১.
….রাত প্রায় দুইটা পয়ত্রিশ।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চের সামনের খোলা উঠানে এখন তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। বড় বড় স্পট লাইট গুলো তাক করা।
বৃষ্টির ফোঁটা গুলো মাটিতে আছড়ে পড়ে কুয়াশার মত সৃষ্টি করেছে মাটির এক হাত উঁচু পর্যন্ত।
বারান্দা গুলোতে উকিল, পুলিশ, ডাক্তার, জেলার সহ আরো কয়েকজন গণমান্য ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছেন।
ম্যাজিষ্ট্রেট হোসনে আরা বেগম মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন এক পাশে।
তাঁর দৃষ্টি সোজাসুজি চলে গেছে উঠানের ঠিক মাঝখানে বসে থাকা ছেলেটার ওপর। জেলের কয়েদীদের পোশাক পরনে।
উঠানে ধ্যান করার মত করে বসে আছে ছেলেটা। বৃষ্টিতে ভিজছে। পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে বয়েস।
হোসনে আরা বেগমের ছোট ছেলেটা যে লেখকটার মহা ভক্ত- সেই লেখকের একটু পর ফাঁসি হতে যাচ্ছে।
উঠানে ধ্যানে বসে থাকা ছেলেটাই লেখক আবিদ হাসান।
মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা পূরণের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিল আবিদ হাসানের কাছে। বিচিত্র এক ইচ্ছা জানিয়েছিল সে।
মৃত্যুর আগ মুহূর্তে শেষ বারের মত প্রাণ ভরে বৃষ্টিতে ভিজতে চায় সে।
হোসনে আরা বেগম কিম্বা জেলার সাহেব সেটা হয়ত মঞ্জুর করতেন না, কিন্তু কাকতালীয় ভাবে বৃষ্টি শুরু হয় এ সময়।
আর আবিদ হাসানেরও সুযোগ মেলে শেষ বারের মত বৃষ্টিতে ভেজার।
স্ত্রী ফারিহা হাসানকে হত্যার দায়ে তাকে ফাঁসি দেয়া হবে একটু পর। হোসনে আরা বেগম মেনে নিতা পারছেন না সেটা।
কোথায় যেন ঠিক মিল নেই পুরো ব্যাপারটায়। খাঁপ ছাড়া, বেমানান লাগছে। ঘড়ি দেখে ছাতা হাতে উঠানে নেমে এলেন।
আবিদ হাসানের পেছনে এসে দাঁড়ালেন। চোখ বন্ধ করে ভিজছে আবিদ।
“তোমার ফাঁসির সময় হয়ে গেছে ।” পেছন থেকে ইতস্ততঃ গলায় বললেন হোসনে আরা।
চোখ খুলে তাঁর দিকে তাকাল, “হুম, জানি।” অদ্ভুত ভাবে হাসল।
“আমার ছোট ছেলেটা তোমার লেখা অনেক মিস করবে আবিদ।” আবিদের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।
ওর চোখে এমন কিছু আছে- বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।
“তাই নাকি!” বিদ্রুপের হাসি ফুটল আবিদের মুখে।
“ফারিহাকে খুন করার ব্যাপারটা আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না! কেন করলে এটা?”
“ঐ যে, বেশি ভালবাসতাম!” হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল আবিদ।
দু’দিক থেকে দু’জন গার্ড এসে আবিদের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল বৃষ্টির মাঝেই।
হোসনে আরা আরো কিছু বলার জন্য মুখ খুলেও থেমে গেলেন। এখন কিছু বলে আর লাভ নেই।
ফাঁসির কাঠগড়ায় নিয়ে যাওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়াটা যেন চোখের পলকে ঘটে গেল।
ফাঁসির পূর্বে মাথায় কালো কাপড় লাগাতে দিল না আবিদ, “বৃষ্টির শেষ ফোঁটাটা মুখে পড়ুক, ওভাবেই না হয় বিদায় নিলাম!”
হাসতে হাসতে বলল আবিদ। হোসনে আরা কিছু বললেন না। ছেলেটার স্নায়ুর জোর অস্বাভাবাবিক বলে মনে হল তাঁর।
রুমালটা হাত থেকে ফেলার আগ মুহূর্তে হোসনে আরা আবিদের মুখের দিকে তাকালেন।
আবিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে বিচিত্র একটা তৃপ্তির হাসি।
বিড়বিড় করে কি যেন বলছে… শোনা যাচ্ছে না…
হোসনে আরা চোখ সরিয়ে নিলেন…
রুমালটা ধীরে ধীরে বৃষ্টির মাঝে ভাসতে ভাসতে মাটিতে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল……
২.
বাসায় ফেরার জন্য গাড়িতে উঠতে যাবেন এমন সময় জেলার সাহেব পেছন থেকে ডাকলেন হোসনে আরাকে, “ম্যাডাম।”
ফিরে তাকালেন, “কিছু বলবেন?”
হাতে একটা খাম নিয়ে ছাতা হাতে এসেছেন জেলার সাহেব। সেটা বাড়িয়ে ধরলেন, “আবিদ হাসান দিয়েছিল আপনাকে।
বলেছিল সে মারা যাওয়ার পর যেন এ চিঠি আপনাকে দেয়া হয়। খুলে না পড়তে অনুরোধ করেছিল আমাকে।”
গাড়ির দরজাটা আবার বন্ধ করে ছাতা হাতে ঘুরলেন অবাক মুখে হোসনে আরা। হাত বাড়ালেন, “দেখি?”
জেলারের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে খোলা মাত্র হোসনে আরা জমে গেলেন।
“ আপা,
খুব অবাক হচ্ছেন ? মরার আগে কেউ চিঠি লিখবে- তাও জেলে বসে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে- অবাক হবারই কথা।
বৃষ্টিতে ভিজে মরার খুব ইচ্ছা ছিল, এখনো জানি না সেটা পুরণ হয়ে মরবো কিনা। তবে মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে।
বৃষ্টি অনেক ভালবাসত ফারিহা, পাগল ছিল এক রকম বৃষ্টিতে ভেজার জন্য। আমাকে নিয়ে জোর করে প্রায়ই ছাদে উঠে ভিজত বৃষ্টিতে।
ফারিহা যে রাতে মারা যায় সে রাতেও অনেক বৃষ্টি হয়েছিল। আমি রিডিং রুমে পড়ছিলাম। হঠাৎ ছাদে ফারিহার আর্তনাদ শুনতে পেলাম।
যতক্ষনে ছুটে গেলাম- ততক্ষনে পেটে চাকুটা বিধিয়ে ফেলেছে। করার কিছু ছিল না।
ক্যান্সারে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে আগেই মরে যাওয়াটা ভাল মনে করেছিল।
আর আমি ওকে ছাড়া বেঁচে থাকার খুব একটা বড় যুক্তিও দাঁড় করাতে পারছিলাম না সে মুহূর্তে।
লেখক মানুষের মেরুদন্ডে জোর বরাবরি কম থাকে। আমারও তাই। ফারিহার মত আত্নহত্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সব সময় যে কোনো কাজ করতে পেছন থেকে একটা ধাক্কা প্রয়োজন ছিল আমার। ধাক্কাটা ফারিহা-ই দিত এতটা দিন।
কিন্তু এখন ধাক্কা দেয়ার জন্য আর কেউ অবশিষ্ট নেই। তাই ওকে খুন করেছি বলে দাবি করলাম। যাতে ওর সাথে আবার দেখা মেলে।
মরার আগে বোধ হয় সাহিত্যিকদের সাহিত্যে ভাঁটা পরে- দেখছেন না কি যাচ্ছে তাই ফালতু চিঠি লিখেছি! হা-হা!
তবে একটা ব্যাপার কি জানেন, ভালবাসায় বোধ হয় যুক্তি থাকে না।
থাকলে ফারিহা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করত- আরেকটু বেশি সময় আমার পাশে থাকত,
আরেকটু বেশি স্মৃতি দিয়ে যেত আমাকে এ সময়টা একাকি পার করার জন্য।
একজন লেখক অনেক সুন্দর সুন্দর কাহিনী সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু তার নিজের কাহিনীটা কখনো সুন্দর হয় না।
হয়ত আমার কাহিনীটাও তেমন-ই রয়ে গেল। শুধু তৃপ্তি এখানটায়- ফারিহা আমাকে ফাঁকি দিতে পারেনি ।
– আবিদ “