পূর্ণতা

পূর্ণতা

নাহিন যখন এগারো ক্লাসে পা দিয়েছে, ঠিক তখনই পরিচয় হয় অরুনিমার সাথে। বাবার সাথে কলেজে ভর্তি হতে এসেই পরিচয় নাহিনের সাথে। প্রায় দু’বছর টিকেছিলো ওদের সম্পর্ক। বর্তমান যুগে সচরাচর দু’বছর খুব কম সম্পর্ক-ই টেকে।

অরুনিমা শহরের বেশ নামকরা একটা স্কুল থেকে বেশ ভালো রেজাল্ট নিয়ে মাধ্যমিক পাস করে শহরের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কে প্রথম চয়েস হিসেবে রেখে আরও চারটা কলেজ চয়েস দেয়। যেদিন কলেজ চয়েস এর রেজাল্ট দেয় সেদিন অরুনিমা রেজাল্ট দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। কারণ শহরের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠেই সে এখন পড়তে পারবে। এর কয়েকদিন পরেই শুরু হয় ভর্তি প্রক্রিয়া। সে সুত্রেই অরুনিমা আজ কলেজে এসেছে ভর্তি হতে। অরুনিমা কলেজের অফিস রুমে ঢুকতেই দেখতে পায় প্রচণ্ড ভীড় জমেছে। ভর্তির শেষদিন হওয়াই আজকে প্রায় সবাই এসেছে। এদিকে অরুনিমার জ্বর। তাই বেশিক্ষণ এই ভীড়ের মাঝে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু আজ-ই ভর্তির শেষ তারিখ হওয়াই ভর্তি না হয়েও উপায় ছিল না। সাথে ওর বাবা থাকা সত্ত্বেও এসব চিন্তা করছিলো অরুনিমা।

অরুনিমার বাবা সবে মাত্র হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন। কিছুদিন আগেই স্ট্রোক করেছিলেন। এখন মোটামুটি সুস্থ হওয়ায় বাসায় এসেছেন। আজ অরুনিমার ভর্তি আর বাসায় কোন ছেলে মানুষ না থাকায় কিছুটা বাধ্য হয়েই তিনি মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এসেও তেমন কিছুই করতে পারছেন না দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া। এরই মাঝে হঠাৎ করেই দেখে যেখানে ভর্তি ফি জমা নিচ্ছে সেখান থেকে একটা ছেলে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড ভীড় থাকায় আটকে যাচ্ছে। অরুনিমা ভাবলো কোনোভাবে যদি ওই ছেলেকে ম্যানেজ করে, ওর কাছে নিজের টাকা আর রশিদ বই দেওয়া যায় তাহলে হয়তো তাড়াতাড়ি ভর্তি হওয়া সম্ভব হবে। অতঃপর সম্ভব হয়েছিল ছেলেটিকে দিয়ে নিজের ভর্তি হওয়াটা।

এই ছেলেটি-ই ছিল নাহিন। ঠিক এরকমভাবে-ই পরিচয় হয়েছিল নাহিন ও অরুনিমার। নাহিন এবং অরুনিমা দুজনেই ধীরে ধীরে খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল। এমনকি ওদের বন্ধুত্বের কথা ওদের ফ্যামিলিতেও জানতো। আর প্রথমদিনের পরিচয় থেকে অরুনিমার বাবাও নাহিন কে বেশ ভদ্র ছেলে বলেই জানতো। দুজনের বন্ধুত্ব দিন দিন আরও গভীর হতে থাকে। দুজনের মধ্যে শেয়ারিং-কেয়ারিংটা একটু বেশিই ছিল। আর সবসময় একসাথে থাকা, চলাফেরা ইত্যাদি দেখে অনেকে অনেক কিছুই ভাবতো। তবে নাহিন ও অরুনিমার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। বেশ ভালোভাবেই চলছিল সময়।

হঠাৎ একদিন নাহিন কলেজ ক্যাম্পাসে এসে দেখতে পায় অরুনিমা এখনও কলেজে আসেনি। অথচ গতকাল রাতেও দুজনের কথা হয়েছিল যে সকাল সকাল চলে আসবে কলেজে। নাহিন একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। কিন্তু পরমুহূর্তেই দুঃশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে এটা ভাবে যে হয়তো ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে তাই আসতে পারেনি, পরে আসবে। নাহিন বসে বসে অরুনিমার অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু সময় ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে, ক্লাস শুরু হবে কিন্তু এখনও অরুনিমা কলেজে এসে পৌঁছায়নি। এর মাঝে ক্লাসের বেল বেজে ওঠায় নাহিন ক্লাসে চলে যায় আর ভাবে কলেজ থেকে বাসায় ফিরে ওকে কল করবে।

নাহিন ক্লাস শেষ করে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়েই অরুনিমা কে কল দেয়। কিন্তু ফোন রিসিভ করে অরুনিমার মা। নাহিন অরুনিমার মা’র কাছে জানতে পারে অরুনিমা খুব অসুস্থ। সকালে হঠাৎ করে জ্বর এসেছে। ঔষধ নিয়েছে কিন্তু কমছে না। নাহিন কল কেটে লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়ে ওদের বাসার উদ্দেশ্যে। নাহিন যখন অরুনিমার বাসায় পৌঁছায় তখন ও কিছুটা সুস্থ হয়েছে। নাহিনকে দেখে অরুনিমার মা-বাবা কথা বলতে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নাহিন ও অরুনিমা কথা বলতে শুরু করে আর এর মাঝেই হঠাৎ অরুনিমা নাহিন কে বলে সে নাহিনকে ভালোবাসে। নাহিন ভাবতেও পারেনি যে হঠাৎ অরুনিমা নাহিনকে এরকম একটা প্রস্তাব দেবে। নাহিন মনে মনে অরুনিমা কে একটুআধটু পছন্দ করলেও কখনও বলা হয়নি। আজ অরুনিমা নিজেই নাহিনকে বললো। নাহিন বুঝতে পারছে না কি জবাব দেবে। নাহিনকে চুপ থাকতে দেখে অরুনিমা-

“কিরে, চুপ করে গেলি যে?”
“কি বলবো বুঝতেছি না।”
“আমি জানি তুইও আমায় পছন্দ করিস বাট কখনও প্রকাশ করিস না। বুঝতেও দিস না। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝি।”
“ঠিক আছে আমি রাতে বলবো, এখন থাক আমি বাসায় যাবো। কিছু কাজ আছে।”

অরুনিমা হেসে ওঠে, তারপর বলে ঠিক আছে যা। রাতে কল করবো। কথা হবে। নাহিন ওখান থেকে বাসায় চলে আসলো। বাসায় এসে নিজেই আনমনে ভাবতে লাগলো, আসলেই কী আমি ওকে পছন্দ করি? ও বুঝলো কী করে!
রাতে অরুনিমা নাহিনকে কল দেয়। নাহিন অরুনিমার কল পেয়ে চমকে ওঠে, রিসিভ করবে নাকি বুঝতে পারছে না। অথচ অন্যদিন এমন হতো না। এর মাঝে একবার কল কেটে যায়,অরুনিমা আবার কল দেয়। নাহিন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই কলটা রিসিভ করে। আর উত্তরে নিজেও আবদ্ধ হয়ে যায় ওর প্রতি।

সেদিনের পর থেকে ওদের সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকে অন্য এক সম্পর্কে নাম নেয়। নাহিন আগের চেয়ে এখন একটু বেশিই উইক হয়ে পড়েছে। কিন্তু দু বছরের মাথায় ফাটল ধরে ওদের সম্পর্কে। নাহিন ও অরুনিমা আলাদা ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর পর-ই। যে ফাটল আর কখনও জোরা লাগার মতো ছিল না। ফলস্বরুপ দুজনে আলাদা হয়ে যায়। সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সমবয়সী সম্পর্কগুলো এমনই হয়, একদিন না একদিন ভেঙে যাবেই। নাহিন প্রথমদিকে কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যয়গ্রস্ত হলেও নিজেকে এটা বলে ঠিক রাখে যে, বাস্তবতা কে মেনে নিতেই হবে। নিজেকে শান্ত করে, পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে পড়ে নাহিন। এখনও অরুনিমা কে সম্পূর্ণ ভুলতে  পারেনি নাহিন।

“কাউকে ভুলে যাওয়ার জন্যও কারোর দরকার হয়।” কিন্তু নাহিনের জীবনে এই কেউ মানুষটাই ছিল না। ভার্সিটিতে বেশ কিছু বন্ধু হলেও তাদের সাথে শেয়ার করতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করে নাহিন। এভাবেই কাটছে সময়। এখন আর কারো জন্য নাহিনের মনে আবেগ জন্মায় না। নাহিন অপেক্ষা করছে সেই মানুষটির জন্য যে এসে সব অতীত কে ভুলে ওকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিবে এবং সেই হবে সে মানুষ যাকে ভালোবাসলে পূর্ণতা পাবে ভালোবাসা। বেশ কিছুদিন পর নাহিন ভার্সিটি থেকে ছুটিতে বাড়িতে এসে ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছে। এখন বন্ধুরাও কারো না কারো কাছে কমিটেড। নাহিন ছাড়া। এর মাঝেই হঠাৎ করে রিয়ন(বন্ধু) এর ফোনে কল আসে। ও উঠে পাশে চলে যায় কথা বলতে। কথা বলা শেষ করে যখন ফিরে আসে ওর মুখে স্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। রিয়ন বেশ আনন্দিত হয়ে নাহিনকে বলে-

“দোস্ত, তোর কথা আমি আদিবা(জিএফ) কে বলেছিলাম তো ওর একটা বোন আছে তোর মনের মতোই। আদিবা তোর ছবি ওকে দেখিয়েছে, তোকে বেশ পছন্দ করেছে। আশা করি তোর সাথে ভালোই মিলবে।” “কিন্তু, আবার যদি আগের মতোই হয়!” “আল্লাহ ভরসা, তুই একবার রাজি হলেই হয়, আর তো মাত্র কয়েকবছর তারপরে আমরা নিজেত পায়ে দাঁড়িয়ে ওদের নিজের করে নেবো ইনশাআল্লাহ।”

“তুই আমার ছোটবেলার বন্ধু, তুই আমার খারাপ চাইবি না এটা আমি জানি। দেখ তোর ভালো মনে হলে নিশ্চয় ভালোই হবে।” আর “ভালোবাসা হারানোর পরও নতুন করে ভালোবাসতে শিখতে হয়, ভালোবাসা থামিয়ে দিতে নেই। থামিয়ে দিতে হয় ঘৃণা, অযত্ন, অবহেলা ও ক্রোধ।’ নাহিন আবারও নতুন করে সবকিছু শুরু করে। আর এই মেয়েটা, মানে নাবিলা একদম নাহিনের মনের মতো। রূপে, গুনে সবদিক থেকেই মাশাল্লা। এদিকে নাবিলা নাহিনের কথা ওর বাসাতেও জানিয়ে দিয়েছে। নাবিলার মা নাবিলা কে বলেছে, “নাহিন যদি ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তবেই নাবিলা ও নাহিনের বিয়ে দেবে।” নাহিন নাবিলার মুখে এ কথা শুনে খুশি হয় সাথে চিন্তিতও হয় কিন্তু ওকে অভয় দেয় রিয়ন। বলে ইনশাআল্লাহ পারবি।

চারবছর পর। লাউড স্পিকারে গান বাজনা চলছে। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। বাচ্চারা হৈ-চৈ করছে, বাড়ির মেয়েগুলো নিজেদের সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত, সবাই বেশ আনন্দ করছে। চারিদিকে একটা উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। নাবিলার বাবা আয়োজনের কোন কমতি রাখেননি। আগে থেকেই তাঁর শখ ছিল একমাত্র মেয়ের বিয়ে তিনি কোন বড় ঘরের ছেলের সাথ অনেক ধুমধাম এর সহিত দিবেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী-ই চারিদিকে নানান রকম আয়োজন। বরযাত্রী থেকে শুরু করে দাওয়াতের কোন মানুষের আপ্যায়নে যেন কোন কমতি না থাকে সেজন্য সব জায়গায় আলাদা আলাদা লোক ঠিক করে রেখেছেন। আর একটু পরেই বরযাত্রী এসে পড়বে। নাহিন আজ সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি না হলেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সে। আজ বদলে গেছে সবকিছুই। আজ নাহিন ও নাবিলার বিয়ে। অনেক ধুমধামের সহিত হচ্ছে।

বাড়ির একটা রুমে সেজেগুজে বসে আছে নাবিলা। পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান এসে ওকে আগেই সাজিয়ে রেখে গেছে। আজকে ওর বড্ড খুশির দিন। নিজের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করছে। ভালোবাসা সেদিনই পূর্ণতা পায় যেদিন ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পাওয়া যায়। নাবিলার ভালোবাসাও আজ পূর্ণতা পেতে চলেছে। আর একটু পর-ই নাবিলার স্বপ্ন পূরণ হবে। পূর্ণতা পাবে দুজনের ভালোবাসা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত