আমার এক কাজিন প্লাস জিগরি দোস্ত খুব ভালো গান করতো । এবং এখনো করে। নাম বললে সমস্যা । ফেমাস পার্সন , ফেসবুকিও ভাষায় যা সেলিব্রেটি নামে পরিচিত । আর খোদা তায়ালা কতৃক কণ্ঠের সাথে সাথে ভাই আমার দেখতেও মাশা আল্লাহ । সচ্ছল ঘরের সন্তান হবার দরুন শাহি ভাবেই জীবন যাপন করে । তবে কেউ ওকে অহংকারি বা বেপরওয়া বলতে পারবে না । ১০ বছর আগের কথা ।
আমাদের বন্ধু সুলভ সম্পর্কের কারনে ওর জীবনে ঘটে যাওয়া প্রায় সব কিছুই আমার সাথে শেয়ার করতো।
প্রথম দিকে যখন ওর এতটা পরিচিতি, নাম, যষ ছিল না, তখন সিলেট একটা পোগ্রাম করার সময় ওর একটা মেয়ে ফ্যান ওর সাথে সেখানে দেখা হয় । তার বাড়ি সিলেটেই ছিলো । এবং প্রথম সাক্ষাতে দুজন দুজনার প্রেমে পড়ে যায় ( লাভ এ্যাট ফাস্ট সাইন ) । দূরবর্তি হবার ফলে ওদের প্রেমটা ছিলো মুঠোফোন কেন্দ্রিক । তখন এসময়ের মতো এতো উন্নত প্রযুক্তি সবার হাতে হাতে ছিলো না । ফেসবুকের জন্ম হলেও এর ব্যাবহারে বাংলাদেশে এতো সমৃদ্ধি অর্জন করেনি । ফলে তখনের ভালোবাসাগুলো এখনের মতো এত সস্তা, মিকে এবং সহজ লভ্য ছিলো না ।
আমাদের গল্পে ফিরি । ওরা অন্যান্যদের মতই ফোনে সারা রাত গল্প করে কাটিয়ে দিত । আমি বলতাম, কি এত কথা বলিস সারা রাত ? কাজিন শুধু হাসতো আর বলতো, ভালোবাসা সত্যিই সর্গিও কিছু । আমি ওর কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না । কাজিনদের ঘরে কথা বলতে সুবিধা হতো না । তাই ও আমাদের বাড়ি ঘুমাতে আসতো । আর হ্যা, আমরা ছিলাম একই গ্রামের বাসিন্দা । খালা ওর প্রতি খুব খেয়াল রাখতেন । যার ফলে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে শোবার অনুমতি ওর ছিলো না ।
পাঠক, আপনাকে বারবার বিরক্ত করছি কাজিন কাজিন বলে । তারচেয়ে চলুন আমরা ওর একটা নাম দেই । ধরুন ওর নাম পথিক, আর ওর সেই দারুন সুন্দরি প্রেমিকাটার নাম রিমি । তো ওদের এই দীর্ঘ রাত পার করা কথাকলির কারনে আমার উপর মাঝে মাঝে বিপদ নেমে আসতো । আমার উপর মানে আমার ফোনের উপর । পথিকের ব্যালেন্স ফুরাবার পর রিমি ফোন করতো । রিমির ফোনের ব্যালেন্স ফুরাবার পর পথিক আমার হতোভাগা, নগন্য, অল্প ব্যালেন্স যুক্ত মটোরোলা C-11 মডেলের মোবাইলটার উপর অত্যাচার চালাতো । এবং তা আমার অজান্তে, যখন আমি গভির ঘুমে তলিয়ে আছি ।
কিন্তু ওদের এই ভালোবাসা খুব বেশি দিন টিকলো না । সিলেটি মেয়ে হবার ফলে রিমির বাবা ওকে জোর করেই লন্ডনি ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন । সেই যে পথিক কষ্ট পেলো, এর পর আর ওকে কখনো কোনো মেয়ের সাথে তেমন কথা বলতে দেখতাম না । রিমি যেমন ছিলো, তেমন কাউকে নাকি কোনোদিনও পাওয়া যবে না ।এটা পথিকের বক্তব্য । যাই হোক, রিমি বিদেশ যাবার পরে পথিককে ফোন করা শুরু করলো । যা পথিককে আরো কষ্ট দিতো । তাই ও হয়তো মোবাইল নাম্বার চেঞ্জ করেছিলো । রিমির কাছে আমার নাম্বার ছিলো । পথিকের খবর নিতে রিমি আমাকে একদিন ফোন দিয়েছিলো ।
এক পর্যায় পথিকের নাম্বার চাইলো । পথিক তখন পুরান ঢাকায় বা পল্টনের দিকে কোথায় যেন বাসা নিয়ে থাকে । আর আমি উত্তরা ৬ নাম্বার সেক্টরে পড়ি । আমাদের ঈদ বা কোরবানি ছাড়া দেখাই হতো না । আমার কাছে ওর নতুন নাম্বার সেদিন ছিলো না । আর আমিও রিমিকে পথিকের নাম্বারটা দিতে চাচ্ছিলাম না । তাই রিমিকে পথিকের বর্তমান অবস্থার কথা বলে ফোন রেখে দিলাম । আর নিজ বুদ্ধিতে যতোটুকু সম্ভব ওকে বোঝালাম যে পথিক আর ওকে চায় না আগের মতো । কারন পথিক আমায় এমনটাই বলেছিলো । যাতে পথিক এবং রিমি দুজনেই নিজেদের বর্তমানের সাথে মানিয়ে নিতে পারে । রিমি হয়তো ওর সংসার ভেঙে পথিকের কাছে ফিরতে চাচ্ছিলো । এরপর আরো একদিন রিমি ফোন দিয়েছিলো ।সেদিন ওকে একেবারে বারন করে দিলাম ফোনদিতে । এবং এখানেই পথিকের প্রথম প্রেমের The End রচিত হলো ।
ঢাকায় আসার পরে আমি একটা পাবলিক লাইব্রেরীতে যাওয়া আসা করতাম । সেটার নাম ছিলো ”ওয়ামি লাইব্রেরী” । মন ভরে বই পড়ার ব্যবস্থা ছিলো এসি রুমে বসে । এটা ২০১২/১৩ এর দিকের কথা । প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর সেখানে সাহিত্য সেমিনার হতো । বিভিন্ন সাহিত্যিক বোদ্ধারা সেখানে এ বিষয়ে বক্তৃতা করতেন । লিখালিখির প্রতি আমার খুব যে আগ্রহ ছিলো, বিষয়টা এমন নয় । তবুও কৌতুহল থেকে হোক বা এসির বাতাস খেতে, আমি কিভাবে যেন ওখানে একদিন বসেছিলাম । তাদের বক্তৃতা শুনে আমার মনে হলো আমি লিখালিখিতে যুক্ত হলে মন্দ হয় না ।
এরপর থেকে এখানে প্রায়ই বসতাম । এক সেমিনারে ঢাকা ভার্সিটি পড়ুয়া কোন এক ভাই (বাংলা বিভাগ হবে হয়তো, তার বারবার রবীন্দ্রনাথের গল্পের রেফারেন্স টানা দেখে মনে হয়েছিলো ) বলছিলেন যে, লেখার সৌন্দর্য ফোটাতে হলে আগে চরিত্রে ঢুকতে হবে । কেউ ভালোবাসা না করে কখোনো প্রেমের গল্প লিখতে পারবে না। আর যদিও বা লেখে , তাতে সেই ভাবটা ফুটে উঠবে না, যা একজন প্রেমিক বা প্রেমিকার লেখায় থাকবে । আরো কয়েকজন লেখকের বক্তৃতা শুনলাম । কিন্তু সেই ঢাকা ভার্সিটির বড়ো ভাইয়ের কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো । আমার আগডুম বাগডুম বিভিন্ন লেখা ছিলো । তবে তখনো পর্যন্ত কোনো ভালোবাসার গল্প লিখিনি । তার এই কথা শুনে মনটা কেনো যেন খারাপ হয়ে গেলো ।
”মৌচাকে ঢিল” নামক ম্যাগাজিন তাদের ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্য জন্য ”ভালোবাসার গল্প” লিখার আহবান করেছিলো । সেরা লেখকের জন্য দারুন পুরস্কারের ঘোষনাও ছিলো । তাই আমি একটা ভালোবাসার গল্প লিখবো বলে মনোস্থির করলাম । এবং শুরুও করেদিলাম । আমার বহু চেষ্টার পরে যখন একটা গল্পর মতন আকৃতি দাড় করাতাম, এবং আমার কোনো ক্লাসমেটকে (যারা লেখালিখি বোঝে ) পড়তে দিতাম। তারা পড়ে বলতো যে, তোর সাথে এসব গল্প যায় না । তুই বরং রম্য গল্প ট্রাই কর । অথচ আমি একটা প্রেমের গল্প লিখতে চাচ্ছিলাম । কিন্তু তা আর সে বছর হলো না।
তখন সিদ্ধান্ত নিলাম একটা প্রেম করে নেই। তারপর না হয় ভালোবাসার গল্প লিখবো। কিন্তু প্রেম করার জন্য দরকার একটা তরতাজা প্রাণসম্পন্ন প্রেমিকা । আমি বিলগেস্ট পুত্র নই বা কোনো আহামরি সেলিব্রেটিও নই যে আমার পিছে বালিকাদের লাইন লাগবে ! দশ জনের মাঝে আমায় কেউ মনে করতে চাইলে হয়তো বড়োজর ৭/৮ এ আমায় স্বরণ করবে । তাই অতো ঝামেলায় না গিয়ে আমি আমার সেলিব্রেটি কাজিন পথিককে ফোন দিলাম একটা রেডিমেট প্রেমিকা পাবার আসায় ।
আর ওকে অনুরোধ করলাম ওর ভক্তকুল থেকে কোন এক সাদাসিধে বালিকার নাম্বার দিতে, আর সাথে আমার জন্য একটু সুপারিশও করতে, যেনো আমি সহযেই আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি । পথিক আমায় জিজ্ঞেস করেছিলো কোনো মেয়েকে মনে ধরেছে কিনা? আমি সোজা সাপ্টা বললাম লিখালিখির জন্য একটা প্রেম করতে চাই। আমার কথা শুনে প্রথমে ও এমন ভাবে কিছুক্ষণ হাসলো,যা বাংলা সিনেমার ভিলেনও পারবে কিনা সন্দেহ । সত্যি বলতে এমন বিস্রি হাসি ওকে কেনো, আমি কাউকেই বাস্তব জীবনে হাসতে দেখেনি। আমি মনে মনে বলতে লাগলাম যে, কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ করেছি ,যে জন্য এভাবে পৈচাশিক হাসি হাসতে হবে ? আসলে ও আমায় একটা অসুন্দর পদ্ধতীতে বোঝালো যে,আমার সাথে প্রেম ভালোবাসা যায় না।
ও বলেছিলো, প্রেম করতে হলে নিজের ভেতরে রোমিও বা আশিকি টাইপ কিছু যোগ্যতা থাকতে হয় ( যেটাকে সহজ ভাষায় নাকি ছেবলামি বলে )। পকেটে মোটা মানিব্যাগ, পাছার নিচে দামি বাইক ,আর মেয়েদের আকর্ষণ করার মতো বিশেষ ক্ষমতা । কিন্তু দুঃখের কথা হলো , এগুলোর কোনোটাই আমার ছিলো না, বা নেই। ফলে আমার লেখক হবার এবং একটা ভালোবাসার গল্প লেখার সখ বিয়ের আগ পর্যন্ত পেইন্ডিংই রয়ে গেলো । এখন বউএর অপেক্ষায় আছি । তার সাথে প্রেম করবো, ভালোবাসা করবো । তারপর না হয় গল্প লিখবো । যেভাবেই হোক, ভালোবাসার গল্প আমার লিখতেই হবে।