“এই নাও ছাতা টা ধরো” সন্ধ্যা হবো হবো প্রকৃতির কোলাহলে চারপাশ যেন বড্ড আবহমান এক নিরাদ্রি জাগ্রত হয়েছে। অবশ্য সন্ধ্যার অনাবহিত কালো রং প্রকৃতিতে না নেমে এলেও বৃষ্টির আবহমানে প্রকৃতিতে বিস্তৃত আকাশের কালো রং যেন সন্ধ্যাকে বেশ আগেই জাগিয়ে দিয়েছে। আমি অফিস থেকে বের হতে একটু দেরিই করে ফেলেছি আজ। অবশ্য দেরি নয়, ছুটির ঘন্টা সঠিক সময়ে বাজার আগেই বৃষ্টির আহ্বানে অফিসের স্টাফগুলো আগেই বিদায় হয়েছে। আমার কেবল একটু বাড়তি কাজ থাকায় রয়ে গিয়েছিলাম।
তাই যখন কাজ শেষ করে, অফিস ব্যাগ কাধে নিয়ে বাইরে বের হলাম তখনি তাসমিম এসে তার ব্যাগ থেকে একটি নীল রং এর ফুট ফুট ডিজাইনের ছাতা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি কেবল আমার চোখ দুটো কিঞ্চিৎ কপালের দিকে প্রসারিত করে অবাকের মত তাকিয়ে আছি। তাসমিম তা বেশ ভালো করেই আন্দাজ করেছে।
– কি হল নাও ছাতাটা?
– ইয়ে মানে, ছাতা.. লাগবে না।
– কেনো? এখনি তো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। শোনোনি নাকি খবর?
– হুমম।
কিছু বললাম না আর। কেবল তাসমিমের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। আমি হয়ত ভেবে ছিলাম অফিসে শেষ মানুষ আমিই আছি। কিন্তু না আমার মত তাসমিম ও ফেঁসে গেছে বৃষ্টির আবর্তমানে। আমি মুখ তুলে মুচকি হেসে বললাম..
– বৃষ্টি তো এখনো আসেনি। আমি রিকশা পেলেই চলে যাবো বৃষ্টি আসার আগেই। ওটা আপনি রেখে দিন।
কথাটা শেষ হতেই বৃষ্টি শুরু হল। ঢাকা শহরের তিনচাকার রিকশা গুলো নিয়ে চালকের পালাতে প্রস্তুত নিজ গন্তব্যে। আমি অফিসের সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আর আমার পাশে তাসমিম দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি শুরু হল, বৃষ্টির ছিপ ছিপ শব্দগুলো পিচঢালা রাস্তায় পড়ে কেমন যেন মনকে এক উন্মাদনায় প্রসারিত করতে প্রস্তুত।
– এইবার যাও? বৃষ্টি তো নেমেই গেছে। ছাতাটা নাও। (তাসমিম)
– আমি নিলে আপনি যাবেন কি করে? আর আমি ভিজেই চলে যেতে পারবো। আমার থেকে ওটা আপনারই প্রয়োজন বেশি।
– দেখো আবির, তোমাকে যা বলছি সেটা করো। আব্বু এখনি গাড়ি নিয়ে আসবে আমি সেটাতে চলে যেতে পারবো। তোমারই ছাতার প্রয়োজন। নাও বলছি…
তাসমিম আমাকে ঝাড়ি দিয়ে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল। আমি হাতটা বাড়িয়ে ছাতাটা নিলাম। এই মেয়ের হাবভাব আমার ভালো লাগছে না। এমনিতেই তো কারো সাথে কথা বলে না। তার উপর আজ আমার সাথে যেচে এসে কথা বলছে। কেমন যেন লাগছে আমার। আসলে এই কেমন লাগার কারনও আছে বেশ বড়।
