রাফিন, সোহান, মুরাদ, তমাল চার বন্ধু মিলে বিকেলে আড্ডা দিচ্ছিলো পার্ক টাইপ জায়গায় বেঞ্চে বসে। প্রায়ই তারা এখানে আড্ডা দেয়, যদিও তাদের আরো অনেক জায়গা আছে আড্ডার, আজ এখানে নিরিবিলি তাই বসেছে সব। হঠাৎ রাফিনের নজরে পড়লো একটা মেয়ে তাদের দিকেই হয়তো আসছে। রাফিন আর মুরাদ চুল ঠিক করে জামা গুছিয়ে পার্ট নিয়ে বসলো, যেন মেয়ে এসেই ওদের দেখে পটে যায়। মেয়ে মোটামোটি সুন্দরী, পরনে ছিল ফুল হাতা কুর্তা তবে সেটার হাতা আবার শার্টের স্লিভের মত গুটিয়ে রাখা, জিন্স না তবে জিন্সের মত পায়জামা পরা আর পায়ে স্পোর্টস জুতো। চোখে মুখে গুন্ডী ভাব। তমালের চোখে মুখে ” কোথায় হারাবো, কোথায় পালাবো ” ভাব, যেন ধরনী দুইভাগ হলে সে ভিতরে চলে যাবে। সোহান একদম ঠান্ডা, তবে ভিতরে ঝড় হচ্ছে।
– মেয়েটা এদিকেই আসছে, মনে হচ্ছে আমাদের দিকেই (মুরাদ)
– প্রপোজ করতে আসছে হয়তো! (রাফিন)
– কথা কম বলো! (তমাল)
– ভয় পাচ্ছিস কেন? (মুরাদ)
– একটু পর বুঝবি কেন এমন করছি? (তমাল)
– সোহান, কিছু বল! তুই আর কি বলবি! তুই বরং চুপই থাক! (রাফিন)
– আমি বললে তোরা আর বলার পরে সুযোগ পাবি না। (সোহান)
– আরে রাখ তো, একটা মেয়েও তো পটাইতে পারলি না। দেখ এটাকে কি করে পটাই! আর পটাতে হবে না, এমনিই হয়তো পটে যাবে! (মুরাদ)
এর মধ্যে মেয়েটা চলে আসে তাদের সামনে, বুকে হাত বেঁধে দাঁড়ায়। তমাল চোখ তুলেই তাকাতে পারছে না, এদিক ওদিক দেখছে । মুরাদ আর রাফিনের মুখে অমায়িক হাসি যেন হাসি দিয়েই মেয়ের মন গলিয়ে দেবে। সোহান, মুরাদ আর রাফিনের ভাব দেখছে। মেয়েটার চোখের ভাষা হচ্ছে ” দুনিয়া উল্টে যাক, আজ তোর খবর আছে ” তবে এই ভাষা কার জন্য সেটাই বুঝতে দিচ্ছে না সে, শুধু দাঁড়িয়ে আছে। কিছুসময় এমন চলার পর মেয়েটা সোহানের টিশার্টের কলার ধরে বসা থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে গেলো। যেন গুন্ডা কাওকে নিয়ে যাচ্ছে মারার জন্য, আর যেতে যেতে বললো ” এক্সকিউজ মি, মিস্টারজজ! আপনাদের বন্ধুটিকে নিয়ে গেলাম আমি! ” কেউ কিছু বোঝার আগেই তমাল বেঞ্চ থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেলো, রাফিন আর মুরাদ ডাবল শকড আপাতত। এক তো একটা মেয়ে তাদের এক বন্ধুকে কলার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তা দেখে আরেক বন্ধু গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।
– আজ খবর আছে! (তমাল)
– বুঝলাম না, কি হইলো? মেয়েটা কে? আর তমাল পড়ে গেলি কেন? (মুরাদ)
– তার আগে বল মেয়েটা কেন সোহানকেই নিয়ে গেল। আমি তো সোহানের থেকে বেশি হ্যান্ডসাম ছিলাম (রাফিন)
– আরে শালারা, ওটা সোহানের প্রেমিকা, বলতে পারিস হবু স্ত্রী, রায়না । বহুত ঘাড় ত্যাড়া মেয়ে। (তমাল)
– কী????? (অবাক হয় মুরাদ আর রাফিন)
– আরে শালা হয়, আজ খবর আছে। আমারে দেখছে মানে আরো খবর আছে। (তমাল)
– আব্বে শালা, ভাল একটা মেয়ে পটাইছে। হেব্বি কিন্তু, চালু আছে। (মুরাদ)
– সে তোরা যা বলার বল, আমি গেলাম (তমাল জুতার ফিতা বেঁধেই দৌড় দিতে যায়। রাফিন আর মুরাদ পিছু পিছু যায় কাহিনী শুনতে)
– আরে দাঁড়া, দৌড়াচ্ছিস কেন? (রাফিন)
– ভাবিরে বলছিলাম, সোহান আমাদের সাথে ঘুরে না, আজ একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলছে। এরপর আমারে ফোন দিয়ে ঝাড়বে সেই। এখন তো সোহানকে ঝাড়তাছে মনে হয়। আমার তো ভাই গলা শুকায় যাচ্ছে। (তমাল)
– আরে সোহান এত ভীতু নাকি? ওর পা পড়লে পুরো এলাকা কাঁপে। (মুরাদ)
– যার পা পড়লে এলাকা কাঁপে, রায়নার সামনে তার হাঁটু কাঁপে। (তমাল)
– আমারে এটা বল, এই হেব্বি আইটেম ও পাইলো কই? (রাফিন)
– এ মুখ সামলে বল, আইটেম কারে বলিস। ভুলে যাস না ও সোহানের বাগদত্তা, ভুলেও ওর কানে এ কথা গেলে খুন করে ফেলবে। (তমাল)
– আরে মেয়ে মানুষের জন্য কেউ বন্ধু হারায় নাকি? ফাওল কথা। (মুরাদ)
– আরে তমাল, এত দ্রুত হাঁটিস না, একটু আস্তে, হাঁপিয়ে যাচ্ছি! (রাফিন)
– ওরে সোহান যদি আমার উপর দোষ চাপায়, ভাবি এসে আমার কলার চেপে ধরবে, আমারে আজ মাফ দে ভাই (তমাল)
– আরে এটা তো বল, সোহান আমাদের জানায়ও নি যে ও কারো সাথে রিলেশন করে! (রাফিন)
– আর এমন একটা মেয়ে কি করে সোহানের মত ছেলের প্রেমে পড়ে! (মুরাদ)
– ভালবাসা, ভালবাসার জায়গায় আর বন্ধুত্ব, বন্ধুত্বের জায়গায়। আর ভুলেও সোহানের সামনে ওর প্রেমিকা নিয়ে উল্টা পাল্টা বলবি না। মেরে লাশ গুম করে দেবে! (তমাল)
– আচ্ছা বললাম না, তবে মেয়েটা সেই! (রাফিন) কিছুক্ষণ কথা বলে যেতে যেতে তারা যে যার বাসার দিকে চলে যায়। সন্ধ্যা প্রায় নামার পথে। ওদিকে রায়না, সোহানের কলার ধরে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে,
– রাঈ, এটা কি ঠিক হচ্ছে?
– খুব ঠিক হচ্ছে, ভাল হচ্ছে একদম!
– এভাবে একটা মেয়ে একটা ছেলের কলার ধরে নিয়ে যাচ্ছে, লোকে কি বলবে!
– লোক তো দেখছি না, আর যারা এটা দেখছে তারা তো আমাদের চিনেই না!
– তারপরেও কি ঠিক??
– বেশি কথা বললে কলার ছেড়ে তোমার কান ধরবো! ধরি? (রায়না জোরে কলার ধরে টান দেয় সোহানের)
– আওওও! আচ্ছা আমি কি করছি বলবা তো?
– অনেক কিছু! এই যে তুমি আমাকে বলো তোমার সময় নেই দেখা করার, কত ব্যস্ত, কিন্তু বন্ধুদের সাথে ঠিকই ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারো। আজ নিজের চোখে দেখলাম।
– আচ্ছা আমরা শান্ত মাথায় বসে কথা বলি?
– কিসের শান্ত মাথা (আবার কলারে টান দেয়) তোমার কি মনে হয় তুমি ইচ্ছামত চলবা? চলো, আমার সমস্যা নাই, তার মানে এই না যে একদমই সময় দেবে না! আবার এটাও না যে আমি কোথাও বের হলে বার বার ইনকোয়ারি করবে!
– আচ্ছা কলারটা অন্তত ছাড়ো, আমি বুঝাই!
– আচ্ছা বলো! (কলার ছাড়ে রায়না)
– সত্যিই আমার সময় হয় না, আজ তমাল খুব করে ধরলো বলেই আসা!
– হ্যাঁ তমাল, ওটাকেও ধরবো! আমাকে বলে “ভাবি সোহান তো আমাদের সাথে দেখাই করে না!” ওটাকে পেলে উল্টো লটকাবো।
– কিন্তু তুমি কি করে জানলে আমি বাইরে?
– সোহাগ ভাইয়া বলছে!
– ভাইয়ার সাথে কোথায় দেখা হইলো?
– সেটা আমার ব্যাপার, এখন তুমি এখানে কান ধরে উঠবস করবে!
– এখানে, এই মাঝরাস্তায়??
– হুম! কেন কি সমস্যা??
– কেমন দেখাবে এটা?
– খুব ভালো, এখন শুরু করো!
– দেখো রাই……
– কথা কম সোহান…..
– ভালবাসার শখ মিটিয়ে ছাড়বে এই মেয়ে, কোন লগ্নে, কোন ক্ষণে এই মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম স্রষ্টা বাঁচাও। (বিড়বিড় করে বলে সোহান)
– বিড়বিড় করে লাভ নেই। যা বলছি করো।
– করছি (কান ধরে এদিক ওদিক দেখে সোহান, তারপর উঠবস শুরু করে)
– এবার বুঝো কেমন মজা। তোমার ওই বন্ধু তমালটাকেও একসাথে উঠবস করাতে পারলে ভাল লাগতো।
সোহান রাগে গজগজ করতে থাকে আর ভালবাসার গুষ্টি ধরে গালি দিতে দিতে উঠবস করছে। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক দেখছে কেউ দেখে কিনা, যেহেতু সন্ধ্যা নামার পথে তাই তেমন কেউ নেই। রায়না হেঁটে হেঁটে সামনে দিয়ে একবার এদিক একবার ওদিক যাচ্ছে, এটা দেখে সোহানের রাগ আরো বাড়ছে, মনে মনে তমালকেও গালি দিচ্ছে। সোহাগ ভাইকেও কম গালি দিচ্ছে না। সোহাগ সোহানের বড় ভাই, সে জানে রায়না কেমন, এটা কি উচিত হইছে তার, ছোট ভাইকে এমন অবস্থায় ফেলা। মনে মনে কান্না পেতে থাকে সোহানের। এমন অবস্থা দেখে রায়না মনে মনে মজাও পায়। কিছুসময় পর রায়না সোহানের পিছনের দিকে চলে যায় তাই সোহান দেখতে পারে না ওকে। এরপর রায়না পিছন থেকে সোহানকে জড়িয়ে ধরে এতে সোহান কিছুটা অবাক হয়। রায়নার হাত পিছন থেকে সোহানের বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে, সোহান কান ছেড়ে রায়নার হাত ধরে।
– কি হয়েছে? (সোহান)
– ভালবাসি()
– আর?
– অনেক ভালবাসি!
– আর?
– অনেক অনেক ভালবাসি!
– হুম, তারপরেও তো সব সময় সন্দেহ করো।
– সন্দেহ কই??
– তাইলে কি? এই যে কান ধরে শাস্তিও দিলে, বন্ধুদের ভিতর থেকে কলার ধরে গুন্ডীর মত নিয়ে এলে। এসব কি?
– এসব আর কি? তুমি আমাকে সময় দাও না তাই এমন করলাম, যেন এরপর অজুহাত দেবার আগে মনে থাকে। হুহ!
– অজুহাত আমি একা দেই? তুমি দাও না?
– হুম দেই তো। তবে তোমার মত না।
– তোমার সাথে কথায় পারা যাবে না।
– পারতে হবে না, চলো।
– কই?
– সন্ধ্যা নেমে এসেছে, এই সময় হাত ধরে হাঁটার মাঝে একটা ফিল আছে
– গুন্ডী মেয়েদের এমন ফিলও আসে, জানতাম না তো।
– ভাল হবে না কিন্তু, আবার ধরবো কান? ধরি, ধরি??
– না না, কান না ধরে হাত ধরো!
– হুম, এখন লাইনে আসছে!
– আসতেই হবে, গুন্ডী প্রেমিকার ভালবাসা বলে কথা!
সোহান আর রায়না হাত ধরে হাঁটতে থাকে পথের পাশ দিয়ে। সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাস বইছে, গোধূলীর ম্রিয়মান আলো এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সারাদিনের পরে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে ভালবাসার নিজ নিজ নীড়ে। তার মাঝে দুই ভালবাসার পাখি সোহান আর রায়না!