ভালোবাসা

ভালোবাসা

প্রতিদিনই অর্থিকে ফলো করি। অর্থিও ব্যাপারটা বুঝে। কিন্তু চুপ করে থাকে। কেউ একজন বলেছিল নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। এই যুক্তির উপর ভরসা করে একদিন অর্থিকে ডাক দিলাম।

– এই যে শুনেন।
:- দেখুন আমি জানি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন।

অহেতুক নিজের সময় নষ্ট করবেন না। এসবে আমার কোনো আগ্রহ নেই। কথা গুলো শেষ করেই সে চলে গেল। আমি বোকার মত তার গমন পথে তাকিয়ে থাকলাম। মনে মনে বলতে লাগল কোন গাধায় বলেছে নীরবতা সম্মতির লক্ষণ? যাইহোক আমি অর্থির পিছু ছাড়িনি। ভালবেসেছি সুতরাং হাল ছেড়ে দিলে হবে না। বেশকিছু দিন যাওয়ার পর একদিন অর্থি আমাকে ডাকলো। খুশি মনে গেলাম।

– জ্বি বলেন।
:- আপনাকে না বলেছি সময় নষ্ট করবেন না। আমি এসবে আগ্রহী নই।
– তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে। আপনা মানুষকে তুমি করেই বলতে হয়।

:- দেখুন আমি গ্রামের খুব সাদাসিধে মেয়ে। তবে আমি বোকা নই। দয়াকরে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। মন খারাপ নিয়ে বাসায় এলাম। তবুও চেষ্টা ছাড়লাম না। অর্থির এক বান্ধবী আমাকে চিনে। এবার তাকে দিয়ে ট্রাই করলাম। অনেক পিড়াপিড়ির পর অর্থি আমার সাথে কথা বলার জন্য আমাকে পার্কে ডাকলো। পার্কে! আমি তাও খুশিতে আকাশে ভাসা শুরু করলাম। সঠিক সময় নির্দিষ্ট স্থানে যেয়ে হাজির হলাম। অর্থিও হাজির। যেয়ে হাই দিলাম। অর্থি তার পাশের খালি স্থানটার দিকে ইশারা করে বলল

:- বসেন। কে ঠেকায় আমারে! ধুপ করে বসে পড়লাম।
– ভাল আছ?
:- হ্যা। কতটুকু ভালনাসেন?
– অনেক অনেক অনেক।
:- কয়দিন থাকবে এই ভালবাসা? দিল বাশ।
– কখনোই ফুরাবে না।
:- ফুরাবে যেদিন লিটনের ফ্ল্যাটে নিতে পারবেন সেদিনই ফুরাবে।
– দেখ হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান না।
:- এই ডায়ালগ অনেক পুরানো। এসব ভালবাসা ফ্ল্যাট পর্যন্ত টিকে। তারপর ঢুস।
– আমার ভালবাসা ফুরাবে না।
:- তাহলে চলুন লিটনের ফ্ল্যাটে। তারপর দেখা যাবে এটা ভালবাসা নাকি অন্যকিছু।
•মেজাজটাই বিগড়ে গেল।

– থাক লাগবে না ভালবাসা। আগে ভালবাসার সম্মান দিতে শিখ। তারপর না হয় ভেবে দেখব। আর কখনো ডিস্টার্ব করব না। বাই। চলে এলাম। ওর কথাগুলো মনের মধ্যে কাটার মত ফুটছিলো। তাই রাগ সামলাতে পারলাম না। বেশ কিছু দিন পার হয়ে গেল। আলি ওর সামনেও যাইনি। সপ্তাহখানেক পর অর্থির সেই বান্ধবীটা বলল অর্থি দেখা করতে চায়। মনের মধ্যে রাগ আছে তবে ভালবাসাটাও তো আছে। তাই দেখা করতে গেলাম। পাশে বসতে বলল। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলাম।

:- এই ভালবাসা?
– তুমিই তো ভালবাসার অপমান করেছিলে। কেন ডেকেছো সেটা বলো।

:- একটা গল্প শুনাব। সময় হবে? অর্থির করুণ মুখ দেখ হ্যাঁ বললাম।

:- একটা মেয়ের গল্প। মেয়েটা সবসময়ই হাসিখুশি থাকে। তাদের পরিবার যৌথ পরিবার। বাবা, মা, দাদা, দাদী, চাচা, চাচী ও চাচাতোভাইবোন এই নিয়ে তাদের যৌথ পরিবার। সবাই এক বাসাতেই থাকে। পুরো বাড়ি নেচে  বেড়ায় মেয়েটা। সবাই খুব ভালবাসে। পরিবারের মধ্যে সেই একমাত্র মেয়ে। কিন্তু হাসিখুশিটা বেশি দিন টিকলো না।

মেয়েটার চাচাতো ভাইয়ের কুনজর মেয়েটার উপর পরলো। ভাই শব্দটার অপব্যবহার করে সেই ছেলেটা দুষ্টামির আড়ালে সবসময় মেয়েটাকে স্পর্শ করে। কিন্তু মেয়েটা কখনো খারাপ ভাবেনি। কারণ ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হওয়ায় ছোয়াছুয়িটা সাধারণ ব্যাপার। তবে ছেলেটার মনে যে অদ্ভুত লোভ জন্মেছে তা মেয়েটা ভাবতেও পারেনি। অতপর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিনটা এলো। বাড়ির সবাই মেলায় গেছে। বাড়ি দাদা-দাদী (কানে শুনে না) ও মেয়েটা ছিল। অসুস্থ থাকায় মেয়েটি যায়নি। অন্যদিকে চালাকি করে ছেলেটা বাড়ি ফিরে এলো। তারপর উচ্চস্বরে গান বাজানো শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর মেয়েটার রুমে এলো। দুজনে কথা বলতে লাগলো। হঠাৎই ছেলেটা ক্ষুধার্ত পশুর মত মেয়েটার উপর ঝাপিয়ে পরলো। মেয়েটা কল্পনাও করতে পারেনি এমন কিছু হতে পারে।

মেয়েটা চিতকার শুরু করল কিন্তু লাভ হল না। উচ্চস্বরে গানের ফলে মেয়েটার চিতকার চার দেয়ালের মাঝেই বন্ধী হয়ে গেলো। ছেলেটা নিজের ক্ষুধা নিবারণ করে পালিয়ে গেলো। মেলা থেকে ফিরে এসে মেয়েটার মা মেয়েটাকে দেখে চিতকার দিয়ে উঠলো। মেয়ের এই দশা দেখে মেয়েটার বাবা তখনই হার্ট স্ট্রোক করলেন। মেয়েটাকে কাপড় দিয়ে মেয়েটাকে ঢেকে দিল। তারপর বাবা মেয়েকে হাসপাতালে নেয়া হলো। বাবা মারা গেলেন। চোখের কোনায় জমে থাকা পানি মুছে অর্থি আবার বলতে শুরু করলো

:- অন্যদিকে বাবার মৃত্যুর খবরে জর্জরিত মেয়েটা পরিবারের সবাইকে সব বলে দিলো। পরিবারের বড়রা ব্যাপারটা পুলিশকে জানালো না। পরিবারের মধ্যেই রাখলো। পারিবারিক সালিশি হলো। ছেলেটাই মেয়েটাকে বিয়ে করবে। বাবার মৃত্যুর কারণে বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হবে। চুপিচুপি যাকে বলা হয়। পরে ধুমধাম করে আয়োজন করা হবে। কিন্তু বিয়ের আগের দিনেই ছেলেটা পালিয়ে গেলো। এবারও পুলিশকে কিছু জানানো হলো না। আবার পারিবারিক সালিশি হল। মেয়েটার ভরণপোষণের দায়িত্ব তার চাচা নিলো। তারপর মেয়েটাকে পড়ানোর নামে শহরে পাঠিয়ে দিলো। ভরণপোষণ তো দূরে থাক মেয়েটা কেমন আছে সেটাও জিজ্ঞেস করার চাচাটা একবার ফোনটাও করেনি। কিছুদিন পর খবর এলো মেয়েটার মাও মারা গেছে। মেয়েটা বাড়ি গেলো। সেই ছেলেটাও ছিলো।

কিন্তু কেউ কিছু বলল না যেন সবকিছুই স্বাভাবিক। মায়ের মৃত্যুর কষ্টে মেয়েটা কাতরাচ্ছে ঠিক তখনই এক রাতে ছেলেটা আবার মেয়েটার রুমে ঢুকলো। মেয়েটা কোনোরকম পালিয়ে শহরে চলে এলো। শহরেও নানা রকম শারিরীক অত্যাচারের মুখে পরেছে। কিন্তু মেয়েটা হার মানেনি। অবশেষে এক বান্ধবীর সহায়তায় মেয়েটা নারী আন্দোলনের একটা সংস্থার সাথে যুক্ত হয়। এরপর দিনগুলো ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। পদে পদে যুদ্ধ কএ বাঁচতে লাগলো মেয়েটা। এখন মেয়েটার মুখে হাসির রেখা দেখা যায়। কিন্তু অন্তরটা আগুনে পোড়া। এবার তুমিই বল এমন মেয়ের মনে ভালবাসা থাকতে পারে? বুঝতে বাকি রইলো না এই গল্পটা অর্থির। আমি স্তব্ধ হয়ে অর্থির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে একটা টু শব্দ বের হলো না। আমার নীরবতা দেখে অর্থি বলল

:- এমন মেয়ের পিছনে সময় ব্যয় করা বোকামি। তাই বলছি সময় নষ্ট করোনা। অর্থি উঠে চলে গেলো। আমি কিছু বলতে পারলামনা। পরেরদিন বাবা মাকে নিয়ে অর্থি যে নারী সংস্থায় কাজ করে সেখানে হাজির হলাম। সাথে বাদ্যযন্ত্র। অর্থি আমাকে দেখে বেশ অবাক হলো। বিয়েটা সেখানেই করলাম। সেখানের এক মহিলা অর্থি গার্ডিয়ানের ভূমিকা নিলো। সাথে আমাকে হুমকি থ্রেটও দিলো। “যদি ধোকা দাও তবে বাংলাদেশের যে জেলাতেও পালাও না কেন খুঁজে করে উপযুক্ত শাস্তি দিব।” ইয়াআআআআআআ লম্বা থ্রেটের পর বিয়েটা শেষ হলো। আমি আমার বাবাকে সব খুলেই বলেছি। অর্থি জীবনী শুনে আম্মু রাজি হয়ে গেলো। আর আম্মু হ্যাঁ মানেই আব্বু হ্যাঁ। তাদেরও প্রেমের বিয়ে তো তাই। বাসরঘরে ঢুকলাম। অর্থি আমার পায়ে পরে কাদতে লাগলো। সালাম করলে অবাক হতাম না। কিন্তু কাদতে লাগলো তাই অবাক হলাম। উঠালাম। চোখের জলগুলো মুছে দিয়ে বললাম

– চোখে জল কেন?
:- আমি ভাবিনি তুমি আমাকে এতো ভালবাস।
– অনেক বেশি বাসি। যা দেখানো সম্ভব না।
:- এভাবে আজীবন বেসে যাবে তো?
– হ্যাঁ যাব।

অর্থি আমাকে জড়িয়ে ধরলো। পাঞ্জাবির কাধেঁর দিকটা চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে। নীরবে কেদে যাচ্ছে অর্থি। হয়তো এটা সুখের কান্না। তাই আর থামালাম না। কষ্টে জর্জরিত জীবনে হঠাত্ সুখে একটু হাওয়া বইলে আমাদের দুচোখ দিয়ে সেই সুখের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অশ্রু ঝরে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত