ভালোবাসা

ভালোবাসা

মামা মেয়েটা হারাইয়া গেছে আমি যাইগা? আফনে অন্য একটা রিক্সা লইয়া যান গা। রিক্সা চলার মাঝখানে রিক্সাওয়ালার মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে এখবর শোনার পর অফিসে যাইতে ইচ্ছে হলোনা। আমি বললাম যাবোনা। আপনার সাথে করে আমাকেও নিয়ে যান। আমিও আপনার মেয়েকে খুঁজবো। রইজ মিয়ার কাছে জিজ্ঞাসা করলাম মেয়ের নাম কি?

‘ফুলি’ বয়স, গায়ের রঙ, উচ্চতা সবকিছু জেনে নিজ থেকেই এক বন্ধুকে বললাম নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির পোষ্টার বানাতে জ্বলদি। রিক্সা শহরের অপরিচিত কোন এক বস্তিতে থামলো। সূর্যের আলো ঠিক কবে এই গলির মাটি ছুঁয়ে দেখেছে আমি ঠিক আঁচ করতে পারছিনা। বস্তির পুরোটা অংশ জুড়ে স্যাঁতসেঁতে, ঝীর্ণ। পুরনো কোন ফ্যাক্টরির ভাঙা অংশে ১০-১২ পরিবারের বসবাস। নিশ্বাসেও কেমন বাজে গন্ধ। হঠাৎ চোখে পড়লো ‘আমার ফুলি কই আমার ফুলি কই’ বলে বলে এক মহিলা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রইজ মিয়া দৌড়ে স্ত্রীকে বুকে টেনে নিলো। চিন্তা করো কেন? ফুলিরে লইয়া আইতাছি। ফুলি যাইবো কই? মোস্তাকগো এনে খবর নিয়া দেখছো? ‘হগল জায়গায় দেখছি ফুলির বাপ, আমার ফুলি নাই’।

আমার বুকের ভিতরটা কেমন নাড়িয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। হারিয়ে যাওয়া বা মৃত্যু সংবাদ আমার মেনে নিতে একটু কষ্ট হয়। বর্ষার এক ভর দুপুরে আমার ছোট বোনটা যখন পানিতে ডুবে মারা যায় সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তখন আমার মাকে দেখেছিলাম কিভাবে চিৎকার দিয়ে প্রতি ১০ মিনিট অন্তর অন্তর অজ্ঞান হয়ে যায় একজন মা। ফুলির মাকে দেখে কষ্টটা বেড়ে গেলো। এই মানুষটা তো জানেই না তার মেয়েটা আছে কি নাই, কোথায় আছে কিংবা পড়ে আছে! শহর এক ঝঞ্জালের নাম। এক গলি থেকে অন্য গলিতে নেমে পড়লে যেখানে রাস্তা চিনা যায়না সেখানে ৬ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে কোথায়, কোন জায়গায় হারিয়ে আছে তা কে জানে! শহর অনেকটা মমতাহীন ও বটে। আমার গ্রামে ভীন দেশী বা অপরিচিত কাউকে চোখে পড়লেই মানুষজন কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে কোত্থেকে এসেছো? বাড়ি কোথায়? এইখানে কার বাড়িতে যাবা?

আর শহর যেন প্রতিটা মানুষের জন্যই ‘নিজের রাস্তা মাপো’ টাইপ ভাব। কতশত মানুষ পাশ কাটিয়ে চলে যায় মুহূর্তেই। কে কার খোঁজ নেয়? কে কাকে জিজ্ঞাসা করতে যায়- বাড়ি কই? কোথায় যাবা? অভুক্ত নাকি?
যেন নিজের রাস্তাটা মেপে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়াটার নাম ই শহর! ফুলি হয়তো শহরের ব্যস্ত কোন রাস্তায় অভুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দিক বেদিক! কেউ দেখেও তাকে দেখছেনা সে নিখোঁজ নাকি তার এই রাস্তার ঠিকানাটা ভুল! রইজ মিয়া বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো- বউ এত ফাগল অইলে অইবো? ফুলিতো আগেও হারাইয়া গেছিলো গা। আমরা ফাইছিলাম না? আইজকাও ফামু। একজন মেহমান আইছে। ডাইল ভাত রান্ধো বউ। ফুলিরে লইয়া আইতাছি!

রাস্তায় দিক বেদিক ঘুরছি। আমি যেহেতু ফুলিকে চিনিনা তাই রইজ মিয়ার পিছনে পিছনে যাচ্ছি শুধু।
এর মধ্যে অফিস থেকে কয়েকবার ফোন আসলো। ধরলাম না। অফিসের HR অর্পণার কাজিন। আমার মতো ভবঘুরে মানুষের জন্য অর্পণা চাকরীটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে যেন বিয়ের সম্বন্ধ নেওয়ার সময় আমার ব্যাপারে কিছু একটা বলতে পারে বাসায়। পান থেকে চুন খসলেই আমি নাকি অফিস কামাই দেই। এই অভিযোগ পাওয়ার পর অর্পণা তার HR কাজিনকে বলে দিয়েছে অফিস টাইম মিস হলে যেন আমাকে একাধিক বার ফোন দেওয়া হয়!
একাধিক ফোন রিসিভ না করে টেক্সট করে দিলাম ‘আমি আজ নিখোঁজ’। মামা একটা মাইকের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? রইজ মিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো – আফনে যে আজকে কি কারনে আছেন মামা, আর অনর্থক কষ্ট করতাছেন। আমি হেসে বললাম দুনিয়ার কিছুই অনর্থক না মামা। বাতাসে ধূলাবালি উড়তেছে মানে শহরের রাস্তাঘাট অপরিচ্ছন্ন, ধূলার পরিমান বেশী। ধূলাবালি উড়ার এটা হচ্ছে কারন আর অর্থ।

ছোটবেলায় আমি একটা বোন হারিয়েছি। হারানোর অর্থ কিংবা কষ্ট আমি বুঝি মামা! রইজ মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো না মামা মাইক লাগবোনা। এম্নিই খুঁজি দেহি আল্লাহ মিলায় কিনা। মাইয়ার মা কয় মাইয়া নাকি গাড়ি দেখলেই গাড়ির পিছনে ছুডে। কোন গাড়ির পিছনে দৌড় দিয়া এহন কই আছে কে জানে! বিকেল হলো খুঁজতে খুঁজতে। পরিচিত সব জায়গায় খোঁজ নিয়েও কোন খবর পাওয়া গেলোনা। বন্ধু ফোন দিয়ে বললো আচ্ছা পোষ্টার যে বানাতে বললি ছবি লাগবে তো, ছবি পাঠা একটা মেইলে। রইজ মিয়া বললো মেয়ের কোন ছবি নাই। ‘ছবি নাই, তুই ছবি ছাড়াই ছাপা’ বলে ফোনটা কেটে রইজ মিয়ার পিছন পিছন হাটছি।

অদ্ভুত ভাবে একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। রইজ মিয়ার মধ্যে মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার তেমন কোন তাড়া নেই। ফুলির মা’র মতো চেহারায় নেই মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো বিষাদের কোন ছাপ। রইজ মিয়া কষ্ট চাপিয়ে রাখার অভিনয় করছে কিনা বুঝতে পারছিনা। তবে যেহেতু তার মেয়ে এর আগেও হারিয়ে গিয়েছিলো এবং খোঁজেও পেয়েছিলো, হতেপারে সেজন্য তার মধ্যে তাড়াহুড়ো কম। তার বিশ্বাস মেয়েকে সে পাবেই। মামা চলেন বাসায় যাই। বউডার কি অবস্থা দেহি। চাইরটা ডাইল ভাত খাইয়া অবস্থা বুইঝা পরে আবার খুঁজবোনে। অর্পণাকে টেক্সট দিয়ে বলেছিলাম বন্ধুর ছাপাখানা থেকে পোস্টার গুলো নিয়ে আসতে। সেজন্য রইজ মিয়াকে বললাম মামা অপেক্ষা করুন, ১০ মিনিট পর যাই। পোস্টার গুলো আসুক।

ফুলির মা খাবার নিয়ে বসেছিলো। যেন সে জানতো এ সময়েই আমরা ফিরবো। ভেবেছিলাম ফুলিকে না নিয়ে ফিরতে দেখলে উনি আবার ভেঙে পড়বে। কিন্তু কিছুই হলোনা। হাসিমুখে আমরা খেলাম। ফুলির মা অর্পণাকে খুব কদর করলো। অর্পণা মাঝে মাঝে আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। হয়তো বুঝাতে চাচ্ছে মেয়ে হারিয়ে গেলে এত হাসিখুশী খাইতে পারে কিভাবে? এটা নিঃসন্দেহে আমার অফিস কামাই দেওয়ার পায়তারা ছিলো! চোখ রাঙানি দেখে বুঝলাম বাহিরে গেলে আমার খবর আছে। খাওয়া শেষ হবার পর ফুলির মা আমাদের পান বানিয়ে দিলো। আমি পান মুখে নিলেও অর্পণা পান হাতে নিয়ে বসে আছে। সে যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। আসলে এই মুহূর্তে আমিও কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা। সকালে দেখেছিলাম কি আর এখন দেখছি কি!

পান মুহে দাও মা। দুফুইরা খাওনের ফরে পান খাইলে বেরেইন(ব্রেইন) সরশ থাহে! ফুলির মা’র কথা শুনে অর্পণা পান মুখে দিলো। এর মধ্যে রইজ মিয়া কথা আছে বলে আমাদের দুজনকে বাহিরে নিয়ে আসলো। ‘মামা দিনটা আমার লগেই ছিলেন। কেন ছিলেন জানিনা। তয় শহরে একজনের লাইগা আরেকজন এম্নে নিজের কাজ কাম বাদ দিয়া উজাড় কইরা দিতারে আফনেরে না দেখলে জানতাম না। বউডা আমার ফাগল। ১৫ বছর আগে বিয়া করছিলাম। ১৩ বছর আগে বাচ্চা অইলো, কিন্তু বাচ্চা মরা। ডাক্তার কইলো বউডা আমার আর নাকি মা অইতে ফারবোনা। বাচ্চার নামডা ফুলি রাখতাম। সেই থাইকা বউডা ফুলি ফুলি করে।

ফুলিরে খাওয়াইয়া দেয়, গোসল করায়, পড়ালেহা শিহায় আবার ফুলি হারাইয়া গেলো বলে চিৎকার পারে। এমন কইরাই গত ১৩ বছর। হারাইয়া গেছে যহন মনে অয় তহন পাগলামিডা একটু বেশী করে। আমার ফুলিরে খুঁজতে অয়, খোঁজার অভিনয় আরকি।’ অর্পণা রইজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে এক পলক! আমিও! জীবনটা যদি মরুভূমির উষ্ণ খরতাপে টিকে থাকার ময়দান হয় তবে ভালোবাসা হচ্ছে সেখানকার বট বৃক্ষ। ভালোবাসার আশ্রয়ে টিকে থাকা যায়, টিকিয়ে রাখা যায়! শুধু ছায়া হয়ে দাড়াতে হয়! পোস্টার গুলো রইজ মিয়া রেখে দিলো। বউকে নিয়ে প্রতি রাতে সে নাকি ফুলির নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে বেড়াবে। ফুলির মা এতে খুশী হবে। মেয়েকে ফিরে পাওয়ার জন্য যেকোন কাজেই ফুলির মা খুব খুশী হয়!

আমি অর্পণা হেটে যাচ্ছি পাশাপাশি, নিশ্চুপ। নীরবতা ভেঙে বললাম – অফিস কামাই দেওয়াতে রাগ করেছো? ‘উঁহু’ অর্পণার হাতটা নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে ভাবছি জীবনের গল্প গুলো কেমন অদ্ভুত সুন্দর! কেউ ভালোবাসা টিকিয়ে রাখার জন্য নিজে যুদ্ধ করে প্রেমিক কে চাকরী পাইয়ে দেয় আবার কেউ ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিদিন মিথ্যে হারিয়ে যাওয়া মেয়ে খুজেঁ বেড়ায়! সত্যি বলতে কি, দিনশেষে আমরা প্রতিটা মানুষই কেমন ‘নিঃশেষে ভালোবাসায় বিভাজ্য’!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত