ব্যাচেলর জীবন থেকে বিবাহিত জীবনে আসাটা আমার কাছে মোটেও সুখকর মনে হয় নি।
তিনবছর প্রেমের পর রাইসাকে বিয়ে করেছি। বিয়ের দিন শর্ত হয়েছিল,কেও কখনও ঝগড়া করবো না।
এবং এটাতে সই করাও লেগেছিল। আইডিয়াটা রাইসারই ছিল।
কিন্তু বিয়ের আটদিনের মাথায় সে ঝগড়া করে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিল।
তেরোদিন পর ফিরে এসে বলেছিল, ভুল হয়ে গেছে, আর কখনও ঝগড়া করব না।
রাইসা বলেছিল, রাত এগারোটার পর বাহিরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ,
এবং বাহির থেকে সব কাজ সেরে এগারোটার আগেই আসতে হবে।
তারপর ভাত খেয়ে দু’ঘন্টা গল্প করবো।এরপর ঘুম।আমি মেনে নিলাম। বোকা মেয়েরা স্বামীকে শাসন করে অকৃত্রিম আনন্দ পায়।
একবার আমার ফিরতে রাত বারোটা বেজে গিয়েছিল। বারোটা এমন কোনও রাত নয়। তাতেই রাইসা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।
কোনও কথা বলছে না,ঝাড়িও দিচ্ছে না। খুব সম্ভব, এখন আমাকে রাগ ভাঙাতে হবে।
আমি তার ফোলা মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, গাল ফুলেছে কিভাবে?
রাইসা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।
আমি সরুচোখে বললাম, তাহলে কাল সকালেই ডেন্টিস্টের কাছে যাব।
নিশ্চয় মাড়িতে কোনও প্রবলেম হয়েছে। নখ দিয়ে দাতঁ খুঁটিয়েছো?
রাইসা এখনও অবাক।
নখের ভাইরাস তাহলে মাড়িতে গিয়েছে। তাই হয়তো গাল ফুলেছে।
গাল তো আর রুটি না যে, যখন তখন ফুলে যাবে। এম আই কারেক্ট?
রাইসা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি ঘুুমুবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাইসা মনে মনে বলছে, জাহিদ, তুমি এত নির্লিপ্ত কেন?
বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, আকাশ ফুঁটা বৃষ্টি যাকে বলে। রাইসা সময় নিয়ে নীল শাড়িটা পরল।
আমিই গিফট করে বলেছিলাম, বৃষ্টিতে নীল শাড়ি পরিহিত মেয়ে দ্যাখতে খুব ভাল লাগে।
তখন সে সরুচোখে তাকিয়ে বলেছিল,কাকে দ্যাখে ভাল লেগেছিল তোমার?
নীল শাড়ি পরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, কেমন লাগছে?
আমি পত্রিকা পড়ছিলাম। পত্রিকা থেকে মুখ উঠিয়ে বললাম, ভাল।
সে অভিমান করে বলল, শুধু ভাল?
আমি আবার পত্রিকা থেকে মুখ উঠিয়ে মুখে কৃত্রিম হাসি এনে বললাম, খুব ভাল। অসাম! ফ্যান্টাসটিক!!
রাইসার হাসি কর্ণ পর্যন্ত প্রসারিত হল। সে উৎসবমুখর পরিবেশে বলল, চল বৃষ্টিতে ভিজি।
আমি পত্রিকা নামিয়ে রেখে বললাম, ছোটবেলায় একবার বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলার পর জ্বর চলে এসেছিল।
সেদিন বাবা খুব মেরেছিলেন, বলেছিলেন, আর কখনও বৃষ্টিতে ভিজলে হাত-পা ভেঙে দিব।
তুমি কি চাও, তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজে আমি আমার হাত-পা হারাই?
সে হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভেতরের রুমে চলে গেল।
মনে মনে বোধহয় ভাবল, আমাকে বিয়ে করে মস্তবড় ভুল করে ফেলেছে।এই ভুল শোধরানো এই জীবনে হবে না।
রাইসা ব্যাগ গোছাতে শুরু করল আমাকে দ্যাখিয়ে দ্যাখিয়ে। আমি এগিয়ে আসাতে তার মুখে হাসি ফুটল।
ভাবলো, বোধহয়, তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলব, চল বৃষ্টিতে ভিজি।
আমি এগিয়ে এসে তার জামা কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরে দিলাম। রাগে তার চোখ মুখ থেকে আগুন বের হচ্ছে।
প্রতি সকালে রাইসা আমার জন্য চা বানিয়ে আনে।আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দ্যাখি সে ঘুমুচ্ছে।
দ্যাখে ভীষণ মায়া হল। জাগাতে ইচ্ছে করছে না। রাতের সেই রাগী মেয়েটা এই সকালে এসে মায়াবতী হয়ে গেল।
আমি কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে নিলাম। পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ছি।
কিছুক্ষণ পর দ্যাখি সে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।বলল,তুমি এত ভাল কেন?
আমি হাসলাম।’ভালর কি দ্যাখলে?’
এই যে আজ দেরি করে উঠার কারণে তুমি আমার জন্য চা বানিয়ে আমার বেডের পাশে রেখে গেছো।
আমি মিষ্টি করে হাসলাম।এ হাসির অর্থ : এ আর এমন কি! রোজই তো তোমাকে ভালবাসি।
রাইসা একচুমুক দিয়েই হতভম্ব হয়ে বলল, এটা কি বানিয়েছো?
আমি হাসিমুখে বললাম, চা-ই বানাতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু চা পাতার বদলে ভুলে কালিজিরা দিয়ে ফেলেছি। সরি! দ্যাখতে তো এক, আমি কি করব?
অনেক সহজ ব্যাপার না বুঝতে পারার জন্য রাইসা আমাকে খুবকরে বকা দিত।
এইতো গত পরশু সে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। চোখমুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় লজ্জায় বলেই ফেলল,এই জানো, আমরা দুজন থেকে এখন তিনজন হতে যাচ্ছি।
বলেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল।ঠিক এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত তা সে বুঝতে পারছে না।
চলে যাবে, নাকি লজ্জা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে?
আমি তার দিকে তাকালাম এবং হতাশ গলায় বললাম,
ও… তোমার মা এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে – এটা এতো কাহিনী করে বলার কি আছে?
আমি কি রাখব না বলছি নাকি?
রাইসা চোখমুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকাল এবং তাকিয়েই থাকল।
আমার এই অদ্ভুত আচরণে তার চোখে জল চলে আসছে।
আমার মতো ছেলের সাথে কিভাবে তিনবছর প্রেম করল, তা নিয়েও সে বিস্মিত।
গতরাতে রাইসা খুব কেঁদেছে, আমার বুকে মাথা রেখে। আদর চাচ্ছিল। আমি তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
বেচারি ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের ভালবাসা পায় নি। জন্মের পরপরই তার মা তাকে তার বড়বোনের বাসায় রেখে আসে।
এরপর থেকে খালা-খালুর কাছেই তার বড় হওয়া। খালা-খালু খুব ভাল মানুষ।
তবুও তার মনে হয়, দরকার ছিল, বাবার কাছে সাইকেল কেনার বায়না ধরার দরকার ছিল।
মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শোনার দরকার ছিল।মাঝেমাঝেই রাইসা আমার কাছে ভালবাসা খুঁজে। বাবা-মায়ের ভালবাসা।
বাচ্চাদের মতো বলে,আমায় কোলে নাও,আমায় চুমু দাও।’না’ করা যায় না।আমার তাকে আদর করতে ভালই লাগে।
আদর করলে সে ভালবাসায় কেঁদে উঠে। সে মুহূর্তটাও অসাধারণ লাগে।
মাঝেমাঝে ভাবি, তার বাবা-মায়ের মতো ভালবাসতে পারলাম তো? রাইসার মতে, আমি মহাবোকা।
মহাবোকা হলেও ভালবাসা আমি ঠিকই বুঝি। পৃথিবীতে যারা ভালবাসে তারা কখনও জটিল সমীকরণে আটকা পড়ে না।
জটিল সমীকরণ তাদের জন্যই, যারা সব বুঝে; শুধু ভালবাসাটাই বুঝে না।