বিয়ের আগে তিনি আমার সাথে ফোনে কথা বলতে চাইতেন না খুব একটা। তখন ভেবেছিলাম মানুষটা হয়তো বেশ লাজুক প্রকৃতির কিন্তু বিয়ের পর আসল কাহিনী জানতে পারলাম। কিন্নর কণ্ঠী মেয়েদের সাথে দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা বললে নাকি ঘুম চলে আসে তার। আর ঘন ঘন কথা বললে স্মৃতিশক্তি দূর্বল হয়ে পড়ে। এই সমস্যার কারণে প্রথম ব্রেকআপের পর তিনি আর কোনো রিলেশনেই জড়ান নি।
বিয়ের পর এর সত্যতা আমি বহুবার পেয়েছি। বাপের বাড়ি যাওয়ার পর তার সাথে ১০ মিনিটের বেশি ফোনে কথা বললেই তিনি ঘুমে ঢলে পড়ে নাক ডাকতে শুরু করে দেন লাইনে থাকা অবস্থায়ই। কি যেন একটা বিষয় নিয়ে একবার মোটামুটি ধরনের ঝগড়া হয়েছিলো আমাদের মধ্যে। তখন আমি তাকে কল দিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছিলাম, বান্দা সেই পরিস্থিতেও ঘুমে কাত হয়ে গেছে! বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার পর আমি নিজে থেকে একদিন ফোন দিলাম তাকে। বললাম, এখন থেকেই নিজেদের মধ্যে একটা ভালো বোঝাপড়া থাকা দরকার।
তাহলে ভবিষ্যতে সৃষ্টি হওয়া সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া সহজ হবে। এর প্রতিউত্তরে তিনি বলেছিলেন, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা এড়িয়ে না গিয়ে সমাধান করতে হয়। এতে করে পারস্পরিক বোঝাপড়াটাও মজবুত হতে শুরু করে।” সেদিন তার সাথে আমার কথা হয়েছিলো প্রায় ৭/৮ মিনিটের মতো। কথা প্রসংগে বলেছিলাম তখন, সন্ধ্যের পর ঢাকার নির্জন কোনো রাস্তায় রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর আর তার মাঝে টং দোকানের চা খাওয়ার শখ আমার অনেক আগে থেকেই কিন্তু কখনো সুযোগ হয়ে উঠেনি এই শখ পূরণ করার। কারণ সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা বাবা পছন্দ করতেন না। এর তিনদিন পর এক সন্ধ্যেবেলা তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, “বের হতে পারবেন একটু? রিক্সা অপেক্ষা করছে।”
বেশ চমকে গিয়েছিলাম সেসময়। এরকম এক কাঠখোট্টা আর নিরামিষ ধরনের মানুষ আমার শখের কথা মনে রেখেছে এবং তা পূরণও করতে চাইছে, অবাক করার মতো বিষয়ই বটে। ভাগ্য ভালো সেদিন বাবা বাসায় ছিলেন না। ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলেন। মাকে গিয়ে বলতেই মা অনুমতি দিয়ে দিলেন কিন্তু শর্ত ছিল- বেশি দেরী করা যাবে না। অন্য সময় হলে আমি হয়তো একটু সময় নিতাম, খানিকক্ষণ ভাবতাম “যাবো কি যাবো না”। অথচ সেই সময় আমি যেন নিজের মধ্যেই ছিলাম না।
উচিৎ অনুচিত ব্যাপারটা মাথায়ই আসেনি তখন। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। প্রচণ্ড রকমের উত্তেজনা কাজ করছিলো মনের মধ্যে। এই প্রথম কারো সাথে সন্ধ্যার পর রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়াবো। তাও আবার সেই মানুষটার সাথে, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। উত্তেজনা দমে গেলো নিচে নেমে যখন গেইটের সামনে শুধু একটা রিক্সা দেখতে পেলাম। এদিকে তাকে যে একটা ফোন করবো সেই উপায়ও নেই। তাড়াহুড়োর মধ্যে মোবাইল ব্যাগে ঢুকাতে ভুলে গেছি। ফিরে আসতে নিচ্ছিলাম, এমন সময় পেছন থেকে একজনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
– আফা, রিক্সায় উডেন। ভাইজান আমারে পাডাইছেন আফনারে নেয়ার লাইগা। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
– মানে? আপনার ভাইজান কোথায়?
