পতি পত্নী সমগ্র

পতি পত্নী সমগ্র

মেয়ে দেখতে আসলে পাত্র-পাত্রীকে যখন আলাদা কথা বলার সুযোগ দেয়া হয় তখন পাত্ররা পাত্রীদের সাধারণত কি ধরনের প্রশ্ন করে থাকে? মেয়েটার ফিউচার প্ল্যান কি, মেয়েটার পছন্দ অপছন্দ, মেয়েটা অন্য কোথাও কমিটেড কিনা, বিয়ের পর জব করার ইচ্ছে আছে কিনা এই প্রশ্নগুলোই চলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাকে করা প্রথম প্রশ্নটা ছিল- “আপনি ডিনার কখন করেন?” এমনিতেই আমি অস্বস্তিবোধ করছিলাম আমার শাড়ির কুঁচি নিয়ে। কারণ চেয়ারে বসার সময় পায়ের নিচে টান লেগে কুঁচি আলগা হয়ে গেছে। এখন উঠে দাঁড়ালেই সবটা খুলে যেতে পারে। তার উপর ভদ্রলোকের মুখে এই উদ্ভট প্রশ্নটা শুনে আমি কয়েক সেকেন্ড তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হলাম। তিনি আমার উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। তার আগেই দ্বিতীয় উদ্ভট প্রশ্নটা করে বসলেন,

– আচ্ছা চুলে শ্যাম্পু করে গোসল করতে আপনার কতক্ষণ সময় লাগে? এবার আমি মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম,
– কেন?
– আসলে আপনার মাথায় ঘোমটা দেয়া বলে আপনার চুল কতটুকু বুঝতে পারছি না।

তাই শ্যাম্পু করার সময় হিসেব করে চুলের সাইজ আন্দাজ করে নিতাম। আর ডিনারের সময়টা জিজ্ঞেস করার কারণ হচ্ছে আমার ডিনার করা লাগে রাত ৮-৮.৩০টার মধ্যে। এরপর একটু হাঁটাহাঁটি করি নয়তো রাতে ভালো ঘুম হয় না।

আমি কিছু বলতে যাবো, এমন সময় আমার পিঠের মধ্যে দু’তিনটে পিঁপড়ার বিচরণ অনুভব করতে লাগলাম। কিন্তু এখানে পিঁপড়া কি করে আসবে! তখন মনে পড়লো, বিকেলবেলা পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাটা আমাদের বাসায় বেড়াতে এসে এই চেয়ারে বসে মিষ্টি খেয়েছিলো। সাথে সাথে মাথায় আগুন ধরে গেলো আমার। এমন কাজ কেউ করে? তারপর বাচ্চাটার বয়সের কথা ভেবে পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে নিলাম। এদিকে সুঁড়সুঁড়ির যন্ত্রণায় স্থির হয়ে বসে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করার পর আর টিকে থাকতে পারলাম না। সামনে বসে থাকা ভদ্রলোক এতক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। আমাকে নীরব থাকতে দেখে একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন।

– আপনি ঠিক আছেন? প্রতিউত্তরে আমি ঝাঁঝালো কণ্ঠে পালটা প্রশ্ন করলাম,
– কেন? আমাকে দেখে কি বেঠিক মনে হচ্ছে?
– না, তেমন না। তো কিছু বলছেন না যে?

এ পর্যায়ে আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এক হাতে শাড়ির কুঁচি ধরে আর আরেক হাত পেছনে নিয়ে পিঠ চুলকাতে চুলকাতে। তার সাথে বিলাপও জুড়ে দিয়েছিলাম, “উঁহ্ বাবা গো, মরে গেলাম গো। আর তো পারছি না।” আমার এ অবস্থা দেখে তিনি বিরক্ত হয়ে মাথা নিচু করে আমার সামনে থেকে চলে গিয়ে আমার এক কাজিনকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন। ওই কাজিনটা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

– কিরে, কি হয়েছে? উনি বললেন, তুই নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছিস?

