প্রকৃত সুখ

প্রকৃত সুখ

বিয়ের বছরখানেক হয়ে গেল। তবুও আবিদ আজ পর্যন্ত নিধির মুখে শুনেনি যে ঘর আলো করতে নতুন অতিথি আসবে। এই নিয়ে আবিদ খুব চিন্তায় আছে। তার খুব শখ কেউ ঘর জুড়ে ছোটাছুটি করবে। অস্পষ্ট ভাবে বাবা, পাপা বলে ডাকবে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের কোনো লক্ষণ দেখছে না। তার ছোট পরিবারটা বেশ হাসিখুশির। বাবা মা গ্রামে চলে গেছেন। বাকি জীবনটা সবুজ শ্যামলার মাঝে কাটাতে চান। মাঝেমাঝে এসে কিছুদিন থেকে যান। দিনগুলো আবিদের কাছে সবচেয়ে সুখের মনে হয়। আবিদ একটা সরকারি চাকরি করে। সততার সাথেই কাজ করে। বেতন মোটামুটি ভালো। তাই আর্থিক অভাব খুব একটা পীড়া দেয় না। পীড়া দেয় শুধু নতুন অতিথির চিন্তায়। ডিনারে,

– আমাদের মনে হয় ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। নিধি বেশ অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকালো।
– কি ব্যাপারে? কি হয়েছে?
– তুমি কি ব্যাপারটা লক্ষ্য করছো না?
– কি ব্যাপারে?
– আজ প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল। তবুও আমাদের ঘরে সন্তানের আনন্দে দেখা যায়নি।

নিধি কিছু বলল না। চুপ হয়ে গেল। এই কথাটায় বলায় নিধির চেহারায় কেমন যেন পরিবর্তন এসেছে। একটা ভয় ভয় ভাব নিধির চেহারায় দেখা যাচ্ছে। ভয়ের কারণ আবিদ ঠিকই বুঝলো। নিধি হয়তো ভাবছে যদি ডাক্তারের রিপোর্টে এমন কিছু আসে যে নিধি মা হতে পারবে না। তখন হয়তো তার ওপর আবিদের ভালোবাসা কমে যাবে। কিন্তু আবিদ জানে এমন কিছুই হবে না। নিধিকে সে ভালোবাসে। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিধির হাত ছাড়বে না। প্রয়োজনে সন্তান দত্তক নিবে।

আবিদ নিধিকে অনেক বুঝিয়েও রাজি করাতে পারলো না। ডাক্তারের কাছে যেতে নিধি রাজি নয়। অবশেষে আবিদ নিজেই গেল। এমনও তো হতে পারে তার সমস্যা আছে। অফিস থেকে সোজা মেডিকেল এসে ডাক্তার দেখালো। বেশ কিছু টেস্ট দিলো। সেগুলো করিয়ে বাসায় এলো। ব্যাপারটা নিধিকে জানালো না। দুদিন পর রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারকে দেখালো। আবিদও বেশ চিন্তায় ছিল। যদি নেগেটিভ আসে। তবে কি করবে? প্রতিটি মেয়েই চায় সন্তান গর্ভে ধারণ করতে। শত কষ্ট সহ্য করে তাকে জন্ম দিয়ে মাতৃত্বের সুখ নিতে। কিন্তু আবিদের জন্য যদি নিধি এই সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে তবে নিধির পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে? এখন যেভাবে ভালোবাসে তখনও কি সেই একইভাবে ভালোবাসবে?

এসির রুমে বসেও আবিদ ঘেমে গেছে। এখন আবিদ বুঝতে পারছে কেন নিধি ডাক্তার দেখাতে রাজি ছিল না। অবশেষে ডাক্তারের কেবিনে আবিদের ডাক পড়লো। আবিদ ভেতরে গেল। রিপোর্ট দেখার পর ডাক্তার জানালো রিপোর্ট ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নেই। আবিদের বুক থেকে যেন পাথর নামলো। আবিদ মেডিকেল থেকে বেরিয়ে এলো। বাহিরে পা রাখতেই মনে পড়লো যেহেতু তার কোনো সমস্যা নেই তাহলে সমস্যাটা কি নিধির? এটা ভাবতেই আবিদের মনে অজানা ভয় চেপে ধরলো। নিধি যদি এটা জানতে পারে তবে কি হবে? আর তার মা-বাবার পদক্ষেপ কি হবে? আবিদ বাসায় ফিরলো। আবিদের গোমরামুখ দেখে নিধি বলল,

– আজ মুড অফ কেন?
– অফিসে একটু ঝামেলা চলছে।
– ঘুষ নেয়ার চিন্তাভাবনা হচ্ছে নাকি? খবরদার ওদিকে পাও দিবা না। আমি এইটুকুতেই খুশি। তুমিও খুশি থাকো।
আবিফ হাসি দিয়ে বলল,
– তোমার মতো স্ত্রী যদি সব সরকারি লোকের ঘরে থাকতো তবে দেশের দুর্নীতি অনেকাংশই কমে যেতো। অনেক সত্‍ লোক স্ত্রীর আকাশচুম্বী চাহিদার মেটাতে ঘুষ নিতে বাধ্য হয়।
– যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার দিচ্ছি।

আবিদ মনের কথা মনেই চেপে রাখলো। নিধির প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি রাখলো না। এখন প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় ফুল, চকলেট, কাচের চুড়ি এসব নিয়ে আসে। যখন তখন জড়িয়ে ধরে। নিধির কপালে উষ্ণ ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়। এসব দেখে একদিন নিধি বলল,

– কি জনাব? ইদানিং এত ভালোবাসা দেখাচ্ছেন কেন?
– বারে, তোমাকে ভালোবাসবো নাতো কাকে বাসবো?
– তা তো বুঝলাম। কিন্তু হঠাৎ এত ভালোবাসা উতলিয়ে পড়ছে যে সন্দেহ হচ্ছে।
– মনেতে আঠারো বছরের কিশোর এসে ভর করেছে।
– হিহিহি।

কেটে গেল আরও কিছু মাস। এই কয়েক মাসে আবিদ সন্তানের কথা একবারও বলেনি। আর কিছুদিন যাক। তারপর সন্তান দত্তক নেয়ার কথাটা নিধিকে জানাবে। একদিন অসুস্থতার কারণে নিধিকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো। সুস্থ মানুষ হঠাৎ এত অসুস্থ হয়ে পড়লো আবিদ ঘাবড়ে গেছে। এতটাই ঘাবড়ে গেছে যে বাবা মাকে শহরে নিয়ে এসেছে। হাসপাতালে ভর্তি করানোর দুদিন পর। আবিদ এখন ডাক্তার নীলার চেম্বারে বসে আছে। উনিই নিধির ট্রিটমেন্ট করছেন।

– ডাক্তার, নিধির কি হয়েছে? কিছুদিন আগেও তো বেশ ভালোই ছিল। হঠাৎ এমন কি হলো?
– এটার জন্য আপনারা দুজনই দায়ী।
– আমি?
– হ্যাঁ।
– কিন্তু কিভাবে? আমি তো আজ পর্যন্ত নিধির উপর হাতও তুলিনি।
– অতিরিক্ত জন্মনিরোধক ইনজেকশন নেয়ার কারণে নিধির শরীরের কিছু সেল কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

সেল মানে কোষ বা টিস্যু। মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ কোষ বা টিস্যু নিয়ে তৈরি। মানুষের শরীরে অজস্র কোষ আছে। এগুলোর কোনো একটা যদি কাজ বন্ধ করে দেয় তবে ধীরে ধীরে শরীরও কাজ বন্ধ করে দেয়। রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাক্তার নীলা আবার বললেন,

– আপনারা কি জানেন না এসব ইনজেকশনে পাশ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। এমনকি মা হওয়া ক্ষমতাও নষ্ট হতে পারে। অতিরিক্ত ইনজেকশন নেয়ার কারণে নিধিরও তাই হয়েছে। এই যাত্রা বড় কিছু হয়নি। তবে ভবিষ্যতে খেয়াল রাখবেন। সন্তান নিতে না চাইলে নিয়ন্ত্রণটা নিজেদের ওপর রাখুন। শরীর আল্লাহর দেয়া, বিজ্ঞানের নয়। আপনি যতো বেশি বিজ্ঞান নির্ভর হবেন তত আপনারই ক্ষতি হবে। কথাগুলো ডাক্তার হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে বললাম। আপাতত কিছু ভিটামিন দিলাম। এগুলো নিয়মিত রাখবেন।

আবিদ চুপচাপ বেরিয়ে এলো। ডাক্তার নীলার কথায় আবিদের মাথা ঝিম মেরে আছে। নীলা যা বলল সেই অনুযায়ী নিধি জন্মনিরোধক ইনজেকশন নিয়েছে। কিন্তু আবিদ এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। ডিসচার্জ করে নিধিকে বাসায় আনা হলো। ভিটামিনের অভাব বলে সত্যটা চাপ রাখলো আবিদ। কিছুদিন বাবা মা ছিল। তাই নিধিকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেনি আবিদ। বাবা মা যাওয়ার পর এক রাতে ডিনারের পর আবিদ নিধিকে বলল,

– আমি কি তোমাকে কখনো বলেছি যে এখন সন্তান নিবো না।
– না তো।
– তাহলে তুমি জন্মনিরোধক ইনজেকশন নিতে কেন? আবিদের কথা শুনে নিধি চুপ হয়ে গেল।