রিক্সাওয়ালা তার হাতে গুঁজে রাখা চিরকুটটা আমার সামনে এগিয়ে দিলো। চিরকুট হাতে নিয়ে দেখতে পেলাম,বড় বড় অক্ষরে লেখা- “তাড়াতাড়ি রিক্সায় উঠে পড়ুন, পরে দেরী হয়ে যাবে বাসায় ফিরতে। ফয়সাল” হাতের লিখা অপরিচিত থাকা সত্ত্বেও সাহস করে উঠে বসলাম রিক্সায়। ভাবলাম, তিনি হয়তো সামনেই কোথাও অপেক্ষা করছেন। কিন্তু না, সামনে এগুতে এগুতে অনেকখানি রাস্তা চলে আসার পরও রিক্সাওয়ালা থামার নাম নিচ্ছে না। কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে রিক্সাওয়ালাকে প্রশ্ন করলাম,
– মামা, আপনার ভাইজান কোথায়? তাকে উঠাবেন না? রিক্সাওয়ালা মামা ঘাড় ঘুরিয়ে তার ফোঁকলা দাঁতের হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন,
– তারে তো উঠানোর কথা নাই।
– তাহলে?
– তাইলে আমি কি জানি? আমারে যা কওয়া হইছে আমি তাই করতাছি।
কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রিক্সা ঘুরাতে বলবো নাকি এভাবেই যেতে থাকবো, ঠিক করতে পারছিলাম না। দ্বিধায় ভুগছিলাম। আবার মনে মনে একটা ক্ষীণ আশাও ছিল, তিনি কি আমার জন্য কোনো সারপ্রাইজ প্ল্যান সাজিয়েছেন? আরো কিছুদূর যেতেই একটা চায়ের দোকানের সামনে রিক্সা থামালো রিক্সাওয়ালা মামা। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বললো,
– ভাইজান কইছে আফনারে টং দোকানের চা খাওয়াইতে।
বারণ করা সত্ত্বেও মামা ধোঁয়া ওঠা এক কাপ গরম চা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। কোনোমতে চা শেষ করে আবার রওনা দিলাম অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না। এখন মনে হচ্ছে, উপরে উঠে মোবাইলটা নিয়ে আসা দরকার ছিল। হঠাৎ চারিদিকে এক ধরনের নিস্তব্ধতা অনুভব করলাম। খেয়াল করে দেখলাম, রিক্সাওয়ালা মামা একটা নির্জন রাস্তার মধ্য দিয়ে রিক্সা চালাচ্ছেন। জনসমাগম তেমন নেই। ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগলো আমার। কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছি না তো? চলন্ত রিক্সার পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর বখাটেদের আনাগোনা আর কুনজর দেখতে পেয়ে আমার ভয় বাড়তে লাগলো। জায়গাটাকে সুবিধের মনে হচ্ছে না একদমই। তাড়াতাড়ি করে রিক্সাওয়ালা মামাকে রিক্সা ঘুরাতে বললাম। বাসায় এসে সবার আগে তাকে ফোন করলাম। দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে তিনি কল রিসিভ করলেন,
– বাসায় পৌঁছে গেছেন? মেজাজ আমি আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
– এ ধরনের ফাজলামোর মানে কি? আমাকে নিচে নামতে বলে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন আপনি?
আমার কণ্ঠে অস্থিরতা থাকলেও তার কণ্ঠে ছিল শীতলতা।
– উধাও তো হইনি। আমি আপনার পেছনের রিক্সায়ই ছিলাম। তা আপনার ঢাকার নির্জন রাস্তায় রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর শখ কি মিটেছে?
– মানে?
– শুনুন, ঢাকা শহরের রাস্তায় সন্ধ্যার পর ঘুরে বেড়ানোটা সবসময় আনন্দদায়ক হয় না। মাঝেমধ্যে ভয়ংকরও হয়। বিশেষ করে নির্জন রাস্তাগুলোতে। আপনাকে এটাই বুঝাতে চেয়েছিলাম আসলে।
– আমি কি একা ঘুরতে চেয়েছিলাম? আপনি সামনে আসেন নি কেন?
– আমি সাথে থাকলে কি হতো? সিনেমার হিরোদের মত অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো মোকাবিলা করে নিতাম?
এগুলো শুধু সিনেমাতেই সম্ভব, বাস্তবে না। রাখছি এখন, আপনার এতটা সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত। সেদিন ফোন রেখে মনে হয়েছিলো এক্ষুণি বিয়েটা ক্যান্সেল করে দেই। এমন উদ্ভট লোকের সাথে সারাটাজীবন কাটানো আমার পক্ষে অসম্ভব। সিদ্ধান্ত পাল্টালাম পরের ঘটনাটা ঘটার পর। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। দরজা খুলে তাকে যে অবস্থায় দেখতে পেলাম, তা দেখে আর হাসি আটকে রাখতে পারলাম না আমি। পুরো শার্ট প্যান্ট জুড়ে ভেজা কাদার ছড়াছড়ি। মুখের অবস্থাও নাজেহাল। আমাকে এভাবে হাসতে দেখে তিনি মোটেও অপ্রস্তুত হলেন না, বরং বললেন,
– আপনার হাসি শেষ হলে বলবেন, তারপর আমি কথা বলবো। সাথে সাথে হাসি থামিয়ে দিলাম আমি।
– এ অবস্থা হল কি করে?
– আপনার সাথে কথা শেষ করে ফোন রাখার সাথে সাথেই কাদায় পা পিছলে বিশ্রীভাবে পড়ে গিয়েছিলাম। বিকেলে বৃষ্টি হয়েছিলো, হয়তো খেয়াল করেন নি। আন্টিকে একটু ডেকে দিবেন? উনার অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে একটু ফ্রেশ হতাম। ভয় পাবেন না, চা-কফির আপ্যায়ন লাগবে না, আবার গরম কফির মগ সামনে এনে দিলেও কিছু মনে করবো না। মনে মনে বললাম, বেশ হয়েছে। আমার মন ভাঙার শাস্তি এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতেই পারে না।
– কি হলো? চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো বরমশাইয়ের ডাক শুনে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলাম। হাতে থাকা চায়ের কাপে আলতো চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– আচ্ছা এখন আপনার ভয় করছে না? বরমশাই পালটা প্রশ্ন করলেন,
– ভয় কেন করবে?
– বিয়ের আগে সন্ধ্যার পর রিক্সায় চড়ে ঘুরতে চেয়েছিলাম বলে আপনি কি কাণ্ডটা ঘটিয়েছিলেন মনে আছে? আর এখন তো রাত দু’টো বাজে। শুনশান রাস্তাঘাট। তবুও টং দোকানে বসে আমাকে নিয়ে চা খাচ্ছেন। বরমশাই প্রসংগ এড়ানোর উদ্দেশ্যে অপ্রাসঙ্গিক লোভ দেখালেন।
– ঝালমুড়ি খাবে? বেশি করে কাঁচামরিচ,পেঁয়াজ আর টমেটো দিয়ে? খাবে কিনা বলো, ব্যবস্থা করতে পারবো।
– কিভাবে? বরমশাই চোখ দিয়ে ইশারা করলেন,
– ওই দেখো…
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম, টং দোকানের মামা একটা বড় বাসনে করে ঝালমুড়ি মাখানোর আয়োজন করছেন। পাশে টমেটো কুচি, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ রাখা আছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই পাশ থেকে বরমশাইয়ের উঁচু গলা শুনতে পেলাম।
– কি গো মামা, একলা খাইবা? আপ্যায়ন করবা না? কাস্টমার তো খালি আমরা দুইজনেই। বরমশাইয়ের কথা শুনে মামা লাজুক হেসে বললেন,
– মাখানো শেষ হোক, তারপর দিতাছি।
ওহ্, আপনাদের তো বলাই হয়নি। বিয়েবাড়িতে না থেকে এই রাত বিরাতে আমরা রাস্তায় ঘুরাঘুরি করছি কার জন্য জানেন? কার জন্য আবার, বরমশাইয়ের জন্যই। বিশাল এক আকাম করে এসেছেন তিনি বিয়েবাড়িতে। তাই লোকলজ্জার ভয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। সেই কাহিনী জানতে হলে একটু ধৈর্য্য ধরে পরের পর্ব পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।