“বাবা, আমার একজনকে খুব ভালো লেগেছে৷ আমি তাকে বিয়ে করতে চাই”- বলতে বলতে বাবার পায়ের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসল বিথী ৷ আফসার উদ্দিন সাহেব তখন রবীন্দ্রনাথের “নৌকাডুবি”তে ডুবে রয়েছেন ৷ বিথী বাবার পা ধরে ঝাঁকুনি দিল ৷
– বাবা!
– হ্যাঁরে মা! একদম ক্লাইম্যাক্সের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম ৷ যেইভাবে নলীনাক্ষ ডাক্তারের সঙ্গে কমলার দেখা হচ্ছে… ৷
– বাবা! আমি তোমাকে একটা কথা বললাম, তুমি শুনলেই না ৷
আফসার উদ্দিন সাহেব বইটা নামিয়ে রেখে বললেন- আচ্ছা এখন বল ৷
– বলেছি যে, আমার একজনকে খুব পছন্দ হয়েছে ৷
– আচ্ছা! তো কে সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি শুনি যাকে আমার মা পছন্দ করেছে ?
– আমি নাম তো জানিনা,
তবে কলেজ যাওয়ার পথে কয়েকদিন দেখেছি ৷ জব করে মনে হচ্ছে ৷ আজ কি হলো জানো, আমি বাসের জন্য অপেক্ষা করছি, তখনই একটা বাইক এসে একজন বৃদ্ধা ভিক্ষুককে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিল ৷ মহিলা চিৎকার করে সাহায্য চাইলেন, ওইখানে অনেক মানুষ থাকা সত্ত্বেও কেউ গেল না ৷ শুধু ওই ছেলেটা গেল ৷ আমার এটা দেখে অনেক ভালো লেগেছে বাবা ৷ আমি তাকে বিয়ে করতে চাই ৷ আফসার উদ্দিন বললেন, হুম ৷ করতে পারিস ৷ তবে একজন বৃদ্ধা ভিক্ষুককে সাহায্য করেছে বলে কাউকে বিয়ে করা ফেলা উচিত হবে না মনে হয় ৷ আরেকটু চিনতে হবে তাকে, তারপর বিয়ে কর ৷ বিথী একটু হাসল ৷
– বাবা, তুমি কফি খাবে ?
– হুম, দিতে পারিস ৷
আচ্ছা- বলে বিথী চলে গেল ৷ আফসার উদ্দিন বই হাতে নিয়ে পড়তে পারলেন না ৷ ভাবতে লাগলেন ৷ মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, আচরণ এখনও ঠিক বাচ্চাদের মতো ৷ পাঁচ বছর বয়সী বিথী যেমন রাস্তার পাশের দোকানে রং পেন্সিলের বক্স দেখে বাবার কাছে বায়না ধরেছিল, আজ একুশবর্ষীয়া বিথী ঠিক তেমন করেই বিয়ে করবার বায়না ধরেছে ৷ আফসার উদ্দিনের বুক থেকে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ৷ সাত বছরের প্রেমের পর যেদিন প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেল, আফসার উদ্দিন প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি জীবনে কোনোদিন বিয়ে করবেন না ৷ সেদিন উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে ছোট্ট বিথীকে পেয়েছিলেন ৷ সন্ধ্যার আলো আঁধারীতে ঝোপের মধ্যে পড়ে থাকা সাদা তোয়ালে প্যাঁচানো শিশুটিকে দেবশিশুর মতো লাগছিল তার কাছে ৷ তিনি কোলে তুলে নিলেন ৷ চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে ৷
গায়ে এখনো রক্ত লেগে আছে, সদ্যোজাত শিশু ৷ তিনি আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না ৷ কি এক অদ্ভুত টানে বাচ্চাটাকে নিজের বাসায় নিয়ে আসলেন ৷ নাম রাখলেন ‘ছায়াবিথী’ ৷ তিনি যত সহজে বাচ্চাটাকে বাসায় নিয়ে আসলেন, তার বাবা-মা তত সহজে মেনে নিল না ৷ তাদেরকে মানাতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছিল আফসার উদ্দিনকে ৷ সেসব বহু আগের কথা, তারপর তার বাবা-মা বিথীকে জান-প্রাণ উজাড় করে ভালোও বেসেছেন ৷ আফসার উদ্দিন মেয়েকে কোনোদিন এসব জানতে দেননি, দেবেনও না ৷ কিছু সত্য জানার চেয়ে না জানা ভালো ৷ তার সেই সেদিনের ছোট মেয়ে আজ কত বড় হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে ৷
– বাবা, তোমার কফি ৷
আফসার উদ্দিন সম্বিত ফিরে পেয়ে কফি নিলেন ৷ এক চুমুক দিয়ে বললেন, তুই যে আজকেও আমার কফিতে চিনি কম দিলি ? বিথী চোখ পাকিয়ে বলল, তোমার স্যুগার লেভেল কত হাই হয়েছে সেই খবর আছে তোমার?
– হোক না ৷ আর কতদিন বাঁচব? অনেকদিন তো বাঁচলাম, এবার একটু ভালো করে খেয়ে দেয়ে মরে যাই ৷
– তুমি এসমস্ত কথা আমাকে বলবে না ৷ আমার খুব কষ্ট হয় বাবা ৷
– আচ্ছা আর বলব না ৷ তুই আমার পাশে একটু বোস ৷
– আচ্ছা বসলাম ৷
– মনে আছে তুই যখন এইটুকুন ছিলি,
আমার একবার চিকেন পক্স হয়েছিল ? তোর দাদু তোকে আমার কাছে আসতেই দিতো না, তোরও হবে এই ভয়ে ৷ ছোট্ট তুই কান্নাকাটি করে ঘর ভাসিয়ে ফেলেছিলি ৷ তারপর মা যখন তোকে আসতে দিল, তুই এসে আমার গায়ের উপর সে কি গড়াগড়ি দিলি – ফুসকুড়ি গুলো ফেটে পানি বের হয়ে তোর গায়ে লাগল ৷আমি যত সরিয়ে দেই, তুই আরো গায়ের সাথে লেগে থাকিস ৷তার একদিন পর দেখি তোরও চিকেন পক্স ৷ বাপ-মেয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছি আর তোর দাদু গালি দিতে দিতে দু’জনের গায়ে হলুদ-নিম পাতা বাটা লাগিয়ে দিচ্ছে ৷ তুই আর আমি হেসেই কুটিকুটি ৷
– হুম বাবা ৷ দাদু এই ঘটনাটা আমাকে প্রায়ই বলতো ৷ দাদু-দাদাকে খুব মনে পড়ে বাবা ৷
– সবাইকে একদিন চলে যেতে হয় গো মা ৷ তুই-আমিও চলে যাব ৷
– তুমি গোসল করবে না বাবা?
– হুঁ করব তো ৷
– আচ্ছা আমি গিজার ছেড়ে গেলাম ৷ তুমি গোসল সেরে নাও৷
কফির মগ নিয়ে বিথী চলে গেল ৷ বিথী নিজের বিছানায় এসে বসল ৷ ছেলেটার নাম কি হতে পারে ? আজ ভার্সিটি অফ ছিল বলে বিথী বাইরে যায়নি ৷ কাল বের হলে কি ছেলেটাকে দেখবে? বিথী নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল ৷ এসির টেম্পারেচারটা আরেকটু লো করে দিয়ে বিথী ভাবছে- কোনো এক ভ্যাপসা গরম পড়া দুপুরে ছেলেটা অফিস থেকে বাসায় আসবে ৷ বিথী দরজা খুলে দিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলবে, মশাইয়ের আজ এত দেরি হল যে? ছেলেটা তার কোমর জাপটে ধরে বলবে, দেরি না করলেও একজনের রাগী রাগী চেহারায় ‘দেরি করলে কেন’ প্রশ্নটা শুনতে ৷
বিথী হেসে ফেলবে ৷ টাইয়ের নট খুলে দিয়ে বলবে, ফ্রেশ হও তাড়াতাড়ি ৷ ছেলেটা হেসে রুমের দিকে যাবে ৷ বিথী একটুকরো লেবু চিপে একগ্লাস পানিতে দেড় চামচ চিনি আর তিন টুকরো বরফ কুচি ছেড়ে দিয়ে ছেলেটার জন্য বসে থাকবে ৷ ছেলেটা গোসল সেরে মাথা মুছতে মুছতে সরবতটুকু খুব তৃপ্তি নিয়ে খাবে আর বিথীকে বলবে, বিথী! তোমার হাতের এই সরবতটুকু খেয়ে মরে যাওয়া যাবে ৷ ঠিক যেমনটা বাবা বলে ৷ বিথী লজ্জা লজ্জা চোখে তাকিয়ে দেখবে তার স্বামীকে ৷ বিথীর গালের দুপাশ আর নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে ৷ সে আর ভাবতে পারল না ৷ ইশ! এই সময় গুলো কবে যে আসবে ৷
সকালে বিথী বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আফসার উদ্দিন বের হলেন ৷ গত কয়েকদিন ধরে তিনি লোক লাগিয়ে ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন ৷ ছেলেটার নাম ‘রাজীব হোসাইন’ ৷ একটা প্রাইভেট কোম্পানির জুনিয়র এক্সিকিউটিভ ৷ ছেলেটার স্বভাব চরিত্র খুবই ভালো ৷ কিন্তু সমস্যা হল ছেলেটার কেউ নেই ৷ মা-বা দীর্ঘদিন আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ৷ ছেলে কাছেই একটা বাসা ভাড়া করে থাকে ৷ এখন অফিস টাইম ৷ আফসার উদ্দিন সাহেব ছেলেটার অফিসের উদ্দেশ্যেই রওনা দিলেন ৷ ছোটখাটো একটা কোম্পানি ৷ সবে দুই বছর হলো খুলেছে ৷ আফসার উদ্দিন তার লোক দিয়ে সংগ্রহ করা ছবি দেখে দেখে ছেলেটাকে খুঁজে বের করলেন ৷ অফিসে ছেলেটাকে দেখে বেশ চমৎকৃত হলেন তিনি ৷ ছবির সাথে বাস্তবের তেমন মিল নেই ৷ আফসার উদ্দিন ‘প্রথমে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী’ নীতিতে বিশ্বাসী নন, তবুও প্রথম দেখায়ই ছেলেটাকে তার ভালো লাগল ৷
গৌর বর্ণের ছ’ফুট লম্বা ছেলেটার চেহারা বেশ মায়াবী ৷ সুপ্রসন্ন কপাল আর মুখে এক চিলতে হাসি লেগেই রয়েছে ৷ আফসার উদ্দিনের বেশ ভালো লাগল ৷ তিনি দূর থেকে ছেলেটাকে দেখলেন, তারপর হাঁটা শুরু করলেন কোম্পানির এমডির রুমের দিকে ৷ সামনে বসা দারোয়ান আটকালো, বলল ‘কে আপনে ?এহন দ্যাহা করন যাইব না৷ স্যার ব্যস্ত আছেন ৷’ তিনি বললেন, তোমার স্যারকে গিয়ে বলো ‘সিবি এন্টারপ্রাইজের আফসার উদ্দিন’ এসেছে ৷ তাহলেই হবে ৷ দারোয়ান অবিশ্বাসী ভঙ্গীতে কপাল কুঁচকে এমডির রুমে ঢুকল আর প্রায় সাথে সাথে এমডি বেরিয়ে এল ৷ এসেই আফসার উদ্দিনকে সালাম দিয়ে বলল, স্যার আপনি এখানে ? আমাকে ডাকতেন, আমিই চলে যেতাম ৷
তারপর দারোয়ানকে বকতে শুরু করলেন ৷ আফসার উদ্দিন মনে মনে বিরক্ত হলেন ৷ অঢেল টাকা আর বড় ব্যবসা থাকলে তাকে সবাই চিনবে- এটা রীতি হয়ে গেছে ৷ এই কোম্পানির এমডিকে তিনি জীবনেও দেখেননি, চেনেনও না ৷ এই শহরে তার টাকা আর ব্যবসা দুটোই আছে বলে এখানকার এমডি তাকে চিনতেই পারে, দারোয়ান তো আর চিনবে না ৷ আদার ব্যাপারী জাহাজের খোঁজ না রাখলে সেটা তো তার দোষ না, বরং এটাই স্বাভাবিক ৷ আফসার উদ্দিন গলা খাঁকারী দিয়ে বললেন, একটু দরকার ছিল মিস্টার …
– আশিক ৷ আমার নাম আশিক, স্যার ৷ রুমে চলুন স্যার ৷
দারোয়ানকে আরো দুটো ঝাড়ি দিয়ে আশিক সাহেব আফসার উদ্দিনকে নিয়ে রুমে বসালেন ৷ কি খাওয়াবেন সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন৷ ৷ আফসার উদ্দিন বললেন, আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না প্লিজ ৷ আমি এখানে খেতে আসিনি৷
– সেটা তো অবশ্যই স্যার ৷ তবুও ….
– আচ্ছা, আপনার এখানে ‘রাজীব হোসাইন’ নামে একজন জুনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার আছে ৷ তার সম্পর্কে একটু জানাশোনা করতে আসলাম ৷
– অবশ্যই স্যার ৷ কি কি জানতে চান বলুন ?
আফসার উদ্দিন তার প্রশ্ন করলেন, আশিক সাহেব তার তীব্র কৌতুহল চেপে রেখে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন ৷ তিনি এই ছোট্ট একটা কোম্পানির এমডি, শহরের সেরা ধনীদের একজন তার কাছ থেকে কিছু জানতে চেয়েছে- তাতেই তিনি ধন্য হয়ে গেলেন ৷ আর তিনি এটা খুব ভালো করেই জানেন যে, বড়লোকরা শুধু প্রশ্ন করতেই পছন্দ করে, উত্তর দিতে নয় ৷
আফসার উদ্দিন সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরলেন ৷ ছেলেটার মোটামুটি নাড়ি নক্ষত্র জানা শেষ ৷ বেশ মেধাবী একটা ছেলে, অল্পদিনের মধ্যে অফিসে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে ৷ ভবিষ্যতে আরো অনেক ভালো কিছু করবে ৷ ছেলেটার দিক তো পরিষ্কার হল ৷ এইবার বিথীর দিকটাও একটু দেখতে হবে ৷ এই বয়সী মেয়েরা হুট করে প্রেমে পড়ে আবার হুট করে অপছন্দ করে ফেলে ৷ দেখা যাক কি হয় ৷ আফসার উদ্দিন অপেক্ষা করতে লাগলেন ৷ বিথী প্রায় বিশদিন পর ঐ একই জায়গায় ছেলেটাকে দেখতে পেল ৷ সাথে সাথে সে দৌঁড়ে গেল ৷ বলল, এই যে! অফিস থেকে দুপুর বেলা তাড়াতাড়ি না আসলে কিন্তু আপনার খবর আছে বলে দিলাম ৷ আমি কত অপেক্ষা করে থাকি ৷ রাজীব হতভম্ব হয়ে গেল ৷ বলল, কে আপনি? এসব কি বলছেন ? বিথী জিহ্বায় কামড় দিল ৷ কি বলে ফেলেছে সে ৷ কল্পনার সাথে বাস্তব গুলিয়ে ফেলেছে ৷
– আমি আমি ছায়াবিথী ৷ আমি দুঃখিত ৷ আসলে আপনার জন্য বিশদিন ধরে এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, আপনার দেখা নেই ৷ আজ আপনাকে দেখে মাথা গুলিয়ে গেল আর কল্পনা বাস্তব একত্র করে ফেলেছি ৷ মাফ করবেন ৷
– আচ্ছা! স্যরি, কল্পনা-বাস্তবের ব্যাপারটা বুঝলাম না ৷
– আসলে আসলে আমি আপনাকে অনেক পছন্দ করে ফেলেছি ৷ আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই ৷ আপনি রাজি আছেন ? এবার রাজীবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ৷ ধমকে বলল, পাগল নাকি আপনি ? দেখে তো ভদ্র ঘরের মেয়েই মনে হচ্ছে ৷ এভাবে রাস্তায় রাস্তায় মানুষকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বেড়ান নাকি ? যত্তসব পাগল ছাগলের পাল্লায় পড়লাম ৷ বিথীর চোখ দিয়ে পানি পড়ে গেল ৷ গলা ধরে এল, মুখ দিয়ে আর একটা শব্দও বের হল না ৷ এভাবে কথা শুনবে সে বুঝতেই পারেনি ৷ এখন প্রচণ্ড খারাপ লাগছে ৷
– এভাবে ন্যাকা কাঁদবেন না ৷ আর আপনাকে যেন আমার সামনে কোনোদিন না দেখি ৷ যত্তসব আজাইরা ৷
রাজীব হেঁটে চলে গেল ৷ বিথী স্থানুর মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দৌঁড়ে বাসায় চলে আসল ৷ রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ৷ আফসার উদ্দিন শঙ্কিত হয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন ৷ বিথী বলল, বাবা, আমি কিছুক্ষণ পর দরজা খুলব ৷ আমার এখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ৷ তুমি ভয় পেয়ো না ৷ আমি উল্টা-পাল্টা কিছু করব না ৷
– আচ্ছা গো মা ৷
আফসার উদ্দিন চিন্তিত হয়ে স্টাডিতে গিয়ে বসলেন ৷ কি এমন হয়ে গেল হঠাৎ যে, মেয়েটা দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করছে ৷ তিনি ছাড়া মেয়েটার কোনো বন্ধুও নেই ৷ আফসার উদ্দিন লোক দেখানো বিলাসিতা পছন্দ করেন না ৷ মেয়েকে তাই সরকারি স্কুল,কলেজে পড়িয়েছেন ৷ বিথী এত ধনীর মেয়ে বলে তেমন কেউই ওর সাথে মিশতে চাইতো না ৷ বিথীও ধীরে ধীরে ইন্ট্রোভার্ট হয়ে গেছে, বাবাই তার পৃথিবী ৷ আফসার উদ্দিনের মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, তিনিই বিথীকে দেখে শুনে রাখতেন ৷ তিনি মারা যাওয়ার পর আফসার উদ্দিনের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল ৷ একই সাথে মা আর বাবা দুটোই হতে হল, সেই সঙ্গে বন্ধুও ৷ মেয়ের এমন কোনো কথা নেই যেটা বাবা জানেন না ৷ আফসার উদ্দিনের স্পষ্ট মনে আছে- বিথীর যেদিন প্রথম ম্যানুস্ট্রুয়েশন হল, বাবার কাছে এসে সেকি কান্না ৷
– বাবা, আমার মনে প্রস্রাবের রাস্তা কেটে গেছে ৷ কেমন রক্ত বের হচ্ছে ৷ আর পেটে কি ব্যথা ৷ আমি মনে হয় মরে যাব বাবা ৷ আফসার উদ্দিন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ৷ মেয়ের কষ্ট হচ্ছে দেখে তিনিও কেঁদে ফেললেন ৷ এসময় একজন মা মেয়ের পাশে থাকেন, আফসার উদ্দিন বাবা হয়ে কতটা কি করবেন বুঝতে পারলেন না ৷ মেয়েকে গোসল করতে পাঠিয়ে তিনি নিজে গিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে আনলেন ৷ তারপর সাহস সঞ্চয় করে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিলেন ৷ মেয়েকে ডেকে প্রথমে স্যানিটারী ন্যাপকিন পরার সিস্টেম বুঝিয়ে পরে নিতে বললেন ৷ তারপর বয়ঃসন্ধিকাল, ম্যানুস্ট্রুয়াল সাইকেল নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করলেন ৷ বিথী ভয় পেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল ৷
– তারমানে বাবা, প্রত্যেক মাসে আমার এমন কষ্ট হবে ?
– হ্যাঁ গো মা ৷ কষ্ট তো একটু হবেই ৷ আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে ৷ এটা খুব স্বাভাবিক মা ৷ এটা যদি না হয়, তাহলেই অস্বাভাবিক ৷ বিথী আর প্রশ্ন করল না ৷ আশ্বস্ত হয়ে ঘুমাতে গেল ৷ আফসার উদ্দিন স্মৃতির রোমন্থন করছিলেন ৷ এর মধ্যে বিথী এসে বাবার কোলে মাথা রেখে ফ্লোরেই বসে পড়ল ৷ আফসার উদ্দিন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন ৷ কান্নার দমকে বিথীর হেঁচকি উঠে গেছে ৷
– বাবা, আমি কি খারাপ ? আমি কি খুব খারাপ দেখতে ?
– না গো মা ৷ আমার মেয়ের মতো এমন ভালো দেখতে আর এতো লক্ষ্মী মেয়ে পৃথিবীতে নেই ৷
– বাবা, তাহলে ওই ছেলেটা আমাকে এইভাবে বলল কেন ? আমাকে এত বকল কেন ?
– ওই যে রাস্তায় দেখা ছেলেটা ?
– হ্যাঁ বাবা ৷ ও আমাকে খুব বকেছে আজকে ৷ ও আমাকে পছন্দ করেনি বাবা ৷ ও আমাকে বিয়ে করবে না ৷
বিথী ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল ৷ আফসার উদ্দিন কি বলবেন কিছুই বুঝতে পারলেন না ৷ মেয়ের কান্নায় তারও কান্না পেয়ে গেল ৷ রুপকথায় যেমন কৌটোর মধ্যে রাক্ষসের প্রাণ থাকে, আফসার উদ্দিনের প্রাণটাও যেন বিথীর মধ্যে ৷
বিথী হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার আজকে এত খারাপ লাগছে বাবা ৷ আমি আজ কিছু খাব না ৷ তারপর নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল ৷ আফসার উদ্দিন নিজেও সারাদিনে কিছু খেলেন না ৷ পাঁচবার মেয়ের রুমের বন্ধ দরজার সামনে থেকে চুপচাপ ফিরে এসে গুম হয়ে বসে থাকলেন ৷
রাত সাড়ে বারোটা ৷ রাজীব একটু পড়তে বসেছে ৷ এমবিএ তে ভর্তি হয়েছে কিছুদিন আগে, সেটার পড়াই পড়ছে ৷ হঠাৎ দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল ৷ রাজীব অবাক হল, এতরাতে কে আসবে তার কাছে ! দরজা খুলে দেখল, একজন সৌম্য দর্শন মধ্যবয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছে ৷ চোখে-মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ ৷ রাজীব বলল, কে আপনি ? এতরাতে আমার কাছে কেন ? আফসার উদ্দিন রাজীবের হাত ধরে কেঁদে ফেললেন ৷ বললেন, আমাকে তুমি চিনবে না বাবা ৷ আমার মেয়েটা তোমাকে খুব পছন্দ করে ৷ তুমি সকালে বকেছো বলে সে সারাদিনে কিছু খায়নি ৷ তুমি গেলে হয়তো খাবে ৷ তুমি কি একবার আমার বাসায় আসবে বাবা ?