শেষ হতে শুরু

শেষ হতে শুরু

আসিফের কোম্পানিতে আজ একজন নতুন সেক্রেটারি জয়েন করেছে। আগের সেক্রেটারিটা খুবই জালিয়েছে, এরকম বোকা মানুষ আসিফ কখন দেখেনি আর দেখতে চায়ও না। একটা কাজ করতে দিলে আরেকটা করে ফেলে, পরে মহা বিপদেই পরতে হয় আসিফকে। বাবার বয়সী, তাই কিছু বলতেও পারেনা আসিফ। সরাসরি তো কারো চাকরি নট করা যায় না তাই বুদ্ধি করে আসিফ প্রমশন এর নাম দিয়ে তাকে অন্য কাজে বহাল করেছে আপাতত। এবার না জানি কি হয়, নতুন সেক্রেটারি এসে কি তামাশা করে কে জানে।

একটু পর ম্যানেজার আসিফের নতুন সেক্রেটারিকে নিয়ে হাজির হল আসিফের রুম এ। আসিফ একনজর চোখ বুলিয়ে নিয়েই নিজের কাজে আবার মনোযোগ দিল। নতুন সেক্রেটারি একটা কমবয়সী মেয়ে। দেখে মনে হয় সচ্ছল পরিবারের মেয়ে, হয়ত শখের বসে কাজ করেছে।
ম্যানেজারঃ স্যার, আপনার নতুন সেক্রেটারি, ফারজানা নিশি…
ম্যানেজার পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেল।
আসিফঃ আপনি এখন থেকে আমার পাশের রুম এ বসবেন, আর আপনাকে কি কি করতে হবে ম্যানেজার সব বুঝিয়ে দিবে, আমি বলে দিব তাকে।
নিশিঃ স্যার আপনি সব টেনশন ঝেরে ফেলে দিন। এখন থেকে এসব টেনশন আমার। আপনার রুম ডেকোরেশন থেকে শুরু করে ডেইলি রুটিন , ফাইলপত্র গুছানো, হ্যান্ডেল করা, সব এখন থেকে আমার দায়িত্ব। এখন থেকেই আমি এ দায়িত্ব নিয়ে নিলাম। আপনি রেস্ট নিন। কফি খাবেন স্যার। নিয়ে আসি গরম গরম কফি।
নিশি এক নিঃশ্বাসে সব গুল কথা গরগর করে বলে গেল, মাঝে একবারও থামল না। শুনে আসিফের বুকটা ধক করে উঠল। একদম চেনা পরিচিত কথার ধরন, সেই একই সুর। কি করে সম্ভব। মেয়ে টা যেন আসিফের সাথে পুরো অধিকার নিয়ে কথাগুলো বলছে। আসিফের পুরানো সেই সৃতি গুলো আবার তাজা হয়ে উঠল। মনে পরে গেল সব কথা নতুন করে আবারও। ঠিক এভাবেই তিথি এসছিল একদিন আসিফের লাইফে, ঠিক এমনটাই অধিকার নিয়ে।
আসিফ সেই কল্পনায় হারিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য………
তিথিঃ এই যে ভাইয়া শুনছো…
আসিফঃ জি…আমাকে বলছেন???
তিথিঃ হ্যাঁ তো। তোমাকেই বলেছি। আমি তোমার এক বছরের জুনিওর। শুনলাম তুমি সবসময় ইকোনমিক্স এ হাইয়েস্ট মার্কস পাও। আমি তো পাই লাড্ডু, কিছুতেই কিছু মাথায় ঢুকে না ঘোড়ার ডিম। তুমি আগামিকাল থেকে আমাকে পড়াবা। কখন পড়াবা সেটা বল। আর তোমাকে তুমি করে বলছি, কারন তুমি আমার থেকে অনলি এক বছরের সিনিওর, এটা তেমন কোন ডিফারেন্সই না। সো কাল কখন থেকে পড়াবা বল ঝটপট…
স্যার???………আসিফ ডাক শুনে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এল।
নিশিঃ স্যার আপনাকে আমি বললাম টেনশন শেষ, আর দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি ডাবল টেনশন শুরু করে দিয়েছেন। এখন বলুন তো স্যার আপনার জন্য আমি কি করব। আর স্যার প্লীজ আমাকে তুমি করে বলবেন, নো আপনি। আমি ছোট মানুষ, আমাকে আপনি করে বলে বুড়ি বানিয়ে দিবেন না প্লীজ…………
নিশি একা একাই বকবক করে যাচ্ছে , আর আসিফ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছে। অনেকদিন পর আসিফের কারও কথা শুনতে এত ভাল লাঞ্ছে। বিরক্ত বোধ করছে না একটুও……

কয়েক মাস পরঃ
আসিফ নিশির কাজকর্মে পুরপুরি মুগ্ধ। মেয়েটা কথা বেশি বললেও কাজের বেলায় একদম পারফেক্ট। যেমনটা তিথি ছিল। নিশির সবকিছুই যেন তিথির সাথে মিলে যায়। আসিফের জীবন থেকে তিথি চলে জাওয়ার পর ভেবেছিল ও আর কখনই অন্য কাউকে ভালবাসতে পারবে না। কিন্তু নিশি মেয়েটার প্রেমে না পরে পারল না আসিফ। তিথি চলে যাবার পর আসিফ কবে প্রান খুলে হেসেছিল বলতে পারবে না। জীবনের সবটাই যেন দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিলো। অফিসের কাজে সারাক্ষন ডুবে থাকত। লাইফ বলতে কিছুই বাকি ছিল না আসিফের। নিশি মেয়েটা আবারও যেন নতুন করে হাসতে শিখিয়েছে আসিফকে। বাঁচতে শিখিয়েছে , ভালবাসতে শিখিয়েছে আবারও নতুন করে। তবে যেই নিশি আসিফ কে এতটা পরিবর্তন করে দিল সেই নিশি কেই এখন ভালবাসার কথাটা জানানো হয়নি আসিফের। আসিফ ঠিক করল আজই নিশিকে ওর ভালবাসার কথাটা জানাবে। তবে তার আগে আসিফ কে যেতে হবে তিথির কাছে। আগে যে তিথির কাছ থেকে অনুমতি নিবে আসিফ। তারপরই তো জানাবে নিশিকে ওর ভালবাসার কথা………
আসিফ সকাল সকাল রেডি হয়ে বের হয়ে গেল। প্রথমে তিথির কাছে যাবে, তারপর অফিসে গিয়ে নিশি কে পিক করে কথাও বেরাতে যাবে, আর সেখানেই আসিফ নিশি কে ওর মনের কথাগুল জানাবে। কিছুক্ষনের মদ্ধেই আসিফ চলে এলো বনানীতে, তিথির কাছে……

বনানী কবরস্থান, তিথির কবরের সামনে দাড়িয়ে আসিফ। পাঁচ বছর আগে তিথির সাথে যখন চুটিয়ে প্রেম করছিল আসিফ, সেই সময়ের এক ভেলেন্টইন্স ডে তে তিথি জেদ ধরল আসিফ কে ও ফুল কিনে দিবে, সবাই যেমন টা দেয়। আসিফ কিছুতেই রাজিনা, কারন ও ভালবাসার জন্য কোন একটা দিনকে সেলিব্রেট করতে রাজি না। আসিফের কাছে ভালবাসার জন্য প্রত্যেকটা দিনই সমান। তবুও তিথিকে আসিফ বুঝাতে পারে না। তিথি নিজের সিদ্ধান্তে অটল, আসিফ কে ফুল কিনে দিবেই দিবে। আসিফ হেরে যায় তিথির জিদের কাছে। আসিফ রাগ করে রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে থাকে আর তিথি অন্য পাশে যায় আসিফের জন্য ফুল কেনার জন্য। তিথি ফুল কিনে নিয়ে হাসি মুখে আসিফের কাছে ফিরতে থাকে, ঠিক এমনি সময় একটি মোটর সাইকেল তিথিকে সজরে আঘাত করে। তিথি ছিটকে পরে গিয়ে প্রচন্ড আঘাত পায় মাথায়। তিথি আসিফ কে ফুল না দিয়েই চলে যায় না ফেরার দেশে। সাথে সঙ্গী করে নিয়ে যায় আসিফের হাসি, আনন্দ, ভালবাসা, সব…… আজ আসিফ আবারও সব ফিরে পেয়ে তিথিকে সেটা জানাতে এসেছে।
আসিফঃ তিথি…… আমি আবারও বাঁচতে শিখেছি, নতুন করে ভালবাসতে শিখেছি। আর এসব আমাকে নিশি শিখিয়েছে। জান…নিশি না ঠিক তোমার মত করে কথা বলে, তোমার মত করে জিদ ধরে, অভিযোগ করে। ওর মাঝে আমি যেন ঠিক তোমাকেই খুঁজে পাই ।আজ আমি যাচ্ছি নিশিকে আমার ভালবাসার কথা জানাতে……
অফিসে ফিরেই আসিফ প্রথমে নিশির খোঁজ নিল। অবাক কাণ্ড!!! নিশি আজ প্রথম অফিস মিস দিল। অথচ এই মেয়ে গত মাসে ১০৩ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে অফিস করতে চলে এসেছিল। পরে আসিফ জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। তবে আজ কি হল। আসিফ দ্রুত নিশির মোবাইল এ কল দিল। আশ্চর্য !!! মেয়েটার মোবাইল ও অফ। তাহলে কি কোন সমস্যা হয়েছে। এসব চিন্তা করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। লাঞ্চের পর নিশি হন্তদন্ত হয়ে আসিফের রুম এ ঢুকল। নিমিষেই আসিফের সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল, তবে মনের মদ্ধে উকি দিল নানান প্রশ্ন।
আসিফঃ আজ এত দেরি করলে নিশি? কোন সমস্যা? তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সারাদিন। তোমার সাথে আজ কিছু জরুরি কথা বলব।
নিশিঃ জরুরি কথা পরে হবে স্যার। আগে এই নিন আমার রেজিগনেশন লেটার। স্যার সরি, আমি আর এ চাকরি টা করতে পারছি না।
আসিফ যেন আকাশ থেকে পরল। ভেবে পেল না ও এমন কি অপরাধ করে ফেলেছে যে নিশি আজ চাকরি টা ছেরে দিচ্ছে।
আসিফঃ কেন নিশি??? কোন প্রব্লেম হয়েছে কি???
নিশিঃ বিরাট বড় প্রব্লেম স্যার!!!আমার মাথার মদ্ধে এখনও আগুন জ্বলছে। সারাটা সকাল আম্মু আব্বুর সাথে ঝগড়া করে এসেছি। শেষমেশ তারাই জিতেছে আর আমি হেরে গেছি। আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি স্যার। সরি…
আসিফঃ কিন্তু কেন??? শান্ত হয়ে বসতো নিশি, তারপর সব খুলে বল আমাকে।
নিশিঃ স্যার, আমার এক ছেলের সাথে অনেক আগে থেকেই বিয়ে ঠিক করা ছিল। ছেলে বাহিরে স্যাটেলড। বিরাট অবস্থা ওখানে। বিয়ের পর আমিও ওখানেই চলে যাব। পুর সংসার আমাকেই সামলাতে হবে। সো আব্বু আম্মুর মতে আমাকে এখন চাকরির পিছনে সময় নষ্ট না করে রান্না বান্না আর সংসারের কাজ সেখা উচিত। দুদিন পর যেহেতু আমাকে চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে অন্য দেশে পারি জমাতে হবে, তাই এখনি এটা ছেড়ে দিতে উনারা প্রেশার দিচ্ছেন।
আসিফ কি বলবে কিছু ভেবে পেল না। চুপচার নিশির রেজিগনেশন লেটার টা সাইন করে দিল। আর বিদায়ের সময় নিশিকে কংগ্রেচুলেশন জানিয়ে বিদায় দিল।

কিছুদিন পরঃ
আজ নিশির বিয়ে। সেদিনের পর থেকে নিশির সাথে আর দেখা হয়নি আসিফের। তবে নিশি ওর বিয়ের কার্ড আসিফের অফিসে সময় মত পাঠিয়ে দিয়েছিল। ফোন করেও অনেকবার করে বলে দিয়েছে অবশ্যই যেতে। কিন্তু আসিফ যায়নি। এতটা কষ্ট হয়ত আসিফের সহ্যের বাহিরে। কিছুদিনের মদ্ধেই হয়ত নিশি ওর স্বামীর সাথে অন্য দেশে চলে যাবে। নিশির সেই বকবক আর শোনা হবে না আসিফের। নিশিকে আর কখনই বলতে পারবে তার ভালবাসার কথা। তবে আসিফ এবার কষ্টের মদ্ধে ডুবে যাবে না। হাসতে ভুলে যাবে না। কারন নিশি চলে যাওয়ার আগে আসিফ কে উপহার হিসেবে দিয়ে গেছে এই হাসি। আসিফ তার হাসির মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে তার ভালবাসাকে, চিরকাল…………

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত