জীবন সঙ্গী

জীবন সঙ্গী

এতিম মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে ঘর থেকে বের করে দিলো আমায়। অরুকে নিয়ে বাসায় যাওয়ায় মা-বাবা আমাকে ছেলে বলতে অস্বীকার করলো। এতিম না হয়ে কোন টাকাওয়ালার মেয়েকে বিয়ে করলে মেনে নিতো । চোঁখের পানি ছেড়ে অরুর হাতটা শক্ত করে ধরে বের হয়ে চলে আসি। তখন অরু আমাকে বললো সে চলে যাবে তাও যেনো আমি আমার মা-বারার কাছে থাকি। একজন সন্তানের মা-বাবা না থাকলে কষ্ট হয় কতটা সেটা অরু জানে তাই তখন এ কথা বলে। অরুকে বিয়ে করাটাও ছিলো সূর্যের আলোয় ভরা দুপুরে বৃষ্টি আসার মতোই।

আমি তখন ভার্সিটির অনার্স ৪র্থ বর্ষের ফাইনাল দেওয়ার কিছুদিন আগের সময়। আমি একদিন মন খারাপ করে বিকালে রাস্তার পাশ দিয়ে হাটঁছি। বাসা থেকে প্রায় ২কি.মি দূরে। হাটঁতে একটা বাসস্টপের কাছাকাছি। যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে একজন রমনী। একবারেই পরিবেশের বিপরীত যা এই ব্যাস্ত শহরে কমই দেখা যায়। মেয়েটা পুরো শরীর ঢাকা কালো বোরকায়। হাত পায়ে গুলোও মৌজা দিয়ে ঢাকা। চোঁখ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। আমি আগ্রহ নিয়ে কাছে গেলাম। আমি জানি পর্দা করা এই শহরের মানুষ করে না। সবই নিজেদের যতই মুসলিম বলে।
আমি কথা বলার জন্য মেয়েটার পাশে দাঁড়ালাম। আমি নাম জানতে চাইলে বলে “হে যুবক তোমরা নিজেরদের চোঁখ সংযত করো।” এটা আল্লাহর কথা। আর কিছু না বলে বাস আসতেই উঠে গেলো। আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। কোন কিছু না ভেবেই সেই বাসে উঠে বসলাম। মেয়েটার পাশে গিয়ে বসলাম। আমি আর কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম। মনে মনে ভাবছি তখন কোথায় যায় কি করে সব দেখবো।

বাস ১৫মিনিট পরেই পরের বাসস্টপে থামলে মেয়েটা নেমে যায়। আমিও তখন নেমে গেলাম। মেয়েটা হাটঁতে একটা এতিমখানায় গেলো। আমিও পিছে পিছে গিয়ে দাঁড়ালাম এতিমখানার গেইটের কাছে। দেখলাম এতিমখানার গেইটে লেখা… “আয়েশা (রঃ) মহিলা হাফেজী মাদ্রাসা” বুঝতে বাকি নাই মেয়েটা হাফেজ বা হাফেজী পড়ে।

কিছুক্ষণ পর একটা ৫বছরের মেয়ে গেইট দিয়ে বের হলো। আমি ডাক দিয়ে মেয়েটাকে কাছে আনলাম। বলি একটু আগে যে গেলো ভিতরে মহিলাটা কে? মেয়েটা বলে তখন ওই মহিলাটা মাদ্রাসার শিক্ষক তাদের পড়ায়।

আমি যা ভাবলাম যে গেলো ভিতরে সে হাফেজ তা হলো। আমি মাদ্রাসার গেইটের কাছাকাছি যে চায়ের টং দোকান আছে সেটায় গিয়ে বসলাম। চা দিতে বলে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি মায়ের কল কয়েকটা দিছে। মা’কে কল দিয়ে আসতে দেরি হবে বলে রেখে দিলাম। চায়ের কাপটা নিয়ে চা খেতে লাগলাম। তখন চায়ের দোকানদার বলে… মামা আপনাকে এদিকে নতুন দেখতেছি। আমি বললাম এমনি। তারপর অনেকক্ষণ কথায় বুঝলাম দোকানদার একটু ভালো মানুষ।

আমি বলি তখন মাদ্রাসার মহিলা শিক্ষককে জানে কিনা? সে বলে দুজন আছে শিক্ষক একজন থাকে যে সবসময় মাদ্রাসায় আরেকজন বিকালে পড়ায় এসে। আমি বলি যে বিকালে পড়ায় তার কথা। দোকানদার বলে ছোটবেলায় মেয়েটাকে দেখছি আমার এই টং দোকানে অনেক সময় খেতো। এখন বড় হয়ে হাফেজী পড়া শেষ করে এখানে চাকুরী করে। নাম তার সুরাইয়া আক্তার অরু। সবাই অরু বলেই চিনে। আর এতিমখানায় ছোট বেলা থেকেই থাকতো। তার কেউ নাই দুনিয়ায়। দোকানদার আমার দিকে আরো ভালো করে তখন তাকিয়ে বলে….আপনিতো মনে হয় কোন ভালো পরিবারের। আপনি? আমি তখন কিছু না বলেই চায়ের দাম দিয়ে চলে আসি। দোকান থেকে বের হয়ে বাসায় এসে বাইক নিয়ে আবার চলে গেলাম মাদ্রাসার সামনে।

অরু সন্ধ্যা পরই বাসার দিকে যাচ্ছে। আমিও তখন পিছে পিছে গেলাম। অরু বাস থেকে নেমে চলে গেলো বাসায়। অরুর বাসা বস্তিতে। আমি সেখানেও তখন তার সম্পর্কে জানতে চাইলাম। সবাই অরুর গুনের কথা বলে শেষ করতে পারে না। কয়েকদিন অরুর পিছনে পিছনে ঘুরছি। তাকে যদিও চেহারা দেখিনি। তবুও তাকে সব কিছুতেই অনুভব করতাম। একদিন মাদ্রাসা পড়িয়ে আসার সময় তার পথ আটকে ধরি।

_ আমি কিছু কথা বলতে চাই। অনুমতি যদি দেন!
_ পর পুরুষের সাথে কথা বলা গুনাহের কাজ। তাও আপনি প্রতিদিন এভাবে পিছনে যাওয়া আসা করেন। কিছু বলতে চাইলে আজকে বলেন তাড়াতাড়ি।

_ আমি আপনাকে ভালবাসি তারমানে ভাববেন না যে খারাপ কিছু। আমি বিয়ে করতে চাই আপনাকে।আমি আপনার মতো হাফেজ না তবে নামাজ পড়ি, ইবাদাত করি। কখনো কোন নারীর সাথে প্রেম ভালোবাসা করি নাই। অন্য কোন কিছু বলতে বা জানতে চাই না।

___আমি আপনার নামও জানি না।আমাকে কখনো দেখেননি তারপরও….

__ বিয়ে করবেন আমায়? নাম না হয় বিয়ের পর জেনে নিয়েন। আমি অনার্স পাশ করে ফেলবো কিছুদিন পর। বাড়ি গাড়ি সবই আছে। কোনটায় কম রাখবো দিতে।

___আমাকে না দেখে….
__ বিয়ে করে দেখবো।

আমি সেইদিন বুঝতে পারি অরুও রাজি বিয়েতে। পরেরদিন আমার বাইক ল্যাপটপ বিক্রি করে দিয়েছিলাম ৩লাখের মত।টাকা নিয়ে অরুর বাসায় গিয়ে অরুকে বললাম তাকে আজই বিয়ে করবো। অরু তার ম্যাডামের সাথে কথা বলছে যাদের কাছে বড় হলো। আমার পরিবার ছাড়া বিয়ে করবো তাও বলে ম্যাডামকে। ম্যাডাম কি বলে শুনিমি। ওই মহিলাই সকালে মাদ্রাসায় পড়ায় অরু বিকালে। আমি আর অরু বাসে করে চলে যাই মাদ্রাসায়। সেখানে ম্যাডাম ও সেই দোকানদার তাকেও নিয়ে চলে আসলাম কাজি অফিসে। আমার দুজন বন্ধুকে আগে থেকেই বলি রাখছি। তাদের বলেছিলো আমরা ভালবেসে পালিয়ে বিয়ে করতেছি। অরু কাবিনের টাকা ৫০হাজার টাকা দিলো। আমার বন্ধুও কাজী নিজেই অবাক এত কম টাকায় বিয়ে। আমি অরুকে বলেছি এত কম টাকায় কেন সে বললো ভালবাসা থাকলে এক টাকাও সংসার থাকে আর ভালবাসা না থাকলে এক কোটিতেও সংসার থাকবে না। সব কিছুই আল্লাহর হাতে।

অরুকে বিয়ে করে কাজীর সামনেই কাবিনের টাকা বুঝিয়ে দিলাম। সবাই এবার আমার কাজ দেখে অবাক। অরুও হাসি খুশীতে টাকাটা নিয়ে ম্যাডামকে দিয়ে দেয়। যখন অরু ম্যাডামকে বলে আমাদের এতিমখানায় টাকা দিয়ে দিয়েন এ গুলো। তখন আমার বন্ধুরা শুনে অবাক হয়ে আমাকে বলে এতিমখানা মানে? আমি বলি অরুর এই দুনিয়ায় কেউ নাই। বন্ধুরা আমার কাজ দেখে নাক-ছিটকায়। আমি অরুকে নিয়ে বাসায় গেলে। বাবা-মা অরুর বংশ জানতে চায়। তখন অরু এতিম শুনে বের করে দেয় ঘর থেকে। বন্ধুরাও এতিম বলে কাজী অফিস থেকে নাক ছিটকিয়ে চলে যায়, আমার মতো তারা নাকি। গরিবের সাথে সম্পর্ক রাখবে। তাদের কথা টাকাওয়ালা মডেলিং মেয়ে হলে হবে।

আমি আর অরু সেইদিন চোঁখের পানি ছেড়ে বাসা ছেড়ে চলে যাই অরুর বাসায় সেই বস্তিতে। বাসর রাতেই অরুকে প্রথম দেখলাম। যাকে বিয়ে করা, বাড়ি ছাড়া তাকে বাসর রাতের আগে দেখি নাই। অরুকে যতটা সুন্দর হবে ভাবছি তার থেকে হাজার গুন সুন্দর। যেনো একটা পরী। বাসর রাতের পরেরদিন,,

_ অরু আমি তোমাকে তো বিলাস বহুল বাড়ি গাড়িতে রাখতে পারলাম না।

অরু আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,,,,, আল্লাহ আমাদের দু-মুঠো ভাত খাওয়ালে হবে। আর আল্লাহর পথে চলতে পারলেই হবে। মনে রাখবেন আল্লাহ চাইলে সব কিছু হতে সময় লাগে না। শুধু দরকার আল্লাহর উপর ভরসা আর হালাল খাওয়ার ইচ্ছে।

আমি সেই দিনের অরুর কথাটা আজও ভুলি না। যে আড়াই লাখ টাকা ছিলো তা দিয়ে একটা ছোট মুদি দোকান দেই। হালাল খাওয়া আর সৎ সাহস নিয়ে চললো জীবন। অরুর মাদ্রাসায় পড়ানো বন্ধ করে দেয় বিয়ের পর। সারাক্ষণ বাসায় নামাজ,রোজা আর ইবাদাতে কাটাতো।আমিও সবসময় নামাজ পড়ি আল্লাহর হুকুম মতো সব করি।
বিয়ের ২ বছর পরই একটা ছেলে হয়। তার ২ বছর পর ২য় একটা মেয়ে হয়।

১০ বছরে আল্লাহর রহমতে আমার ব্যাবসা অনেক বড় হয়ে যায়। দুটা দোকান দেই বড় মার্কেটে। যাতে লোকদিয়ে কাজ করাই। আরেকটা চাউলের মিল খুলী। একটা বাড়ি করে আমরা নিজেরা থাকি আবার ভাড়াও দেই কয়েকটা রুম। আমার এই সাফল্যের পিছনে অরুর হাত। সে সবসময় পাশে থেকে সাহস দিতো। আল্লাহর কাছে দোয়া করতো। তাইতো আজ ঘর ছাড়া ছেলেটার ঘরে যেনো স্বর্গের সুখ বিদ্যমান। আর কোটিপতি।

১০বছর পর আজকেই মা-বাবাকে আনতে যাচ্ছি আমার বাড়িতে। ছোট ভাইটাকে বিয়ে করানো পর নাকি তার বড় লোকের বেডি মা -বাবাকে কখনো ভালো ব্যবহার করে না, অসুস্থ এখন সেবাও করে না। আর সেই আমার দু বন্ধু তাদের নায়িকা মার্কা বউ একজন ডিভোর্স দিয়েছে আরেকজনের নাকি পরকীয়া করে পালিয়েছে।

গাড়ি করে অরু, বাচ্চাদের নিয়ে চলে আসলাম বাবা মার কাছে। তাদেরকে নিয়ে চলে আসি বাসায়। জানি অরু কখনো সেবায় কমতি রাখবে না। একজন নেককার এমন স্ত্রী পেয়ে আমি জীবনের সবচেয়ে দামী জিনিস পেলাম। একজন আদর্শ স্ত্রী পেলাম। যার কারনে আমার কুঁড়ে ঘরেও আনন্দের সীমা ছিলো না। সারাজীবনই থাকবে আল্লাহর কাছে চাই এমন ভালোবাসা, সুখ আমাদের জীবন।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত