রাহু

রাহু

রাত টা বোধ হয় আজ একটু বেশীই অন্ধকার তপুর কাছে। সারা আকাশ খুঁজে কোথাও একটু রোমান্টিকতার চিহ্ন পেল না ও। রাহু যেন চাঁদটাকে একটু একটু গ্রাস করে ফেলছে। একটা রেজাল্ট কি জীবনের সবকিছু এতোটা বদলে দিতে পারে। কেড়ে নিতে পারে সবকিছু? জীবনের সব একাগ্রতা ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে পারে? প্রশ্নটা নিজেকেই করল তপু। কোনো জবাব নেই নিজের কাছে। হয়তো কারো কাছেই থাকে না, যখন এমন অসহায়ত্ব নিজের সামনে এসে দাঁড়ায়। আগে উপযুক্তো হও, তারপর প্রত্যাশা কর। মহাপুরুষদের দেয়া এই উক্তিটাই হয়তো জীবনের মৌলিক সূত্র। না হলে তার জীবনের যোগ বিয়োগ গুন ভাগ সব কিছুতে এতোটা গরমিল হতে পারে?

খবরটা প্রথম শুনে সেদিন যেন তপুর মাথায় সারা আকাশটা ভেঙ্গে পড়েছিল। আর সবার মতো ওর নিজেরও বিশ্বাস হতে চায়নি। হায়ার সেকেন্ডারিতে এসে ওর রেজাল্ট আটকে যাবে এটা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি তপু। এস এস সির গন্ডিটা প্রত্যাশিত ফলাফল নিয়েই পেরিয়ে এসেছিল ও। স্কুলে বরাবর প্রথম স্হানটা ওর জন্যই নির্ধারিত ছিল। স্কুল সেকেন্ডারিতেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। হায়ার সেকেন্ডারিটা স্টেজ টা প্রতিটা ছাত্রের জন্যই জীবনের সব চেয়ে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকে। জীবনের বৃহত্তর লক্ষ্যের উত্থান পতনের ভিতটা বোধহয় এখান থেকেই তৈরি হয়। অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এ স্তরের রেজাল্টই সবার জীবনে সব চেয়ে বেশী গুরুত্ব বহন করে।

স্কুল জীবনে এইম ইন লাইফ লেখার সময় প্রতিটা ছাত্রই ডাক্তার, ইন্জ্ঞিনিয়ার হওয়ার স্বপক্ষে খাতায় যুক্তির পর যুক্তির বন্যা বইয়ে দেয়। এইচ এস সি লেভেলে যারা লক্ষ্যটাকে স্হির রাখতে পারে তারাই কাঙ্খিত জাইগায় পৌঁছে যায়। তপু নিজেও এদের ব্যাতিক্রম ছিল না। বড় হওয়ার মরু তৃষা নিয়েই কলেজে পদার্পণ করেছিল। কিন্তু ওর জীবনের দোতারা কবে উল্টো সুরে বেজেছিল? তবে কি ওর জীবনে শিপ্রার অনুপ্রবেশ—? রাত্রির নিকষ কালো অন্ধকারের মতো এমন হাজারও প্রশ্ন আজ ওকে ঘুণ পোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে।

আর দশটা ছেলের মতো তপু নিজের ভালবাসা কে জীবনে বিধাতার শ্রেষ্ঠ উপহার ভেবে নিয়েছিল। শিপ্রাকে পেয়ে জীবনের লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়েছিল। শিপ্রাকে নিয়ে স্বপ্নের পর স্বপ্নের জাল বুনেছিল। অপরিসীম উচ্ছাসে ভেসে গিয়েছিল। রিলেশন টা গাঢ় হবার পর তপুর প্রতিটা দিন শুরু হতো নিজের শিরা উপশিরায় শিপ্রার উপস্হিতি নিয়ে। রাত নামতো শিপ্রার স্বপ্ন চোখে নিয়ে। পাঠ্য বইয়ের পাতায় হয়তো কালো কালির হরফ গুলোর পরিবর্তে নিজের মানষ প্রতিমার মুখটাই অহর্নিশ দেখতে পেত। যার অনাকাঙ্খিত প্রাপ্তি ওর হায়ার সেকেন্ডারি থেকে ছিটকে পড়া।

কিন্তু একটা রেজাল্টই সব বদলে দিতে পারে? একটা অনার্চ পড়ুয়া মেয়ে তার চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলেকে বিয়ে করতে পারে? হয়তো এমনটি হলে একবিংশ শতাব্দির মানব সভ্যতা উল্টো দিকে ঘুরবে। ইতিহাস বিধদের হয়তো নতুন করে প্রেমের উপাক্ষাণ লিখতে হবে। শ্বাশত প্রেমের অনির্বান শিখা নিয়ে গল্প উপন্যাসে যতো মহামূল্যবান বানী সোনার হরফে লেখা হোক না কেন তা যে শ্রেফ সাহিত্যের পাতাকে মহিমান্বিত করার জন্য তা বোধ আজ তপুর মতো ভাল আর কেউ জানে না।

তপু আর শিপ্রার এক সাথে পথ চলা স্কুল লাইফ থেকেই। কলেজ লাইফে সেই মাত্রা টা গন্ডি পেরিয়ে গিয়েছিল। দুজনের হৃদয় উঠানে দুজনের অবাধ যাতায়াত দিনকে দিন যেন সমকালিন সব লাভ স্টোরি কে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তপু। জীবনের অভিষ্ট লক্ষ্যের চেয়েও বড় ভয় ছিল নিজের জীবন থেকে শিপ্রাকে হারানোর ভয়। জীবনের গন্তব্য থেকে একবার ছিটকে গেলে নতুন উদ্দোমে শুরু করার দিশাটা হয়তো সবাই পায় না। তপু কেও সব সময় একটা ভয়, একটা দ্বিধা তাড়া করে ফিরতো। নিজের পরিবারের অকুণ্ঠ সমর্থনে আবারও শুরু করে ছিল তপু। কিন্তু যে আশংকা টা তপুকে সব সময় ছায়ার মতো তাড়া করে ফিরতো তা এতো তাড়াতাড়ি ওকে গ্রাস করতে ছুটে আসবে ভাবেনি ও।

শিপ্রার জন্য একটা অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব। মধ্যবিত্ত বাঙালী সমাজের ঐতিহ্য টাকেই নতুন করে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। মেয়েরা প্রেমের ক্ষেত্রে যতোটা আবেগী, জীবনের বাস্তবতায় ততোটাই হিসেবি। মহা পুরুষদের মুখের অমিয় বানিটির সফল নাট্যরুপ দিতে নির্দ্বিধায় অতীত ভুলে বর্তমানের দিকেই দু হাত বাড়িয়ে দিয় শিপ্রা। একটা মাত্র রেজাল্ট ওদের শৈশব থেকে কৈশরে পা রাখা ভালবাসার মাঝে যে দেয়াল তুলে দিয়েছিল তা অতিক্রম করার কোনো রাস্তায় সারা পৃথবীর কোথাও খুঁজে পাচ্ছিল না তপু। আবার শিপ্রাকে জীবন থেকে বাদ দিতেও পারছিল না। তাতে নিজের হৃদয় টাকে নিজ হাতেই যখম করতে হয়। ক্ষত বিক্ষত করতে হয়। কিন্তু এতো বড় দক্ষ সার্জন হতে পারছিল না তপু।

পিছনের একান্ত সুখের মূহুর্ত গুলো মানুষ কি করে এতো সহজে ভুলে যায় ভেবে কোনো কুল পাচ্ছিল না তপু। নিজের অযোগ্যতা, অক্ষমতা গুলোকে বার বার সামনে এনেও নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছিল না। নিজের হৃদয়ের গোপন কুঠোরির ফরিয়াদ,আর্তি গুলো নিয়ে শিপ্রার সামনে দাঁড়িয়েছিল তপু। নিজের ভালবাসার শত সহস্র স্মৃতির দুয়ার খুলে দিয়েছিল। শিপ্রার অনুভূতির বন্ধ দুয়ার আর খুলতে পারেনি তপু। উল্কা একবার আকাশ থেকে ছিটকে গেলে তার অনিবার্য পরিণতি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া।

রাত্রি বাড়ার সাথে সাথে সেই চোরাবালিতেই ডুবে যাচ্ছিল তপু। অতৃপ্ত কোনো আত্মা যেন ওকে বার বার উপহাস করে বলছে আগামী কালের সূর্য্যদ্বয়টার সাথে সাথে তার শিপ্রা অন্যকারও হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে তার কাছ থেকে। সারা জীবনের নিঃসঙ্গতার ঘুটঘুটে অন্ধকার ওকে রাহুর মতো গ্রাস করছিল প্রতিটা মূহুর্ত। শুন্যতার ক্ষতটা যেন গভীর থেকে গভীর হচ্ছিল। না, শিপ্রাকে ছাড়া ও বাঁচতে পারবে না। কখন কিভাবে নিজের সব কিছু শিপ্রাকে দিয়ে ফেলেছে বুঝতেই পারেনি তপু। হয়তো এটাই বিধি। বিচ্ছেদের মূহুর্ত না আসা পর্যন্ত ভালবাসা নিজেও তার গভীরতা বুঝতে পারে না।

বার বার মনে হচ্ছিল এই আঁধার যদি আর শেষ না হতো। যদি এই রাত আর ভোর না হতো। মহাকালের আরও একটা মহা সত্য। কারো দুঃখেই সময় একটুও থমকে দাঁড়ায় না। সেই অন্ধকার কেটে গিয়ে আলো এসেছিল। রাত শেষ হয়ে ভোর এসেছিল। শুধু সেই ভোর, সে ভোরের আলো দেখা হয়নি তপুর। সুরতহাল রিপোর্টে ডাক্তার লিখেছিল শরীরে ফ্রিজিয়ামের মাত্রা অনেক বেশী।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত