জোঁনাক জ্বলা ভালবাসা

জোঁনাক জ্বলা ভালবাসা

“হয় সংসার নয় চাকরি দুটার মধ্যে তোমায় একটা বেছে নিতে হবে”। দিয়ার দিকে তাকিয়ে মারুফ চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে। দিয়া চোখভর্তি জল নিয়ে মারুফের দিকে তাকিয়ে থাকে। মারুফের যা বলার বলা শেষ। সে তখন টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করায় মন দেয়।

দিয়া চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। মারুফকে সে প্রতিত্তোরে অনেককিছুই বলতে পারতো। কিন্তু যার কাছে চোখের জলের কোন দাম নেই, মুখের ভাষা যে তার কাছে অর্থহীন মনে হবে- এটা দিয়া বেশ ভাল ভাবেই জানে। উপরের ঘটনার বছর দুই আগের ঘটনা! দিয়ার সাথে রনির শেষ কথা হয়েছিল বছর দুই আগে। সে দিয়ার দুই ব্যাচ সিনিয়র। তো যাইহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে রনি দুইটা কাজ করতোঃ এক. পলিটিক্স টলিটিক্স করতো। দুই. সময় পেলে দিয়ার পেছন পেছন ঘুরতো। দিয়ার হাজার বারণেও রনিকে বুঝানো যায়নিঃ দিয়া, রনি এবং তার কর্মকাণ্ড; কোনটাকেই পছন্দ করে না।

কিন্তু কে শোনে কার কথা! আর এভাবেই চলছিল সবকিছু। হঠাৎই ক্যাম্পাসে মারামারি! দুদলের প্রচন্ড সংঘর্ষে রনি মারাত্মকভাবে আহত হয়। সত্যিকথা বলতে- দিয়ার এটা শোনার পরে তেমন একটা ভাবান্তর হয়নি। রাজনীতি করলে টুকটাক মার হজম করতে হবে এটা কে না জানে। তবে দিয়ার প্রচন্ড কান্না পেয়েছিল সেদিন, যেদিন রনির বন্ধু শাহীন দিয়ার কাছে রনির একটা চিঠি নিয়ে আসে। রনির মানিব্যাগে চিঠিটা ভাঁজ করে রাখা ছিল। ছোট্ট একটা কাগজে চার লাইনের কবিতা!

“এত্ত হাসি এত্ত আগুন এত্ত মায়াজল। এক পৃথিবী আলো ছেড়ে আমার সঙ্গে চল্। হাতে আমার হাতটি রেখে জোনাক হোস্ তুই। আঁধার হয়ে রাত্রি বেলায় তোর সে জোনাক ছুঁই”। আজ শুক্রবার। বেশকিছু কাজ জমা হয়ে আছে। অনেকগুলো কাপড় ধুতে হবে। রান্নাবান্নার আয়োজন করতে হবে। তাদের মোটে দুজনার সংসার কিন্তু প্রতিদিনই তাকে মারুফের জন্য কয়েক পদের রান্না করতে হয়। দিয়ার এতে তেমন একটা অসুবিধা হয় না কিন্তু খেতে বসে মারুফ যখন রান্নাবান্নার খুঁত ধরতে থাকে দিয়ার চোখ তখন ছলছল করে ওঠে!

মারুফের কন্সট্রাকশনের বিজনেস। সারাক্ষণ তাকে ব্যবসার কাজে তুমুল ব্যস্ত থাকতে হয়। দিয়াকে সময় দেবার মতো সময় মারুফের হাতে নেই। কিছু কিছু মানুষ আছে; ভাবে- এক ছাদের নিচে পাশাপাশি থাকলেই, ঠিকমতো খেতেপড়তে দিতে পারলেই; বোধহয় সংসার করা হয়ে যায়। পাশে থাকা মানুষটার কষ্টগুলোকে যতোক্ষণ না ছুঁয়ে দেখতে পারা যায়, এরকম শতশত বছর এক সাথে পার করলেও সেটা আর যাইহোক; সংসারযে হবে না- এ কথা মারুফ কখনো বুঝেনি, বুঝতে চায়ও নি। চব্বিশশো বর্গফুটের বিশাল এক ফ্লাটে দিয়ার একা একা সময় কাটানোটা ছিল প্রচন্ডরকম কঠিন একটা কাজ। আর তাই ইংরেজিতে মাস্টার্স করা দিয়া একটা চাকরি খুঁজছিল। অবশেষে পত্রিকার অফিসে তার একটা চাকরি হয়েও যায়। মাস শেষে তার হাতে বেশকিছু টাকা এসে জমতে লাগলো। ছোট ভাইটাকে পড়াশোনার জন্য কিছু দেবার পরেও দিয়ার হাতে বেশ খানিকটা টাকা পড়ে থাকতো।

বিয়ের পর মারুফ নিজে থেকেই বলেছিল দিয়ার ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার জন্য যদি কোন আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন হয় সেটা মারুফ ব্যবস্থা করে দিবে। মারুফ যে সাহায্য করতো না তা কিন্তু না। তবে মাঝেমধ্যেই দিয়াকে এর জন্য অনেক অপমান সহ্য করতে হতো। চাকরিটা পাবার পরে ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার জন্য মারুফের দিকে চেয়ে থাকতে হচ্ছে না এটাই দিয়াকে পরম মানসিক শান্তি দিত। দিয়া রান্নাঘরে। একমনে মাছ কুঁটছিল। পেছনে মারুফ এসে দাঁড়ায়।

-তুমি কি আমার কথায় রাগ করেছো দিয়া? দিয়া পেছন ফিরে শুধু তাকায়, কিছু বলে না। দিয়া জানে- মিষ্টি এ কথার পরে এখন কী ঘটবে! মারুফ দিয়ার সামনে টুলটা টেনে এনে বসে।

-রনির সাথে কি এখনো কথা হয়? দিয়া এখনো নিশ্চুপ।

-কিরে কথা বলিস না ক্যান? তোর পুরান নাগরের সাথে এখন আর কথা হয় না? নাকি এখন নাগরের লগে অন্যকিছু করা শুরু করছোস? মারুফ খেঁকিয়ে ওঠে।

-একজন মানসিক প্রতিবন্ধীর সাথে কথা বলা যায় মারুফ? দিয়া এক নিশ্বাসে কথাটা বলে।

-রনি যে পাগলের ভং ধরে নাই এইটাও বা অবিশ্বাস করি কেমনে?

কথাটা বলে মারুফ ফোসফোস করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। দিয়া খুব শক্ত ধাঁচের মেয়ে। নিজের কাছে নিজে সে আরো ভালভাবে প্রতিজ্ঞা করে- চাকরি সে ছাড়ছে না, ছাড়বে না এ সংসারও!

শেষ কথাঃ দিয়া আজো জানে না রনির সে চিঠিটা কার জন্যে লেখা! হয়তো তার জন্যে, নয়তো অন্য কারো জন্যে। তবু সে মনে প্রাণে চাচ্ছে- চিঠি লেখার মানুষটা ভাল হয়ে উঠুক। ভালবাসার কথা যে এত সুন্দর করে লিখতে পারে, তার এভাবে পৃথিবীকে ফাঁকি দিয়ে চুপচাপ সরকারি মেন্টাল হসপিটালে বসে থাকাটা মানায় না! দিয়া টাকা জমাচ্ছে। একদিন সে টাকায় রনির চিকিৎসা হবে!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত