একটি সুন্দর মুহুর্ত

একটি সুন্দর মুহুর্ত

এই নিয়ে আজ দুইবার রিফাত আমাকে সবার সামনে কথা শোনালো পারিবারিক একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো,আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর দেবর রিফাত ওদের পাশে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলো। আমি সবার জন্য বিকেলের নাস্তা তৈরী করে নিয়ে এসে এক কোণায় বসলাম…

আমি এমনিতেই শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক আলাপে কখনোই নাক গলায় না।কারণ,আমার মনে হয়,পারিবারিক বিষয়ের আলোচনা গুলো বেশ জটিল হয়।তারপর আমি মাত্র কয়টা দিন বউ হয়ে এসেছি।বেশির ভাগ ব্যাপারই আমার অজানা।না জেনে আমি যদি হুট করে কিছু বলে বসি,তবে সেটা বেমানান হবে।তাই এরকম সিচুয়েশনে পড়লে,হয় কোন কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই।না হয় আমি চুপচাপ বসে থাকি।।আজকের টপিক কি বুঝতেছিনা।কিন্তু সবার চেহারার গাম্ভীর্য দেখে মনে হচ্ছিলো,বেশ জটিল ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে।আমি সবার সামনে নাস্তা এগিয়ে দিয়েও,কাউকে খাওয়ার কথা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না।তবুও ভয়ে ভয়ে আব্বার সামনে প্লেট এগিয়ে খেতে বললাম।।

আব্বা খেতেও লাগলো..এর মাঝে হুট করে মা আব্বার উপর কেমন জানি রাগ করে উঠলো।আব্বাও রাগ করে উঠলো।মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশ একেবারে গরম হয়ে গেলো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম।আব্বা মায়ের সাথে কেমন জানি রাগ করে উঠলো।আমার মোটেও সহ্য হল না। আমি আস্তে গলায় আব্বাকে বলে উঠলাম— “আব্বা,মাথা ঠাণ্ডা করেন মায়ের সাথে এভাবে কথা বলবেন না,দয়া করে…”

আমি এই কথা বলার সাথে সাথে সবাই কেমন জানি এক যোগে আমার দিকে বিস্ময় চোখে তাকালো। আমিও হা করে তাকিয়ে থাকতেই রিফাত খবরের কাগজটা নামিয়ে আমাকে ধমকের সুরে বলে উঠলো— “তুমি যা বোঝ না,তা নিয়ে মোটেও কথা বলবে না..” আমি চমকে উঠলাম ওর মুখে কড়া গলার এই কথা শুনে।সাথে কেমন জানি লজ্জায় শিউরে উঠলো,পুরো শরীর।আমি মাথা নিচু করে ফেললাম সাথে সাথে।কারো দিকে তাকাতে পারবো না আমি।সবার সামনে ও এভাবে আমাকে বললো কেন?অভিমান আর আর লজ্জায় আমার চোখের কোণে পানি জমে আসলো।

কিন্তু কিছুতেই কান্না করা যাবে না। সবাই দেখে ফেলবে,বুঝে ফেলবে। অনেক কষ্টে,নিজেকে চেপে রেখে আমি গলা টেনে জোর করে হাসি কণ্ঠে বললাম– “ওহ হো..আমি চুলায় পানি গরম দিয়ে আসিনি তো বলেই আমি কারো উত্তরের অপেক্ষা না করেই আস্তে করে উঠে দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে পালিয়ে গেলাম চোখ দিয়ে পানি পড়বে পড়বে ভাব।আমি কোন রকমে চুলায় পানি গরম করতে দিয়েই এক দৌড়ে আমাদের ঘরে গেলাম।। গিয়েই আমি যেন হাফ ছেড়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম।খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার।অথচ আমি তো কোন অন্যায় কথা বলিনি। তবুও রিফাত সবার সামনে নিজের কাছে খুব ছোট লাগছিলো।

আমি বিছানায় শুয়ে কাঁদছি। কিছুক্ষণ পরে রিফাত এলো ঘরে। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে আমি সাথে সাথে চোখের পানি মুছে ফেললাম।না বুঝেই যে আমাকে কষ্ট দিলো,তাকে চোখের পানি দেখিয়ে লাভ নেই।এই অভিমানে আমি কান্না থামিয়ে দিলাম জোর করে।রিফাত আমার পাশে এসে বসলো।ও হয়তো কিছু খেয়াল করছিলো।পাত্তা দিচ্ছিলাম না অভিমানে।আমি বিছানা থেকে নামতে গেলাম।রিফাত আমার হাত ধরলো।।

আমি কিছু বলার আগেই আমাদের ঘরে মা আসলো হুট করে।আমি সাথে সাথে হাত সরিয়ে দিয়ে মাথায় কাপড় টেনে মাকে এসে বসতে বললাম।মা আমার মুখের দিকে তাকালো।আমি লজ্জায় মুখ নিচে করে থাকলাম।মা আমাকে কোন কিছু না বলে,কড়া গলায় সরাসরি রিফাতকে বললো—- “রিফাত,আজ যা করলি করলি।এর পরে কোন দিন যদি আমি তোকে দেখেছি আমার বউমার উপরে একটা কড়া গলায় কথা বলতে।তবে আমি সেদিন সবার সামনে তোকে ঝাঁটা দিয়ে পেটাবো…” মায়ের এমন কথায় আমি খুব বেশি অবাক হলাম।হুট করেই আমি মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখি,মা রিফাতের কান টেনে ধরে আছে। আমি কেমন জানি একটু খুশি হলা।।রিফাত আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। মা ওর কানে একটু মোচড় দিয়ে বলে উঠলো— “মেয়ে,মায়ের পক্ষে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। তুই নিজে যেটা বুঝিস না,সেটা নিয়ে মোটেও কথা বলবি না সবার সামনে…”

বিষয়টা আমার মনের ভেতর অন্যরকম একটা শান্তির অনুভুতি জাগালো।চোখের সামনে মনে হলো,আমার মা যেন আমার কষ্ট বুঝতে পেরে তার আরেক সন্তানকে শাসন করছে..আমার চোখে খুশির পানি চলে এলো।কোন কিছু না ভেবেই,আমি মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম ভালোবেসে আর জয়ী কণ্ঠে মাকে আল্হাদ আবদার করে বললাম– “মা,আরো জোরে টেনে দিন ওর কান…” মা এক হাত দিয়ে আমার মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে আরেক হাত দিয়ে বোধ হয়,সত্যি সত্যি ওর কানটা জোরে মুড়ে ধরলো।।রিফাত কাতর কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো– “আ…মা….কান টা ছাড়ো না।ব্যাথা পাচ্ছি তো…”

মা সাথে সাথে ছেড়ে দিলো।ওদিকে থেকে বাবার ডাক পেয়ে মা জলদি করে বের হলো আমাদের ঘর থেকে।আমার অভিমান,কষ্ট গুলো মা যেন গায়েব করে দিয়ে গেলো।রিফাতের কান টা লাল হয়ে আছে।আমার দিকে তাকাচ্ছে না।মুখটা ভারী করে আছে।আমি হাসিমুখ করে,ওর পাশে গিয়ে বসে আস্তে আস্তে ওকে বললাম– “আমার কোন ভুল হলে তুমি আমাকে শাসন করতেই পারো।কিন্তু সেটা এই চার দেয়ালের মাঝে।আর বিনা অপরাধে সবার সামনে যদি আমাকে কথা শোনাও আমার ভীষণ কষ্ট লাগে..মনে হয় তুমি ইচ্ছে করে আমার কলিজায় আঁচড় দিয়েছো। তুমি এর আগেও একদিন এমন করেছো।এগুলো করলে,স্ত্রীর সম্মানে আঘাত আসে।যেটা আমি বুঝতে পারি বলেই,আব্বাকে আমার অধিকার থেকে মায়ের সাথে চেঁচিয়ে কথা বলতে না করেছিলাম..”

রিফাত আমার কথা শুনে ধীরে ধীরে ওর মুখ উঁচু করলো।ওর চোখে মুখে অনুতাপের ছাপ।বিবর্ণ লাগছিলো মুখের রঙ।ওকে দেখে মায়া লাগলো ভীষণ।আমি তাকিয়েই আছি ওর দিকে,ও নরম গলায় আস্তে করে বলে উঠলো–
“আমার ভুল হয়েছিলো,নিশু। আমি এখন বুঝতে পারছি।” এটুকু বলেই আমি কিছু বলার আগে রিফাত ওর দুইহাত দিয়ে কান টেনে ধরে আমাকে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো– “আর এমন হবে না,শ্বাশুড়ির বউমা। সরি আমি ওর সরল বোঝাপড়া দেখে ফিক করে হেসে উঠলাম।তারপর ওর মুখের দিকে মায়া ভরে তাকিয়ে থেকে একটু ঢং করে ওর কানটা আস্তে করে টেনে বলে উঠলাম– “মনে থাকে যেন,মায়ের ছেলে….।হুম…”

তারপর দুজন মিলে হেসে উঠলাম একে অপরের প্রতি ভালোবাসার চাহনী নিয়ে।একটু আগে যে সময়টা কষ্টের আঁধার নিয়ে এসেছিলো আমার বুকে।।সেই সময় টাতে একটু ভালোবাসার অবদানে হুট করেই একটি সুন্দর মুহুর্তে পরিণত হয়ে গেলো…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত