এখনো রেগে আছেন। সাতদিন ঘুরে বেরিয়ে, ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। লোপা তার পছন্দের সব জায়গায় নিয়ে গিয়েছে।
সকালের ট্রেনে ঢাকা চলে যাবো। রেডি হয়ে নাস্তা শেষ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তারপর রওনা দিলাম নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কাল থেকে শুরু হবে আবার ব্যস্ত জীবন । লোপাদের বাসার গেইটের সামনে আসার পরে মনে হল কেউ এক পলক দেখার জন্য পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে ফিরে তাকালাম দেখলাম লাবনী ওর রুমের সামনে বারান্দায় এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজের অজান্তে চোখের কোণে জল এসে গেছে। আমি আর দেরি না করে দ্রুত ওখান থেকে চলে এলাম।
আজ আমাদের বিয়ের তেরোতম বিবাহ বার্ষিকী দেখতে দেখতে কিভাবে একযুগ কেটে গেলো। সামনে কেক নিয়ে বসে আছি। পুরো রুম অন্ধকার শুধু চারটা মোমবাতি জ্বালানো। কেকটা একাই কাটতে হবে লোপা এখনো বাসায় ফেরেনি। ইদানীং ও অনেক ব্যস্ত। অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। হয়তো এই বিশেষ দিনটার কথা ভুলে গেছে। লোপা আর আগের মত নেই অনেক বদলে গেছে। বিয়ের প্রথম চার বছর আমরা খুব সুখেই ছিলাম। পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ ছিলাম আমরা দু’জন। যেদিন শুনতে পেলাম লাবনী প্রেগন্যান্ট ওই দিন থেকে আমার সুখের ঘরে আস্তে আস্তে করে আগুন লাগতে শুরু করলো।
লোপাও মা হতে চায় বেবি নেবার জন্য সেও উঠে পরে লেগেছে। জন্মমৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছাতে হয়। আল্লাহ যদি না দেয় কারো ক্ষমতা আছে বাচ্চা দেবার। কত চেষ্টা করলাম,, ডাক্তার দেখাল, বিদেশেও ট্রিটমেন্ট করালাম কোন কিছুই হলো না বাচ্চার মুখ আর দেখতে পারলাম না। আমার আর লোপার কারো কোন সমস্যা নেই দু’জনে সন্তান জন্মদিতে সক্ষম। তার পরেও আমাদের কোলজুড়ে কোন সন্তান আসেনি।
বাচ্চা বাচ্চা করে প্রথম প্রথম কথা কাটাকাটি,মন মালিন্য হত, এর পর ঝগড়া ঝাটি । প্রতিদিনি ঝগড়া লাগত এমনও হত সহ্য না করতে পেরে গায়ে হাত তুলে ফেলতাম। চার/ পাঁচ দিনেও কেউ কারো সাথে কথা বলতাম না। এখন মাসেও একদিন লোপার সাথে কথা হয় না। একি ছাদের নিচে থাকি ঠিকি কিন্তু আলাদা আলাদা রুমে। আমরা এখন নামে মাত্র স্বামী -স্ত্রী। গত তিন বছর ধরে আলাদা থাকি।
লাবনীর সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি আমি। এইজন্য আল্লাহ তালাহ তার শাস্তি আমাকে প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে। লাবনী স্বামী সংসার নিয়ে অনেক সুখে আছে। দুইটা ছেলে আছে ওদের ঘরে । নিজে এখন প্রতিষ্ঠিত। কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে আছে। আমি ডিভোর্স দেবার তিন বছর পরে নিজের পছন্দ মত ডাক্তার ছেলেকে বিয়ে করেছে। শুনেছি ওর স্বামী খুব ভালো মানুষ লাবনীকে অনেক ভালবাসে।
অনুসূচনায় শেষ হয়ে যাচ্ছি আজ। যদি লবনীকে ডিভোর্স না দিতাম..? যদি ওর সাথে সংসার থাকতো..? তাহলে হয়তো আমিও সুখে থাকতাম। আমিও সন্তানের বাবা হতাম, বাবা ডাক শুনতে পেতাম। ভুল করেছি অনেক বড় ভুল। আমি লাবনীর মত মানুষকে বিশ্বাস করে ভুল করেছি। লোপাকে বুঝানোর জন্য,সংসারের ঝামেলা ঠিক করার জন্য বন্ধু রাশেদকে বাসায় থাকতে দিয়েছিলাম।
এখন দেখি বন্ধু আমার লোপাকে বুঝাতে বুঝাতে নিজের করে নিয়েছে। আমাকে কিক মেরে দূরে ফেলে দিয়েছে। রাশেদ আর লোপা এক বছর ধরে রিলেশনে আছে। ছুটির দিন বাসায় থাকে না রাশেদের সাথে লং ড্রাইভে চলে যায়। প্রায় সময় রাত করে বাসায় ফেরে। লোপাকে পড়াশুনা করিয়ে বিসিএস ক্যাডার বানিয়েছি। আর এখন সে বলে আমি নাকি আনসোশ্যাল ওর যোগ্য না এই কথা শোনার জন্যই তো লোক ধরে ঘুষ দিয়ে তোমারে ক্যাডার বানিয়েছি। সবি আমার কপাল। আমিও সব নিরবে মেনে নিয়েছি। সমাজের মানুষের কথার ভয়ে, সম্মান বাঁচানোর জন্য।
লোপা আমার কাছ থেকে মুক্তি চায়। খুব তাড়াতাড়ি রাশেদকে বিয়ে করবে। আমাকে উকিলের সাথে কথা বলে কাগজপত্র ঠিক করতে বলেছে। আমিও এখন গভীর রাতে দরজার ওপাশে লোপা আর রাশেদের হাসি ঠাট্টার আওয়াজ পাই। শুনতে পাই ওদের ভালোবাসার খুনসুটি কিন্তু লোপা তুমি তো শুনতে পাওনা দরজার এপাশের নিঃশব্দের কান্নার আওয়াজ।