বৃষ্টি পড়ছে বেশ জোরে। দুজন মানুষ অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন হবে আমি তো কখনো ভাবতেই পারিনি। মাস তিন আগেও তাসমিম আমার দিকে ফিরেও তাকাতো না। আর আজ হুট করে এসে কথা বলছে কেন জানিনা সেটা মেনে নিতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। অফিসে এসেছি বছর খানিক হল প্রায়। অফিসে জয়েন করার পরেই নতুন এমডি হিসেবে জয়েন করে অফিস মালিকের মেয়ে তাসমিম। দেখতে বেশ মিষ্টি হলেও সে কারো সাথে কথা বলতো না। অফিসে কেও কোনো ভূল করলে তাকে সাতদিন অবদি খালি ঝাড়ির উপরে রেখে দিত। আমি রোজ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কেনো জানিনা মেয়েটাকে রাগলে আরো বেশি সুপ্ত এক তাজা গোলাপের মত লাগে। কেবল ভালোলাগার পার্সেন্টেজ ছিল শতভাগ।
আমি তাসমিমের দিকে তাকিয়ে থাকতাম বারবার,লুকিয়ে, আড়ালে। অনেক দিন ধরাও পড়ে গিয়েছি। কিন্তু সে এ ব্যাপারে কিছুই বলতো না। কিন্তু কি করার। ছেলেদের মন কি আর এসব বহুদিন নিয়ে চলতে পারে। তাসমিমকে ভালো বেসেই ফেললাম। কিন্তু কখনো কিছু বলতে পারিনি। আর এই বলতে না পারার পিছনে কারন, ও বসের মেয়ে+এমডি। তার উপর কেমন খিট খিটে মেজাজে সবসময় বসে থাকে। এমন একটা ভাব করে যেন ৪০ বছরের এক মহিলা অফিসের সব কাজ হ্যান্ডেল করে।
অফিসের সবাই তাসমিমকে দেখলে চুপ হয়ে যায়। কোনোদিকে তাকাবে না। সোজা নিজের কেবিনে প্রবেশ করবে হনহন করে হেঁটে। প্রয়োজন ছাড়া ওনার কেবিনে তিনি কাউকেই ডাকবেন না। কথা তো দুরের কথা। আর একটু ভূল হলেও রাজ্যের কত কথা শোনাবে সবাইকে। আঙ্গুল উচিয়ে চোখের পাতা বারবার নাড়িয়ে মুখটা যখন একটু বাঁকিয়ে মেয়েটা কথা বলে তখন কি সে জানে তাকে কতটা সুন্দর লাগে।
হয়ত তাসমিম জানে না। আর সেই সৌন্দর্যের অপার্থিব দৃশ্যগুলো আমি মিস করতাম না কখনোই। সাদা কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ওর প্রতিটা চলাফেরা আমি নজরে রাখতাম। এভাবে কাটে কয়েক মাস। একদিন অফিসে এসে জানতে পারি আজ অফিস দুপুরের পরেই ছুটি হয়ে যাবে। তার কারন আজ বিকেল থেকে অফিসের সবাই স্যারের বাসায় তার মেয়ের বার্থডে উপলক্ষে অনুষ্ঠানে যাবে। মনে মনে খুশি হলাম যে তাসমিমকে আরো অনেক টা সময় দেখতে পারবো।
সন্ধ্যার কিছু সময় পর স্যারের বাসায় গেলাম। বেশ বড় একটি বাড়ি। এর আগে কোনোদিন এই বাড়িতে আসিনি। হাতে এক তোড়া বুকে। রঙিন কাগজে মোড়া। বাড়িতে প্রবেশ করেই সব দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি। তখনি দেখলাম কোনো একজন সাদা ড্রেস পরে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে। পা থেকে মাথা অবদি সাদা রং এ ভর্তি। মুখটার দিকে তাকাতেই বড় রকমের একটা ধাক্কা খায়। প্রথমে চিনতেই পারিনি উনি কে। পরে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বুঝেছিলাম ও তাসমিম। কিন্তু এতটা সুন্দর লাগবে কখনো ভাবতেই পারিনি। অনেক লম্বা চুল। একদম নিকশ কালো চুলগুলো মাথার পিছন বেঁয়ে অনেকটা নিচেই নেমে গেছে। আমি কিছুক্ষন বোকার মত তাকিয়ে সে দিকে চেয়ে আছি। কোনো এক কলিগ এসে বলে “কি মি, আবির সাহেব। ম্যাডাম এতটা সুন্দর আগে তো খেয়াল করিনি”।
আমি ওনার কথার কোনো জবাব দিলাম না। কেবল তাসমিমের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বুকের হার্টবির্ট যেন বারবার সংকোচিত হতে লাগল। কেন যেনো মনে হচ্ছে ভালোলাগার ভূমিকম্প আমার বুকের বাঁ পাশে বিশাল ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বেশ কিছুক্ষন তাকে নিয়ে ভাবছি আমি। ঠিক কয়েক মিনিট পরেই কেক কাটে ও। তারপর সবার সামনে সার ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দেয়। আমার বয়সি একটি ছেলের সাথে “আমার বন্ধু, ও অফিসের সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনুন, এই হল রাতুল। বিজনেস ম্যান। আগামী বছরের প্রথম তারিখেই আমার একমাত্র মেয়ে তাসমিম বিনতে মিম এর সাথে তার বিয়ের দিন ঠিক করছি। আপনারা সবাই কিন্তু সেদিন উপস্থিত থাকবেন।” কথাগুলো শোনার পর যেন কেমন পা কাঁপতে থাকে আমার। চারপাশ যেন কেমন ঘুর্নিয়ান হতে লাগল। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। কারো সাথে কোনো কথা না বলে সোজা বাড়িতে চলে আসি। তারপর কয়েকদিন অফিসে যায়নি।
বেশ ক দিন বন্ধ করার পর যখন অফিসে গেলাম সবাই কেমন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আমি সোজা গিয়ে নিজের ডেস্কে বসতেই কাদের মিয়া এসে হাজির..
– স্যার, ম্যাডাম ডাকছে আপনাকে ওনার কেবিনে।
– কেনো? (আমি)
– এতদিন আসেন নাই, তার উপ্রে পুরোনো কাজের ফাইলও জমা দেন নাই। মেডাম পুরা খাইপা আছে। এখনি যেতে কইছে। যান।
কাদের মিয়া কথাগুলো বলে চলে গেল। আমি কিছু পুরোনো কাজের ফাইল হাতে নিয়ে তাসমিম এর কেবিনের দিকে গেলাম। দরজাটা একটু খুলে বললাম “ভিতরে আসবো?”
আমার কথা শুনে তাসমিম আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে ভিতরে আসার নির্দেশ দেয়। আমি ধীর পায়ে হেঁটে যায় ওনার সামনে। ওনার টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার খালি পড়ে আছে। আমি চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে এক প্রকার ঝাড়ি শোনার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলাম।
– আবির সাহেব.. সেদিন ওভাবে আমাদের বাড়ি থেকে চলে এসেছিলেন কেনো?
আমি অবাক চোখে ওনার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলাম। ওনার শান্ত ভঙিতে বলা কথাটা আমার বারবার কানের কাছে এসে বাজতে লাগল। আমি ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছি না। কেনো আমি সেদিন ওনাদের বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম? আর এখন উনি ঝাড়ির বদলে খুব শান্ত গলায় আমার সাথে কথা বলার কারনই বা কি?
– কি হল মি. আবির সাহেব? চুপ কেনো? বলে ফেলুন কেনো সেদিন চলে এসেছিলেন?
– ইয়ে মানে ম্যাম, আগের ফাইলগুলো নিয়ে এসেছি। আর সরি আমি এ কদিন আসতে পারিনি কারন খুব অসুস্থ ছিলাম।
– হিহিহি…
তাসমিম হাসতে লাগল। আমি একবার তাকালাম ওনার দিকে। ওনার মুখে যে তাচ্ছিল্যের হাসি অনবরত সংকুচিত হচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু উনি কেনো হাসছেন তা জানার প্রবল ইচ্ছে মনের মধ্যে জাগলেও জানার চেষ্টা করার মত সাহস আমার হচ্ছে না।
– আপনি যে মিথ্যে বলতে পারেন না, তা সেটা কি সবাই জানে?
– মানে?
– মানে আপনি অসুস্থ ছিলেন না। ঠিকই বাড়িতে সুস্থ শরীরে কাটিয়েছেন। অফিসে না আসার কারন কি সেদিন চলে আসা? তাহলে বলুন কেনো সেদিন চলে এসেছিলেন?
কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমি একদমই জানতাম না উনি বেশ বুদ্ধিমতী। বাট ওনার দিকে তাকিয়ে আমি কোনো কথায় বলতে পারছি না। কেমন যেন হচ্ছে আমার।
– কি হল কি.. বলুন, কেনো চলে এসেছিলেন?
– আসলে.
– আসলে কি?
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। হাতের ফাইলগুলো কয়েকবার নাড়িয়ে আবার হাত বন্ধ করে নিলাম। ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম..
– আসলে আমি ইচ্ছে করে চলে আসেনি।
– সেটা তো জানি। কিন্তু সেই কারনটা তো বলুন।
আমি আবারো চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কথাগুলো সাজাতে লাগলাম। বারবার মনে হতে লাগল এই অফিস থেকে চাকরি চলে গেলে আপাতত বাড়িতে কি বলবো? তারপর কি করবো? কিন্তু তবুও কেমন যেন তাসমিমকে কিছু বলার সাহস কোথা থেকে উদয় হল বুঝতে পারছি না। আমি বললাম..
– আসলে জানিনা, কথাগুলো বলা ঠিক হবে কিনা। এটাও জানিনা কথাগুলো বলার পর কি হবে? আমি সোজাসুজি বলছি আপনাকে আমি ভালোবাসি। আপনার ভালোবাসতে হবে আমার তার কোনো দরকার নেই। সব ভালোবাসা যে পূর্নতা পাবে তা কোথাও লেখা নেই। আপনাকে ভালো লাগতেই পারে,কিংবা পছন্দ হয়ে যেতেও পারে। এমনি ভালোবাসতেও পারে। দেখতে সুন্দর অথবা স্মার্ট বলেই হয়ত এইটুকু আপনি ডিজার্ভ করেন। তার মানে এটা নয় যে আপনার প্রেমে সবাই হাবুডুবু খাচ্ছে,কিংবা দেওয়ানা হয়ে গেছে। আপনি যেন আমাকেই ভালোবাসুন এটা আমার কাছে ভালোবাসার লক্ষ্য নয়, আমি আপনাকে কতটুকু ভালোবেসেছি এটাই আমার লক্ষ্য।
আপনাকে আমার ভালোবাসতেই হবে সেটা বলছি না। আমাকে আপনার ভালোবেসে গ্রহন করতে হবে সেটাও বলছি না। কেবল আপনাকে ভালোবাসার সুযোগ চেয়েছি। কিন্তু আমি বড্ড দেরি করে ফেলেছি। যেখানে আপনাকে ভালোবেসে পাওয়ার আমার কোনো চান্স নেই। আছে কেবল হতাশা আর দূর্বিসহ কষ্ট। সরি ম্যাম, আপনাকে এসবকিছু বলার জন্য। আমি জানি আজকের পর এসবকিছু বলার পর আমার চাকরি থাকবে না। তাই আসি ম্যাম, ভালো থাকবেন। তারপর আমি সোজা চলে আসি অফিস থেকে। টানা দুই সপ্তাহ গৃহবন্দি হয়ে ছিলাম। একদিন সকালে নতুন চাকরি খোজার জন্য বাড়ি থেকে বের হবো তখনি কলিং বেল বেজে ওঠে। আমি যেয়ে দরজা খুলতেই দেখি কাদের মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে উনি বলতে লাগলে..
– ধুর মিয়া আপনি তো বহুত ভেজল একটা লোক। আপনার জন্য আর পারি না। অফিস ছেড়ে চলে আসছেন কেন? এই নিন, আপনার নতুন প্রমোশন লেটার। কালই চলে আসবেন। ম্যাডাম নিজে আপনাকে প্রমোশন লেটার দিয়েছে। তারপর আর কি, লজ্জার মাথা খেয়ে আরো দুদিন পর অফিসে চলে আসি। কিন্তু তারপর আর কোনোদিনও ম্যাডামের সাথে কথা বলিনি। উনিও আমার দিকে আর তাকায়নি। উনি অফিসে আসার আগেই আমি কাজের ফাইলগুলো ওনার টেবিলে রেখে আসতাম।
নতুনভাবে জয়েনের পর ওনার দিকে খুব একটা তাকাতাম না। আর আজ এই বৃষ্টির দিনে সেদিনের পর আজ তাসমিম এসে কথা বলছে আমার সাথে।
– ছাতা টা নিয়ে কি ভাবছো? বাসায় যাবে না?
তাসমিমের কথায় স্তম্ভিত ফিরে ওর দিকে তাকালাম। সাদা এ্যাঁশ কালারের বোরখা ওর গায়ে। মাথায় গোলপী ফুলের মত করে কার্ফ দেওয়া। কয়েকটা চুল ওর গালে এসে পড়েছে। ঠোঁটের ডান কোণে ছোট্ট একটি তিল। যা আমাকে ওর প্রতি বহবার আকর্ষীত করে। উপচে পড়া অনুভূতিগুলো বারারর যুদ্ধ করে ওকে দেখার জন্য। আমি একটু মুচকি হেসে বললাম..
– আপনি যাবেন না বাড়িতে?
– হুম, এখনি গাড়ি চলে আসবে।
কথাটা শেষ হতেই দেখি স্যারের গাড়ি সামনে চলে এসেছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে খুব। তাসমিম আমার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট এক হাসি দিয়ে বললো “তাহলে আসি?”
সে দৌড়ে গাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো। আমিও ভদ্রতার হাসি দিয়ে তাকিয়ে রইলাম সে দিকে। তাসমিমের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আমি অফিসের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। গাড়িটা কিছুদুর যাওয়ার পর আমি পায়ের জুতো খুলে, প্যান্ট হাঁটু অবদি গুছিয়ে হাটা শুরু করলাম। বিষন্ন মন, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির ফোট পড়ছে প্রকৃতিতে। জর্জরিত হৃদয় নিয়ে হাঁটছি আমি। ঠিক তখনি খেয়াল করলাম আমার পাশে তাসমিমের গাড়ি এসে থেমেছে। আমি থেমে যায়। অবাকতার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকি গাড়ির দিকে। খেয়াল করলাম তাসমিম আরেকটা ছাতা নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
– কি ব্যাপার ম্যাম, আপনি নামলেন যে?
– ব্যাগুলো দাও।
– কেনো?
– আরে দাও তো। এই যে ফয়েজ আংকেল, এই ব্যাগগুলো ১৯ নাম্বার বাড়িতে রেখে আসবেন। তারপর চলে যাবেন সোজা বাসায় আমি আসছি।
তাসমিমের কথাগুলো শুনে আজ অনেক বেশিই অবাক হচ্ছি। সে আমার বাড়ির ঠিকানাও জানে? এসব হচ্ছে কি? ড্রাইভার ফয়েজ গাড়ি নিয়ে শো শো করে চলে গেল। দুজন মানুষ ছাতা মেলে রাস্তার এক পাশে সন্ধ্যাঘন সময়ে বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছি। কিছু বলতে পারছি না। বুকের ভিতরটা কেমন ঢিপ ঢিপ করছে..
– চলো হাঁটি..
তাসমিম হাঁটছে। আমি ওর পিছনে হাঁটছি। কেমন যেন আজ অন্যরকম লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা হবে। চারপাশে বৃষ্টির সাদা ধোয়ায় বহিভূত করে তুলেছে রাস্তার পাশে থাকা হলদে ল্যামপোষ্টের আলোগুলো।
– এই যে,এত ধীরে হাঁটো কেনো? পিছনেও বা কেনো? পাশে আসো, না থাক, আমিই পাশে আসছি।
তাসমিম আমার পাশে এসে হাঁটছে। আমার কেমন যেন অস্বস্থি বোধ হচ্ছে। এভাবে অফিসের বস আমার সাথে খালি পায়ে বৃষ্টির দিনে হাঁটছে ভাবতেই এক অন্যরকম অনুভূতি জাগছে মনে।
– এই ছাতাটা দাও তো। দাঁড়াও…
তাসমিম ওর ছাতাটা ফেলে দিয়েছে। আমার হাত থেকে ছাতাটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল রাস্তায়। হালকা ঝড়ো হাওয়াতে দুটো ছাতা নিমিষেই অনেকটা দুর পিছনে চলে গেল। আমি কেবল হা হয়ে তাসমিমের দিকে তাকিয়ে আছি। মাথার স্কার্ফ খুলে গলায় ঝুলিয়ে নিল। চুলগুলো পিছনে বাধা। বৃষ্টির প্রকোপ যেন আরো বেশি গভীর হতে থাকে। দুজন মানুষ বৃষ্টিতে ভিজছি।
– ম্যাম, এটা কি করলেন? এখন তো পুরোই ভিজে গেলাম।
– হুমম গেলাম। এটাই তো পারফেক্ট সময়। আমার আংগুলের দিকে তাকাও।
– কি?
– আরে তাকাও তো।
– আংগুল ছাড়া তো কিছুই নেই।
– আরে গাধা, আমার বিয়ের অগ্রীম বিয়ের আংকটিটা নেই চোখে কি দেখছো না?
– হায় হায়.. কোথায় পড়ে গেছে? চলুন খুজি।
– কোথায় পড়েনি। আমি নিজেই ছুড়ে ফেলেছি।
– মানে?
– আসো হাঁটি..
তাশমিমের কাজে আজ সন্ধ্যা থেকে খালি অবাকই হচ্ছি। কি যে করছে আর কি বলছে কিছুই আমার মাথায় আসছে না। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছি আমি ওর দিকে। দুজনে হাঁটছি। ভিজে একদম চুপসে গেছি মনে হয়। হঠাৎ করেই তাসমিম আমার হাত ধরলো। আমি চমকে উঠলাম। ভাবলাম এটা মনের ভুল, কিন্তু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সত্যিই তাসমিম আমার হাত ধরে হাঁটছে।
– আবির সাহেব, তোমাকে আজ অনেক কিছু বলার আছে।
– জ্বি।
– হয়ত তুমি তা কখনো আশাও করোনি আমি এখন যা বলবো।
– জ্বি।
– তুমি কি প্রস্তুত তা শোনার জন্য?
– জ্বি..
– কি জ্বি জ্বি করছো.. চুপচাপ শোনো..
আমি কাঁপছি, শীতে নয় তাসমিম আমার হাত ধরেছে বলে কেমন এক উষ্ণতা বয়ে যাচ্ছে আমার চিকন শরীরে তার জন্যই বারবার কেঁপে উঠছি আমি। কি বলবে সে তা শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম।
– শোনো, আবির আমি এত তোমার মত করে গুছিয়ে প্রপোজ করতে পারি না। সারাক্ষন যে আমাকে নিয়ে ফেসবুকে গল্প লেখো আর সেই গল্পে আমাকে এত গুছিয়ে প্রপোজ করো ওটা কিন্তু আমি পারবো না। আমি সরাসরি বলছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি। কি শুনতে কেমন যেন লাগছে তাই না? তাসমিম যা বললো তা আমার কান যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি থেমে যায়। তাসমিম আমার হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমি ওর দিকে তাকাতেই ও মাথাটা নিচু করে নিল। আমি জোরে হাসতে যাবো তখনি তাসমিম বললো..
– যদি তুমি আমার থেকে দুরুত্ব চাও, তবে আমি তোমাকে দুর থেকেই তোমাকে চাই। আমি সবসময় চেয়েছি, এমন একজন আসুক যে আমাকে বেলাশেষে আপন নিঃশ্বাসে জড়িয়ে রাখবে। আমার একলা থাকার সঙ্গী হবে। মুঠোফোনের ভালোবাসি শব্দটা যখন উপেক্ষা করে লাইন কেটে দেবো, তখন সে সামনে এসে ভালোবাসি, ভালোবাসি বলে পাগল করে তুলবে।
আমার সেই মানুষটার প্রতি হাজারাা স্বপ্ন ও ভাবনা রয়েছে। আমি কখনই চাইতাম না কাউকে না চিনে ভালোবাসবো বা বিয়ে করবো। কিন্তু হুট করে আব্বুই বিয়ের পাত্র দেখে নিয়েছে। যখন ছেলেটা আমার হাতে আংটি পরাচ্ছিল তুমি তখন রাগ করেই চলে এসেছিলে। আমি তোমার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। কারন আমি আগে থেকেই জানতাম তুমি আমাকে ভালোবাসো। রোজ অফিসে আমাকে তুমি লুকিয়ে দেখতে,তাকিয়ে থাকতে অনেকটা সময়। সবকিছুই আমি জানি।
বিয়ের আংটি খুলে ফেলেছি। বাড়িকে জানিয়ে দিয়েছি “আমি ঐ ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি কেউ একজনকে ভালোবাসি।” আর সেই একজনটা হলে তুমি। আবির আমি তোমাকে ভালোবাসি। জানিনা কবে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি তবে এটা জানি তোমাকে আমার চাই- চাই। তুমি কি আমাকে এখনো সেই আগের মত ভালোবাসো? আমি কিছু বললাম না। হা হয়ে তাসমিমের কথাগুলো শুনছিলাম আমি। ওর দিকে একটু তাকিয়ে আমি পকেটে হাত গুজে হাঁটা শুরু করলাম। তাসমিম দৌড়ে এসে আমার হাতের মধ্যে হাত গুজে হাঁটতে শুরু করেছে। আমি থেমে গেলাম। তাসমিম আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ল্যামপোষ্টে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো ও। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম..
– আমি সবসময় চাইতাম এমন একজন আসুক যে আমার সাথে কারনে অকারনে ঝগড়া করবে, ঝগড়ার এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়েই আমার বুকে মাথা রাখবে আর প্রতিনিয়ত আমার প্রেমে পড়বে। এই এলোমেলো আমাকেই ভালোবাসবে আর বলবে, “তুমি এমনি অগোছালো থেকো সমস্যা নেই, আমিই তোমাকে গুছিয়ে নেবো।”।
তাসমিম কিছু বললে না। বৃষ্টির ছিটে ওর মুখে এসে পড়লো। কেনো যেনো মনে হচ্ছে ও কাঁপছে। শীতে নাকি আমার মত ব্যাখাহীন অনুভুতিতে? সে যেভাবেই কাঁপুক। আমার মনে হয় তাকে জড়িয়ে ধরা দরকার। আর সেটা শক্ত করেই। ভাবনাগুলো বাস্তবে প্রকোপ করার আগেই তাসমিম আমাকে জড়িয়ে ধরল। তাও শক্ত করে। বুকের মাঝে সে ঝাপটে আছে। বিশাল আকাশ হতে সমগুণে বৃষ্টির ক্রোন্দন আমাদেরকে ভিজিয়ে দিলেও ভালোবাসার বৃষ্টিতে আজ না হয় দুজন বৃষ্টিবিলাস করি। দুজন হাঁটছি, আমার হাত শক্ত করে জড়িয়ে তাসমিম আমার কাধে মাথা রেখে হাঁটছে। সামনেই ওদের বড় বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। বাড়ির সামনে আসলাম..
– তোমাদের বাড়ির সামনে এসে গেছি। (আমি)
– হুমম।
– যাও এবার?
– কোথায়?
– তোমাদের বাড়িতে।
– ওহ।
তাসমিম আমাকে ছেড়ে দিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। আমি বোকার মত তাকিয়ে রইলাম। কি মেয়েরে বাবা, দুটো কথাও না বলে চলে গেল? ধুর আমি ঘুরে হাঁটা ধরবো তখনি খেয়াল করি কে যেন আমার কাধে হাত রেখেছে। আমি ঘুরে তাকাতেই তাসমিম ধুম করে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে দৌড়ে আমার বাড়ির মধ্যে চলে গেল। আমি এবার হাবার মতই তাকিয়ে আছি। কেবল মনে হতে লাগল পৃথিবী এত সুন্দর কেনো?