– কি হলো জবাব দাও।
– আসলে আমি সন্তানের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
– সেটা তুমি আমাকে জানাতে পারতে। আমার অগোচরে তুমি কেন এটা করলে? এটা কি একপ্রকার আমাকে ধোকা দেয়া না?
– তুমি এভাবে রিয়েক্ট করছো কেন? বিয়ের পরপরই সন্তান নিতে হবে এমন নিয়ম আছে নাকি? মাত্র বিয়েটা করলাম। আগে লাইফটা ইনজয় তো করি। তারপর না হয় সন্তান নিয়ে ভাবা যাবে।
– ইনজয়? কিসের ইনজয়? বিয়ে মানে দায়িত্ব। আর তুমি বলছো ইনজয়? ছিঃ নিধি ছিঃ আমি তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি।

– আরে তুমি এভাবে রাগছো কেন? ওকে ফাইন। আমরা এ বছরই সন্তান নিব। এবার খুশি?
– নিধি, আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম তোমাকে সর্বদা পর্দায় দেখে। ভেবেছিলাম তোমার লাইফ স্টাইল ইসলামিক পদ্ধতিতে চলে। কিন্তু এখন দেখছি তোমার মাঝে ইসলামের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। একটা হাসি দিয়ে আবিদ আরও বলল,

– তুমি কি ভাবো সন্তান হাতের মোয়া? সন্তান হলো আল্লাহর নিয়ামত। তিনি যাকে খুশি তাকে দিবেন। তাঁর ইচ্ছে হলে ছেলে দিবে। ইচ্ছে হলে মেয়ে দিবেন। এতে মানুষের কোনো হাত নেই। আমার রুবি ফুফাকে দেখো। দশটা বছর তারা সন্তানের জন্য ডাক্তার, কবিরাজ, মসজিদ, মাজার সব জায়গায় ঘুরেছেন। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন তাদের সন্তান হবে না। অনেক ঘুরাঘুরির পর তারা একটা সন্তান দত্তক নিয়েছিল। এরপরের বছরেই ফুফার একটা মেয়ে হলো। আল্লাহ পদে পদে দেখিয়ে দেয় যে বিজ্ঞানের উপরে তিনি। তবুও আমরা বুঝতে চাই না।

নিধি চুপচাপ আবিদের কথা শুনে যাচ্ছে। কিছু বলার ভাষা নেই। বিয়ের পরেই সে বুঝেছিল সন্তানকে ঘিরে আবিদের মনে অনেক আবেগ আছে। কিন্তু নিধি তখন সন্তানের ঝামেলা চায়নি। তাই আবিদের অগোচরে এই পথ অবলম্বন করেছিল। কিন্তু সত্য কখনোই মাটিচাপা দেয়া যায় না। আবিদের কাছে সত্যটা ধরা দিলোই।

– আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি। অনেক বড় পাপ করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।
– ক্ষমা আমার কাছে নয়। আল্লাহর কাছে চাও। তাঁর নিয়ামাতকে তুমি প্রত্যাখ্যান করার মতো অপরাধ করেছ।

আবিদ উঠে বেডরুমে চলে গেল। নিধি বসে বসে কাঁদতে লাগল। সত্যিই সে বড় পাপ করে ফেলেছে। সাময়িক সুখের মোহে সন্তানের সুখকে সে প্রত্যাখ্যান করেছে।

পাঁ বছর পর, রাত্রি তার অস্পষ্ট সুরে বা…বা…বা করে যাচ্ছে। আবিদ ছোট্ট রাত্রির নাকে নিজের নাক ঘষে দিয়ে বলছে, “বাবা বলো। সুন্দর করে বলো। তাহলে তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাবো।” রাত্রি খুশিতে হাত পা নাড়তে শুরু করলো আর অস্পষ্ট মুখে বা বা বা উচ্চারণ করতে লাগল। যেন সে বুঝতে পেরেছে ঘুরতে যাওয়ার কথাটা। নিধি নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে। এমন দৃশ্য হয়তো আরও আগেই দেখতে পেতো। কিন্তু তার একটা সিদ্ধান্তের কারণে দেরি হলো। তবে মেয়েটাও যেন খুব রাগী। আজ আড়াই বছর হলো। তবুও মা শব্দটা রাত্রির মুখে ফুটেনি। অথচ সন্তানের মুখের প্রথম বুলি হয় মা। হয়তো ছোট্ট রাত্রি নিধির সাথে আড়ি নিয়েছে। তবে নিধি এখন খুশি। সে বুঝতে পেরেছে মাতৃত্বের সুখ অন্যান্য সকল সুখের উর্ধ্বে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত