দুষ্টু ভালোবাসা

দুষ্টু ভালোবাসা

এতো রাতে! তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?”
–“মাথা খারাপ হবে কেন? মাথা ঠিকঠাক আছে।”
–“রাত কয়টা বাজে বলো তো দেখি?”
–“তেমন কোন রাত হয়নি, কেবল দেড়টা বাজে।”
–“সকালে আসি? বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, দেখছো তো। বের হলে ভিজে যাবো তো।”
–“ভিজতে ভিজতেই আসবে, বাসার সামনে এসে দশমিনিট দাঁড়াবে, এরপর চলে যাবে।”
–“কেন বলো তো?

–“তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।”
–“ভিডিও কল দেই, তাহলেই তো দেখতে পাবে।”
–“না আমি তোমাকে সামনে থেকে দেখতে চাই। আসবে নাকি আসবে না তাই বলো?”
–“তুমি এতো রাতে বাসার বাইরে বের হবে কি করে?”
–“আমি বের হবো কেন? বারান্দা থেকে দেখবো।”
–“আসতেই হবে?”
–“না আসলে মনে করবো তুমি আমাকে ভালোই বাসো না।”

দিশার আবদার রক্ষার্থে বাসা থেকে বের হলাম। এমন একটা কথা সে বলেছে যে না গিয়ে আর উপায় নেই। ভালোবাসার প্রমাণ দিতে আমরা বাঙ্গালী ছেলেরা সর্বদা একধাপ এগিয়ে থাকি। গত সপ্তাহে আমার বন্ধু সয়ফল যা কাণ্ড করেছে! বেচারার সারাগায়ে চুলকানি রোগ হয়েছে। হৃদিতা ওর প্রেমিকা—গত সপ্তাহে হৃদিতা এক নর্দমার সামনে গিয়ে সয়ফলকে বলেছিল, “তুমি না আমাকে ভালোবাসো?” সয়ফল বলেছিল, “তোমার কোন সন্দেহ আছে?”

–“তাহলে এখানে একমুহূর্তে লাফ দাও।”

হৃদিতা বলার সাথেই সয়ফল নর্দমায় লাফ দিলো, কয়েক ঢোক নর্দমার পানিও সে খেয়ে নিয়েছে। কয়েকদিন পেটের পীড়ায় ভুগে বর্তমানে পেট ঠিকঠাক হলেও চুলকানির ব্যামো সারেনি। দিশাদের বাড়ির সামনে কোন নর্দমা বা ডোবা নেই এখানেই রক্ষা। বাসা থেকে বের হয়ে গলির সামনে যেতেই নাইটগার্ড আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “বাবা এতো রাতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কোথায় যাচ্ছেন?” আমি সাথে সাথে বললাম, “একটু হাসপাতালে যাবো। এতো রাতে হাসপাতালের ফার্মেসি ছাড়া তো আর কোন ফার্মেসি খোলা পাওয়া যাবে না।”

–“আচ্ছা সাবধানে যান।”

আমি হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তার বাতিগুলো সম্ভবত বৃষ্টির কারণে নেভানো। অন্ধকার রাস্তা, চারিদিকে সুনসান নিরবতা। হঠাৎ একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। সেই কুকুরের সাথে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে আরও কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো এবং ক্রমাগত করতেই থাকলো। আমি এক পা সামনের দিকে বাড়ালে এরাও একপা সামনে বাড়াচ্ছে। মহা ঝামেলায় পড়া গেল, কি করবো না করবো দিশা না পেয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। আমার পিছু পিছু কুকুরগুলোও দৌড়াতে শুরু করেছে।

আমি দৌড়াচ্ছি, কুকুরগুলোও দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে শেষপর্যন্ত এক জায়গায় এসে কুকুরগুলো থেমে গেলো, বুঝতে পারলাম—কুকুরগুলোর সীমানা শেষ। এরা আর এক পাও সামনে আসবে না। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম কিন্তু সামনের দিকে পা বাড়াতেই আবারও একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এক নাইটগার্ড ঘুমিয়ে আছে তার পোষাকুকুর আমাকে দেখে চেঁচাচ্ছে। আমি নাইটগার্ডকে ডাকলাম। বেশ কয়েকবার ডাকার পর তিনি উঠে কুকুরটাকে শান্ত করে বললেন, “এখন যান আর কিছু বলবে না।” আমি সামনের দিকে পা বাড়ালাম এবং সাথে সাথেই কুকুরটা ঘড়ঘড় শব্দ করে উঠলো, নাইটগার্ড বলল, “লালু চুপ।” নাইটগার্ডের নির্দেশে কুকুরটা চুপ হয়ে গেল। আমিও হাঁটতে থাকলাম।

দিশাদের বাড়িতে যাবার সময় মাঝপথে একটা গোরস্থান আছে—মাতুয়াইল গোরস্থান। গোরস্থানের কাছাকাছি এসে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। সামনে যেতে সাহস হচ্ছে না। রাস্তার বাতিগুলো এখনো জ্বলেনি। দিশাদের বাড়িতে যাবার আর কোন বিকল্প রাস্তাও নেই, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও লাভ হচ্ছে না, ভয় তীব্র থেকে তীব্র আকার ধারণ করছে। যা আছে কপালে ভেবে বুকে থুতু মেরে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম।

গোরস্থানটা বেশ বড়, চারপাশে কাঁটা তার দেয়া। এই অন্ধকারের মধ্যেও আমি ভেতরটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, সাদা কাফনের কাপড় পরিহিত গোরস্থানের বাসিন্দারা দলে দলে উঠে এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। আমি যতই চেষ্টা করছি গোরস্থানের দিকে না তাকাতে ততই আমার দৃষ্টি সেদিকে চলে যাচ্ছে। মনে প্রাণে চাইছি রাস্তায় একজন লোকের দেখা যেন পাই, কিন্তু পুরো রাস্তা জনমানবহীন শূণ্য—হঠাৎ আমার পাশ ঘেঁষে সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত এক লোক হেঁটে গেল। তাকে দেখে আমার বুকের ভেতরটা ধকধক করে উঠলো। মনে হলো সে কোন মানুষ না, যে কোন সময় সে উল্টো ঘুরে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। চারিদিক থেকে কারা যেন খিলখিল করে হাসছে।

কি করবো না করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না—হঠাৎই রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠলো এবং আমি দেখলাম সামনের আগন্তুক কোন জ্বীন অথবা ভূত না সে একজন মানুষ। মুহুর্তেই ভয় কেটে গেল। আমি আবারও হাঁটতে শুরু করলাম। দিশাদের বাড়ির সামনে এসে দিশাকে ফোন করে বললাম, “আমি তোমাদের বাড়ির সামনে।” দিশা বলল, “একটু দাঁড়াও।” আমি প্রায় মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকলাম। দিশা বারান্দায় এসে আমাকে ফোন করে বলল, “পালাও।” আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, “এতো এতো পথ পাড়ি দিয়ে, অসীম ভয়-ভীতিকে জয় করে এসেছি কি পালানোর জন্য?”

–“তুমি বুঝতে পারছো না, দ্রুত পালাও।”
–“পাগল হয়ে গেলে নাকি?”
–“আরে পালাও…”

হঠাৎই কাঁধের উপর কারও স্পর্শ অনুভব করলাম। পেছন ফিরে তাকিয়ে যাকে দেখলাম তিনি দিশার বাবা। মুহুর্তের মধ্যে তিনি আমার কলার চেপে ধরলেন এবং আমাকে টেনে-হিঁচড়ে গেটের ভেতর নিয়ে গিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে ফেললেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আমাকে এভাবে বাঁধছেন কেন? আমি কি করেছি?”

দিশার বাবা ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, “কি করেছিস? গতকাল রাতে দুইটা ফ্ল্যাট থেকে মোবাইল চুরি করছিস। আবারও চুরি করতে আসছিস? এত্তো বড় সাহস! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।”তিনি পকেট থেকে ফোন বের করে দিশাকে ফোন করে বললেন, “তাড়াতাড়ি গেটের সামনে আয় তো। চোর ধরেছি।” দিশা গেটের সামনে আসতেই তিনি দিশাকে বললেন, “এখানে একটু দাঁড়াতো। আমি সব ফ্ল্যাটে খবর দিয়ে আসি। দেখিস কোনভাবে যেন পালাতে না পারে।” দিশার বাবা চলে যেতেই দিশা বিরক্তমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে বললাম পালাতে। তুমি তো শুনলে না। এখন বুঝতে পারছো?” আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে বললাম, “তুমি কি আগে আমাকে বলেছ তোমার বাবা চোর পাহাড়া দিচ্ছেন?”

–“আমিও কি জানতাম নাকি?”

রশির বাঁধন খুলে দিয়ে দিশা বলল, “এখন দ্রুত ভাগো।” আমি দ্রুত গেটের বাইরে এসে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলাম। এক দৌড়ে মহল্লায় এসে থামলাম। কি সব ঘটনা আমার সাথে ঘটে গেল তড়িৎ গতিতে সবকিছুর দৃশ্যপট আমার চোখের সামনে ভেসে ভেসে আসছে—হঠাৎ পেছন থেকে ঘড়ঘড় শব্দ কানে এলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম চার-পাঁচটা কুকুর আমার দিকে বিরক্তমুখে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই তারা গলা ফাটিয়ে ঘেউঘেউ করতে শুরু করলো। আমি আবারও দৌড়াতে শুরু করলাম। আমার পেছন পেছন কুকুরগুলোও দৌড়াতে শুরু করলো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত