অর্কের সাথে হাসপাতালে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।প্রায় সাড়ে তিন বছর পর দেখা ওর সাথে।দুজন চোখাচুখি হতে চোখ সরালাম আমি।আমার সাথে তিন তিনটা বাচ্চা।আর অর্ক এখনো বউ নিয়ে বাচ্চার জন্য এ ডাক্তার থেকে ও ডাক্তার দৌড়াচ্ছে। অর্ক আমার প্রাক্তন স্বামী।স্বামীর চেয়েও অর্ককে আমি একটু বেশি যা ভেবেছিলাম তা হচ্ছে বেস্টফ্রেন্ড। অর্ক আমার জীবনের প্রথম পুরুষও বটে।যাকে আমি মনেপ্রাণে ভালোবেসেছিলাম। যার সাথে আমি বিয়ের পর নিজের পুরো লাইফলাইন শেয়ার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
তিন বছর সাত মাস তেরো দিনের সংসার করেছিলাম আমরা। কেয়ার এন্ড রেসপেক্ট ছিলো অনেক।ফলে বোঝাপড়াটাও অনেক ভালো ছিলো।কিন্তু তার মধ্যেও সবচেয়ে বড় অভাব ছিলো একটা বাচ্চার।প্রায় তিন বছর ধরে চেষ্টা করার পরো যখন বাচ্চা হয়নি অর্ক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দ্বিতীয় বিয়ে করবে।কারণ তার বাবা হওয়ার অনেক শখ ছিলো।বললো, আমার উপর তার আর ভরসা নাই।
বুড়ো হয়ে গেলে তাকে দেখবে কে?বুড়ো বয়সে তাকে কামাই করে খাওয়াবে কে? সংসারে অশান্তি শুরু হয়ে গেলো।শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই অর্কের সিদ্ধান্ত সাপোর্ট করেছিল। তারপর একদিন অর্ক আমি থাকা অবস্থায় তার অফিসের এক কলিগকে বিয়েকরে নিয়ে আসে।এবং আমার হাতে ডিভোর্স লেটার ধরিয়ে দিয়ে বলে,আমার আর দরকার নাই।আমি বাপের বাড়ি যেতে পারি। অর্কের আত্মবিশ্বাস ছিলো বাচ্চা না হওয়ার সমস্যাটা আমার।ওর না।কারণ ছেলেদের এরকম সমস্যা থাকেনা,সব সমস্যা মেয়েদের।তাই যখনই বলতাম ডাক্তারতো বলল আমার কোন সমস্যা নেই, তুমি একটু চিকিৎসা করে দেখো না।যদি সমস্যা তোমার হয়।
তখন অর্ক খুব একটা ছোট মানসিকতা নিয়ে বলতো,তোমরা মেয়েদের জাত এরকম হও বুঝি,তোমরা এতো নির্বোধ কেন?ছেলেদের আবার সমস্যা হয় নাকি? বাচ্চা কি ছেলেদের গর্ভে জন্মে?ছেলেদের সমস্যা থাকতো। অর্কের এই ছোট মানসিকতার উত্তর আমি দিতে পারতামনা আমার শ্বাশুড়ি আম্মার কারণে।একটু প্রতিবাদ করলে উনি যা-তা বলতেন।এক লাইন বললে দশলাইন বানিয়ে বানিয়ে আমার ননদীকে ডেকে বিচার দিতেন। তারপর সবাই মিলে বন্ধ্যা বলে যতো অপমান। শেষবার অর্ককে বলেছিলাম আমরাতো একটা সন্তান পালতে পারি।যে হবে আমাদের সন্তানের মতোই। অর্ক সেবার রেগেগিয়েছিল অনেক।হাত তুলেছিল আমার গায়ে।
যাইহোক অর্ক ডিভোর্সটা আমায় দিয়ে ভালো করেছে। মুক্তি পেয়েছি আমি,আর এরকম একটা আত্মবিশ্বাসী সংসারের দেখা পেয়েছি।যেখানে শুধু রেসপেক্ট এন্ড কেয়ার না ভালোবাসা আর ভরসাও অনেক আছে সাথে। বাবা-মা টেনশনে ছিলেন অনেক।বাচ্চা কোনদিন হবেনা অর্কের মতো এরকম ভুল ধারণা আমার বাবা-মায়েরও ছিলো।তাই উনারা দেখেশুনে সদ্য পত্নী বিয়োগ হয়েছে এরকম দুই সন্তানের বাবার সাথে আমায় বিয়ে দিলেন। লোকটাকে প্রথম প্রথম মানতে না পারলেও ধীরে ধীরে বোঝে উঠেছিলাম,লোকটা অন্তত অর্কের মতো ছোট মানসিকতার নয়।ও আমার উপর ভরসাটা করে বেশি।
বাচ্চাদের জন্য আমি মা হতে পারবোনা জেনে বিয়ে করেছিলেন লোকটা।তাই যখন আমি প্রেগন্যান্ট বুঝতে পারলাম তখন ভয়ে ভয়ে উনাকে জানিয়েছিলাম যে আমি প্র্যাগনেন্ট।লোকটা তখন উল্টো অনেক খুশি হলো। বলল,তোমায় যে ভুল বোঝেছিল আজ প্রথম মিষ্টিটা তার মুখে দিলে কেমন হয় বলোতো? ঠিকানাটা দিবে আমায়? উনার কথায় আমি শুধু খুশিতে নিরবে উনাকে জড়িয়ে ধরে দুফোঁটা চোখের জল ফেলেছি।আর বলেছি,দরকার নাই আর তার,আমাকে এরকম একটা খুশির দিন উপহার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। বাচ্চা দুটোও অনেক খুশি।তারা আরেকটা বাবু পাবে। বাপ-বেটা মিলে খুশিতে সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন।
বাবু পৃথিবীতে এসেছে সাতদিন হলো।হাসপাতাল থেকে রিলিজ সার্টিফিকেট পেয়ে বাসায় যাচ্ছিলাম আমার স্বামী সহ আমাদের তিন সন্তান।বড় দুজন আমার হাত ধরে আছে।আমাকে হাটতে সাহায্য করছে তারা।পিচ্চিটা তার বাবার কোলে।অর্ক তাদের দিকে তাকালো।অর্কের দ্বিতীয় স্ত্রীটারো হয়তো আমার কথা এখনো মনে আছে। থাকারও কথা সেইতো অর্ককে সাহায্য করেছিলো আমাকে তাড়াতে।এখন সব ঠিকঠাক বুঝে ওঠেছে নিশ্চয়। সেও অবাক দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে।হয়তো ভাবছে,ওরতো বাচ্চা হওয়ার কথা ছিলোনা, এখন হল কি করে? উনার হাতে ডাক্তারের ফাইল আর চেহেরাটা দেখে বুঝতে পারলাম,চিকিৎসাটা এখনো ঐ আপুর হয়,অর্কের না।
লিফট ছেড়ে আমরা নিচে এসে গাড়িতে উঠলাম,আড়চোখে তখনো দেখলাম অর্ক আর ওর স্ত্রী দুজনেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।দুঃখ শেষে আমার সুখের গাড়ি চললো সুখের সংসারের গন্তব্যে।শুধু রেসপেক্ট এন্ড কেয়ার থাকলে যে ভালোবাসা হয়না সেটা আমি একটু দেরিতে হলেও বুঝেছি।বুঝেছি দায়িত্ব্যের সাথে সংসারটা চালিয়ে নিতে ভালোবাসা আর ভরসার মূল্য অনেক বেশি।