লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলে আসলে কিছুই হয় না, কথাটা আরিফের বন্ধুরা ওকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু কারো কথাই শোনেনি আরিফ৷ সে সিনেমার মত একটা প্রেম হওয়ার অপেক্ষায় আছে। রাস্তায় যেতে যেতে কোনো একটা মেয়ের চোখে চোখ পড়বে, দুনিয়া স্লো মোশনে চলা শুরু করবে, চারপাশের পরিবেশ গোলাপি রঙ ধারণ করবে, ব্যাকগ্রাউন্ডে টুং টাং গিটারের সুর বাজবে, তারপর তাদের মাঝে জনম জনমের প্রেম হয়ে যাবে। আগে থেকে ভেবেচিন্তে, ফোনে কথা বলে বলে, একসাথে ঘুরাঘুরি করে কোনোদিন প্রেম হয় নাকি? ধুর! এজন্যই পাক্কা ছাব্বিশ বছর ধরে সিঙ্গেল আরিফ।
ওর সবচাইতে লাজুক ফ্রেন্ডটারও চার নাম্বার প্রেম চলছে, সবচাইতে ভদ্র ফ্রেন্ডও শতাধিক চুমু খেয়ে ফেলেছে, সবচাইতে চরিত্রবান ফ্রেন্ডটাও এখন পর্যন্ত লিটনের ফ্লাটে গিয়েছে তিনবার। আর আরিফ বসে আছে কবে কার সাথে ধাক্কা লাগবে, কার চোখে চোখ পড়বে, কোন মেয়ের ওড়না বেধে যাবে ওর ঘড়ির সাথে। বন্ধুরা হাসাহাসি করে। বলে, ‘তুই আসলে সিনেমার নায়ক ঠিক আছে। কিন্তু তোর সিনেমার নাম হল প্রেম বিরহী। আর তুই নায়ক বাপ্পারাজ। তোর জীবনে কোনোদিন প্রেম আসবে না।’ আরিফ রাগি রাগি গলায় বলে, ‘হাসো, বেশি করে হাসো। কিন্তু যেদিন আমার দিন আসবে, সেদিন দেইখো।’
তারপর ফাইনালি আরিফের দিন আসে। না না, রাত আসে ঠিকভাবে বলতে গেলে। রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে বন্ধুর বোনের বিয়েতে পঞ্চগড়ের তিসিখালি গঞ্জে যাওয়ার সময় ট্রেন ছেড়ে দেয়ার এক সেকেন্ডের মাথায় একটা মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আসে প্লার্টফর্ম ধরে। ঠিক দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গের কাজলের মতন, চেন্নাই এক্সপ্রেসের দিপীকার মতন, শুভ মঙ্গল জিয়াদা সাবধানের আয়ুস্মান খুরানার মতন। শাহরুখ খানের মত হাত বাড়িয়ে দেয় আরিফ। মেয়েটা আরিফের হাত ধরা মাত্রই চারপাশ রঙিন হয়ে যায়, দুনিয়া স্লো মোশনে চলতে শুরু করে, মাথায় মধ্যে বাজতে থাকে, ‘তুঝে দেখা তো এ জানা সানাম!’
ছাব্বিশ বছরের জীবনে প্রথমবারের মত প্রেমে পড়ে আরিফ।
মেয়েটা আরিফের সামনের সিটেই বসে। ফোন বের করে টিপতে থাকে। আরিফ ভাবে কিভাবে কথা শুরু করা যায়! কাল সকালে ট্রেন তিসিখালি পৌছানোর আগ অব্দি একটা মাত্র রাত আছে ওর হাতে। ছাব্বিশ বছরের জীবনে সবচাইতে মূল্যবান, সবচাইতে আকাঙ্ক্ষিত এই রাত। আচ্ছা, মেয়েটা কি সিঙ্গেল? যদি বয়ফ্রেন্ড থাকে? যদি বিবাহিত হয়? নির্ঘাত সুইসাইড করবে আরিফ।
ওর জীবনে সবুজ প্লাজো আর আকাশী টপ পরা এই মেয়েটাকে লাগবেই। মেয়েটার ফোনে কল আসে। দীর্ঘসময় ধরে কারো সাথে কথা বলে মেয়েটা। আরিফ যতটুকু বুঝতে পারে ওপাশে মেয়েটা যেখানে জব করে সেখানকার বস হবে সম্ভবত। দশ মিনিট মনোযোগ দিয়ে কথা শুনে আরিফ দুইটা মূল্যবান জিনিস জানতে পারে। প্রথমত, মেয়েটার নাম জিনিয়া। দ্বিতীয়ত, মেয়েটা হঠাৎ পড়ে যাওয়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিসিখালি যাচ্ছে, খুব দ্রুতই ঢাকা ব্যাক করবে। মেয়েটা কথাটা বলেছে ঠিক এভাবে, ‘হ্যা স্যার, আমি কাজ শেষ করেই ঢাকা ব্যাক করতেছি। আপনি একদম টেনশন করবেন না। যত দ্রুত সম্ভব আমি আবার ঢাকার ট্রেনে উঠবো।’
এরমধ্যেই ঘটে আরিফের জীবনের সবচাইতে বড় দূর্ঘটনা। জিনিয়া নামের মেয়েটার সাথে কিভাবে কথা শুরু করা যায় ভাবতে ভাবতে ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়ে আরিফ। বন্ধুদের ডাকে যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল সাড়ে নয়টা। লাফ দিয়ে ওঠে আরিফ, ‘আমি কোথায়? মেয়েটা কই? ট্রেন কখন থেমেছে?’ রাজন হাসে, ‘কোন মেয়ের কথা বলছিস? ট্রেন সেই সকাল সাতটায় তিসিখালি স্টেশনে এসে পৌছেছে। তুই ঘুমাচ্ছিলি বলে ডাকিনি। আমরা চা নাস্তা করে আসছি। তুইও যা।’
– মানে? জিনিয়া কই?
– কোন জিনিয়া?
– আমার সামনে যে মেয়েটা বসেছিলো!
ব্যাগ গুছাতে গুছাতে রাজন বলে, ‘আমার অতো খেয়াল নেই। ট্রেনের সব যাত্রীই সেই কোন সকালে নেমে বাড়ি চলে গেছে। এখন ওঠ তুই।’ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে আরিফ। শেষ, সব শেষ। তার জীবন পুরোপুরি ফিনিশ। জীবনের প্রথম প্রেমে পড়েও সামান্য ঘুমের জন্য সে মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললো। এখন ও কি করবে! কোথায় যাবে! জিনিয়া নাম আর কল্পনায় একটা চেহারা সম্বল করে ঢাকা, পঞ্চগড়, তিসিখালির কোথা থেকে খুজে বের করবে মেয়েটাকে? এটা কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব না৷ এদিকে বন্ধুরা তাড়া দেয় দ্রুত উঠে ট্রেন থেকে বের হতে। যে বন্ধুর বোনের বিয়ে তার বাসা থেকে লোক এসেছে ওদের নিয়ে যেতে। ঠিক তখনই আইডিয়াটা আসে আরিফের মাথায়। আস্তে করে সীটের ওপর বসে বলে, ‘আচ্ছা রাজন, আমরা ট্রেনে কেন আসছি? বাস, লঞ্চ বা প্লেনে কেন আসিনি?’
– কারণ পঞ্চগড়ের এই জায়গাটায় বাস বা লঞ্চ চলে না৷ এয়ারপোর্ট ও নাই। থাকলেও প্লেনে আসার মত টাকা আমাদের কাছে ছিল না। কিন্তু কেন বল তো? আরিফ মুচকি হাসে, ‘তোরা বিয়েতে যা, আমি যাবো না।’
– মানে কি?
– মানে হলো আমি এই স্টেশনে ওয়েট করবো। জিনিয়ার ঢাকা ফিরতে হলে এখান দিয়েই ফিরতে হবে। অন্য কোনো পথ নেই।
– তুই কতদিন ওয়েট করবি?
– যতদিন জিনিয়া ঢাকা ফেরার জন্য এই তিসিখালি ট্রেন স্টেশনে না আসে!
বন্ধুরা বহু অনুনয় বিনয় করে। কখনো রাগ করে ঝাড়ি দেয়। কিন্তু আরিফকে টলাতে পারে না। সে শুধু বলে, ‘আমি বিয়েতে যাওয়ার পর যদি জিনিয়া ঢাকা চলে যায়? তাহলে তো আর কোনোদিন দেখা পাবো না। এখানে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই আমার।’ বন্ধুরা শেষমেষ বাধ্য হয় ওকে ছাড়াই বিয়েতে যেতে৷ তিনদিন পর অনুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পথে স্টেশনে আবার দেখা হয় আরিফের সাথে। কিন্তু আরিফ ঢাকা যাবে না। রাজন রেগে যায়। বলে, ‘দেখ, অনেক হইছে আর পাগলামি করিস না। ঢাকা চল আমাদের সাথে।’
– জিনিয়া এখনো আসেনি।
– প্লিজ, দুনিয়ায় মেয়ের অভাব নেই। তোর পায়ে পড়ি। চল তুই।
– জিনিয়া এখনো আসেনাই রে।
– আমরা ঢাকা গিয়ে ওকে খুজে বের করবো। সবাই মিলে খুজবো। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দিয়ে খুজবো। তুই ঢাকা চল ভাই আমার।
আস্তে করে আরিফ শুধু বলে, ‘কিন্তু জিনিয়া এখনো আসেনি যে।’ তিসিখালি স্টেশনে শুরু হয় জিনিয়ার অপেক্ষায় আরিফের দিন গোনা। পাশের হোটেলে ভাত খেয়ে প্রতিটা ট্রেন ছাড়ার আগে সামনে এসে দাঁড়ায় ও। দিন রাত কোনো বিরাম নেই। স্টেশনে পাটি পেতে ট্রেনের টাইমটেবিল অনুযায়ী এলার্ম দিয়ে অল্প অল্প করে ঘুমায়। ট্রেন ছাড়ার সময় হলেই দ্রুত ঘুম থেকে উঠে খোজ নেয়৷ কোনো কম্পার্টমেন্টে মেয়েটা আছে কিনা। নেই। নেই তো নেই। সপ্তাহ চলে যায়। দেখতে দেখতে এক মাস। মেয়েটা যেন গায়েব হয়ে গেছে। কিন্তু একটুও ক্লান্ত হয়না আরিফ। প্রতিদিন ঠিক টাইম মত ট্রেনের সামনে ওকে দেখা যায় আঁতিপাঁতি করে খুজছে মেয়েটাকে।
এভাবেই কেটে যায় তিন মাস। আরিফের বাসা থেকে ফোনের পর ফোন আসে। আরিফকে নিতে একবার ওর বড়ভাই এসে ওকে রাজি করাতে না পেরে ফিরে যায়। এরপর কাঁদতে কাঁদতে আরিফের মা আসে। রাগি চোখ নিয়ে আসে বাবা। কিন্তু কেউ ওকে একটুও টলাতে পারে না৷ আরিফ শুধু বলে, ‘জিনিয়া এখনো আসেনাই মা।’ আরিফের মা বলে, ‘বাবারে আমরা অনেক ভালো মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দেব৷ প্লিজ ফিরে চল তুই। তোর আল্লাহর দোহাই লাগে।’ আরিফ হাসে, ‘অন্য কোনো মেয়েকে আমি চাইনা মা। সে ক্যাটরিনা হলেও না। আমি আমার জীবনে একটা মেয়েকেই ভালোবেসেছি। ছাব্বিশ বছর অপেক্ষা করেছি শুধুমাত্র একটা মেয়ের জন্য। এই মেয়ে আমার প্রথম প্রেম মা। এ আমার শেষ প্রেমও।’
কাঁদতে কাঁদতে একসময় আরিফের মা ও ফিরে যায়। কিন্তু দেখা নেই জিনিয়ার। এভাবে একবছর কেটে যায়৷ কিন্তু আরিফ ঝড় বৃষ্টি রোদ শীত যা ই হোক না কেন, স্টেশন ছাড়ে না। প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে, কিন্তু হাসপাতালে যায় না। যদি এর মধ্যে জিনিয়া চলে যায়? তাহলে কি হবে ওর? বাসা থেকে আর কতদিন টাকা নেয়া যায়? নিজের পেট চালানোর জন্য প্রথমে স্টেশনে কুলির কাজ করে। তারপর পানি বিক্রি শুরু করে কম্পার্টমেন্ট ঘুরে ঘুরে। শেষমেশ একটা চায়ের দোকানে পার্মানেন্ট কাজ পেয়েছে। কাস্টমারদের চা বিস্কুট সার্ভ করে। কিন্তু শুধুমাত্র ট্রেন যতক্ষন না আসে ততক্ষন। ট্রেন ছাড়ার সময় হলেই যতই চাপ থাকুক দোকানে, আরিফ গিয়ে হাজির হয় জিনিয়াকে খুজতে।
আরো একবছর কেটে যায়। কাটে আরো এক বছর। কিন্তু দেখা নেই মেয়েটার। বন্ধুরা এসে বলে, ‘দেখ, জিনিয়া তিসিখালি গিয়ে মারা গেছে।’ আরিফ কোনো কথা বলে না। চুপ করে থাকে। বন্ধুরা আবার বলে, ‘অথবা দেখ ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ঢাকায় না ফিরে কোনো গ্রামে ঘর সংসার করছে।’ আরেক বন্ধু বলে, ‘নাহয় বর্ডার পার হয়ে নেপাল চলে গেছে তোর মেয়ে। ঢাকা ফেরার হলে এতোদিন ফিরত। তুই চল আমাদের সাথে।’ আরিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘কিন্তু জিনিয়া যে এখনো আসেনি দোস্ত।’ তুই থাক তোর বালের জিনিয়া নিয়ে, রেগেমেগে চলে যায় বন্ধুরা। কেটে যায় আরো এক বছর।
আরিফের ছোট ভাইয়ের মুসলমানি হয়। যায়না আরিফ। মেজবোনের বিয়েতেও যায় না। বাড়ির লোক আবারো আসে সবাই মিলে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। বড়ভাইয়ের বিয়ে হয়। যায়না আরিফ। ভাই ওকে ফোন দিয়ে বলে, ‘তুই না আসলে আমি বিয়ে করবো না।’ আরিফ কিছু বলেনা। হাসে শুধু। আরিফের ছোট ভাইয়েরও বিয়ে হয়ে যায়। বোনের বাচ্চা হয়। আরো কত অনুষ্ঠান হয় বাড়িতে। যায়না আরিফ। এভাবেই কেটে যায় মোট দশ বছর। তিসিখালি স্টেশনে আরিফ এখন অতি পরিচিত মুখ। সবাই ওকে চেনে পাগলা প্রেমিক নামে। দেখা হলেই জিজ্ঞেস করে, ‘মেয়েটা এসেছিলো?’ স্থানীয় পত্রিকায় ওকে নিয়ে খবর বের হয়, ‘প্রেমিকার জন্য প্রেমিকের দশ বছর অপেক্ষা’ শিরোনামে।
অনেকে ওর ফোন নাম্বার নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই আপনার প্রেমিকা এসেছে?’
একসময় তারা ক্লান্ত হয়ে ফোন করা বন্ধ করে দেয়। শুধু ক্লান্ত হয়না আরিফ। তিসিখালি স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন ছাড়ার বাশি দিলেই চিরাচরিত একটা দৃশ্য দেখতে পায় সবাই। মলিন মুখে এলোমেলো চুলের একটা ছেলে ট্রেনের দরজায় আঁতিপাঁতি করে খুজছে কাউকে। একেকজন আরিফের কাছে এসে বলে, ‘ভাই আমি তিন বছর আগে একবার এখানে এসেছিলাম। তখন আপনাকে দেখেছিলাম। আজ তিন বছর পর আবারো এসেছি। আপনি সেই মেয়েটাকে এখনো খুজে পাননি, তাইনা ভাই? আপনি এখনো ক্লান্ত হননি? আপনার কখনো অধৈর্য হয়ে খোজা ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করেনি?’ আরিফ ক্লান্তির হাসি হেসে বলে, ‘আমি ওকে ভালোবেসেছি যে! এতো সহজে অধৈর্য হলে কিভাবে চলবে!’
– আপনার কখনো অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছা করেনা? ভালো কোনো বিছানায় ঘুমাতে ইচ্ছা করে না? স্টেশনের হোটেল ছাড়া অন্য কোথাও খেতে ইচ্ছা করে না? দেশের অন্য কোনো জায়গা দেখতে ইচ্ছা করে না?
– করবে না কেন, অবশ্যই করে।
– তাহলে যান না কেন। একদিনের জন্য অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসুন।
আরিফ অনেক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলে, ‘কিন্তু জিনিয়া যে এখনো আসেনাই।’ পনেরাে বছর পর ফাইনালি একদিন ঢাকা ফেরে আরিফ। তাও মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য। আরিফের বাবা মৃত্যুশয্যায়। মা ফোন দিয়ে বলে, ‘তুই যদি আমার ছেলে হয়ে থাকি, আমি যদি তােকে পেটে ধরে থাকি, তাহলে তুই তাের বাবাকে শেষ দেখা দেখতে আসবি।’
আরিফের পাশে এসে দাড়ায় স্টেশনের সবাই। কুলি মজুর চাওয়ালা ঠেলাওয়ালা থেকে শুরু করে স্টেশন মাস্টার পর্যন্ত। সবাই বলে, ‘ভাই আপনি যান। আমরা আছি। এই স্টেশন দিয়ে কোনাে মেয়ে পরিচয় না দিয়ে আগামীকাল কোথাও যেতে পারবে না। আমরা সবাই সারাদিন স্টেশনে থাকবাে। জিনিয়া নামের মেয়ে তাে দূরের কথা, একটা মাছিও ঢাকা ফিরতে পারবে না আমাদের চোখ ফাকি দিয়ে।’ সজল চোখে বিদায় নেয় আরিফ। বলে, ‘একটা দিন আপনারা শুধু দেখে রাইখেন। আগামীকাল রাতের ট্রেনেই ফিরে আসবাে আমি।’
স্টেশনের বাদাম বিক্রি করা ছেলেটা বলে, ‘আরিফ ভাই, আমার জান চলে গেলেও আমি জিনিয়া ভাবীকে কাল। কোথাও যেতে দিব না এই স্টেশন দিয়ে।’ চাওয়ালা রফিকও আরিফের কাধে হাতরেখে বলে, ‘আপনার ভালােবাসা রক্ষার দায়িত্ব আগামীকাল এই তিসিখালি স্টেশনের প্রত্যেকটা মানুষের। আরিফ ঢাকা যায় বাবাকে দেখতে। পরদিন রাতের ট্রেন স্টেশনে ঢুকলে সবাই আরিফের জন্য দাড়িয়ে থাকে। কিন্তু নামেনা আরিফ। ভীষণ অবাক হয় তিসিখালি স্টেশনের সব মানুষ। সবাইকে আরাে অবাক করে দিয়ে পরদিনও ফেরেনা আরিফ। তারপরদিনও না। তার পরের দিনও না। স্টেশন থেকে আরিফের নাম্বারে ফোন করে ফোন অফ পাওয়া যায়।
আরিফের বাসার লােকজন তাে খুব খুশি। ছেলে তাদের ছেড়ে আর ফিরে যাচ্ছেনা। আরিফের মা মানত করে রাখা একশাে রাকাত নামাজ আর একমাস রােজা শুরু করে দেয়। বাসায় সব আত্মীয় স্বজন আসে। শুরু হয় আনন্দ উল্লাস। আরিফের বাবা যে মৃত্যুশয্যায় সেই হিসাব নেই কারাে। ছেলে ফেরার আনন্দেই আত্মহারা সবাই। একমাস কেটে যায়। আনন্দেও ভাটা পড়ে। বাসাও ফাকা হয়। আত্মীয়স্বজনরা একে একে যার যার বাসায় ফিরে যায়। প্রথম প্রথম আরিফের কাছে কেউ তিসিখালির ঐ মেয়ের ব্যাপারে কোনাে কথাই বলতাে না। কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর আরিফের বড়ভাই একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করে, ‘কি ব্যাপার, তােমার সেই মেয়েকে আর খুজতে যাবা না?’ আরিফের বড় ভাইয়ের স্ত্রী অর্থাৎ আরিফের ভাবী তখন। বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছিলাে। সেদিকে একবার তাকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরিফ বলে, ‘তার আর দরকার নাই আসলে।’
পরিশিষ্টঃ আরিফ সারাদিন বাসাতেই থাকে। ঘরে বসে বসে বাপ্পারাজের সিনেমা দেখে। আরিফের রুম ভর্তি বাপ্পারাজের ছবিওয়ালা পােস্টার। আরিফের ভাবী একদিন রুমে এসে বলে, ‘তুমি এর এতােবড় ফ্যান নাকি? এখন তাে এসব মুভি কেউ দেখে না। আমরা ছােটবেলায় দেখতাম। তবে ঐসময় আমি সালমান শাহ আর রিয়াজের ফ্যান ছিলাম।’ আরিফ জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা ভাবী আপনি কখনাে পঞ্চগড় গিয়েছেন লাইফে?’
– নাহ, একবার বিয়ের আগে পঞ্চগড়ের তিসিখালি গঞ্জে অফিসের কাজে যাচ্ছিলাম এক ক্লায়েন্টের সাথে মিট করতে। বাট মাঝপথে ফোন আসে সে নাকি পঞ্চগড় নেই৷ আমি তাই ঠাকুরগা স্টেশন থেকেই ব্যাক করে ঢাকা চলে আসি। কেন বলাে তাে। তুমি তাে ঐখানেই নাকি কোন মেয়ের আশায় পনেরাে বছর কাটায় এসেছাে শুনেছি। কি যেন নাম মেয়েটার?
– জিনিয়া।
– আরে কি মিল। আমার ডাক নামও তাে…
থেমে যায় আরিফের বড় ভাবী। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘আচ্ছা, আমি যাই। তােমার ভাইয়ের খাবার দিতে হবে। থাকো। বলেই দ্রুত বের হয়ে যায় ঘর থেকে। আরিফ বাপ্পারাজের ‘প্রেম বিরহী’ সিনেমাটা আবার গােড়া থেকে দেখা শুরু করে। খারাপ না মুভিটা। ভালােই লাগে!