মনে মনে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,”মাথা মোটা একটা।” আমি নিশ্চিত ছিলাম এই লোক বাইরে গিয়ে সবাইকে বলে দিবেন যে, আমাকে তার পছন্দ হয়নি। খুব স্বাভাবিক। আমি তো কোনো কথাই বললাম না তার সামনে, এমনকি যে দুটো প্রশ্ন করলেন সেগুলোরও উত্তর দিতে পারিনি। কি করে দিবো? উত্তর দেয়ার সময়টুকুতে তো তব্দা খেয়েই বসে ছিলাম। কিন্তু ঘটনা ঘটলো তার বিপরীত। পরদিন বিকেলবেলা জানতে পারলাম, পাত্র আমাকে পছন্দ করেছে। এখন আমাদের কোনো আপত্তি না থাকলে তারা কথা আগাতে চান।

সেদিনের সেই ভদ্রলোকটিই হলেন আমার বরমশাই। উপমাকে বধূবেশে সাজতে দেখে আজ হঠাৎ আমার ওই সময়টার কথা মনে পড়ে গেলো। পার্লারের মেয়েরা বাসায় এসে উপমাকে সাজিয়ে দিচ্ছে আর আমি সেদিকে তাকিয়ে থেকে অতীতে কখন ডুব দিয়েছিলাম, বুঝতেই পারি নি।

এখনো আমার ভাবতে অবাক লাগে, এই মানুষটার সাথেই আমি আজ সংসার করছি যেখানে বিয়ের পরদিন থেকেই মানুষটার হাবভাব দেখে আমার সন্দেহ হচ্ছিলো এই সংসার আমার দু’দিনও টিকবে কিনা! অথচ আজ তিনমাস হতে চলেছে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বিয়ের আগে আমি যেমন রাত ১০টার পর ডিনার করতাম, এখনো তেমনই করি। আর তাকে ৮টার সময় ডিনার রেডি করে দিলেও তিনি আমাকে ছাড়া খেতে চান না। শেষমেশ দেখা যায়, তিনি সেই আমার সাথেই ১০টার পর ডিনার করছেন। এজন্য প্রথম প্রথম বরমশাই মুখ ফুলিয়ে রাখতেন ঠিকই কিন্তু পরে মানিয়ে নিয়েছেন। শুধু কি তাই? যে মানুষ আগে সুগন্ধি তেলের ঘ্রাণ নিতে পারতেন না, তিনি এখন কড়া সুগন্ধযুক্ত হেয়ার ওয়েল আমার চুলে লাগিয়ে দেন নিয়মিত।

আচমকা বসার ঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেয়ে খানিকটা চিন্তিত হয়ে সেদিকে পা বাড়ালাম। এই সময়ে কিসের চেঁচামেচি হচ্ছে এতো? ঘরভর্তি মেহমান, কোনো গণ্ডগোল হলো না তো আবার? বসার ঘরে যেতেই দেখতে পেলাম, বরমশাইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে মেজো খালু অবশ ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছেন। আর খালাম্মা তার পাশে দাঁড়িয়ে সমানে বকে যাচ্ছেন। তবে বকাগুলো ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করে তা বুঝা যাচ্ছে না। মেজো খালুকে দেখে মনে হচ্ছে অচেতন অবস্থা। কিন্তু দু’ঠোঁট নাড়িয়ে কিসব যেন বিড়বিড় করে চলেছেন। আমি এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে। খালাম্মা আমাকে দেখে যেন আরো জোর পেলেন।

– দেখেছিস প্রিয়তি? আমি কাকে নিয়ে সংসার করছি? কোথা থেকে কিসব ছাইপাঁশ খেয়ে এসেছে। এখন অবস্থা দেখ মানুষটার। আজকে যে তার মেয়ের বিয়ে, সেই খেয়াল কি আছে? ছিঃ মরণ হয় না কেন আমার? এসব কথা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কানে গেলে উপায় আছে বল্?

এতক্ষণে মেজো খালুর পাঞ্জাবির উপর চোখ পড়লো আমার। পুরো পাঞ্জাবি জুড়ে শুকনো বমি লেপ্টে আছে। দেখেই কেমন গা ঘিনঘিন করছে। কিন্তু ব্যাপারটা আমার সুবিধের মনে হল না। খালু বরমশাইকে নিয়ে কি একটা কাজে বের হয়েছিলেন দুপুরের দিকে। খালুর টুকটাক বদ অভ্যাস আছে সত্যি তবে তিনি এতটাও অবিবেচক মানুষ না যে, ভাগ্নি জামাইয়ের সামনে উল্টোপাল্টা জিনিস গিলবেন। তাও আবার নিজের মেয়ের বিয়ের দিনে! সবাই মেজো খালুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমি হুড়মুড় করে বরমশাইকে নিয়ে আমার ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। বরমশাই চোখমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– এখনি দরজা বন্ধ করলে কেন? রাত পর্যন্ত সহ্য হচ্ছে না তোমার? এত কিসের তাড়া? আমি তেড়ে গেলাম তার দিকে।
– বাজে কথা রেখে আসল কথায় আসুন। মেজো খালুর কি হয়েছে?
– ও, এই কথা? তিনি আরাম করে বিছানায় পা তুলে বসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন,

– আরে হয়েছে কি জানো? মেইন রোডে উঠতেই হাতের বাম পাশে একটা নতুন পার্ক হয়েছে বাচ্চাদের জন্য। জায়গাটা ছোট কিন্তু পরিবেশ ভালো। তো খালুকে নিয়ে সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় আমার এক ক্লোজ ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো। কথা প্রসংগে জানতে পারলাম, এই পার্কের শেয়ারে সেও আছে। খুব রিকোয়েস্ট করলো আমরা যেন একবার পার্কটা ঘুরে দেখে আসি। খালুকে জিজ্ঞেস করলে তিনিও বললেন,

– এত করে যখন বলছে, চলো ভেতরে গিয়ে একবার দেখে আসি। খালুর সম্মতি পেয়ে গেলাম ভেতরে। ছোটভাই চায়ের আপ্যায়ন করলো। কিন্তু খালু আপত্তি জানালেন। একটা রাইড আছে না? ওই যে, চেয়ার সিস্টেম দোলনা, গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। নামটা মনে পড়ছে না। হঠাৎ ওই রাইডের দিকে তাকিয়ে খালু বলে উঠলেন, “একসময় এই রাইডে কত চড়েছি তোমার খালাম্মাকে নিয়ে তার হিসেব নেই।” দেখে মনে হল, তিনি অতীতকে খুব মিস করছেন। তাই আমি বললাম,

– খালু চলুন, আপনাকে নিয়ে উঠি এই রাইডটাতে। কড়া চোখে আমার দিকে তাকালেন তিনি,

– তোমাকে নিয়ে উঠবো কেন? আমি একা চড়তে ভয় পাই নাকি? ছোটভাইটা পাশ থেকে বলে উঠলো,
– খালু আপনি একাই যান। চিন্তা করবেন না, এর জন্য আমি টাকা নিবো না আপনার কাছ থেকে।

ছেলেটা হয়তো খালুকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলো, মানুষটা কৃপণ প্রকৃতির। যাই হোক, খালু রাইডে উঠে বসলেন। ওখানে আর কেউ ছিল না সেই সময়। দুপুর টাইম তো, এইসময় পার্ক ফাঁকা থাকে প্রায়। ছেলেটা রাইড ছেড়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে চা খেতে চলে গেলো। চা খেতে খেতে আড্ডাতে মজে গেলাম দু’জনই। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়ার পর মনে পড়লো খালুর কথা। দৌঁড়ে গেলাম সাথে সাথে। গিয়ে দেখলাম তিনি দোলনায় ঘুরতে ঘুরতেই প্রেগন্যান্ট মহিলাদের মতো অনর্গল বমি করে যাচ্ছেন। এতক্ষণ ধরে ঘুরতে থাকলে এমন অবস্থাই তো হবে বলো?
বরমশাইয়ের সব কথা শুনে জানতে চাইলাম,

– তো খালাম্মাকে তখন সব খুলে বললেন না কেন?
– খুব তো বীরত্ব দেখিয়ে একা চড়তে গিয়েছিলেন তোমার খালু। এখন কিছুক্ষণ ঠেলা সামলাক। সুস্থ হওয়ার পর নিজেই মুখ খুলবেন।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত