এইটা তোমার গল্প কিংবা আমার

এইটা তোমার গল্প কিংবা আমার

– তুমি এখানে?

– আমি তো এখানেই থাকি। প্রায় মাসখানেক হল। তুমি এখানে?

– সপ্তাহখানেক হল দেশে এসেছি।

বাক্যটা শেষ হতে না হতেই চট করে হাত ছুঁয়ে বলি।

– একটু বাসায় ঘুরে যাও, দেখাই যখন হল।

একটা পুরানো বিদ্যুৎ আর কিছু স্মৃতি যেন ঝলকে উঠল। আর স্মৃতিগুলো মাতাল ডুবুরি হয়ে সাঁতরে চলে গেল অন্য এক সময়ে।

বাতাসে তখন ছিল মৌঘ্রাণ। তুমি-আমি পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। এ বাড়ির বারান্দা দিয়ে ও বাড়ির দোতলার ঘর খুব ভাল করে দেখা যেত।

আমাদের ছিল লাল দেয়ালের বাড়ি। আর তোমাদের হলুদ।

বিকেল হলে তুমি যখন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির পথে ফিরতে, আমি ঘড়ি ধরে ঠিক ওই সময়েই বারান্দায় গিয়ে ঝপ করে এক গ্লাস জল নিচে ফেলে দিতাম।

তুমি ঘাড় বাঁকা করে উপরে তাকাতে। আমি একটু হাত নাড়তাম। তুমিও। এক ঝলকে দুজনের মাঝে অগুনতি কথা হয়ে যেত।

ছুটির দিনগুলোতে দুপুরবেলা সিনেমা দেখার জন্য যখন সবগুলো রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত আমরা তখন ঘুরে বেড়াতাম।

খান সাহেবদের বিশাল বড় বাগান ছিল। সেই বাগানের গাছে গাছে গোলাপ, গাঁদা, সূর্যমুখি ফুটে থাকত।

সবুজ পাতার পেছনে লুকিয়ে থাকত কচি পেয়ারা আর করমচা। পায়ের নিচে সবুজ ঘাসের ভেতরে তুলার বলের মত সাদা সাদা খরগোশ ঘুরে বেড়াত।

তুমি মাঝে মাঝে দু একটাকে আঁকড়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে। সেই দৃশ্য যেন ছবির মত মনে হত।

খান সাহেবদের বাগানের পেছন দিয়ে বেশ দূরে একটা ঝিল ছিল। আমার মনে হত সেটা হয়ত একটা হারিয়ে যাওয়া সমুদ্র।

মনে হত, একদিন সেখানে প্রচণ্ড জোয়ার উঠবে আর রবিনসন ক্রুসোর মত স্যালি নামের কোন জাহাজে করে আমরাও কোন সমুদ্রযাত্রায় চলে যাব।

তারপর ঘটনা-অঘটনায় বহুদূরের কোন দ্বীপে আশ্রয় নেব। আমার সাথে থাকবে তুমি। তোমার হাত, আঙুল, ঘ্রাণ, স্পর্শ আর কণ্ঠ।

*

একবার ঘুরতে ঘুরতে এক পার্কে চলে গিয়েছিলাম আমরা। বিশাল বড় গাছের নিচে সিমেন্টের বেঞ্চিতে পা ভাঁজ করে বসে ছিল এক জ্যোতিষী।

পরনে ধবধবে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি। তাঁর চুল সাদা, দাঁড়ি সাদা এমনকি ভ্রু দুখানাও সাদা।

সবুজের গাছগাছালির মাঝে উনি নিজেও যেন একটা গাছের মত ডাল পালা ছড়িয়ে বসে আছেন।

আমাদের হেঁটে আসতে দেখে তোমাকে লক্ষ্য করে গমগমে সমুদ্রের মত স্বরে বলেছিলেন,

-বিদেশ ভ্রমণে বেশি দেরি নেই।

তুমি থমকে গিয়েছিলে। আর আমিও! তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে দুজন মিলে হাত দেখিয়েছিলাম সেই জ্যোতিষীকে।

জানতে পেরেছিলাম, তোমার জীবনে প্রেমের পরিণতি আসবে অনেক পরে। প্রবাসী হবে তুমি। আর আমার জীবনে আছে খুব বড় ভাঙন।

বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে আমরা বেশ খানিকক্ষণ মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিলাম।

তারপর থেকে সন্ধ্যা নামার আগের সময়টুকু দুজন পার্কে বসে কাটাতাম। ওদিকের বেঞ্চিতে বসত শুভ্র জ্যোতিষী আর এদিকের বেঞ্চিতে আমরা।

কেমন যেন একটা সম্মোহনী যোগাযোগের মত সমস্ত ব্যাপারটা। এতো কাছে, মুখোমুখি কিন্তু মনে হত আমরা একটা অচিন দূরত্ব এঁকে বসে আছি।

তারপর এক সন্ধ্যায় তিনি কেন যেন হেঁটে হেঁটে তোমার কাছে এলেন।

পাঞ্জাবির পকেট থেকে খুব ছোট্ট একটা কিছু বের করে তোমার হাতে গুঁজে দিয়ে চলে গেলেন লেকের বাঁকা পথটা ধরে।

তুমি মুঠো খুলে দেখলে একটা গোল আংটি। অষ্টধাতুর তৈরি। আকারে বেশি বড় ছিল না আংটিটা। অন্তত তোমার আঙুলে হবার মত নয়।

তুমি আমার বাঁ হাতটা ধরে আংটিটা পরিয়ে দিলে আমাকে। আমি চুপ করে থাকলাম।

অথচ বুকের ভেতরটা মনে হচ্ছিল সাবানের বুদ্বুদের মতো ফেটে যাবে এখনই।

সেদিন আমরা দুজন দীর্ঘক্ষণ বসে ছিলাম পার্কে। যেন আমাদের দুজনেরই নতুন করে জন্ম হয়েছে।

আমাদের পুরনো হাতের রেখাগুলো ঝরে পড়ছে, এক একটা হেমন্তের পাতার মত।

যেন সেই জ্যোতিষী এসে আমাদের দুটা নাম আর একটা পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন হঠাৎ। আর ঠিক তখনি যেন আমরা টের পেয়েছি, আমরা আমাদের কে!

তোমার দিকে সেদিন তাকাতে পারি নি ঠিকমত কেন যেন।

তোমাকে একই সাথে একটা নতুন গল্পের মতো অপরিচিত আর নিজের স্মৃতির মত আপন লাগছিল।

কল্পনা আর বাস্তবতার সূক্ষ্ম সীমারেখার মাঝে দোল খাচ্ছিল সুখ-বাকশো।

সেদিনের পর সেই জ্যোতিষীর সাথে আমাদের আর দেখা হয় নি।

*

বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশ ফ্যাকাসে নীল। পথঘাট সুনসান। গাড়িঘোড়া, পথচারী কমে এসেছে ক্রমশ।

পা টিপে টিপে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম অকারণে। মাটি ভেজা ঘ্রাণ চারপাশে। এরই সাথে হঠাৎ যুক্ত হল চমৎকার আরেকটা ঘ্রাণ।

মনে হল ফুলের ঘ্রাণ। বকুল, হাসনাহেনা কিংবা কাঠগোলাপ। ও বাড়ির জানালায় তোমাকে দেখা গেল একটু। ফুলের ঘ্রাণ তীব্র হল।

এরপর প্রায়ই তোমার আশেপাশে থাকলে আমি এমন ঘ্রাণ পেতাম। বুঝতে পেরেছিলাম এটা বকুলঘ্রাণ।

যদি তুমি কোন বিকেলবেলা বকুল ফুল হয়ে ঝরে পড়তে তাহলে আমি তোমাকে বুকের মাঝে ধরে বাড়ি নিয়ে আসতাম।

কেউ দেখত না। কেউ জানত না। অথচ তুমি থাকতে আমারই কাছে।

এর আগে কোন নারীর কাছে কি কোন পুরুষকে ফুলের মত মনে হয়েছে? আমার জানা নেই।

পৃথিবীর অজস্র রহস্যের মত এই ভাবটানাও আমার কাছে রহস্যই থেকে যাবে।

তবে কি তোমাকে আমার বকুল ফুলের মত ভাবতে ভালো লাগে? আমি জানি না।

শুধু জানি, বকুল ফুল যত শুকোয় ততই ঘ্রাণ ছড়ায়। হয়তো ফেলে আসা খুব সুখের কোন গল্পের মত।

*

সে বছর কলেজ পাশ করে আমরা হুট করে অন্য পাড়ায় চলে গেলাম। বেশ দূরে। মা, আমার ভাই রাসেল আর আমি।

লাল বাড়ির দেয়াল বদলে গেলো পুরনো ইটের দুটি ঘরে। তিন বারান্দার বাড়ি থেকে দুই ঘরের বাসা।

যেখানে ইটগুলো দেয়ালে আঁকাবাঁকা করে বসানো। পলেস্তারা যেন অদ্ভুত সব দেশের ছবি এঁকেছে ভেঙ্গেচুরে। নামমাত্র চুনকামের ছোঁয়া।

আর ঘরের কোণায় কোণায় নোনা ধরা। দুটো ঘরে একটি করে জানালা। জং ধরা জানালার গ্রিল।

একটিকে আবার ভালো করে বন্ধ করতে গেলে খোলা যায় না, কিংবা খুলে ফেললে বন্ধ করতে বেগ পেতে হয়।

একটাই বারান্দা। পূর্ব পশ্চিমে ছড়ানো। কিন্তু বারান্দায় এসে দাঁড়ালে স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলাধরা দেয়ালে দৃষ্টি থেমে যায়।

সবুজ বিষণ্ণতা যেন একাকার হয়ে মিশে আছে দেয়ালটাকে ঘিরে। বাড়ির অন্যপ্রান্তে গুমোট একটা রান্নাঘর। এই তো।

একটাই শুধু অন্যরকম ব্যাপার। পাশের বাড়ির দেয়াল ছাপিয়ে একটা বকুল গাছ একটু এগিয়ে এসেছে এ বাড়ির উঠানের কাছে।

যেন কোন গল্পবাজ প্রতিবেশী আগ বাড়িয়ে জানতে চাইছে, কী খবর?

রোজ অল্প কিছু বকুল ফুল ঝরে পড়ে থাকে উঠোনের মাটিতে। আর সেই ফুল কুড়াতে গেলে মাথার উপর নীল আকাশ দেখা যায়।

নিজেকে তখন বেশ স্বাধীন লাগে। সেই স্বাধীন সময়ে নীল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আমি একটা মৃত্যুর কথা ভাবি। বাবার মৃত্যু।

খুব সকালে কাটা গাছের মত তাঁর মাটিতে পড়ে যাওয়া। যেন কোন প্রাচীন বৃক্ষকে কেউ কুড়াল মেরে মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।

তারপর তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে মায়ের আর্তনাদ। রাসেল ভাইয়ের কিছু বুঝতে না পেরে বাবার মাথায় পানি ঢালতে চাওয়া।

আর মায়ের অনবরত বলেই যাওয়া, ডাক্তার ডাক। ডাক্তার ডাক। ডাক্তার…

বাবাকে ওরা শুইয়ে রেখেছিল বসার ঘরের মেঝেতে। চারপাশে কান্নার রোল। মা থেকে থেকে জ্ঞান হারাচ্ছেন।

রাসেল ভাই চোখ মুছেই যাচ্ছে। কেবল আমি দাঁড়িয়ে আছি স্তব্ধ হয়ে, সমাপ্তি ছাড়া গল্পের মত।

বাবার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল উনি ঘুমাচ্ছেন প্রশান্তমুখে। যেন এখুনি বলবেন,

– এক ঘণ্টা পর ঘুম থেকে ডেকে দিস তো মা। দুপুরের ঘুমানো ভালো নয়। তবুও মাঝে মাঝে ঘুমাতে ইচ্ছে করে।

আমি মনে মনে বললাম,

– এই যে সবাই শুনুন, শশশ… বাবা ঘুমাচ্ছেন। শব্দ করা যাবে না। জেগে যেতে পারেন। এক ঘণ্টা পর ডেকে দিতে হবে…
– আহহা! বললাম তো। কেউ এত শব্দ করবেন না। উনার অসুবিধা হবে।

আমার কণ্ঠ কেউ শুনতে পেল না। অগুনতি কান্নার গল্পের ভিড়ে একটা কবিতার মত।

পেছন থেকে এক মধ্যবয়স্ক মহিলা আমার কাঁধে ছোট্ট ধাক্কা দিয়ে বলে উঠল, ঘরের দেয়াল থেকে মৃত মানুষটার ছবিগুলান সরান।

না না, আসলে সবার ছবিই সরান, নইলে ফেরেশতা আসব না।

কথা শোনামাত্রই পাশ থেকে আরও দু তিনজন মাথা নেড়ে সায় দিতে থাকল।

আমি ভেতরে ভেতরে বোকা কান্না কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দেয়াল থেকে আমাদের ছবি সরাতে থাকলাম।

মা আর বাবার বিয়ের ছবি।
আমাদের চার জনের পারিবারিক ছবি।
আমার জন্মের সময় বাবার কোলে থাকা ছবি।
বাবা, রাসেল ভাই আর আমার ছবি আঁকা।
আমাদের প্রথম সমুদ্র দেখার।
রাঙ্গামাটি ঘুরতে যাওয়ার।
ক্রিকেট খেলে রাসেল ভাইয়ের ট্রফি নিয়ে আসার।

কত ছবি। কত স্মৃতি। কত গল্প। এতকিছু নিয়ে আমি কোথায় লুকাব?

কোথায় রাখব কেউ কি বলতে পারবে?

*

প্রায় রাতেই উঠানের দরজা ভালো করে আটকে এসে বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে দেই। বাইরে থেকে মৃদু বাতাস আসে।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গলে দেখতে পাই শ্যাওলা ধরা দেয়ালে বসে আছে দুটা চড়ুই। আর ভেজা মাটিতে হুটোপুটি খাচ্ছে কিছু বকুল ফুল।

সাড়ে সাতটা বাজলেই রান্নাঘর থেকে চায়ের সুবাস আসে। রাসেল ভাই ছোট্ট একটা চাকরি নিয়েছে।

সকাল সকাল তাই কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। ঠিক যেন বাবার মত।

এদিকে আমি গায়ে কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি তাও তো একটা মাথা গোঁজার ঠাই আছে আমাদের।

এটুকু ভাবার পরপরই তোমাকে খুব মনে পড়ে। মনে মনে বলি, দেখো। জীবন কেমন বদলে যায় ক্ষণিকেই।

প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হয়, তারপর সবকিছু ঠিক কোন না কোন নিয়মে চলে আসে।

জীবন যদি একটা চরিত্র হয়। সেই চরিত্র বড় বিচিত্র!

*

ছেলে বিমানচালক। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি, গাড়ি আছে। উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট। মাসিক আয় ভালো।

এত উপার্জন আর উচ্চতায় ঢেকে যায় আমার নাজুক হাল, আগোছালো জীবন। তোমাকে জানালাম সব।

তুমি বাসায় কতকিছু বললে, কোনই লাভ হল না। আমিও বললাম, কেউ শুনল কী? চাইলে আমরা পালাতে পারতাম।

সবাই বলে, পালিয়ে যাওয়া খুব সহজ। কিন্তু কেন যে এই সহজ কাজটাই আমাদের দিয়ে হল না আজও জানি না।

শুধু বুঝতে পারলাম একই শহরে থেকেও অনেক দূরে চলে গিয়েছি। যেভাবে কোন পথিক বহুদূর হেঁটে হেঁটে এক সময় একটা বিন্দুতে পরিণত হয়।

আমিও যেন তাই হলাম। অষ্টধাতুর আংটি বাম হাতের অনামিকা থেকে চলে এল ডান হাতের অনামিকায়।

সেই বৈমানিককে ঠকালাম? নাকি তোমাকে? হয়তো নিজেকেই।

বৈমানিক তো দেশ বিদেশে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

খবর দিলে তুমিও প্রবাসী হচ্ছ।

আমি তাহলে কেন ডানাহীন পাখি হলাম?

বিমানবন্দর থেকে থেকে তুমি ফোন করেছিলে। তারপর তেত্রিশ মিনিট আট সেকেন্ডের বাকহীন আলাপ।

আহ! তুমি এত নিঃশব্দে কাঁদতে জানো?

*

মা মারা গেলেন বিয়ের তৃতীয় বছরে। তারপর ঠিক চতুর্থ বছরে আমার কোলজুড়ে জন্ম নিলেন। আমার সময় বদলে গেল।

মাকে বড় করতে হবে, সময় দিতে হবে, ভালোবাসতে হবে। বোহেমিয়ান ভাবালুতার আর সময় নেই।

ফেলে আসা বৃষ্টিঝরা সময়ে আমি মাকে আর ভিজতে দেব না। মা আমার, এবার তুমি শুধুই যেন আলোর মুখ দেখ।

আমি তোমার প্রদীপ হয়ে থাকব।

*

হীরা খালার কথা মনে আছে? ওই যে দূর সম্পর্কের খালা আমার। খুব বড় পরিবারে বিয়ে হল। আট ভাইয়ের এক বোন। খুব আদরের।

দেখতে পরীর মত। চকচকে চামড়া। দুধে আলতা রঙ। নাম তাই হীরা।

সেই ছোটবেলায় শুনেছি স্নান করতে গেলে উনি দেড় ঘণ্টার আগে ফিরতেন না। ধবল শরীর থেকে ভুরভুর করে সাবানের ঘ্রাণ আসত।

খালুজান বাজারের সবচেয়ে দামী বিদেশী সাবান কিনে দিতেন উনাকে। কুচকুচে কালো চুলে অলিভ ওয়েল দিতেন।

খুব লম্বা বিনুনি হত উনার। খালুকে কেউ একদিন বাড়ি ফেরার পথে গুম করে দিল। খালু আর ফিরলেন না।

তিন দিন পর লাশ পাওয়া গেল বড় রাস্তার পাশে। সেই থেকে মাঝরাতে খালা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন উদ্ভ্রান্তের মত।

কত গল্প উঠেছিল তখন উনাকে নিয়ে। কেউ বলত, কোন এক জ্বিন উনার প্রেমে পড়ে খালুকে মেরে ফেলেছেন।

কেউ বলত, মাঝরাতে বড় রাস্তার পাশের বট গাছে উপর বসে থাকতে দেখা গিয়েছে উনাকে।

কেউ বা বলত সুন্দরী বউ স্বামীর জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। অনেকে আবার বলত, দুশ্চরিত্রা বলেই মাঝরাতে ঘর থেকে বের হয়।

না জানি কার কাছে যায়।

জীবিত থাকতে খালু তো হীরা খালাকে রাণীর মতই যত্ন করে রেখেছিলেন। অথচ মানুষটা হারিয়ে দুঃখী ও নিঃসঙ্গ খালা হয়ে গেলেন চরিত্রহীনা।

খালুকে অবশ্য দীর্ঘদিন একা থাকতে হয় নি।

এক বর্ষার রাতে কে বা কারা ঘরে এসে খালাকে ছুরি দিয়ে পাউরুটির মত দু ভাগ করে ফেলে রেখে গিয়েছিল।

টেবিলে এক গ্লাস গরম দুধ ছিল। ধস্তাধস্তিতে গ্লাস ভেঙ্গে চৌচির হয়ে পড়েছিল।

বাড়ির সবাই যখন খবর পেয়ে ছুটে এলো, তখন দেখতে পেলো লাল রক্ত আর সাদা দুধে মেঝেতে যেন একটা বিষণ্ণ ছবি হয়ে আছে।

খালার শরীরটা তখনও কিছুটা উষ্ণ। চোখদুটো খোলা। যেনবা কিছু বলতে চাইছে।

আমার কেন যেন খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে পৃথিবীর পরেও কোন জীবন আছে। সেখানে আছে কিছু পাওয়া না পাওয়ার গান।

আর হয়ত কিছু অভিমান।

*

প্রবাসে তোমার দিনগুলো কীভাবে কাটত? একা একা রান্না করতে কি খুব কষ্ট?

তোমার ওখান থেকে থেকে ঢাকা আসতে প্রায় এক দিন পার হয়ে যায়।

পথের দূরত্ব দিয়ে কি মনের দূরত্ব মাপা যায়?

বলেছিলাম, বিয়ে করো।

উত্তর দিয়েছিলে,

– করব। কোন একদিন।

সেই কোন একদিন আজও এলো না। তোমাদের আগের বাড়ির মত তুমিও যেন একটা হলুদ স্মৃতিতেই বাস করছ।

অথচ দেখো, বইয়ের পুরোনো পাতার মত আমাদের লাল বাড়িটা আমি হারিয়ে ফেলেছি বেশ আগেই।

হারিয়ে ফেলেছি খান সাহেবের সাজানো বাগানের মত শৈশব-স্মৃতি।

শুধু মধ্য দুপুরে ডেকে যাওয়া লেইস-ফিতাওয়ালার মত কিছু স্মৃতি আমাকে আজও ডেকে ডেকে বেড়ায়। আর বাকি সব বিভ্রম।

বলা হয় নি হয়ত, বৈমানিক এখন ইউরোপে। সাথে আছে শ্বেতাঙ্গ বিদেশিনী। এ ঘটনার পর আমি নির্ভার হব ভেবেছিলাম।

কেন যেন হতে পারি নি। আমরা পাখি হতে চাইলেও খাঁচা হতে খুব ভালোবাসি।

কিংবা আজীবন খাঁচা হয়ে থাকি বলে যখন পাখি হবার সুযোগ আসে তখন আর উড়তে চাই না।

তবে সত্যি বলি? বেশ আছি কিন্তু। মেয়েকে নিয়ে জীবন কেটে যাচ্ছে জল তরঙ্গের মত।

বুঝতে পারি ওকে নিয়ে আমার একাই ভাসতে হবে এখন।

অতল রাতগুলোতে মাঝে মাঝে মনে হয় হুট করে যদি খবর পাই তুমি দেশে ফিরছ তাহলে মেয়েকে নিয়ে বিমানবন্দরে ছুটে চলে যাব।

তারপর তোমার সাথে দেখা হলে ওকে একটা লাল ফুল আর হলুদ ফুলের গল্প বলব।

মুখবইতে তোমার অনেকগুলো ছবি দেখা যায়। সবগুলো ছবিতে তুমি একা। বরফের মাঝে একা, সমুদ্র সৈকতে কিংবা কফিশপে একা।

দেখে দেখে ভাবি একাই যদি হও তাহলে ছবিগুলো তুলে দিল কে? আসলে সবার মনেই কৌতূহল নামের এক শিশু বাস করে।

সমসয়ে অসময়ে সে খিলখিল করে হাসে। আর আমরা যেন অযথাই উতলা হই।

এই যে তোমার সাথে আজ দেখা হল। এমন দেখা তো রোজই হয় আমাদের।

প্রতিদিন।

একইভাবে।

একই পথে।

তুমি রোজ এক রকম পোশাক পরে থাক। আমি শুধু রঙ বদলাই। আমাদের কথাবার্তা একটু একটু করে পরিধি বাড়ায়।

অবশ্য আজকাল তুমি কিন্তু বেশ কম কথা বল। আমিই বেশি বকবক করে যাই। তুমি ঘুরে ফিরে চেনা কিছু শব্দেই আটকে থাক।

যেন আর নতুন কোন শব্দ জানা নেই তোমার।

এতদিন চলে গেল এখনও কি তোমার নতুন করে কিছু বলার নেই? একটা দিন আসুক যেদিন শুধু তুমিই কথা বলবে।

আমি শুনব শুধু।

তাকিয়ে থেকো না, এবার কথা বল।

আমি জানি মুখবইতে ‘রিমেম্বারিং’ একটা শব্দমাত্র।

তুমি আছ এখানে।

আমাদের খুব কাছে।

ছায়া হয়ে…

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক · ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত